প্রভাত পট্টনায়েক
নেহরু-মহলানবিশ অর্থনৈতিক কৌশল মূলত এক সার্বিক নিয়ন্ত্রণবাদী (dirigiste) পরিকল্পনার ভিত্তিতে এগোনোর ভিত্তি ছিল। ঐ নীতি এখন তীব্র অপপ্রচারের শিকার। শুধু মোদী-গোষ্ঠীই নয়, কংগ্রেস ও অন্যান্য জায়গাতে নিওলিবারেল শক্তিগুলোও এতে সামিল। নিওলিবারেলিজম যত সংকটে নিমজ্জিত হচ্ছে এবং এর প্রতি মানুষের মোহভঙ্গ ততই বাড়ছে, এর সমর্থকরা ততই চিৎকার করে বলছে - নিয়ন্ত্রণবাদী শাসনের বিপরীতে নিওলিবারেল পরিবর্তন কত মহান! স্বভাবতই, নেহরু-মহলানবিস কৌশলকে হেয়প্রতিপন্ন করার এই প্রচেষ্টা বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থকেও সিদ্ধ করে।

আসলে, নয়া-উদারবাদী সমালোচনা উপস্থাপিত হওয়ার অনেক আগে থেকেই বামপন্থীরা নেহরুপন্থী কৌশলের সমালোচনা করেছে, কিন্তু তা এগিয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন যুক্তির নিরিখে। নেহরু’র পন্থার প্রতি বাম ও নয়া-উদারবাদী সমালোচনার পার্থক্য বোঝা জরুরি। বামপন্থীরা নেহরুর নীতিকে সমর্থন করেছিল নিম্নলিখিত কারণে:
- উপনিবেশিক আন্তর্জাতিক শ্রমবিভাজনের ধারা ভাঙার চেষ্টা
- দেশে মুলধনী পণ্য (মার্কসের ‘বিভাগ I’[1] তৈরির সক্ষমতা গড়ে তোলা)
- প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতা অর্জন
- রাষ্ট্রীয় খাতকে উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার
- সব খনিজ সম্পদ জাতীয়করণ
- বড় ব্যাংক ও বীমা কোম্পানিগুলোর জাতীয়করণ
- বিদেশি পুঁজিকে তার উপনিবেশিক সুবিধাজনক অবস্থান থেকে উৎখাত
নয়া-উদারবাদী (নিও-লিবারেল) বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গী যেসকল নীতির বিরোধিতা করে, বামপন্থীরা সেগুলিকে সমর্থন করেছিল।
কিন্তু বামপন্থীদের সমালোচনার মূল লক্ষ্য ছিল অন্যত্র। নেহরুপন্থী আর্থিক কৌশল অভ্যন্তরীণ বাজারভিত্তিক বৃদ্ধির উপর নির্ভরশীল ছিল। ভারতের মতো দেশে অভ্যন্তরীণ বাজার বাড়ানোর মূল চাবিকাঠি কৃষির উন্নতি। তাই কৃষিতে দ্রুত বৃদ্ধি আনতে কৃষি জমির সংস্কার সাধন ছিল অপরিহার্য। এ বিষয়ে বামপন্থীদের সমালোচনা ছিল - নেহরুর কৌশল জমির মালিকানার কেন্দ্রীভবন ভাঙেনি, এমনকি প্রকৃত চাষিদের জমির অধিকারও দেয়নি। এর প্রভাবে ঐ নিয়ন্ত্রণবাদী যুগের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এতটাই সীমাবদ্ধ ছিল যে, উপনিবেশিক উত্তরাধিকার হিসেবে থাকা বিপুল বেকারত্ব ও দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব হয়নি।
এ ব্যর্থতার ফলেই নয়া-উদারবাদের বিরুদ্ধে শ্রেণীসংগ্রামের মাত্রা দুর্বল ছিল। নয়া-উদারবাদীনীতি প্রচলিত হতে তেমন বাধা পায়নি। অথচ প্রকৃত চাষিদের অধিকারের স্বীকৃতিই যে কত বড় পরিবর্তন আনতে পারে তার প্রমাণ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। ‘অপারেশন বর্গা’-র পর নব্বইয়ের দশকে এই রাজ্য দেশের মধ্যে কৃষিখাতে সর্বোচ্চ বৃদ্ধি অর্জন করেছিল। নেহরুপন্থা এ দিক থেকে ব্যর্থ হয়।
কিন্তু নয়া-উদারবাদের তরফে যে সমালোচনা আসে তার বুনিয়াদ একেবারেই ভিন্ন, তাআসলে বুদ্ধিবৃত্তিকে ব্যবহার করে এক ফাঁকিবাজির উপর নির্ভর করে। তারা ‘অভ্যন্তরমুখী’ ও ‘বহির্মুখী’ উন্নয়ন কৌশলের তুলনা করে বলেছে - পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মতো "বহির্মুখী" কৌশল ভারতের জন্য বেশি কার্যকর হতো। তাদের মতে, ‘বহির্মুখী’ কৌশল অর্থ হলো -
- পণ্য, সেবা ও পুঁজির (অর্থসহ) অবাধ প্রবাহ
- সরকারের ‘রাজস্ব শৃঙ্খলা’ (অতি ক্ষুদ্র ঘাটতি)
- মজুরি ও শ্রমিক ধর্মঘট কমানোর মাধ্যমে ‘বিনিয়োগবান্ধব’ পরিবেশ
এই যুক্তি তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক - দুই দিক থেকেই ভুল। পরবর্তী গবেষণায় দেখা গেছে, পূর্ব এশিয়ার উন্নয়ন নয়াউদারবাদীমডেলের অনুকরণে হয়নি। সেখানে পণ্য, সেবা বা পুঁজির অবাধ প্রবাহ ছিল না, সরকারও হাত-গুটিয়ে বসে থাকেনি। তাত্ত্বিকভাবে, ‘বহির্মুখী’ কৌশলের পক্ষে যুক্তি দেখানো হয় এইভাবে ধরে নেয়া হলো - প্রতিটি দেশ ‘ক্ষুদ্র দেশ’, যা ইচ্ছা মতো রপ্তানি করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে, বিশ্বব্যাপী চাহিদা সীমিত। এক দেশ বেশি রপ্তানি করলে অন্য দেশ কম করবে। তাই, সব দেশই পূর্ব এশিয়ার মতো সফল হতে পারবে না – এইসহজসাধারণ সত্যটি নিওলিবারেলরা ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যায়।
নয়া-উদারবাদ (নিও-লিবারেলিজম) আসলে বিশ্ব দক্ষিণের দেশগুলোর মধ্যে এক হতাশাজনক প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করেছে - কে কার চেয়ে কম মজুরি দেবে, বেশি শ্রম নিষ্পেষণ করবে। একইসাথে, কৃষক ও ক্ষুদ্র উৎপাদকদের জন্য রাষ্ট্রীয় সহায়তা কমিয়ে তাদের চরম দুর্দশায় ফেলা হয়েছে। নিওলিবারেল পুঁজিবাদের সংকট বিশ্বব্যাপী চাহিদা আরও সংকুচিত করে এই সমস্যাকে তীব্র করেছে।
নয়া-উদারবাদীরা জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতি বাড়াকে তাদের সাফল্যের প্রমাণ হিসেবে দেখায়। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির হিসেবই সন্দেহযুক্ত। ভারত সরকারের এক প্রাক্তন মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টাও স্বীকার করেছেন - দাপ্তরিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ভয়ানকরকমভাবে অতিমূল্যায়িত। তাছাড়া, অন্যের জিডিপি দিয়ে কারো পেট ভরবে না। তাই, নিয়ন্ত্রণবাদী ও নিওলিবারেল যুগের তুলনা করতে হলে শ্রমজীবী মানুষের প্রকৃত অবস্থা দেখতে হবে।
নয়া-উদারবাদের যুগে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য যে হারে বেড়েছেতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। টমাস পিকেটি ও অন্যান্যদের পরিচালিত ‘ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ডাটাবেস’ অনুযায়ী, স্বাধীনতার সময় দেশের শীর্ষ ১% মানুষের জাতীয় আয়ে অংশ ছিল ১২%, যা ১৯৮২ সালে নেমে ৬%-এ দাঁড়ায়। কিন্তু নয়া-উদারবাদের যুগে তা বেড়ে ২০২৩ সালে ২৩% হয়েছে। এমন বৃদ্ধি গত শতাব্দীর মধ্যে সর্বোচ্চ। অর্থাৎ আয়ের নিরিখে এখনকার বৈষম্য ঔপনিবেশিক যুগের চাইতেও বেশি।
এর চেয়েও ভয়াবহ হল শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রার অবনতি। নয়া-উদারবাদের যুগে কৃষক আত্মহত্যার বিপুল সংখ্যাই এর প্রমাণ। কিন্তু আরও এক সুনির্দিষ্ট সূচকের দিকে নজর দেওয়া যাক। গ্রামীণ ভারতের দৈনিক গড় ক্যালোরি গ্রহণের চিত্রের দিকে তাকালে কী পাওয়া যায়? পরিকল্পনা কমিশন গ্রামীন এলাকায় মাথাপিছু দারিদ্র্যের সীমা নির্ধারণ করেছিল দিন প্রতি ২২০০ ক্যালোরি। ১৯৭৩-৭৪ সালে (এনএসএস তথ্য অনুযায়ী প্রথম দারিদ্র্য অনুমান) ঐ সীমার নিচে ছিল ৫৬.৪% গ্রামবাসী। ১৯৯৩-৯৪ সালে (নিওলিবারেল নীতি চালুর দুই বছর পর) এই হার ছিল ৫৮.৫%। কিন্তু ২০১১-১২ সালে তা বেড়ে ৬৭% এবং ২০১৭-১৮ সালে ৮০%-এ পৌঁছায়। তখন মোদী সরকার এনএসএস তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি বদলে ফেলে, যাতে আগের তথ্যের সাথে তুলনা করা না যায়।
অর্থাৎ নেহরুপন্থী আর্থিক কৌশলের সময় গ্রামীণ দারিদ্র্যের হার বাড়েনি।বরঞ্চ স্বাধীনতার সময়ের করুণ অবস্থার তুলনায় কিছুটা উন্নতি হয়েছিল (যদিও সঠিক তথ্য নেই)। ১৯৭৩-৭৪ থেকে ১৯৯৩-৯৪ পর্যন্ত দারিদ্র্যের হার প্রায় একই ছিল - যা নেহরুবাদী কৌশলের বাম সমালোচনার সত্যতা প্রমাণ করে। কিন্তু নিওলিবারেল যুগে দারিদ্র্য ব্যাপক হারে বেড়েছে। জমি সংস্কার না করতে পারার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, নেহরুবাদী কৌশল শ্রমজীবী মানুষের জন্য নিওলিবারেল কৌশলের চেয়ে উত্তম ছিল।
নয়া-উদারবাদের কৌশল মূলত উপনিবেশিক অর্থনৈতিক নীতিরই পুনরুজ্জীবন। তখনও পণ্য, সেবা ও পুঁজির অবাধ প্রবাহ ছিল (শুধু যুদ্ধকালীন ‘বাছাইকৃত সুরক্ষা’ কিছুটা বাধা দিত)। এখনও এই নীতি ভারতের সীমিত জমিকে (যেখানে উৎপাদন বাড়ানোর রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ নিওলিবারেলিজমে অসম্ভব) বিদেশি পুঁজির দখলে ছেড়ে দিচ্ছে - স্থানীয় জনগণের খাদ্যাভাবকে অবজ্ঞা করে। এই পুষ্টিহীনতা নিওলিবারেল কৌশলের অনিবার্য ফল, যা ব্রেটন-উডস প্রতিষ্ঠান ও উন্নত দেশগুলিরদ্বারা সমর্থিত এক সাম্রাজ্যবাদী কৌশলমাত্র।
ভবিষ্যতে আমাদের এমনও শুনতে হতে পারে যে, ‘দেশ থেকে দারিদ্র্য লোপ পেয়েছে, তাই খাদ্যশস্য সংগ্রহ ও সরকারি বণ্টন ব্যবস্থা বাতিল করা হোক’। ভারতের কৃষিজমিকে বিদেশি চাহিদার জন্য পুরোপুরি উন্মুক্ত করার দাবি জোরালো হবে। নেহরুপন্থী অর্থনৈতিক কৌশলের উপর বর্তমান আক্রমণ তারই প্রস্তুতিমাত্র।
৬ জুলাই, ২০২৫ পিপলস ডেমোক্রেসী পত্রিকায় প্রকাশিত
ভাষান্তর: অঞ্জন মুখোপাধ্যায়, সৌভিক ঘোষ
লেখার সঙ্গে যুক্ত ছবিগুলি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহারে নির্মিত
[1] ‘বিভাগ I’ বলতে অর্থনীতির সেই ক্ষেত্রকে বোঝায় যা উৎপাদনের উপকরণ তৈরি করে, যা মূলধনী পণ্য নামেও পরিচিত। এগুলি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত পণ্য, যেমন যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম, কাঁচামাল এবং কারখানা। এর বিপরীতে বিভাগ II হচ্ছে অর্থনীতির সেই ক্ষেত্র, যা ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।