লেখায় : ময়ূখ বিশ্বাস
কাজ নেই,তাই
খই ভাজছেন? ব্রিগেড চলুন
শিক্ষা দামী। ওদিকে স্কুল কলেজে শিক্ষক নেই। শিক্ষক থাকলেও স্থায়ী নন। অপর দিকে চাকরি নেই। কারণ পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ নেই। শিল্প নেই। যেটুকু চাকরি আছে তা পেতে হলে ঘুষ দিতে হবে তৃণমূল নেতাদের। আর গরিবের পেটে ভাত নেই। মধ্যবিত্তের পকেটে টাকা নেই। মুখ্যমন্ত্রী ঠিক করে স্কুটি চালাতে পারলেও এগুলো নেই, না পারলেও এগুলো নেই!
এদিকে বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যজুড়ে একটা বাইনারি তৈরির চেষ্টা চলছে৷ টেলিভিশন খুললেই স্ক্রিন ভাগ করে বিজেমূলের টেলি সিরিয়াল চলছে। কোকেন বনাম কয়লার খেউড় চলছে। কিন্তু যে ছেলেটা এমবিএ পাশ করে করোনায় চাকরি হারিয়ে ডেলিভারি বয় হয়ে গেছে, তার যন্ত্রণা কে বুঝবে? লকডাউন-পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে কর্মসংস্থানের চেহারা ভয়ানক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। দিদিমণি ঘটা করে বেঙ্গল বিজনেস সামিট করলেও শিল্প আসেনি ওনার জমি নীতি - তোলা বাজি - রাজ্যব্যাপী অশান্তির কল্যাণে। এমনিই 'আচ্ছে দিনে' বেকারির হার রেকর্ড ছুঁয়েছে। শুধু উত্তরপ্রদেশেই ৬২ টা পিওনের পদের জন্যে ৩৭০০ পিএইচডি,২৮০০০ পোস্ট গ্রাজুয়েট, ৫০০০০ গ্রাজুয়েট আবেদন করেছে। 'মেক ইন ইন্ডিয়া' এমনিই স্বরূপ যে, করোনাতেই কাজ হারিয়েছেন প্রায় ১৫ কোটি ভারতবাসী। আর ঠিক সেই সময়ে মোদিজীর আম্বানি বাবু ঘন্টায় ৯০ কোটি টাকা কামিয়েছেন। অক্সফার্মের রিপোর্ট সে কথাই বলছে। আর অগাস্ট-নভেম্বর ২০২০, যখন দেশে বেকারীর হার ছিল ৭.১%, বাংলায় তখন সেই হার ছিল ১১.২%। তবে এই দুরবস্থা চলছে লকডাউনের অনেক আগে থেকেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গোটা ২০১৯ সাল জুড়ে মাত্র ১টি নতুন কারখানা (মাত্র ১৪ কোটি টাকার বিনিয়োগ) তৈরি হয়েছে রাজ্যে। আর বামফ্রন্ট সরকারের সময় আমরা গোটা দেশের নিরিখে বিনিয়োগে ২১ থেকে ৩ নম্বরে পৌঁছে গেছিলাম। আর এখন ১৬ নম্বর স্থানে। শালবনির ইস্পাত-শিলিগুড়ির ভিডিওকন-সিঙ্গুরের মোটর গাড়ির যে কারখানাগুলোয় সাইরেন শোনার কথা ছিলো, আজ সেখানে শিয়াল সাপের আড্ডা। যে সেক্টর ফাইভ সিলিকন ভ্যালি হওয়ার স্বপ্ন দেখতো সেখানে আজ ২০২১ এ মাত্র ৬৮ হাজার ছেলেমেয়ে কাজ করে। যা ২০১১ তে ছিলো ১ লাখের বেশী। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গুলো আজ বন্ধ হতে বসেছে বাংলায়। কারণ সেখানে কাউন্সিলিং বন্ধ। কারণ চাকরি দেওয়ার লোক নেই। ছাত্ররাও বাংলায় বা দেশে নিজেদের শিক্ষাগত অনুযায়ী চাকরিও পাচ্ছে না। এর সাথেই রয়েছে বাংলায় সরকারি চাকরিতে রয়েছে দুর্নীতি ও বেনিয়ম। আজ শিক্ষকরাও রাস্তায়। তারাও মার খাচ্ছেন মমতার পুলিশের হাতে। যেমনটা ত্রিপুরার বিজেপি সরকারের হাতে মার খাচ্ছেন ওখানকার শিক্ষকরা। এদিকে গ্রামে কৃষির হাল বেহাল। ১০০ দিনের কাজও নেই। গ্রাম পুরুষ শূন্য হয়ে যাচ্ছে। এসবের মাঝে সরকার বলেই যাচ্ছে ওদের ভাঁড়ারে নাকি টাকা নেই। কিন্তু আমরা দেখছি শারদোৎসবে সরকারি টাকার বিনিময়ে দিদি-মোদি'র মুখ দেখানোর প্রকল্প চলছে। মোদির নতুন পার্লামেন্ট বা মূর্তি বানানো আর দিদিমণির ইমাম,মোয়াজ্জেম বা পুরোহিতভাতা, মেলা বা ক্লাবে মোচ্ছবের আসর বসিয়ে ভোট মেশিনারী তৈরী ও বিভাজনের ছক অব্যাহত রয়েছে। সেখানে বাংলার কয়েক কোটি তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ আজ প্রশ্নের মুখে। বাংলা ছেড়ে আজ তারা পাড়ি দিচ্ছেন নয়ডা, ব্যাঙ্গালোর, মুম্বাই, কেরালায়। কাজের খোঁজে। শুধু মমতার ব্যক্তিগত ইচ্ছে পূরণের তাড়নায় প্রতারিত হয়েছে বাংলার কয়েক কোটি মানুষ। হাজার হাজার ছেলে মেয়ের জীবন জীবিকাকে বন্ধক রেখে তিনি নবান্নের ১৪ তলার লিফট ধরেছিলেন। মমতার ওই আত্মঘাতী রাজনীতির ফলে একটা সিঙ্গুর, একটা টাটা-একটা ইনফোসিস কেড়ে কেড়ে নিয়ে গেছে বাংলার স্বপ্নগুলোকে। বাংলা আজ শুধুই বৃদ্ধাশ্রম বা প্রবাসী বঙ্গবাসীর কাছে হলিডে ডেস্টিনেশন।
দুই সন্তানের পিতা মইদুল ইসলাম মিদ্দা তো এই কাজ পাওয়ার জন্যেই সরকারের থেকে জবাবদিহি চাইতেই কলকাতার রাজপথে প্রতিবাদে নেমেছিলো। সেও এক শিক্ষিত যুবক ছিলো। কিন্তু কাজ না পেয়ে অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়েছিলো অটো চালাতে। সেদিন কথা ছিলো মিছিল শেষে সন্তানদের জন্যে কলেজ স্ট্রীট থেকে বই কেনার। কিন্তু পুলিশের নির্মম লাঠি তাকে নিথর লাশ বানিয়ে গ্রামে পাঠিয়েছে। ডিওয়াইএফআই কর্মী মইদুল আজ শহীদ। আসলে বদলে যাওয়া দেশ বা বাংলার এটাই রীতি। ফেসবুক থেকে রাস্তা।
প্রতিবাদীদের কপালে জুটছে জেল,গুলি,লাঠি। কিন্তু টিয়ার গ্যাসের শেল, জল কামান, লাঠির আঘাতের দগদগে ঘা নিয়েও মইদুলের সাথীরা তবু হাল ছাড়তে নারাজ। তারা আবার আসছে কলকাতার ময়দানে। শপথের ব্রিগেডে। যখন আমাদের রাজ্যের ছাত্র-যুবরা বাধ্য হচ্ছে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিতে। আমরা চাই, এখানেই কাজের সুযোগ তৈরি হোক সবার জন্য। আমরা চাই, বাংলা আবার এগিয়ে চলুক শিল্পায়নের স্বপ্নকে সামনে রেখে।
আর লোকের যখন চাকরি নেই। তখনই বাড়ছে শিক্ষার খরচ। লোকের আটা কেনার পয়সা নেই কাজ হারিয়ে, মাইনে না পেয়ে। মোদি-দিদির সরকার বলছে ডাটা কিনতে। যাতে লাভ হয় জিও বা বাইজুর মতো সংস্থার। কারণ মোদি দিদি থোড়াই মাথায় রাখে ওই বালির ট্যাক্সিওয়ালা বাবার কথা। যার প্রতিভাবান মেয়েটি স্মার্ট ফোন না পেয়ে, পড়াশোনা করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। এই প্যান্ডেমিকে যখন দরকার ছিলো পড়ুয়াদের জন্যে বিশেষ প্যাকেজের। মিড ডে মিল চালু রাখার। এখন লকডাইন পরবর্তী পরিস্থিতিতে সব কিছু যখন স্বাভাবিক, এখন আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো খোলার। কিন্তু দেখা গেল বিভাজনের দাদা দিদির কাছে এইগুলো কোনোও ইস্যু না। কিছুদিন আগে দেশের অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশ করেছেন। দেখা গেছে শিক্ষায় বরাদ্দ কমেছে ৬.১৩%। ৯৯ হাজার কোটি থেকে ৯৩ হাজার কোটি। এই ১৩০ কোটির দেশে। স্কলারশিপ তাই বন্ধ। রিসার্চ স্কলারদের কি পরিণতি হবে, সে প্রশ্ন করাই তো এই দেশ বা রাজ্যের শাসকের কাছে করা অপরাধ। অন্যদিকে গবেষণাগার গুলোর সরঞ্জাম পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও ফি আকাশচুম্বী। এসএফআই দাবী জানিয়ে ছিলো মেহুল চোস্কি-মালিয়া-রামদেবদের কর ছাড় দিলে ছাত্রদেরও ফি মকুব করতে হবে। কারণ তো আমরা দেখছি। এই পড়ুয়াদের ৭৫-৮০% আসে প্রান্তিক অংশ থেকে। যাদের একটা বড় অংশ স্থায়ীভাবে শিক্ষাঙ্গন থেকে ড্রপ আউট হচ্ছে। আদিবাসী স্কুল বা হোস্টেলগুলো আজ ভগ্ন দশা হয়ে গেছে। শিশু শ্রমিক, বাল্য বিবাহ, পাচার, জোর করে বিয়ের মতো ঘটনা বাড়ছে বাংলায়। ছাত্রদের এই অবস্থায় আর 'দুয়ারে' দেখা যায়নি দিদিমণি বা তাকে বুদ্ধি দেওয়া ৬০০ কোটির পিকের টিমকে। দেখা যায়নি কোনোও 'ভিকাশ' বা 'উন্নয়ন'কেও।
আবার আমরা দেখেছি কিভাবে এই প্যান্ডেমিককে 'মওকা' বানিয়ে শোষণ ও মগজ ধোলাইয়ের মেশিনারিকে সচল রাখা হচ্ছে। ওরা এই সময় সর্বনাশী কৃষি আইন প্রয়োগ করতে যাচ্ছে, ৮ ঘন্টার বদলে ১২ ঘন্টা কাজ করার জন্যে শ্রম আইন পরিবর্তন করছে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই চালু হতে যাচ্ছে আরএসএস-আম্বানির স্বপ্নের প্রজেক্ট জাতীয় শিক্ষা নীতি। যা আমাদের দেশের শিক্ষাকে পুরোটাই বাজারের হাতে বিক্রি করে দেবে। সাথে সাথে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অবধি আরএসএসের নিয়ন্ত্রণও জোরদার করবে। ইতিমধ্যেই তার ছায়া আমরা দেখছি। বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে পারলো না। এদিকে গরু বিজ্ঞানের পরীক্ষার ফরমান দিয়েছে ইউজিসি।
এই সময় তাই এদের প্রতিরোধের। আমরা দেখেছি শ্রমজীবী রান্নাঘর কিংবা হেঁসেল, বাজার নিয়ে রাজ্যজুড়েই বিপন্ন মানুষের পাশে ছিলো বামপন্থী ছাত্ররা। এখন সময় রবি ঠাকুরের জমি যাতে
সাম্প্রদায়িক শক্তির লীলাক্ষেত্র না হয়, তা দেখার।তাই দরকার দিল্লির মোদি আর বাংলার দিদির বিভাজনের বাইনারী, লুঠের নক্সা ছিন্ন করা কাজ-শিক্ষার মতো মানুষের দৈনন্দিন যন্ত্রণার বিষয়গুলি নিয়ে সরব হয়ে। গরিব মানুষকে তার ঘরের সন্তানদের সমস্যা আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসতে হলে বাম জোটের শক্তি বাড়াতে হবে৷ কুঁদঘাটের ম্যানহোলে যে ৪ জন শ্রমিক মারা গেলেন, তাঁদের পরিবারের যন্ত্রণা নিয়ে যাতে বাংলার সমাজ রাজনীতিতে কথা হয়, মইদুলের সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্যে,পশ্চিমবঙ্গের সন্তানরা যাতে বাইরে না চলে যান, শিল্পের জন্যে, বাংলার ৬ লক্ষ শূন্যপদ পূরণের জন্যেই তো ব্রিগেড যাওয়া।
আর কয়েক ঘন্টা বাকি ব্রিগেডের জন্যে। কাঠামো তৈরী। রাত জেগে কাজে হাত লাগাচ্ছে ছাত্র কমরেডরাও। আসলে এভাবেই বাংলায় ক্ষুদিরামের উত্তরসূরী তৈরির কাজ চলছে, তৈরি হচ্ছে আসফাকুল্লা খান- রাম প্রসাদ বিসমিল- ভগৎ সিংয়ের সাথে কাঁধে কাঁধ রেখে লড়ার মতো মৃত্যুহীন বাহিনী। ওরা ১১ই ফেব্রুয়ারিতে যন্ত্রণা ভাগ করে নিয়েছে। ওরাই ২৮শে ফেব্রুয়ারিতে ‘মোটরসাইকেল ডায়ারিজ’ রচনা করবে এ বাংলায়। ওরাই সুদীপ্ত- মইদুল-তিলক টুডুর কমরেড। আগামীর কাছে শপথ নিতে, প্রতিটি লাঠির দাগের হিসেব বুঝতে ওরা আসবে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে।