সরিৎ মজুমদার
“আর নয় নিস্ফল ক্রন্দন
শুধু নিজের স্বার্থের বন্ধন
খুলে দাও জানালা আসুক
সারা বিশ্বের বেদনার স্পন্দন
ধরনীর ধুলি হোক চন্দন
টিকা তার মাথে আজ
পরে নাও পরে নাও পরে নাও।”
আজকের দিনটা ভাবতে গেলে পরে ঠিক তেমনি একটা দিন। পথ চলা শুরু হয়েছিল আজ থেকে ঠিক ১০২ বছর আগে,১৯১৯ সালের ২০ নভেম্বর, বার্লিনে। Young Communist International এর। যুব আন্তর্জাতিক ঠিক কী? কলোন্তাই এর লেখা ধার করলে বলতে হয়- “নতুন আন্তর্জাতিকের জন্য একটি সত্যিকারের এবং দৃঢ় ভিত্তি শুধুমাত্র সমাজতান্ত্রিক তরুণরাই গঠন করতে পারে। তরুণরা, ভবিষ্যতের বাহক; যুব, যারা অতীতের উপর নির্ভরশীল নয়, যারা ভবিষ্যৎ থেকে সবকিছু আশা করে… যুব, যাদের হৃদয় পাতি-বুর্জোয়া অনুভূতিতে কলুষিত নয় এবং যাদের চিন্তা অতীতের মতবাদে বিপথগামী হতে পারে না…তাজা, সাহসী , বিপ্লবী, আত্মত্যাগী শ্রমজীবী যুব, যারা এগিয়ে যায়, সবসময় এগিয়ে যায়!” চেষ্টা আগেও হয়েছিল। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সময়, ১৮৯৬ সালে বেলজিয়ামে "লা জিউন গার্ডে/ডি জংজে ওয়াচট"(“La Jeune Garde/De Jonge Wacht”) নামে প্রথম সমাজতান্ত্রিক যুব সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।কিন্তু দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের অসংখ্য তর্ক-বিতর্ক, সংশোধনবাদের দিকে ঝুঁকে পড়া এই প্রয়াসকে খুব একটা শক্তিশালী করতে পারেনি।
চেষ্টা তাও থেমে থাকে নি। সেইসময় কমিউনিস্ট পার্টি, কমিউনিজম, এই শব্দগুলো ছিল ভীন গ্রহের। ইউরোপের দেশগুলোতে বামপন্থীরা নিজেদের সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাট বলেই খুশি থাকত।ঝামেলা ঝঞ্ঝাট নেই। কোথাও রাজার পক্ষে বা কোথাও বড়লোকদের নির্বাচিত ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারের পক্ষে ,কখনো বিপক্ষে। বিষয়টা জমাট বাঁধছিল না। তারপরে লেনিন এসে স্পষ্ট করলেন যে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট আর কমিউনিস্ট এক ধাঁচার নয়। সে এক অন্য বিষয়।
১৯০৭ সালে স্টুটগার্টে সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনালের একটি কংগ্রেস, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ সোশ্যালিস্ট ইয়ুথ (IUSY) এর ভিত্তি তৈরি করে।প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, IUSY-এর অনেক সদস্য সংগঠন কট্টরপন্থী হয়ে ওঠে। ১৯১৫ সালে বার্নে(সুইজারল্যান্ড) তারাই ইউরোপীয় সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের জাতীয়তাবাদী "বার্গফ্রিডেন" (Burgfrieden একটি মধ্যযুগীয় জার্মান শব্দ,সোজা ভাবে বললে সামন্তপ্রভুদের সাথে আপোষকারী, পক্ষ বিপক্ষ নির্বিশেষে) রাজনীতির বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক যুব সংগঠনের একটি সম্মেলনের আয়োজন করে। এই সম্মেলন থেকে তারা স্পষ্টভাবে যুদ্ধের বিরোধীতা করে , আর সেখানেই তারা থেমে যায়নি। স্পষ্ট একটা যুদ্ধবিরোধী অবস্থানকে তারা গোটা ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে দেয় ।
স্টুটগার্টে সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনালের ১৯০৭ সালের কংগ্রেসের পরে, ১৪টি বিভিন্ন দেশের ২০ জন প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সম্মেলন থেকে IUSY-এর পত্তন হয়। কার্ল লিবনেখট চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তখন তিনি ছিলেন জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা।
১৯১৪সালের ৪আগস্টে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে, সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল এবং আইইউএসওয়াই ভেঙ্গে যায়। দেশের সরকারের যুদ্ধের রাজনীতিতে সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাট দলগুলো রাষ্ট্রের কাছে নিজেদের মাথা বিকিয়ে দেয়।প্রতিযোগীতা শুরু করে দেয় কোন দল কতটা দেশপ্রেমিক এটা প্রমাণ করতে। শুধুমাত্র একটা ছোট অংশ "বার্গফ্রিডেন" রাজনীতিকে প্রতিরোধ করেছিল। এর মধ্যেই IUSY ১৯১৫ সালের ৪ এপ্রিল বার্ন সম্মেলনে নয়টি দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।কিন্তু এরপরে সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল তৈরি হতে, জিমারওয়াল্ড সম্মেলন বলা হয় যেটাকে- আরও পাঁচ মাস সময় নেয়। এটাই দেখিয়েছিল আন্তর্জাতিক ধারণা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তরুণদের অগ্রণী ভূমিকা।
উইলি মুনজেনবার্গের নেতৃত্বে জুরিখে IUSY-এর নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়। তাঁরা যুদ্ধরত দেশগুলোতে যুব সংগঠনগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয় করতে এবং "Jugend-Internationale" (আন্তর্জাতিক যুব) পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করে।এই প্রকাশনার লক্ষ্য ছিল শ্রেণী সংগ্রাম ও যুদ্ধবিরোধী সংগ্রামের ভিত্তিতে সমাজতন্ত্রকে সংগঠিত করা। শান্তিবাদী মতামত সাধারণত প্রাধান্য পায়। কিন্তু এই সংগ্রামের নেতা লেনিন স্পষ্ট করে বলেছিলেন যে, শুধুমাত্র পুঁজিবাদের বিপ্লবী উৎখাত এবং সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে জনগণের (গৃহযুদ্ধে) যুদ্ধে পরিণত করার মাধ্যমেই যুদ্ধ বন্ধ করা সম্ভব।
বিশেষ করে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থানের কারণে যুব আন্দোলন সাধারণ শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে কিছুটা অগ্রগামী ভূমিকা পালন করে। তরুণরা বৈজ্ঞানিক-সমাজতন্ত্রের চেতনার মশাল-বাহক হতে চেয়েছিল এবং সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। ১৯১৬ সালে,লেনিন আবারও যুবকদের স্বনির্ভরতার ও স্বতন্ত্র সত্ত্বার কথা বলেছিলেন। লেনিন জানতেন ,বিপ্লবের জন্য যে দৌড়টা লাগবে , যে ভালোবাসাটা দরকার, যে একনিষ্ঠতা জরুরি সেটা যুব সমাজ থেকেই পাওয়া সম্ভব।
যুদ্ধের পর, ১৯১৯ সালের মার্চ মাসে মস্কোতে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল (Comintern) নামে নতুন করে তৃতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কাঠামোর মধ্যে, দুই মাস পরে কমিন্টার্নের কার্যনির্বাহী কমিটি সমস্ত ‘সর্বহারা যুবদের’ একটি ইয়াং কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল গঠনের আহ্বান জানায়।তৈরি হয় Young Communist International।
“ ‘কমিউনিস্ট ইয়ুথ ইন্টারন্যাশনাল’ তৃতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেসের প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্থাপিত হয়েছে এবং এটি কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের একটি অংশ। কমিউনিস্ট ইয়ুথ ইন্টারন্যাশনালের সদর দপ্তর সাংগঠনিকভাবে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের সাথে যুক্ত এবং তারসাথে সবচেয়ে বড় লড়াইয়ে একনিষ্ঠ সহযোদ্ধা হিসাবে ভাবে।" [ওয়াইসিআই: ইশতেহার, কর্মসূচি, সংবিধি পৃ. ১২]”
YCI-এর জন্ম হল। এই কংগ্রেসের পরেই ওয়াইসিআই সদস্য সংখ্যায় জোয়ার এল। ১৯১৯ সালের শেষের দিকে ২,১৯,০০০ সদস্য নিয়ে ১৪টি ‘বিভাগ’(দেশ) থেকে ১৯২১ এর শুরু পর্যন্ত সময়কালে ৮লাখ সদস্য নিয়ে ৪৯টি বিভাগে পৌঁছেছিল (ইয়াং সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল ১৯২৪ সালে ৩৩টি সমিতিতে আড়াই লাখ সদস্যের সংগঠন) এই বৃদ্ধির কারণগুলো একদিকে ছিল নতুন সংগঠন তৈরি হওয়া এবং অন্যদিকে সংশোধনবাদী ও বলশেভিক ধারণার লড়াই। যেখানে বিপ্লবী চেতনার জোরটাই বলশেভিক ধারণাকে এগিয়ে দিয়েছিল আপোষকামীদের বিরুদ্ধে।
একটা সম্পূর্ণ নতুন ধাঁচায় তৈরি হয়েছিল এই Young Communist International। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সংশোধনবাদী মনোভাব থেকে জিমারওয়াল্ড সম্মেলন হয়ে এই মতাদর্শগত ও বাস্তবিক সাম্রজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে যুব সমাজের ঐক্যবদ্ধতার ইতিহাস স্মরণ করতেই হয়। পরবর্তীতে কমিনটার্নের সাথেই এর অবসান ঘটলেও , এই উদ্যম ছিল অনন্য ও অভূতপূর্ব।