samyabad o nari surakkha

চাই সাম্যবাদ, চাই মেয়েদের নিরাপত্তা

মধুজা সেন রায়

আর জি কর- এই শব্দবন্ধ শুনলে গত কয়েক মাস ধরে হাসপাতাল শব্দটি বা ডাক্তার রাধা গোবিন্দ কর এর নাম আর মনে পড়ে না অধিকাংশ মানুষের।মনে পড়ে এক তরুণী চিকিৎসক পড়ুয়ার কথা। কর্মক্ষেত্রে তাঁকে ধর্ষিতা ও খুন হতে হয়েছিল। আজ আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবসে দাঁড়িয়ে আর জি কর এর নৃশংস ঘটনা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বারবার মনে হচ্ছে, আজ থেকে ১১৬ বছর আগে নিউ ইয়র্কের দর্জি শ্রমিকরা যে ধর্মঘট ডেকেছিলেন তার অন্যতম একটা দাবী ছিল কাজের সুস্থ পরিবেশ দিতে হবে।আজ একবিংশ শতকে এসে শুধু আর কাজের জায়গায় সুস্থ পরিবেশ নয়, দাবিটা এখন কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা আর সম্মানজনক কর্মক্ষেত্রের দাবিতে পরিণত হয়েছে। আর জি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় সারা রাজ্য দেশ পৃথিবী তোলপাড় হয়ে যাওয়ার পর এ রাজ্যের সরকার একগুচ্ছ নিয়ম কানুন এনেছে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের সুরক্ষার জন্য। এখানে বলা হয়েছে রাতে কাজ করা মহিলাদের সুরক্ষার জন্য রাত্তিরের সাথে অ্যাপ চালু হবে রাতের শিফটে কাজ করা মহিলাদের নিরাপত্তার জন্য রাত্তিরের সাথী নামক নিরাপত্তা বাহিনী থাকবে।। এই নির্দেশিকায় আরও অনেকগুলি কথার সাথে বলা হয়েছে নিরাপত্তার স্বার্থে মেয়েদের জোড়ায় জোড়ায় অথবা দলবদ্ধভাবে কাজ করার ওপর জোর দিতে হবে। মহিলা চিকিৎসকদের ১২ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না। কর্মক্ষেত্রে সিসিটিভি দ্বারা সুনিশ্চিত সেফ জোন তৈরি করে সেখানেই মহিলাদের কাজ করতে পাঠানো হবে এবং নির্দেশিকার প্রায় একদম শেষে এসে সরকার লিখেছে মেয়েদের যতদূর সম্ভব রাতের শিফটে কাজ করানোর থেকে বিরত থাকতে হবে।

স্বভাবতই সমাজের সর্বস্তরে আলোড়ন তৈরি হয়েছিল এই নির্দেশিকাকে ঘিরে। সুপ্রিম কোর্ট এসব দেখে যারপরনাই বিস্মিত হয়ে বলেছে রাতের শিফটে মেয়েদের কাজ করা আটকানো যাবে না এই নির্দেশিকা প্রত্যাহার করতে হবে।।

আচ্ছা, তারা তৈরি করল এই নির্দেশিকা? একটা গোটা সরকারের জনপ্রতিনিধি থেকে আমলা কেউ কি খোঁজ রাখে না শ্রম আইনের? ১৯৪৮ সালের ‘ফ্যাক্টরি আইনে’ বলা হয়েছিল মেয়েদেরকে সকাল ছটা থেকে সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত কাজ করানো যাবে। এরপরেও কোন রাজ্য সরকার মনে করলে বড়জোর রাত্রি দশটা অবধি তাদেরকে দিয়ে কাজ করাতে পারে।

কিন্তু তারপরে কখনোই নয়। এরপর ১৯৮১ সালে এই ফ্যাক্টারি আইনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংযোজনী সংশোধনী নিয়ে আসা হয়। এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজনী ছিল,সন্ধ্যে সাতটা থেকে সকাল ছটা পর্যন্তও মেয়েরা কাজ করবে।সাথে নির্দিষ্ট করে এও বলে দেওয়া হয়েছিল কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের নিরাপত্তা এবং পর্যাপ্ত সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে হবে এমপ্লয়ারকে। এই নিয়মগুলি না মানলে দু বছরের জেল অথবা এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা দুটোই একসাথে শাস্তি হিসেবে নেমে আসতে পারে।

তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়েছে। ১৯৯৬ সালে রাজস্থানের বনোয়ারি সিং নামক সরকার নিযুক্ত এক কমিউনিটি ওয়ার্কার কাজ করার সময় ধর্ষিতা হলে নির্যাতিতার পক্ষে মামলা লড়ে মহিলাদের জন্য পরিচালিত কতকগুলি এনজিও ও বিভিন্ন সংস্থা। পরবর্তীকালে রাজস্থান হাইকোর্টে এই মামলায় নির্যাতিতা হেরে গেলে বিশাখা নামের একটি প্লাটফর্ম তৈরি করে তারা সুপ্রিম কোর্টে মামলাটিকে নিয়ে যায়। সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উঠে আসে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি সংক্রান্ত আইনি দুর্বলতার দিকগুলি। তৈরি হয় বিশাখা গাইডলাইন। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের ২৩ শে এপ্রিল প্রণীত হয় একটি আইন। the sexual harassment of worker at workplace (prevention ,prohibition and redressal )act, 2013। এই আইনের হাত ধরেই তৈরি হয় I CC বা internal complaint committee.

দেশের আইনের কোনো খোঁজ না রেখে এরকম একটি অদ্ভুত নির্দেশিকা জারি বোধহয় এ রাজ্যেই সম্ভব। খুব স্বাভাবিকভাবেই অনেকগুলি প্রশ্ন উঠে আসছে জোড়ায় জোড়ায় বা দলবদ্ধ ভাবে কাজ করলেই কি মেয়েরা নিরাপদ থাকতে পারে আদৌ আক্রমণকারীরা যদি দলবদ্ধ হয় বা ক্ষমতাধারী হয়... তখন? না এ প্রশ্নের উত্তর নেই। শুধু সিসিটিভি নিয়ন্ত্রিত জায়গায় কাজের অধিকার থাকবে মেয়েদের যেখানে সিসিটিভি থাকবেনা সেখানে safe zone নয় বলে মেয়েরা কাজ করতে পারবে না? আসলে তো এইভাবে মেয়েদের সামনে কাজের সুযোগ ক্রমশ কমে আসবে। সমানাধিকারের প্রশ্ন তো আছেই। কিন্তু যেখানে রাস্তার সরকারি আলো দিনের পর দিন খারাপ হয়ে পড়ে থাকে সেখানে সিসিটিভি খারাপ থাকবেনা এই গ্যারান্টি কি করে পাওয়া সম্ভব?আসলে শুধু সিসিটিভি দিয়ে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা সম্ভব না।

ঠিক যেমন শুধুমাত্র কন্যাশ্রী, রুপশ্রী প্রকল্পের মাধ্যমে নাবালিকা বিবাহের হার কম করা যায়না। অপরিনত বয়সের মাতৃত্বের হার ক্রমশ বেড়েই চলে!এর জন্য প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা।প্রয়োজন রাজনৈতিক - প্রশাসনিক উদ্যোগ। মেয়েদের অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতেই চাই বিশেষ উদ্যোগ।

২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে। আমাদের দেশের মোট ২৫.৫১ শতাংশ মহিলা কর্মরত। আবার কর্মরত মহিলাদের মধ্যে একটা বড় অংশই কৃষিক্ষেত্রে যুক্ত। এর মধ্যেও আবার বেশিরভাগ মহিলাই ক্ষেতমজুর হিসাবে কাজ করেন। বাকি যে মহিলারা অন্যান্য কাজের সাথে যুক্ত, সেই মহিলাদের অধিকাংশই কাজ করেন চুক্তিভিত্তিক কর্মী, প্রকল্প কর্মী,আয়া বা গৃহ সহায়িকা হিসাবে অথবা নিম্মপদস্থ কর্মী হিসাবে। উচ্চপদ গুলিতে মেয়েদের অংশগ্রহণ তুলনামুলক ভাবে এখনও অনেকটাই কম। অধিকাংশ কর্মরত মহিলা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করায় এনাদের চাকরি, মজুরি এমনকি মাতৃত্বকালীন ছুটি ও নিশ্চিত নয়। আইটি, অটোমোবাইল সহ একাধিক কাজের ক্ষেত্রে গর্ভবতী মহিলারা মাতৃত্বকালীন ছুটির পর ফিরে এলে হয় কাজ ফিরে পাননা অথবা প্রজেক্ট পাননা।বহু জায়গায় বিবাহিত মহিলাদেরকে কাজে নিয়োগ ই করা হয়না। আবার এই দেশেই, সংখ্যায় কম হলেও কিছু কোম্পানি আছে যেখানে মেন্সট্রুয়াল লিভ ও ক্রেশের ব্যবস্থা রয়েছে। ভারতে মেনস্ট্রুয়াল লিভ এর ধারণা ও দাবী সে অর্থে বহুল প্রচারিত নয়। কর্মক্ষেত্রে এবং সাধারণ পাবলিক টয়লেটে স্যানিটারি ন্যাপকিন এর ভেন্ডিং মেশিন শুধুমাত্র কর্মরত মহিলাদের জন্য না, সামগ্রিক ভাবেই এটা মহিলাদের স্বাস্থ্যের অধিকার। কিন্তু এই বিষয়ে সামাজিক সচেতনতার অভাব যেমন আছে, তেমনই প্রশাসনিক উদ্যোগের ও অভাব আছে। নতুন শ্রমকোডে এই বিষয়গুলি তো নেই ই। উপরন্তু, সম কাজে সম মজুরীর যে আইন ছিল, নতুন কোডে তার ও উল্লেখ নেই। বিড়ি থেকে জরি শিল্প, নির্মাণ থেকে রূপালী দুনিয়া সর্বত্রই মহিলাদের কম মজুরী পাওয়ার একাধিক ঘটনা রয়েছে। শ্রমকোড লাগু হলে ছোট কারখানার যে শ্রমিকেরা শ্রমিকের মর্যাদা হারাবেন, হারাবেন ইউনিয়ন করার অধিকার তাঁদের একটা বড় অংশই তো মহিলা।

