world environment day 2025

বিশ্ব পরিবেশ দিবস এবং প্লাস্টিক দূষণ

সৌরভ চক্রবর্ত্তী

আজ ৫৩ তম বিশ্ব পরিবেশ দিবস। ১৯৭২ সালে সুইডেনের স্টকহোম শহরে 'হিউম্যান এনভায়রনমেন্ট 'শীর্ষক বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবার পরের বছর ১৯৭৩ সাল থেকে প্রথম বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয় সারা বিশ্বজুড়ে।

প্রথম বিশ্ব পরিবেশ দিবসের মূল ভাবনা ছিল ‘অনলি ওয়ান আর্থ’।

এবারের মূল ভাবনা হলো ‘পুটিং এ্যান এন্ড টু  প্লাস্টিক পলিউশন’। প্রচারমূলক ভাবনা হল, ‘বিট প্লাস্টিক পলিউশন’।

১৯৭২ সালে স্টকহোমের বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলন মঞ্চে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী  ইন্দিরা গান্ধী এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন যা আজকের সময়ে খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছিলেন, ‘দারিদ্র্য এবং প্রয়োজনই কি সর্বোচ্চ প্রদূষক  নয়? উদাহরণস্বরূপ, যতক্ষণ না আমরা আদিবাসী এবং জঙ্গল এবং  জঙ্গলের আসে পাশে বসবাসকারী মানুষদের চাকরি এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনের ক্রয় ক্ষমতার অধিকারী না করতে পারছি, বেঁচে থাকার জন্য জঙ্গল থেকে খাবার সংগ্রহের, পশু শিকার, বা গাছপালা কাটা থেকে তাদের প্রতিহত করতে পারিনা। যখন তারা আদিবাসী নিজেরা নিজেদের বঞ্চিত বলে মনে করে তখন কি করে আশা করব তারা বন্যপ্রাণ রক্ষা করবে’।

তিনি বলেছিলেন যে,  ‘দেশে দেশে এটা বলা হয় যে উন্নয়ন আর প্রকৃতির ওপর আক্রমণ সমার্থক। আমরা যারা প্রকৃতির অংশ, প্রকৃতি নির্ভর তারাই প্রকৃতিকে শোষণের কথা বলি। যখন ১৯৫৩ সালে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আরোহন করা হ'ল, জহরলাল নেহেরু তখন এভারেস্ট বিজয় শব্দটাতে আপত্তি জানিয়েছিলেন’।

ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ‘আজকের অনেক উন্নত দেশ বর্তমানে প্রাচুর্যে উপনীত হয়েছে অন্য জাতি এবং দেশের উপর কর্তৃত্ব বিস্তার করে তারা তাদের নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদকে শোষন করেছে’।

ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ’এটা স্পষ্ট যে বর্তমান বিশ্ব যে পরিবেশ সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে তা ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত করবে, আমাদের  সে যেই হোক না কেন এর থেকে পরিত্রান পাবে না। পরিবর্তনের প্রক্রিয়া বর্তমান আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চ্যালেঞ্জ করছে। ‘একটাই পৃথিবী’ নিয়ে ক্রমবিকাশমান সচেতনতা কি আমাদের ‘একটাই মানবতা’তে উত্তরণ ঘটাতে সমর্থ হবে?

অনেক গুরুত্বপূর্ণ মত তিনি তুলে ধরেছিলেন বিশ্বের দরবারে।

প্রায় ১৮০ বছর আগে ১৮৪৪ সালে কার্ল মার্কস ‘ইকোনমিক অ্যান্ড ফিলোসফিক ম্যানাস্ক্রিপ্ট’ এ বলেছিলেন, ‘মানুষ প্রকৃতিতে বাস করে অর্থাৎ প্রকৃতি তার শরীর যদি তারা মরে না হয় তাহলে প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সাথে বিনিময় করতে হবে কারন মানুষ প্রকৃতির অংশ..... শ্রম, মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে’।

১৮৮৩ সালে লিখিত ‘প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা’য় এঙ্গেলস লিখেছিলেন, ‘প্রকৃতিকে জয় করা যায় কারণ এমন প্রতিটি বিজয়ে প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয়’।

মার্কস ক্যাপিটাল এর তিন নম্বর খন্ডে বলছেন - মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে বিপাকীয় সম্পর্কের কথা এবং বিপাকীয় সম্পর্কের মধ্যে অপূরণীয় ফাটলের কথা, যে ফাটল পুঁজিবাদী সমাজ তৈরি করেছে।

সার্বিকভাবে আজ পরিবেশ নিয়ে উপরোক্ত আলোচনা খুবই প্রাসঙ্গিক - মানুষ এবং পরিবেশের মধ্যে ফাটল আজকের পরিবেশ সংকটের মূল কারণ।

স্টকহোম কনফারেন্স - নতুন পথ চলা

'স্টকহোম কনফারেন্স' এর সিদ্ধান্তক্রমে ইউনাইটেড নেশনস এনভারমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনইপি) গঠিত হয়

যারা বিশ্ব পরিবেশ দিবসকে সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয় করেছে। সম্মেলন থেকে ঘোষিত হয় ২৬ নীতি যা, স্টকহোম ঘোষণা বলে পরিগণিত।

উন্নয়ন বনাম দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন

স্টকহোম কনফারেন্সের সিদ্ধান্তক্রমে গঠিত হয়েছিল ব্রান্ডল্যান্ড  কমিশন, ১৯৮৭ সালে 'আওয়ার কমন ফিউচার' বলে তারা রিপোর্ট পেশ করেন এবং' উন্নয়ন' শব্দটিকে প্রতিস্থাপিত করে দীর্ঘস্থায়ী বা টেকসই উন্নয়নের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেন - " দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন হলো সেই উন্নয়ন যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিজেদের প্রয়োজনের মেটাবার সামর্থের সাথে আপোষ না করে বর্তমানের প্রয়োজন মেটায়। "

আজ যখন বর্তমান পৃথিবীর মানুষ বল্গাহীন স্বেচ্ছাচারী ভোগসর্বস্যতা চালিত পথে কার্যত দুটো পৃথিবীর সম্পদকে গ্রাস করেছে এবং এই পথকেই উন্নয়ন বলে জাহির করছে তখন উন্নয়ন কথাটাকে দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতেই হবে না হলে এই বিশ্বের কোন ভবিষ্যৎ নেই।

১৯৭২ সালে স্টকহোমে আয়োজিত 'হিউম্যান এনভায়রনমেন্ট ' শীর্ষক সম্মেলনের এখানেই সার্থকতা।

বিশ্ব পরিবেশ দিবসের মূল ভাবনার পুনরাবৃত্তি

১৯৭৩ সালে 'অনলি ওয়ান আর্থ' এর মূল ভাবনা শুরু হয়েছিল প্রথম বিশ্ব পরিবেশ দিবসে, এর পরে ৫০ তম বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আবার ফিরে এসেছিল 'অনলি ওয়ান আর্থ ' এর মূল ভাবনা। এর মাঝে অনেকগুলো বছরে একটু অদলবদল করে একই মূল ভাবনা পুনরাবৃত হয়েছে। ২০২৫  সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের মূল ভাবনা হল, " পুটিং এন এন্ড টু  প্লাস্টিক পলিউশন"  আর "বিটিং প্লাস্টিক পলিউশন " হলো প্রচার ভাবনা। এই মূল ভাবনা ২০১৮ এবং ২০২৩ এও ছিল। এবার নিয়ে তিনবার একই  মূল ভাবনা নিয়ে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হচ্ছে। এতে বোঝা যায় বর্তমান পৃথিবীর মানুষ যতই প্রাকৃতিক ভারসাম্য এবং প্রকৃতির সুস্থিতির কথা ভাবুক না কেন আসলে বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং কাঠামো যদি ভারসাম্যহীন হয় অস্থিতিশীল হয় তাহলে প্রকৃতির ভারসাম্য কখনোই কার্যকর হতে পারে না।  প্রকৃতি এবং মানুষকে শোষণ করা ভোগসর্বস্য মুনাফালোভী পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় প্রকৃতি - মানুষের মধ্যেকার বিপাকীয় ক্রিয়ার ফাটলকেই ত্বরান্বিত করে এবং মনুষ্য প্রজাতির সামনে পরিবেশগত সুকঠিন চ্যালেঞ্জকে অবধারিত করে। প্রাকৃতিক সম্পদের বল্গাহীন লুটতরাজকারি পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আজ মনুষ্য প্রজাতি বিলোপের হাতছানির মধ্যে এনে ফেলেছে, ফলে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের মূল ভাবনা বাড়ে বাড়ে পুনরাবৃত হচ্ছে।

নতুন এক দিগন্ত

স্টকহোম সম্মেলন বিশ্বের দরবারে পরিবেশ চেতনা ও কর্মকাণ্ডের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিলো। গঠিত হলো, 'ইউনাইটেড নেশন এনভারমেন্ট প্রোগ্রাম',  'ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ ' যারা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কাজ  শুরু করলো, বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন নিয়ন্ত্রনে কিয়োটো প্রোটোকল এবং প্যারিস চুক্তি সম্পাদনে  ভূমিকা গ্রহণ করল, ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন টু কমব্যাট ডেজার্টিফিকেশন ', মরুকরণ এবং খরা প্রতিহত করার কাজে হাত দিলো, 'কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি', জীববৈচিত্র্য রক্ষার কাজে ব্রতী হল। এনভারমেন্ট শীর্ষ সম্মেলন এক যুগান্তকারী ঘটনা বলে উজ্জ্বলরূপে চিহ্নিত।

অনেক কথা বলার আছে আজ

ইউএনইপি র মূল ভাবনাকে উপজীব্য করেই বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়ে থাকে কিন্তু শুধু প্লাস্টিক দূষণ প্রতিহত করার আহ্বানেই  বিশ্ব পরিবেশ দিবসে তাৎপর্যমণ্ডিত হয় না, আরো অনেক কথা থেকে যায়।

২০০৭  সাথে স্টকহোম রেজিলিয়েন্স এর ডিরেক্টর যোহান রকস্ট্রম এবং তার সতীর্থরা নয়টি ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করে  'নাইন প্লানেটারি বাউন্ডারি'  মডেল এনেছিলেন যার মধ্যে ছয়টি  ক্ষেত্রই বিপদসীমাকে লঙ্ঘন করেছে। এই ছ'টি ক্ষেত্র হলে -  জলবায়ু পরিবর্তন, জৈব বৈচিত্রের ক্ষয়, ভূমির চরিত্র পরিবর্তন, স্বাদু জল সরবরাহ, নাইট্রোজেন - ফসফরাস চক্রের ক্ষয় এবং সমুদ্রের অম্লতা বৃদ্ধি।

এই ছ'টি ক্ষেত্র আজ গোটা মনুষ্য সভ্যতাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উষ্ণতা বৃদ্ধি, ঋতুর পরিবর্তন, খরা বন্যা দাবানল, ফসলের ক্ষতি, শ্রমদিবস নষ্ট, ভাইরাস সংক্রমণ, মানুষ - গবাদি পশুর মৃত্যু,মাইগ্রেশন ঘটেই চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ঙ্কর রূপ আজ গোটা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছে।

অত্যধিক মনুষ্য ভোগের কারণে উদ্ভিদ ও প্রাণীদের ওপর চরম আগ্রাসন, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ও ভূমিরূপের পরিবর্তনের কারণে জীব বৈচিত্রের ক্ষয় হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া এবং ভূগর্ভস্থের অত্যধিক জল নিষ্কাশনের জন্য স্বাদু জলের সংকট দেখা দিচ্ছে।

কৃষি ক্ষেত্রে অত্যধিক রাসায়নিক সারের ব্যবহার জনিত কারণে নাইট্রোজেন - ফসফরাস চক্রের ক্ষয় হচ্ছে।

তীব্র দূষণ জনিত কারণে সমুদ্রের অম্লতা বাড়ছে, ২৫ শতাংশ সামুদ্রিক জীবকুলের আবাসভূমি প্রবালদ্বীপ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও প্রাণীকুলের ক্ষয় হচ্ছে।

সভ্যতার বিবর্তনের এক সন্ধিক্ষণে পরিবেশ -  উন্নয়নের দ্বন্দ্ব তীব্র হচ্ছে। এই দ্বন্দ্ব যেন বৈরিতামূলক দ্বন্দ্বে পর্যবশিত না হয় তাহলে এই বিশ্বের কোনো ভবিষ্যত নেই।

উন্নয়নের নামে চলছে প্রাকৃতিক সম্পদের বল্গাহীন লুটতরাজ। এই লুটতরাজের প্রশ্নে কর্পোরেট সংস্থাগুলি

রাষ্ট্রের অভূতপূর্ব সহায়তা পাচ্ছে, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের রক্ষাকবচ আইনকানুন লুটতরাজকারি

বৃহৎ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রতি পক্ষপাত করছে, আইনগুলিকে ভোঁতা করে দেওয়া হচ্ছে।

হিমালয়ের গঠন, ভূতত্ত্ব, নদ-নদী, ভূগর্ভস্থ জলাধার,ভূমির গঠন, বহন ক্ষমতা, সৃষ্টির সময়কার  চ্যুতি - এগুলিকে অস্বীকার করে পর্যটন এবং ধর্মীয় পর্যটনের নামে

বিশাল চওড়া সড়ক, হোটেল রিসর্ট, বিশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বিপুল কংক্রিটের জঙ্গল তৈরি করা হচ্ছে। এর সাথে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত মেঘভাঙা বৃষ্টি যুক্ত হয়ে চরম দুর্ঘটনা ঘটছে। বাঁধ ভেঙে ধ্বংসলীলা ঘটছে, মানুষের ধন সম্পত্তি নষ্ট হচ্ছে, মানুষের মৃত্যু ঘটছে, ধ্বংস হচ্ছে হিমালয়ের বাস্তুতন্ত্র।

