ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
কেরালার কমিউনিস্ট নেত্রী এবং প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী কে কে শৈলজা র্যামন ম্যাগসায়সায় পুরস্কার প্রত্যখ্যান করেছেন। কেউ কেউ একে “ঐতিহাসিক ভুল” বলে বসছেন। এমন বক্তব্য যে স্রেফ নির্বুদ্ধিতা তাই নয়, বামপন্থী রাজনীতির মূল্যবোধ সম্বন্ধে প্রখর অজ্ঞতারও পরিচয়। খবর হিসাবে মুখরোচক বানানোর জন্য হয়ত এমন মন্তব্য ছুঁড়ে দেওয়া চলে, কিন্তু সম্পাদকীয় কলামে একে “দ্বিতীয় ঐতিহাসিক ভুল” বলে দাগিয়ে দেওয়াটা আসলে এক রাজনৈতিক কর্মসূচী।
ফিলিপিন রাষ্ট্রের তথা পূর্ব এশিয়ার আধুনিককালের ইতিহাস নিয়ে যাঁরা আগ্রহী, তাঁদের জন্য এডোয়ার্ড ল্যান্সডেল নামটি অপরিচিত থাকার নয়। মার্কিন যুকরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীতে কর্মজীবন শুরু করে সিআইএ’’র (সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির) তরফে ফিলিপিন্স দ্বীপরাষ্ট্রের দায়িত্বে ছিলেন এই ল্যান্সডেল। বিংশ শতকের পাঁচের দশক। যখন পূর্ব এশিয়া’য় কমিউনিস্ট আন্দোলনের পক্ষে জনমত ক্রমবর্ধমান ঠিক তখনই ফিলিপিন্স প্রজাতন্ত্রের পক্ষে সম্মিলিত মার্কিণ সামরিক সহায়তা প্রকল্পের প্রধান ছিলেন তিনি। ল্যান্সডেলের সব চাইতে বড় সাফল্যই হল ১৯৫০ সালে র্যামন ম্যাগসায়সায়’কে প্রথমে ফিলিপিন্সের প্রতিরক্ষা সচিব বানানো, পরে ১৯৫৪ সালে রাষ্ট্রপতি হতে ‘সাহায্য’ করা। এই ভূমিকায় ম্যাগসায়সায়’কে বিশেষভাবে প্রস্তুত করেন ল্যান্সডেলই। ১৯৫১ সাল- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি অফ স্টেট, জেমস ই. ওয়েব রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান’কে জানান কিছুটা অর্থ এবং বেশ কিছুটা সময় খরচ করে সাফল্যের সাথে ম্যাগসায়সায়’কে রাজনৈতিক এবং সামরিকভাবে শক্তিশালী একটি অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন তারা।
নির্বাচনে ম্যাগসায়সায় জিতলে ১৯৫৩ সালের নভেম্বর, সংখ্যায় টাইমস পত্রিকা লেখে এই জয় আসলে বহু দিক থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জয় এবং একথা কোনো লুকোনোর বিষয় নয় যে ম্যাগসায়সায় আসলে মার্কিনিদেরই লোক- ‘আমেরিকা’জ বয়’।
এমন কথা বলা হল কেন? ১৯৫০ সালে কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন, ‘হুকবালাহাপ’ (Hukbong Bayan Laban sa Hapon বাংলায় ‘জাপ আগ্রাসন প্রতিরোধকারী গণফৌজ’) বিপ্লবীরা যখন ফিলিপিন্সের রাজধানী ম্যানিলা শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তখন মার্কিন কূতনীতিকরা হুক বিপ্লবীদের দমন করার দায়িত্ব ম্যাগসায়সাইয়’র হাতে তুলে দিতে তৎকালীন ফিলিপিনো রাষ্ট্রপতি কুইরিনো’কে বাধ্য করে। কুইরিনো তখ ‘লিবারাল পার্টি’র প্রতিনিধি হিসাবে জাম্বালেজ অঞ্চলের নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন। এভাবেই প্রতিরক্ষা সচিবের পদে পদন্নোতি ঘটে ম্যাগসায়সায়ের। হুকদের নিধন করার একমাত্র উদ্দেশ্যে।
ম্যাগসায়সায়ের মন্ত্র ছিল চারটি ‘এফ’। ‘ফাইন্ড দেম’ (খুঁজে বার করা), ‘ফুল দেম’ (বিভ্রান্ত করা), ‘ফাইট দেম’ (সরকারী সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়োগ করা), ‘ফিনিস দেম’ (হত্যা করা) এবং এসব মিটলে তখন হুকদের প্রতি “শান্তির হাত” বাড়িয়ে দেওয়া! সামরিক বাহিনীর উদ্দেশ্যে একটি বক্তৃতায় ম্যাগসায়সায় বলেন “আমি জানি যে আপনারা এ দেশে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এই মুহূর্তে সামরিক শিক্ষা হিসাবে যা আপনারা ফোর্ট লেভেনওয়ার্থ, ফোর্ট বেনিং এবং সামরিক আকাদেমিতে শিখেছেন, ভুলে যান। হুকরা অপ্রচলিত কায়দায় যুদ্ধ করছে। আমাদেরও অপ্রচলিত উপায়েই তাদের মোকাবিলা করতে হবে। গেরিলা জীবনে যা কিছু আমার সবচাইতে বেশি ক্ষতি করেছে (র্যামন ম্যাগসায়সায় নিজে তিন বছর ফিলিপিন্সের লুজন প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে গেরিলা বাহিনীর সদস্য ছিলেন; এই লুজন অঞ্চলেরই হতদরিদ্র কৃষকদের মধ্যে থেকে হুকবালাহাপ বিপ্লবী বাহিনীরও উৎপত্তি ঘটে), সেইসব কিছুই এখন হুকদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করব আমরা’। ম্যাগসায়সায় প্রত্যেক ফিলিপিনো সৈনিকের জন্য দুটি কর্তব্য নির্দিষ্ট করে দিলেন। জনসাধারণের কাছে সরকারের তরফে শুভেচ্ছার বার্তাবাহক’ হতে হবে এবং একই সাথে হুকদের নির্মমভাবে হত্যা করতে হবে।
১৯৫১ সালেই ম্যাগসায়সায়ের দায়িত্বে ১৩৬৩ জন হুক বিপ্লবীকে হত্যা করা হল। বেশ কয়েক হাজার বিপ্লবীকে হয় কারারুদ্ধ করা হয় কিংবা বিনা বিচারে, কোনো তথ্যপ্রমাণ না রেখেই সরাসরি খুন করা হয়। পরবর্তী বছরগুলিতে এর চেয়ে এওনেক বেশি হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করা হয়েছিল। তথ্য গোপন রাখা এবং নথি নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে নির্দিষ্ট সংখ্যা জানা সম্ভব হচ্ছে না।
পশ্চিমী সংবাদ মাধ্যম স্বাভাবিকভাবেই ‘হুক উপদ্রব’ নির্মূল করার জন্য ম্যাগসায়সায়ের পক্ষে প্রশস্তির বান বইয়ে দেয়। ১৯৫১ সালের এপ্রিল মাসে টাইমস পত্রিকা খবর ছাপে ম্যাগসায়সায়ের বাহিনী ৪০০ জন হুককে গ্রেপ্তার করেছে। এরা সকলেই ফিলিপিন্সের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর ৬ জন সদস্যকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছিলেন। এই ৪০ জনকেই বন্দী করা হয়। ৬ জন পলিটব্যুরোর সদস্যকে ম্যানিলা উপসাগরে একটি জাহাজে বন্দী করে রাখা হল যাতে কোনো উদ্ধারকারী দল তাদের কাছে পৌঁছতে না পারে। জাহাজে বন্দী থাকাকালীন তাঁরা মনের সুখে মাছ ধরতে পারেন বলে ঠাট্টা করা হয়। খবরে প্রকাশিত ১৯৫১’র এপ্রিল মাসে ম্যানিলা শহর এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোয় আরো বেশি করে সেনা মোতায়েন করতে ফিলিপিনো বাহিনীকে আদেশ দিয়েছিলেন ম্যাগসায়সায়। প্রত্যেক ‘সন্দেহভাজন’ ব্যাক্তি এবং তাদের ঘরবাড়ি খানাতল্লাশ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। হুকেদের প্রতিটি আস্তানা ধ্বংস করে ক্যান্ডাবা অঞ্চলের জলাজমিতে তাদের যাবতীয় গৃহস্থালীকেই আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ ছিল। দেশে তখনো ৮০০০ হুক বিপ্লবীরা বেঁচে আছেন, অঙ্কের হিসাবে ফিলিপিনো বাহিনীর প্রতিটি প্ল্যাটুন পিছু ৫ জন করে হুক। সেই গোটা সপ্তাহটিকে হুকেদের “লিকুইডেশন উইক” অর্থাৎ নির্মূলকরণের সময় হিসাবে ধার্য করেন তিনি।
১৯৫৪ সালের পরে ল্যান্সডেলকে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে একটি বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়। কার্যত ম্যাগসায়সায়ের মন্ত্রণাদাতা এবং প্রচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন ল্যান্সডেল। মার্কিন দূতাবাসের কাউন্সিলর উইলিয়াম ল্যাসি প্রতিদিন ম্যাগসায়সায়কে পরামর্শ দিতেন। আমেরিকার প্রখ্যাত বামপন্থী সাহিত্যিক উইলিয়াম পমেরয় ম্যাগসায়সায়’কে বর্ণনা করতে ‘সবচাইতে ভয়ঙ্কর মার্কিনী পুতুল’ বলেছিলেন।
১৯৫৭ সালে বিমান দুর্ঘটনায় ম্যাগসায়সায়ের মৃত্য হয়। কিন্তু ফিলিপিন্সে তার ভূমিকা মার্কিন যুকরাষ্ট্রের এতটাই মনপসন্দ ছিল যে ৬’র দশকের মাঝামাঝি লিন্ডন জনসের নেতৃত্বাধীন সরকার সক্রিয়ভাবে ভিয়েতনামের জন্যেও একটি ‘ভিয়েতনামি ম্যাগসায়সায়’ খুঁজে বার করার ব্যার্থ চেষ্টা চালিয়ে যায়। দক্ষিণ ভিয়েতনামে প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের অনিবার্য পতন রোধ করতেই তারা এমন লোকের সন্ধান করতে শুরু করে।
সুতরাং কে কে শৈলজা আসলে কি করলেন?
এমন পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমেই ১৯৫০’র ফিলিপিন্সে শহীদ হুক বিপ্লবীদের প্রতি উপযুক্ত সম্মান জানিয়েছেন তিনি।
শৈলজার এই সিদ্ধান্তে শিলমোহর দিয়েছে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)।
শৈলজা পুরস্কারটি গ্রহণ করলে মালায়লম সংবাদপত্রগুলো রাতারাতি ফিলিপিন্সে পৌঁছে যেত। পার্টির বিরুদ্ধে কুৎসা করতে শহীদ হুক বিপ্লবী পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাতকার সরাসরি সম্প্রচারিত হত।
পৃথিবীর নানা দেশে সমাজকর্মীদের কাজের স্বীকৃতি হিসাবেই র্যামন ম্যাগসায়সায় পুরস্কার প্রদান করা হয়। বামপন্থী বলে পরিচিত এমন ব্যাক্তিরাও সেই পুরস্কার পেয়েছেন। ব্যাক্তিগতভাবে বামপন্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল এমন কারোর এই পুরস্কার গ্রহণ সম্পর্কে পার্টির কতটুকুই বা বলার থাকে? কিন্তু বামপন্থী পার্টির নেতৃস্থানীয়রা এমনসব পুরস্কারের আমন্ত্রণ অস্বীকার করবেন এমনটাই স্বাভাবিক।
*অধ্যাপক রামাকুমারের লেখা ও অধ্যাপিকা ডঃ চিরশ্রী দাশগুপ্তের ফেসবুক পোস্টকে ভিত্তি করেই প্রতিবেদনটি লিখিত