ভারতের আধা সামন্ততান্ত্রিক - আধা পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পিতৃতন্ত্রের দাপট সমাজের বিভিন্ন স্তর বিভিন্ন রূপে বর্তমান। এর একটি বড় উদাহরণ হলো মজুরিবিহীন শ্রমে মেয়েদের অংশগ্রহণ এর হার। SBI এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী জিডিপি তে শুধুমাত্র মহিলাদের মজুরী বিহীন কাজের অবদান ৭.৫%। টাকার বিচারে অঙ্কটা প্রায় ২২ লাখ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী মহিলাদের সর্বমোট ৩৬.৭ শতাংশ মহিলা মজুরীবিহীন কাজের সাথে যুক্ত। ২০১৯ সালে কোভিডের আগে সারা পৃথিবীর মহিলারা পুরুষদের তুলনায় care work এ ৩ গুণ বেশি যুক্ত থাকলেও ভারতে এই হার ছিল ৮ গুণ বেশি। কোভিডের সময় পুরুষের তুলনায় মহিলাদের কাজ হারানোর হার বেশি হওয়ায় এই care work এ মহিলাদের অংশগ্রহণ আরও বেড়েছে। আবার ভারতবর্ষের মধ্যেও এই অনুপাত রাজ্য গুলিতে একই রকম নয়। হরিয়ানা, পাঞ্জাব, গুজরাট, রাজস্থানের মতন রাজ্য গুলিতে মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের মজুরি বিহীন care work এ সময় দেওয়ার হার অনেক কম হলেও পূর্ব ভারতের রাজ্য গুলি যেমন আসাম, অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড এর মতন রাজ্য গুলি এবং গোয়ার ক্ষেত্রে চিত্রটা কিন্তু উল্টো। পুরুষ ও মহিলাদের ক্ষেত্রে অনুপাত টা প্রায় সমান সমান ।কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষরা ঘরের কাজে বেশি সময় ব্যয় করেন। এই তথ্যটি কে যদি মহিলাদের পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে বিচার করা যায়, তাহলে দেখা যাবে সামাজিক, পারিবারিক ভাবে মেয়েরা যেখানে যত বেশি অবদমিত, সেখানে মহিলাদের এই মজুরিবিহীন কাজেও অংশগ্রহণ তত বেশি।আবার উত্তর পূর্ব ভারতের উল্লেখিত রাজ্য গুলির বিস্তৃত অংশ জুড়ে আদিবাসী মানুষের বাস।এখানে এই আদিবাসী সমাজ এখনও অনেকাংশে মাতৃতান্ত্রিক। তাই, মেয়েদের অধিকারের বিষয়টি শুধুমাত্র মেয়েদের বিষয় নয়। এটি সামগ্রিক ভাবে আর্থ সামাজিক অবস্থার সাথে সম্পর্কযুক্ত। এই সমাজে যেদিন থেকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা এলো, আদিম সাম্যবাদী সমাজের পতন হলো, সেদিন থেকেই মেয়েদের পেছনের দিকে হাঁটা শুরু হলো।

তাই, এই শ্রেণী বিভক্ত পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা বদলাতে না পারলে বদলাবে না মেয়েদের অবস্থাও।আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস মানে এক দিনের উদযাপন নয়, এটা সারা বছরের লড়াই, দীর্ঘমেয়াদি লড়াই।এই লড়াই শুধু মেয়েদের লড়াই নয়, সবার লড়াই। এই বোধ সমাজে এবং সংগঠনে সঞ্চারিত না হলে লড়াইও দীর্ঘ মেয়াদী হবেনা। মর্যাদাপূর্ণ জীবন আমাদের অধিকার।এই অধিকার দীর্ঘ সংগ্রামের রাস্তায় আমাদেরকে লড়েই নিতে হবে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন