জয় আবুল বাসারের বুথে - কী ঘটেছে ডায়মন্ডহারবারে

চন্দন দাস

মোট ভোট পড়েছে ৭০৪। একটি ভোটও বাতিল হয়নি। সিপিআই(এম) শূন্য। বিজেপি পেয়েছে ১টি ভোট। দুই নির্দল ১টি করে ভোট পেয়েছেন। তৃণমূল ক’টি পেল? ৭০১টি।এটি ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রের ফলতা বিধানসভার ১৭ নং বুথের ভোটদানের ছবি।

৭ নং বুথ কী দেখাচ্ছে? মোট ভোট পড়েছে ৬০৩টি। সিপিআই(এম) প্রার্থী? একটিও ভোট পাননি। কিন্তু তিন নির্দল প্রার্থী ১০টি ভোট ভাগ করে নিয়েছে। আর বিজেপি? ২৬টি। দখলের বুথে কে দিয়ে গেল পদ্মে ভোট? নির্দলে ভোট দিয়ে সিপিআই(এম)-কে শূণ্য রাখার এই পাটিগণিত ডায়মন্ডহারাবার লোকসভার অনেক বুথে দেখা যাচ্ছে।

অভিষেকই বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি কী ভাবে জিতেছেন। কার প্রতি ‘দায়িত্ব’পালন করেছেন। কয়লা পাচারের মতো ভোট হয়েছে ডায়মন্ডহারবারে। ৭টি বিধানসভার বুথগুলির ফলাফল দেখলে এই সত্য গোরুর দুধের মতোই খাঁটি বোঝা যাবে। তবে বুথ ভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেদার ভোট লুট ছাড়াও অভিষেক ব্যানার্জির আর একটি কৌশলের ইঙ্গিত আছে। লুট করা বুথেও তৃণমূল কর্মীরা কয়েকটি ভোট বিজেপি-কে দিয়ে রেখেছে। কিন্তু যতদূর সম্ভব চেষ্টা করেছে সিপিআই(এম)’র ভোট কম রাখতে। তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপি’র একাংশের বোঝাপড়ার কথা বৃহস্পতিবারই স্পষ্ট করেছেন বিজেপি’র বিষ্ণুপুরের সাংসদ সৌমিত্র খাঁ। দলের মধ্যেই তৃণমূলের আড়কাঠি থাকার কথা বলেছেন বর্ধমান-দুর্গাপুরে হেরে যাওয়া, শুভেন্দু অধিকারীর বিরোধী দিলীপ ঘোষ।

মোদী, অমিত শাহ কেন ডায়মন্ডহারবার কেন্দ্রে প্রচারে আসেননি, কেন ‘ভাইপো’ নিয়ে মোদী, অমিত শাহ’র মতোই শুভেন্দুও কোনও কথা বলেননি, তা রাজনৈতিক রহস্য। সিপিআই(এম) লাগাতার অভিষেক ব্যানার্জির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে প্রচার করেছে। বিজেপি’র সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপোর বোঝাপড়া নিয়ে ধারাবাহিক প্রচার করেছে বামফ্রন্ট। নির্বাচনী ফলাফলের বিধানসভা ভিত্তিক, বুথ ভিত্তিক ফলাফলের তালিকা এই সবের প্রতিফলন। ডায়মন্ডহারবারে অভিষেকের বাহিনী সিপিআই(এম)’র প্রতি সবচেয়ে আক্রমণাত্মক ছিল। বুথ ভিত্তিক ফলাফলেও সেই ছবি স্পষ্ট।

ফলতার একের পর এক বুথে অভিষেক ব্যানার্জির এই ভোট ডাকাতির উদাহরণ। ফলতার ২৬০টি বুথের ২০টিতে সিপিআই(এম)-কে একটি ভোটও পেতে দেওয়া হয়নি। ১৫১টি বুথে সিপিআই(এম) ভোট পেয়েছে ১০-র কম। ফলতায় অভিষেক ব্যানার্জির ভোট-ম্যানেজার শেখ জাহাঙ্গির। ফলতার সব বুথ দখল হয়েছে। তবু বিজেপি’র ভোট যাতে সিপিআই(এম)’র পাওয়া ভোট থেকে বেশি হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখেছে তৃণমূল।

অভিষেক ব্যানার্জির বুথ দখলের প্রমাণ ফলতা ছাড়া বাকি এলাকাতেও আছে। ডায়মন্ডহারবারেও এক ছবি। উদাহরণ বুথ ২৮। সিপিআই(এম) পেয়েছে ২টি ভোট। বিজেপি’র জুটেছে ৩৮টি ভোট। এক নির্দলকে ৮টি ভোট দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তৃণমূল পেয়েছে ৩৬৭টি ভোট। এমন অঙ্কের বিবরণ আরও অনেক বুথে আছে।

এরই মাঝে কিছু জায়গায় সিপিআই(এম) কর্মীরা কয়েকটি ভোট সাতসকালে দিয়ে দিতে পেরেছিলেন। বেলা বাড়ার পরে বুথ জুড়ে শুধু ‘জয় বাংলা’বাহিনীর জমিদারী ছিল। তারও উদাহরণ আছে। ডায়মন্ডহারবারেরই আর একটি বুথ ৬৬ নং। সেখানে সিপিআই(এম) পেয়েছে ১০টি ভোট। বিজেপি পেয়েছে ৩টি ভোট। আর তৃণমূল পেয়েছে ১১৮০ ভোটের মধ্যে ১১৫৬।

সাতগাছিয়ারও অনেক বুথে স্পষ্ট বুথ দখলের ছবি। যেমন সেখানকার ১৪৮ নং বুথ। সিপিআই(এম) পেয়েছে ৮টি ভোট। বিজেপি পেয়েছে ২টি ভোট। আর তৃণমূল পেয়েছে ৫০৯টি ভোট। সাতগাছিয়ার ১৪০নং বুথে সিপিআই(এম) পেয়েছে ৯টি ভোট। বিজেপি পেয়েছে ৮টি ভোট। আর তৃণমূল পেয়েছে ৪৮৬টি ভোট।

বজবজ বিধানসভা এলাকার ৫নং বুথে সিপিআই(এম) পেয়েছে ৩টি ভোট। বিজেপি পেয়েছে ১৫টি ভোট। আর তৃণমূল পেয়েছে ৮৮৬টি ভোট। বজবজেরই ১১৩ নং বুথে মোট ভোট পড়েছে ৭১৫। তৃণমূল পেয়েছে ৭১৩, বিজেপি ২, সিপিআই(এম) একটিও ভোট পায়নি। ১১৪নং বুথে ৯১৪টি ভোটের মধ্যে ৮৯৮টি ভোট তৃণমূল পেয়েছে। সিপিআই(এম) একটি ভোটও পায়নি। বিজেপি পেয়েছে ৮টি ভোট। এই বিধানসভা এলাকারই ১২১নং বুথে মোট ভোট পড়েছিল ৬৫৫টি, সিপিআই(এম) পেয়েছে ৩টি ভোট, আর তৃণমূল পেয়েছে ৬৪৫টি ভোট। ১২৭নং বুথে মোট ভোট পড়েছিল ১১০১, তৃণমূল পেয়েছে ১০৯৫ ভোট। সিপিআই(এম) পেয়েছে ১টি ভোট, আর বিজেপি ৪টি ভোট। ২৩৬ নং বুথে ভোট পড়েছিল ৪২৯টি। বিজেপি পেয়েছিল ৮টি ভোট। সিপিআই(এম) কোনও ভোট পায়নি। তৃণমূল ৪২১টি ভোট পেয়েছে।

তবু এই ভোট লুটের আঙিনায় অভিষেককে রুখে দিয়েছে শম্পা মির্জানগরের আবাসন। আরও নির্দিষ্ট করে বললে মহেশতলা এলাকার ৩৮নং বুথ। ১৯৭৭ পরবর্তী কোনও নির্বাচনে এই বুথে সিপিআই(এম) হারেনি। এবারও অন্যথা হয়নি। তৃণমূলের বাইক বাহিনী হুমকি দিয়েছে। ফলাফল ঘোষণার পরেও পার্টিকর্মীদের বাবা, মা, সন্তান, স্ত্রীদের নাম করে তৃণমূলসুলভ অশ্লীল গালিগালাজ দিচ্ছে, হুমকি দিচ্ছে। আজও। কারণ? এই বুথে অভিষেক ব্যানার্জি হেরে গেছেন। বিজেপি তৃতীয়। প্রথম সিপিআই(এম)। পার্টি পেয়েছে ১৩৬টি ভোট। তৃণমূল ১২৯টি এবং বিজেপি পেয়েছে ১০৬টি ভোট। পার্টিনেতা প্রিয়ব্রত মুখার্জির কথায়, ‘‘হেরেছে বলে আমাদের আবাসনে ঢুকে পার্টিকর্মীদের বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে অশ্রাব্য কথা বলছে। কিন্তু কমরেড আবুল বাসারের এলাকা এটি। লাল ঝান্ডা এখানে কখনও হারেনি। আমরা বুথ রক্ষার চেষ্টা চালিয়েছি সর্বোতভাবে।’’

কোনও সন্দেহ নেই, ডায়মন্ডহারবারের সব এলাকা মহেশতলার ৩৮নং বুথ এলাকা হতে পারে না। বেশিরভাগ বুথে সিপিআই(এম)’র এজেন্টদের ঢুকতে দেয়নি অভিষেকের বাহিনী। ভোট গণনার সময়ও অত্যাচার হয়েছে। তবে জয় এসেছে দেশের পঞ্চম বৃহৎ ব্যবধানে, সাড়ে সাত লক্ষের বেশি ভোটে। কিন্তু এত আয়োজন কেন? তার উত্তরও ভোটের পরিসংখ্যানে আছে। অবাধ ভোট করতে দিলে, বিজেপি’র সঙ্গে বোঝাপড়া না থাকলে অভিষেক, অর্থাৎ তৃণমূল এখানে হেরে যেতে পারে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন