অরিন্দম মুখোপাধ্যায়
জয়নগর লোকসভা আসনটি তপশিলী জাতির জন্য সংরক্ষিত। এই আসনের অন্তর্ভুক্ত সাতটি বিধানসভা ক্ষেত্র হল জয়নগর, গোসাবা, বাসন্তী, ক্যানিং পূর্ব, ক্যানিং পশ্চিম, মগরাহাট পূর্ব ও কুলতলী। এই লোকসভা আসনের সিংহভাগই নদীনালা বেষ্টিত সুন্দরবন ও উপকূল এলাকা অধুষ্যিত। এখানকার মানুষের সমস্যা মূলত প্রাকৃতিক, ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক কারণকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়।
সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ। সুন্দরবনের মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ। এখানকার জনবসতি এলাকায় কৃষি জমির পরিমাণ ৩ লক্ষ হেক্টর। কিন্তু সেই জমির মাত্র ২০-২৫ শতাংশ সেচসেবিত। বাকি সবটাই বৃষ্টির জলের ওপর নির্ভরশীল। নদীনালা বেষ্টিত হলেও বঙ্গোপসাগরের লবনাক্ত জলে সেচ কার্য সম্ভব নয়। তাই এখানকার মানুষের একান্ত প্রয়োজনীয় দাবি হল বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করে জলাধার নির্মাণ। প্রকৃতির খেয়ালখুশির ওপর নির্ভরশীল কৃষিকাজ মার খায় প্রায় ফি বছর। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের ঘটনা লেগেই আছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে যিনি সাংসদ, তিনি এই সমস্যাটি অনুধাবন করে ক’দিন সংসদে তা নিয়ে আলোচনা করেছেন বা দাবি জানিয়েছেন কারো জানা নেই।
কৃষিকাজের পাশাপাশি সুন্দরবনের মানুষের জীবিকা ধারণের অন্যান্য মাধ্যম হল মাছ চাষ, জঙ্গলের কাঠ ও মধু আহরণ। কিন্তু এই পেশাতেও নতুন প্রজন্মের আগ্রহ কম। প্রথমত বিশ্ব উষ্ণায়ন ও ব্যাপক হারে অরণ্য নিধনে জীব বৈচিত্র্যর পরিবর্তন ঘটে চলেছে অহরহ। তার ফলস্বরূপ সামুদ্রিক মাছের খাদ্য ও বাস্তুতন্ত্রের সংকট দেখা দিচ্ছে। যার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মৎস্যজীবিদের পেশা। জঙ্গলে মধু ও কাঠ আহরণে নানা বিপদ ও বাধা। তার ওপর নেই আহরিত বস্তুগুলিকে বাজারজাত করার কোনও সর্বজনীন সরকারি উদ্যোগ। রয়েছে দালাল-ফড়েদের চক্র। তাই এইসব ঝামেলা এড়িয়ে কিছু করতে না পেরে প্রাকৃতিক সম্পদশালী বিস্তীর্ণ সুন্দরবন এলাকার গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে যুবকরা ভিন রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এটা এখানকার এক জ্বলন্ত সমস্যা।
অথচ গ্রামের মধ্যেই ম্যানগ্রোভ রক্ষার কাজে, লোনা মাটিতে চাষের উন্নত প্রথা উদ্ভাবন করে, বহুফসলী চাষের সুযোগ বৃদ্ধি করে ওই যুবকদের বিকল্প পথের সন্ধান দেওয়া যেত। এর সঙ্গে রয়েছে অর্থকরি ফসল চাষের সুযোগ সৃষ্টি করা, তরমুজ, লঙ্কা ইত্যাদির চাষ বাড়িয়ে প্রক্রিয়াজাত শিল্প বাড়ানোর প্রচেষ্টা গ্রহণ সহ নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা।
ম্যানগ্রোভ সহ নির্বিচার অরণ্য নিধন সমগ্র সুন্দরবনের অস্তিত্ব সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। গত কয়েক বছরে এই ক্ষতিসাধন হয়ে চলেছে ক্ষমতাসীন তৃণমূল দলের নেতা ও জন প্রতিনিধিদের গোচরে ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। বাসন্তীর ঝড়খালী, গরাণ বোস, ভরতগড়, গোসাবার হ্যামিল্টন আবাদ, রাঙাবেলিয়া সহ নানা জায়গায় ব্যাপক ভাবে ম্যানগ্রোভ ও অন্যান্য বৃক্ষ ছেদন করা হয়েছে। এই ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজে মানুষ ক্ষুব্ধ। কিন্তু কোনও প্রতিকার নেই। ম্যানগ্রোভ ভূমিক্ষয় রোধ করে, জলোচ্ছ্বাস রোধ করে, ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডব থেকে বসতি এলাকাকে রক্ষা করে। ম্যানগ্রোভ রক্ষা ও প্রসারে সরকারি উদ্যোগ দরকার। জয়নগর লোকসভা কেন্দ্রের বামফ্রন্ট মনোনীত আরএসপি প্রার্থী কমরেড সমরেন্দ্রনাথ মণ্ডলের প্রচারে এই ইস্যুগুলি জোরের সঙ্গে উঠে আসছে।
এই লোকসভা ক্ষেত্রের মগরাহাট পূর্ব অংশে দর্জি, জরি, ঝাড়ু শিল্পের ওপর নির্ভরশীল অনেক মানুষ। এদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও এদের তৈরি পণ্যের বিকিকিনিতে সরকারি সাহায্য প্রয়োজন। কে ভাববে এদের কথা? কে ভাববে সুন্দরবনের মানুষের উপরোক্ত সমস্যার কথা? মানুষ বুঝে গেছেন আকণ্ঠ দুর্নীতির পাঁকে ডুবে যাওয়া, বোমা-বন্দুক-মানুষ খুনের রাজনীতির পান্ডা তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার নয়। জুমলাবাজদের দ্বারা পরিচালিত কেন্দ্রের বি জে পি সরকারও নয়। একাজ করতে পারে বামপন্থীরা, যদি তাদের দ্বারা সমর্থিত একটি সরকার দিল্লীতে তৈরি করা যায়।
আর একটি প্রয়োজনীয় কথা। ক্যানিং-এর পর বাসন্তী, গোসাবার দিকে রেলপথ সম্প্রসারিত আজও হল না। দশ-বারো বছর ধরে মানুষ কেবল মাতলা নদীর ওপর রেলসেতুর জন্য তৈরি স্তম্ভই দেখে আসছে। অথচ সুন্দরবনের মানুষের জীবন জীবিকা উজ্জীবনের স্বার্থে এবং সেখানকার অর্থনীতির উন্নতির স্বার্থে রেলপথের প্রয়োজনীয়তা অসীম। মানুষ বুঝতে পারছেন বি জে পি বা তৃণমূল যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একাজে গুরুত্ব দেয় নি। পারলে একাজ বামপন্থীরাই পারবেন, যদি তাদের শক্তি বাড়ানো যায়!
আয়লা, আমফান, রেমাল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সামনে সুন্দরবনবাসী কত অসহায়। তাই কয়েকবছর ধরেই দাবি উঠছে মাটির বাঁধ নয়, কংক্রিটের বাঁধ। সবার মাথার ওপর পাকা ছাদের বাড়ি। এর জন্য প্রয়োজন পরিকল্পিত সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ ও অর্থ বরাদ্দ করা। যে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। এই দাবি সংসদে জোরের সঙ্গে তুলে ধরতে পারে কারা? নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতায় মানুষ বুঝতে পারছেন, বামপন্থীরা ছাড়া কেউ নয়। অতীতে বামফ্রন্ট আমলে ক্যানিং, বাসন্তী, জয়নগর, কুলতলী জুড়ে অসংখ্য সেতু ও সড়ক নির্মাণ করে যোগাযোগ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক উন্নতি সাধন করেছিল বামপন্থীরাই। তাই আজকের প্রেক্ষিতে সমগ্র জয়নগর লোকসভা আসনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের পাহাড়প্রমাণ সমস্যার সমাধান করতে পারবে ওরাই।