দেশ এবং রাজ্যের নদীগুলি সংকটের মধ্যে পড়েছে।

নদীবাঁধগুলিতে পলি জমা, নদীর তটভূমিতে  বনায়ন না করা, বন ধংস করা, কৃষিকাজে মাটির তলা থেকে অত্যধিক হারে জল তুলে নেওয়া, বৃষ্টিপাত কম হয়ে যাওয়া, নদীবক্ষ জল কমে যাওয়া বা শুকিয়ে যাওয়া, নদীর বালি মাটি লুট করা, নদীবক্ষ দখল করা, ইত্যাদি কারণে অনেক ছোট নদী যেমন হারিয়ে গেছে তেমন বড় নদী গুলিও অবাধ নির্মল জলধারা নিয়ে প্রবাহিত হতে পারছে না। ২০ হাজার কোটি টাকা থেকে শুরু হয়ে আজ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকায় উপনীত হওয়া ' নমোমি গঙ্গে 'প্রকল্প কার্যত ব্যর্থতায় পর্যবশিত হয়েছে - চরম দূষিত হয়ে পড়ছে।

এর সাথে উন্নয়নের নামে চলছে অবাধে বৃক্ষচ্ছেদন এবং জলাভূমি ভরাট, কলকাতার কিডনি - রামসার সাইট পূর্ব কলকাতা জলাভূমি বুজিয়ে ফেলা এবং নোংরা জলের ঘাটতির সঙ্কট।

সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে সুন্দরবনের নদীগুলির লবনাক্ততা বাড়ছে, সাইক্লোন - বন্যায় জমির লবনাক্ততা বাড়ছে, চিংড়ি কাঁকড়া উৎপাদনে সঙ্কট দেখা দিচ্ছে, একবগ্গা মেছো ঘেরি কৃষিজমির ক্ষতি করছে, মাটির তলার জল লবনাক্ত হচ্ছে। এরসাথে আছে নদী দূষণ,শব্দ দূষণ,আছে এসবের প্রতিকারে কেন্দ্রীয় সরকারের মাস্টার প্ল্যান না করা।

বিক্রি হয়ে যাচ্ছে পাহাড়। রাজ্যজুড়ে পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা সাধ্যমতো সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে পরিবেশ রক্ষার প্রশ্নে মানুষের মধ্যে প্রচারে তীব্রতা বাড়াচ্ছে, জলাভূমি রক্ষায়, অরণ্য রক্ষায় কলকাতা হাই কোর্ট, জাতীয় সবুজ আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছে কিন্ত তেমন সুফল পাওয়া যাচ্ছে না, আদালতে জয়ী হয়েও রায় কার্যকর হচ্ছে না।

প্যারিস চুক্তি মোতাবেক ২০২১ সালে গ্লাসগোতে জীবাশ্ম জ্বালানি কমিয়ে নবীকরণযোগ্য শক্তি বাড়ানোর দেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা কমছে, উল্টোদিকে কয়লা উত্তোলনের  বাস্তব সম্ভাবনা না থাকা সত্ত্বেও বীরভূমের দেউচা- পাচামিতে কোল ব্লক বন্টন করা হলো এবং কোনও বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভয় ভীতি গোপনীয়তায় ব্যাসাল্ট উত্তোলনের প্রক্রিয়া শুরু হলো, বিজ্ঞান কর্মী - সিলিকোসিস নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা কর্মীদের সশস্ত্র বাহিনী দেউচা - পাচামি যেতে বাধা দিল, পুলিশ প্রশাসন কোনও সাহায্যই করলো না। রাজ্যের মধ্যে দেউচা - পাচামি নিষিদ্ধ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে আজ।

প্লাস্টিক দূষণের ভয়ঙ্কর রূপে মাইক্রোপ্লাস্টিক

২০১৬ সালে ইকোলজিস্ট ইগনাসিও গেস্টোসো এবং তার সাথীরা পর্তুগালের আগ্নেয় দ্বীপ মদেরিয়ার  সমুদ্রতটে পাথরের গায়ে সাদা এবং নীল রঙের চুইংগামের বা মুখ থেকে ফেলে দেওয়া ফেনাযুক্ত টুথপেস্টের মত পদার্থ সেঁটে আছে লক্ষ্য করেন। তারা ভাবতে বসলেন এগুলো কি? কোথা থেকেই বা  এলো?

রাসায়নিক পরীক্ষায় জানা গেল এগুলো হচ্ছে পলিইথিলিন। কিভাবে সমুদ্র তটে এই পলিইথিলিনের পদার্থ তৈরি হলো? জানা গেল মাইক্রোপ্লাস্টিকই গড়ে তুলেছে পাথরের গায়ে দৃঢ়ভাবে সেঁটে থাকা এক পদার্থের সমাহারকে।

মাইক্রো এবং ন্যানোপ্লাস্টিক অর্থাৎ যাদের আকার ১মাইক্রন মিটার থেকে ৫ মিলি মিটার পর্যন্ত হয় এমন প্লাস্টিকের সুক্ষ সুক্ষ কনিকা। সমুদ্রতটে পাথরের গায়ে জমে জমে যে পদার্থ তৈরি করেছে তার নাম হলো 'প্লাস্টিক্রাস্ট '- এ যেন এক ভয়ানক সৃষ্টি! পাথরের উপর বসবাসকারী এবং পাথরের উপর শৈবাল খেয়ে বেঁচে থাকা অণুজীবগুলোর খাদ্যশৃঙ্খলে প্লাস্টিক ঢুকে পড়লো।

আজ দেখা যাচ্ছে বাতাসে জলে কৃষি জমিতে ঘরের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক - পাওয়া যাচ্ছে মায়ের প্লাসেন্টা, পুরুষের টেস্টিস, লিভার, কিডনি এবং ব্রেনে, জননতন্ত্র এবং  ডিএনএ কাঠামোতেও অনুপ্রবেশ ঘটেছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের।

সারা বিশ্বে ভারত সর্বোচ্চ প্লাস্টিক দূষণকারী

২০২৪ সালের নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ভারত সারা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ প্লাস্টিক দূষণকারী দেশের শিরোপা পেয়েছে। ভারত বছরে ৯.৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন করে - প্রতিদিন জনপ্রতি উৎপাদন করে ০.১২কিলোগ্রাম।

একটা হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে,ভারতবর্ষ বছরে যা প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন করে তাকে ভর্তি করতে গেলে, কলকাতা থেকে ২০ ফুট চওড়া ৪ ফুট উচ্চতার একটা গাড়ি লম্বায় হতে হবে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত। ভাবা যায়!এই

উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে রয়েছে 'গ্রেট প্যাসিফিক গার্বেজ প্যাচ' ( জিপিজিপি), দিগন্ত বিস্তৃত এক ভূমিরূপ তৈরি হয়েছে সমুদ্রের উপর যা শুধুই বর্জ্য দিয়ে তৈরী এবং যার বেশির ভাগটাই প্লাস্টিক - যার আয়তন ১.৬ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার এবং যা ১.৮ ট্রিলিয়ন প্লাস্টিক টুকরো দিয়ে তৈরি, ভাবা যায়! আমাদের ফেলে দেওয়া  প্লাস্টিক বর্জ্যের গায়ে আমরা যদি নাম লিখে দিতাম তাহলে সেই নামাঙ্কিত প্লাস্টিক কি উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের 'গ্রেট প্যাসিফিক গার্বেজ প্যাচ' এ  পৌঁছে যেত?

প্রায়ই আমরা ছবিতে দেখি, বিশাল তিমি মাছ সমুদ্রতটে ছটফট করে মারা গেল - তার পেট কেটে পাওয়া গেল টনটন প্লাস্টিক। কোথাওবা মাছ ধরার প্লাস্টিক জড়িয়ে ছটফট করতে করতে মারা গেল এক কচ্ছপ।মাইক্রোপ্লাস্টিক যে মাছ খেলো, সে মাছ যখন মানুষ খেলো  তার শরীরেও অনুপ্রবেশ ঘটালো মাইক্রোপ্লাস্টিক

ভারতের প্লাস্টিক পরিচালন ব্যবস্থা

ভারত ২০১৬ সালে 'এক্সেন্ডেড প্রডিউসার রেস্পন্সিবিলিটি'( ইপিআর) লাগু  করে। 'ইপিআর' - 'পলিউটার  পেজ' নীতি কে কার্যকর করে এবং প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ, রিসাইকেল  এবং পুনর্ব্যবহার এর দায়-দায়িত্ব যারা প্লাস্টিক পন্যের  মোড়ক  উৎপাদন করে তাদের ওপর ন্যস্ত  করে অর্থাৎ একজন উৎপাদক যখন আমদানিকারীর থেকে কিনে সরাসরি বাজারে নিয়ে যায় তখন তার দায়দায়িত্ব হলো সংগ্রহ এবং রিসাইকেল করা। একইভাবে কোন ব্র্যান্ড মালিক কোন উৎপাদক বা আমদানিকারীর থেকে প্লাস্টিক কিনে যদি  বাজারে নিয়ে যায় তাহলে সেই ব্র্যান্ড মালিকের উপরই সেই প্লাস্টিক বর্জ্যের জীবন চক্রের সমাপ্তির ( এন্ড অব লাইফ) পরিচালন ব্যবস্থার দায় দায়িত্ব বর্তায়।

প্লাস্টিক ক্রেডিট পারচেজ সিস্টেম - দুর্নীতি পরায়ণ

২০২২ এর সংশোধনীতে 'প্লাস্টিক ক্রেডিট পারচেজ সিস্টেম'  এলো - এর অর্থ হ'ল যে, যদি কোনো প্রদূষক বাজারে একটা নির্দিষ্ট ক্যাটাগরির যে পরিমাণ প্লাস্টিক নিয়ে গেছে তার বেশি বর্জ্য সংগ্রহ করে তাহলে সে এই হিসেবটাকে পরবর্তী আর্থিক বছরে টেনে নিয়ে যেতে পারবে বা সেই ক্যাটাগরির প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করবে এমন কোন প্রদূষকের  কাছে বিক্রি করে দিতে পারবে।

খাদ্যের ক্ষেত্রে রিসাইকেল করা প্লাস্টিক কার স্বার্থে?

ভারতে প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা শুরু হয়েছিল ১৯৯৯ সালে, 'ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড ইউসেজ রুলস' দিয়ে - এতে পরিষ্কার বলা ছিল যে, খাদ্যের ক্ষেত্রে রিসাইকেল করা  প্লাস্টিক নিষিদ্ধ।

২০১৬ সালে  প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্ট রুল এই নিষিদ্ধতাকে  বহাল রেখে বলল, রিসাইক্লিং করা ক্যারি ব্যাগ বা রিসাইকেল করা প্লাস্টিক দ্রব্য দিয়ে খাবার মজুদ, বহন করা বা সরবরাহ করা যাবে না কিন্তু সেপ্টেম্বর ২০২১ এর ২০১৬ র  সংশোধনী রুলস এ প্রথমবারের জন্য খাবারের ক্ষেত্রে রিসাইকেল করা প্লাস্টিকের অনুমোদন দিয়ে দেওয়া হলো! কেন? কার স্বার্থে? কার চাপে?

 ১৮ ই জানুয়ারি, ২০২২ এ 'এফ এস এস এ আই', 'ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং সংশোধিত রুলস ২০২২ এ বলল, শুধুমাত্র রিসাইকেল করা পলিইথিলিন টেরিথ্যালেট (পি ই টি) দিয়ে  খাদ্যের ক্ষেত্রে মজুদ বহন এবং সরবরাহ করা যাবে।

'এক্সটেন্ডেড প্রডিউসার রেস্পন্সিবিলিটি’ (ইপিআর) নির্দেশিকা ২০২৫-২৬ সাল  থেকে উৎপাদক, আমদানিকারী, ব্র্যান্ড মালিকদেরই রিসাইকেল করা প্লাস্টিক ব্যবহারকে বাধ্যতামূলক করেছে!

রিসাইকেল করা প্লাস্টিকের গুণমান ঠিক করা এক কঠিন চ্যালেঞ্জ, যে 'ইনফর্মাল' ক্ষেত্রগুলো রিসাইকেল করে তারা গুণমান রক্ষার ক্ষেত্রে আপোস করে এবং  রিসাইকেল করার ক্ষেত্রে  পেশাগত স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার দিকে নজর দেয় না। এরপরে আছে, প্লাস্টিক শিল্প এমন রাসায়নিক ব্যবহার করে যা মানুষের কাছে অপরিচিত। এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে ১০,০০০ অ্যাডিটিভ, প্রসেসিং এইডস এবং মনোমার প্লাস্টিক উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। এই ১০,০০০ দ্রব্যের ৫৫% এডিটিভ,৩৯% প্রসেসিং এইড, ২৪% মনোমার। এদের এক-তৃতীয়াংশের কাজ, কোথায় কিভাবে কতটা ব্যবহার করা হচ্ছে, তা জানা যায়না। আসলে ভারতে নতুন আইন যথেষ্ট নয়, দরকার কড়া নজরদারি এবং কাজে পরিণত করার ক্ষমতা কিন্তু তা করবে কে?

সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিকের নামে ভাঁওতাবাজি

২০১৮ র ৫ ই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে দেশের প্রধানমন্ত্রী জোর দিয়ে বললেন যে,  ভারত 'সিঙ্গেল ইউজ  প্লাস্টিক ' বা একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিককে 'ফেজ আউট' করবে বা ধীরে ধীরে তুলে নেবে। ১৫ই আগস্ট ২০১৯ এ স্বাধীনতা দিবসে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে জানালেন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক মুক্ত দেশের কথা, ওই বছরের ২রা অক্টোবর গান্ধীজীর ১৫০  বছরের জন্মজয়ন্তীতে একই কথা বললেন - তিন বছর পর একুশে জুলাই ২০২২ এ চিহ্নিত ১৯ টি একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের উৎপাদন, আমদান, মজুদ, বিতরণ, বিক্রি নিষিদ্ধ হলো।

ইউ এন এর তথ্য অনুযায়ী সর্বমোট যা পলিমার তৈরি হয় তার ৫০%ই হলো একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক দ্রব্য।

২০২৩ এ ' প্লাস্টিক ওয়েস্ট মেকার্স ইনডেক্স ' অনুযায়ী ভারত সারা পৃথিবীতে প্লাস্টিক পলিমার উৎপাদনে ১৩ তম স্থানে আছে, ভারতের রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ পলিমার উৎপাদনে সারা বিশ্বে অষ্টম স্থান অর্জন করে - প্লাস্টিক দ্রব্য উৎপাদনের যে কাঁচামাল প্রয়োজন হয় তাতে ৩.১মিলিয়ন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়! এরপর একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ক্ষেত্রে 'জি এ আই এল ইন্ডিয়া'  ৩৪ তম  স্থানে, 'ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন' ৪৩ তম স্থানে, যাদের একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ ০.৭ এবং ০.৬ মিলিয়ন টনের।  পলিমার উৎপাদকদের যারা মূলধন যোগায় সেই শীর্ষ  ব্যাংকদের অন্যতম 'এসবিআই ' এর স্থান ৪৩ তম! 2023 সালে ভারত পৃথিবীর মধ্যে 5.5 মিলিয়ে নেন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন করে পৃথিবীর মধ্যে তৃতীয় স্থান অধিকার করে। এই দ্বিচারিতায় বাজারে একবার মাত্র ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক কমবে! শুধু মানুষকে দায়ী করে, তাদের জীবন শৈলী পরিবর্তন করে, তাদের নিষিদ্ধ  ক্যারি ব্যাগ বর্জনের আওয়াজ তুলে সমস্যার সমাধান হবে! ফুটো পাত্রে জল ঢেলে তৃষ্ণা নিবারণের চেষ্টা কার স্বার্থে?

মালিকদের মিথ্যার বেসাতি

২০২২ সালে ' এক্সটেন্ডেড প্রডিউসার রেস্পন্সিবিলিটি ' অনুযায়ী যে কেন্দ্রীয় পোর্টাল  হয়েছে তাতে ব্র্যান্ড মালিকদের বলতে হয় যে তারা কতটা প্লাস্টিক বাজারে এনেছে আর কতটা ফিরিয়ে নিয়েছে কিন্তু এখানে তারা সত্য বলে না,তারা তাদের 'প্লাস্টিক ফুটপ্রিন্ট ' গোপন করে।

'এক্সটেন্ডেড প্রডিউসার রেস্পন্সিবিলিটি' তে ব্যবসার জন্য এবং মোড়কে যে বর্জ্য উৎপাদন হয় তার দায়-দায়িত্ব  উৎপাদকেরই - তাদের প্লাস্টিক পণ্যের জীবন চক্রের দায় সমেত,এতে সংগ্রহ, রিসাইকেল এবং নিরাপদ নিষ্পত্তির মূল্য ধরা আছে।

 ভারতে 'ইপিআর' ২০২২ সালে লাগু করা হয় 'ইপিআর' সব ধরনের মোড়ক সামগ্রী, প্লাস্টিক, ধাতু, কাচ,কাগজ উৎপাদকদের সংগ্রহ, রিসাইকেল এবং বর্জ্য হ্রাসে নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হয়।

 ভারতে প্লাস্টিক মোড়কের ক্ষেত্রে মাইক্রো স্মল এবং মিডিয়াম (এমএসএমই) কে সংগহ এবং রিসাইকেল থেকে ছাড় দিয়েছে।

'ইপিআর' ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ : দুর্বল নিয়ম-কানুন এবং অপর্যাপ্ত বলবৎকরণ।

এর ব্যর্থতা হল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মোট খরচকে ধরতে না পারা। অনেক ব্যবসায়ী উদ্যোগ ন্যূনতম ফ্রী দিয়ে ক্রেডিট কেনে যা সংগ্রহ,রিসাইকেল  এবং 'ডিসপোজাল' এর প্রকৃত খরচকে প্রতিফলিত করে না। উদ্যোগীরা সরাসরি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সাথে যুক্ত হয় না, ফলতঃ ব্যবস্থাপনা কার্যকরী হয় না। এর সাথে আছে বর্জ্য উৎপাদন এবং রিসাইক্লিং এর ব্যাপারে সঠিক তথ্যের অভাব। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, আন্তর্জাতিক নিয়মে কিছু উৎপাদককে রিপোর্টিং এর ক্ষেত্রে থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে।

প্রতারণামূলক ক্রেডিট বেসড পারচেজ সিস্টেম

আরেকটা উদ্বেগের বিষয় হল প্রতারণা! ভারতের 'ক্রেডিট বেসড ' ব্যবস্থা প্রতারণামূলক, কোম্পানিগুলো রিসাইক্লিং এবং জাল ক্রেডিট ক্রয়কে বাড়িয়ে রিপোর্টিং করে,ফলে ব্যবস্থা দূর্বল হয়। প্রদূষকেরা ছাড় পেয়ে যায়। রিসাইক্লিং এর উপর জোর অনেক ক্ষেত্রে বর্জ্য কমানো এবং পুনর্ব্যবহারকে আড়াল করে, ফলে  ভারতে ১৯৯৯ এ ৮৮% পুনর্ব্যবহার থেকে ২০১৯ এ পুনর্ব্যবহার ৩৪ % নেমে এসেছে।

ভীষণ প্রয়োজন ছিল আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার আইনের

২০২২ এর ২রা মার্চ ১৭৫ টি দেশের প্রতিনিধিরা কেনিয়ার নাইরোবিতে 'ইউএন এনভায়রনমেন্ট অ্যাসেম্বলি' প্লাস্টিক দূষণ শেষ করতে এবং 2024 এ বাধ্যবাধকতার এক আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনে একমত হন। দেশগুলি প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে অ্যাকশন প্ল্যান তৈরী করবে, প্লাস্টিক প্রতিরোধ এবং বর্জনের বিষয়ে ভূমিকা গ্রহণ করবে এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কে সমর্থন করবে।

ভারতে বৃত্তাকার অর্থনীতি সোনার পাথরবাটি

এই চুক্তি তৈরী করতে গিয়ে বৃত্তাকার অর্থনীতি বা ' সার্কুলার অর্থনীতির কথা বলা হয়েছে - ' রিডিউজ ', ' 'রিসাইক্লিং', 'রিইউজ ', অর্থাৎ প্লাস্টিক বর্জ্য কমাও, রিসাইকেল করো, পুনর্ব্যবহার করো - যতটা প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়েছে তাই নিয়েই এই তিনভাবে বৃত্তাকারে ঘোরো এবং প্লাস্টিক বর্জ্য না বাড়িয়ে এই পরিচালন ব্যবস্থার আয়ু বাড়িয়ে যাও। খুবউ মহতী উদ্যেগ কিন্তু ভারতে প্লাস্টিক  রিসাইক্লিং কমছে, ২০২৩ এর হিসেবে ৮%, ভারতে' রিইউজ ' বা পুনর্ব্যবহার কমছে ১৯৯৯ এ ৮৮% থেকে ২০১৯ এ ৩৪%।

ভারতে প্লাস্টিকের বৃত্তাকার অর্থনীতি সোনার পাথরবাটি! কিন্তু কেন? কাদের জন্য এবং কাদের চাপে ভারতের প্লাস্টিক পরিচালন ব্যবস্থা উৎকেন্দ্রিক?

শেষ হোক ফুটোপাত্রে জল ঢেলে তৃষ্ণা নিবারণের দিন

২০০০ থেকে ২০১৫  পর্বে প্লাস্টিক উৎপাদন ৭৯ শতাংশ বেড়ে গেছে বলে 'স্টকহোম রেজিলিয়েন্স সেন্টার' বলছে। পৃথিবীতে সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ওজনের থেকে মোট প্লাস্টিকের ওজন দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

প্লাস্টিক দূষণ রোধের সিদ্ধান্তের পরিকল্পনাকে ওজোন স্তর রক্ষার মন্ট্রিল প্রোটোকল এবং প্যারিস চুক্তির সমতল বলে মনে করা হচ্ছে। ভারতের অবস্থান হল এই আন্তর্জাতিক চুক্তি ভারতের জাতীয় অবস্থা এবং সামর্থের উপর দাঁড়িয়ে স্বেচ্চাধীন হোক, বাধ্যবাধকতার নয়!  কেন? কার নির্দেশে?

পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প গুলো এই চুক্তিতে খুশি নয় কারণ প্লাস্টিক, জীবাশ্ম জ্বালানির চাহিদা বৃদ্ধির চালিকাশক্তি। ভারতে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের শেয়ার পড়ে যায় আন্তর্জাতিক চুক্তির খবরে! রিলায়েন্স ভারতের প্লাস্টিক ইকোসিস্টেমের ৪২%এর অংশীদার! কার স্বার্থে তবে আন্তর্জাতিক চুক্তিকে বাধ্যবাধকতার না হয়ে স্বেচ্ছাধীন করার জন্য দরবার করা?

বাধ্যবাধকতার আন্তর্জাতিক প্লাস্টিক চুক্তি ভীষণ জরুরী ছিল। চুক্তিকে চূড়ান্ত করতে ' ইন্টারগভর্নমেন্টাল নেগোশিয়েটিং কমিটি' ( আইএনসি)  গঠিত হয়েছিল। দক্ষিণ কোরিয়ার ভূষণে বিগত ২০২৪ এর নভেম্বরে চুক্তি চূড়ান্তকরণের জন্য তারা পঞ্চম পর্বে মিলিত হয় কিন্তু তা ফলপ্রসু হয়না। একটা লিখিত খসড়া প্রস্তাবও তৈরী করা যায়নি। পেট্রোলিয়াম শিল্পোন্নত দেশগুলি - সৌদি আরব, ইরান, রাশিয়া বাধা দিয়েছে, তারা রিসাইক্লিং দিয়ে সমস্যার সমাধান চাইছে, ভারতও বাধ্যবাধকতার নয়, স্বেচ্ছাধীন চুক্তির পক্ষে। এরপরে আইএনসি - ৫.২ বসবে ৫-১৪ ই আগষ্ট, ২০২৫ এ সুইজারল্যান্ডের জেনিভাতে। আমরা অপেক্ষা করবো আর চাইবো ফুটোপাত্রে জল ঢেলে তৃষ্ণা নিবারণের দিন শেষ হোক।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন