তেভাগার ৭৫ তম বর্ষ, মহান খাঁপুর - মানবেশ চৌধুরি ...

প্রথম পর্ব

১৯৩৬ সালের ১১ ই এপ্রিল গড়ে ওঠল সারাভারত কৃষক সভা। তার এক বছর পরেই বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভা।

শ্রেণি স্বার্থে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, কংগ্রেস, মুসলিমলীগ, জনসংঘ-হিন্দু মহাসভা, ক্ষত্রীয় সমিতি বর্গাদার তথা গ্রামীণ মেহনতি মানুষের বিরোধী ছিল।

গ্রামীণ জনসামাজের গড়িষ্ঠ অংশ তখন - রায়ত চাষি, আধিয়ার, ক্ষেত মজুর, দিন মজুর, কারিগর, কুটিরশিল্পী, মৎসজীবী ইত্যাদি। এঁরা জমিদার জোতদারের দ্বারা শুধু শোষিতই হতেন না, নিয়ত হতেন অপমানিত-লাঞ্ঝিত। কৃষক সভার কাজ শুরু হলো তাঁদের মধ্যে।

গ্রামীণ এই জনসমাজের মধ্যে অরক্ষিত, অবহেলিত ও শোষিত প্রজা ছিলেন আধিয়ার বা বর্গাদাররা। গ্রামীণ জন সংখ্যার ৪১ শতাংশ। জমিদার, জোতদার, মধ্যস্বত্তভোগী বিভিন্ন ধরণের রায়তদের সঙ্গে মৌখিক লিজে চুক্তিবদ্ধ এক শ্রেণীর কৃষক। তাঁদের যখন তখন উচ্ছেদ করা যেত। এর বিরুদ্ধে আইনের কোন সুযোগ ছিল না, তাঁদের কাছ থেকে অর্ধেকের বেশি ধান আদায় করা হতো। আরও ছিল কত ধরণের জুলুম-আদায়! ছিল চড়া হারে সুদ-যুক্ত দাদনের কারবার। তাঁদের নিজেদের বাড়িতে ধান তোলার অধিকারও ছিল না।

কৃষক সমিতি হিসাব করে দেখাল – চাষের সরঞ্জাম ও শ্রম এই দু’টি দেন আধিয়ার। শুধু জমির মালিকানা - এই একটি জিনিস জমিদার–জোতদার-মধ্যসত্বভোগীর। তাই দাবি উঠলো, ফসল তিন ভাগ করে এক ভাগ, জমিদার-জোতদার বা জমির মালিক পাবে। অন্য দুই ভাগের হিস্যা বর্গাদারের। এই হলো তেভাগা। আর নিজের বাড়ির খৈলানে বা বর্গাদারদের ‘দশের খৈলান’-’এ ধান উঠবে।

এখানে বলার, ১৯৩৮ সালেই বর্গাদারদের বিভিন্ন দাবিতে তখনকার ফজলুল হক মন্ত্রীসভার তৈরি ফ্রান্সিস ফ্লাউড কমিশনের কাছে স্মারক লিপি দেওয়া হয়েছিল।

১৯৩৭–’৩৮ সালে কারাবন্দিত্ব থেকে মুক্ত তরুণ বয়সের কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সভা গঠনের তাগিদ অনুভব করে দিনাজপুর শহর থেকে রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করে পার্টি ও কৃষক সভা গঠন করলেন।

কৃষক সমিতি গ্রামীণ জীবনের জ্বলন্ত নানাবিধ সমস্যা নিরশনের দাবির আন্দোলনের সঙ্গে সে সময় জেলার ঠাকুরগাঁ মহকুমার কয়েকটি থানায়, তেভাগের না হলেও সত্যিকারের আধিয়ার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন এবং তার বিজয়ও হয়েছিল।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ও তার পরম্পরায় বাংলায় মানুষের তৈরি মহা মন্বন্তরে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যেতে থাকেন। ব্রিটিশ ও এদেশীয় মজুতদার, কালোবাজারীরা বেপরোয়া মুনাফা করতে থাকে। অন্নহীণ মানুষ কলেরা, বসন্ত মহামারিতে আক্রান্ত হয়েও মারা যেতে থাকেন গ্রামের পর গ্রামে। এসময় কৃষক সভার মূল কাজ হয়ে দাঁড়ায় – মজুদ উদ্ধার, লঙ্গরখানা খোলা ও রোগগ্রস্ত মানুষের শুশ্রুষা করা। কোথাও কোথাও ভূখ মিছিলও সংগঠিত হতো। সারা বাংলার সঙ্গে দিনাজপুর জেলাতেও এই কাজগুলি সংগঠিতভাবে করা হতো। আবার আমন ধানের আবাদ যাতে ভালো হয় ও তাকে রক্ষা করা হয়, তার জন্য ১৯৪৪ সালের দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে অনুষ্ঠিত কৃষক সভার ৭ম প্রাদেশিক সম্মেলন থেকে আহ্বান জানানো হয় – আমন ধান রক্ষা করো।

এরই মধ্যে বিরাট ইতিবাচক ঘটনা ঘটে ১৯৪৫ সালে সোভিয়েতের বিজয়ের মধ্য দিয়ে। প্রগতিবাদীদের মনে উৎসাহ উদ্দীপনা। কৃষক সংগঠনেও তার ছাপ পরে।

কিন্তু যুদ্ধ রেখে যায় লাখো কোটি নিরন্ন, বুভুক্ষু, সর্বস্বান্ত মানুষকে। সমস্ত জিনিস বেশি দামে গ্রামীণ প্রান্তিক মানুষকে কিনতে হচ্ছে। জীবন যাপনের দুর্বিসহ গ্লানি মোচনের জন্য, তার সর্বশেষ সম্বল হালের বলদকেও বিক্রি করে দিতে হয়েছে। মহজন-জমিদার-জোতদারের কাছ থেকে বেশি বেশি কর্জ করতে হয়েছে। ইতোমধ্যে কৃষকরা বিশেষ করে বর্গাদাররা মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তাঁরা কী করে কিনবেন আবার হালের বলদ, কী করে শুধবেন তাঁদের কর্জ করা টাকা? তাই তাঁরা দাবি তুললেন – তেভাগা চাই, নিজ খৈলানে ধান তোল। কিন্তু তখনও তো মন্বন্তরের রেশ চলছে। তাই আন্দোলন জমাট বাঁধলো না। মূলত ত্রাণ, পুনর্বাসন, মজুদ উদ্ধার, কালোবাজারি নিয়ন্ত্রণ, রোগমুক্তির কাজই চলতে থাকল।

চলবে...


শেয়ার করুন

উত্তর দিন