আনলক-১ ভারতের শহরে কর্মসংস্থানের হালহকিকত

চার দফার লকডাউন পেরিয়ে আমরা এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ভাষায় আনলক-১ পর্যায়ে আছি। কিন্তু বাস্তবে করোনা সঙ্কট আরো জাঁকিয়ে বসেছে দেশ জুড়ে। ভারতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ছুঁতে সময় লেগেছিল ১০৯ দিন, সেখানে ১লাখ থেকে দু লাখ ছুঁল মাত্র সাড়ে ১৪ দিনে।অমানবিক কেন্দ্রের সরকারের খামখেয়ালিপনার খেসারত দিতে হচ্ছে ১৩০ কোটি ভারতীয়কে।

একদিকে করোনা অন্যদিকে ভয়াবহ আর্থিক সঙ্কটের জোড়া আক্রমণে মানুষ আজ দিশাহীন।দেশের সরকারের কাছে করোনা সংক্রান্ত তথ্য আছে, 'আরোগ্য সেতু' এ্যাপ আছে কিন্তু লকডাউনের ফলে কর্মহীনতার চিত্র নিয়ে কোন পরিসংখ্যানই নেই তাদের কাছে। গত পয়লা জুন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার এক সদস্য স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে সরকারের কাছে লকডাউনের ফলে কর্মচ্যুতির কোন নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই এমনকি এই আনলক-১ এ সেই কাজ কীভাবে ফিরে আসবে সেই বিষয়েরও কোন নির্দিষ্ট রূপরেখা তাদের কাছে নেই। ২০ লক্ষ কোটি টাকার যে গল্প শোনানো হয়েছে তাতে সরাসরি খেটে খাওয়া মানুষের হাতে নগদ টাকা তুলে দেওয়ার কোন উল্লেখ ই নেই ,আছে তাদের ধার নেওয়ার মহাজনী ফিকির।

সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি (CMIE) ও আজিম প্রেমজী বিশ্ববিদ্যালয় লকডাউনের ফলে কর্মচ্যুতির তথ্য সংগ্রহ করছিল এবং একই সাথে সরকারের ঘোষিত রিলিফ প্যাকেজের হালহকিকত ও পর্যবেক্ষণ করছিল। আজিম প্রেমজী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তারিত সমীক্ষা থেকে দেশের গ্রাম ও শহর মিলিয়ে শ্রমজীবিদের তিনটি প্রধান কর্মক্ষেত্র- স্বনিযুক্ত, নিয়মিত, ও চুক্তিভিত্তিক-এর ক্ষেত্রেই কর্মচ্যুতির একটা চিত্র ফুটে উঠেছে।১৩ এপ্রিল থেকে ২০ মে ২০২০ এর মধ্যে করা এই সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে লকডাউনে ২৭ কোটি৬২ লক্ষ মানুষের কাজ চলে গেছে। মূলত দুটি বিষযের উপর ভিত্তি করে তারা এই সংখ্যাতে উপস্থিত হয়েছে, প্রথমত : পিরিওডিক লেবার ফোর্স সার্ভে(PLFS) ২০১৭-১৮ এর ভিত্তি একদম তৃণমূল স্তর অবধি সমীক্ষা করে ২০১৯ সালে আজিম প্রেমজী বিশ্ববিদ্যালয় দেখিয়েছিল গোটা দেশের সম্মিলিত শ্রমশক্তি হল ৪৬কোটি ৫১ লক্ষ । দ্বিতীয়ত: PLFS এর ২০১৭-১৮ সমীক্ষার ভিত্তিতে গ্রাম ও শহরে নারী ও পুরুষদের কর্মসংস্থানের অনুপাতকেও বিবেচনার মধ্যে রাখা।

Image Courtesy: www.businesstoday.in/

এই ২৭কোটি৬২ লক্ষের মধ্যে শহরাঞ্চলে কর্মচ্যুতির পরিমান ১১কোটির কাছাকাছি। যদিও এই সমীক্ষার ক্ষেত্রে একটা বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল পরিযায়ি শ্রমিকদের সপরিবারের তাদের রাজ্যে ফিরে যাওয়ার ঘটনা ফলতঃ বহুক্ষেত্রেই কর্মসঙ্কোচনের সম্পূর্ণ সঠিক চিত্র উপস্থিত হয়নি। এই পরিযায়ি শ্রমিকদের সি়হভাগই মুখ্যত উত্তরপ্রদেশ,বিহার,ঝাড়খন্ড, পশিচমবঙ্গ ও মধ্যপ্রদেশের বাসিন্দা।

Image Courtesy: www.businesstoday.in/

১ জুন থেকে আনলক-১ ঘোষণা হলেও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পুরোদমে চালু হওযার ক্ষেত্রে অনকেগুলো বাস্তবিক সমস্যা আছে, যেমন - ভাইরাসের ভীতি, সব কলকারখানায় বা নির্মাণশিল্পে 'সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং' মেনে অতীতের মত বড় সংখ্যায় শ্রমিকদের নিয়োগের সমস্যা ,লকডাউনের অমানবিক কড়াকড়ি নিয়ে পরিযায়িদের মধ্যে শহর সম্পর্কে ভীতি, এবং সর্বোপরি অর্থনীতির বেহাল দশা।

২০১৯-২০ অর্থবর্ষের শেষ ত্রৈমাসিকের জিডিপির যে চিত্র আমাদের কাছে হাজির হয়েছে তা ভয়াবহ। ২০০৯ এর পরে গত ১১ বছরে সবথেকে কম বৃদ্ধি ঘটেছে জানুয়ারি-মার্চ ২০২০ এই সময়ে, মাত্র ৩.১%।লকডাউনের আগের চিত্র এরকম হলে সহজেই অনুমান করা যায় দুমাসাধিক কাল ব্যাপী লকডাউনে পরিস্থিতি আরো কতটা খারাপ হয়েছে।

ইকোনমিক টাইমস পত্রিকার একটি নিবন্ধে ফুটে উঠেছে বিভিন্ন ক্ষেত্রভিত্তিক কর্মহীনতার চিত্র। গাড়ি নির্মাণ শিল্পে কোভিড পরিস্থিতির আগে নিযুক্ত ছিলেন প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ বর্তমানে কাজ হারিয়েছেন ২০-৩০ লক্ষ মানুষ । এই শিল্পে জড়িত ৫৫% মানুষই চুক্তিভিত্তিক কাজে যুক্ত। গাড়ির চাহিদা এখন তলানিতে স্বাভাবিকভাবেই আরো অনেকে কর্মহীন হবেন ভবিষ্যতে। গাড়ির শোরুম ও ডিলারশিপের ক্ষেত্রে যুক্ত ছিলেন প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। ডিলারদের খরচের ৪০%ই হয় শ্রমিকদের মাইনে ও অন্যান্য শ্রমিক সংক্রান্ত খাতে। খরচ কমানোর অছিলায় লকডাউনের মাঝেই কাজ গিয়েছে ২ লাখের বেশি আশঙ্কা আরো অন্তত ৮লাখ মানুষ কাজ হারাবেন। সংগঠিত ও অসংগঠিত মিলিয়ে খুচরো ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন ৪কোটি ৬০লাখ মানুষ তিনমাসে কর্মহীন হয়েছেন প্রায় ৬০লাখ । একটা ছোট উদাহরণ দিলে পরিস্থিতির ভয়াবহতা আরো স্পষ্ট হবে। স্যামসোনাইটের সব থেকে বড় ফ্রাঞ্চাইজি ব্যাগজোন লাইফস্টাইল গোটা দেশে তাদের ১০০র বেশি শোরুম বন্ধ করে দিয়েছে। কোলকাতা সহ দেশের সব বড় শহরেই দেখা গিয়েছে বিগবাজার, রিলায়েন্স ফ্রেশ, স্পেনসার্স এ কর্মীসঙ্কোচন ও বেতন কমানোর বিরুদ্ধে কর্মচারিদের আন্দোলনের ঘটনা। এ্যাপ নির্ভর ট্যাক্সি সংস্থা উবর ইতিমধ্যেই বিশ্বে তাদের ৩০% কর্মীসঙ্কোচন ঘোষণা করেছে, প্রত্যাশিতভাবেই ভারতেও তার অভিঘাত পড়বে।

রিয়াল এস্টেটের ক্ষেত্রে যুক্ত প্রায় ৭ কোটি মানুষ যাদের মধ্যে ৭০% পরিযায়ি শ্রমিক। ইতিমধ্যেই দেড় কোটির বেশি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। সরকার ব্যাঙ্কগুলোর মাধ্যমে গৃহঋণে অনেক সুযোগ সুবিধার কথা ঘোষণা করলেও বাস্তবে মধ্যবিত্তরা এই সঙ্কটের মূহুর্তে বাড়িবা ফ্ল্যাট কেনায় বিশেষ আগ্রহী হবে এমন আশা করা যায় না ফলে এই ক্ষেত্রে আরো অনেক কাজ যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পর্যটন শিল্পের সাথে সরাসরি যুক্ত মানুষের সংখ্যা করোনা পরিস্থিতির পূর্বে ছিল সাড়৫ কোটি। ইতিমধ্যেই অনেকে কাজ হারিয়েছেন। আগামী কয়েকমাসের মধ্যে এই শিল্প চাঙ্গা হওয়ার সুযোগ নেই,শিল্প মহলের আশঙ্কা কাজ হারাবেন প্রায় ৪ কোটি মানুষ।

Image Source: CMIE Twitter handle

পর্যটনের অনুসারি পরিবহন শিল্প , গাইড এইসব ক্ষেত্রে জড়িত আরো ১ থেকে দেড় কোটি মানুষ কাজ হারাবেন। একটা সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে রেস্টোরান্ট শিল্পে যুক্ত ৭৩ লাখ মানুষের মধ্যে ২০ লাখ ইতিমধ্যেই কাজ হারিয়েছেন এবং অদূর ভবিষ্যতে প্রতি ১০টা রেস্টোরান্টের মধ্যে ৪টি চিরকালের মত বন্ধ হয়ে যাবে। শিক্ষাক্ষেত্রে জড়িত প্রায় ২ কোটি মানুষের মধ্যে লকডাউনে কাজ হারিয়েছেন ৩৬-৪৫ লাখ মানুষ। অনলাইন শিক্ষার প্রসার ঘটলে এই ক্ষেত্রে আরো কাজ হারানোর ভয় রয়েছে। মিডিয়া ও বিনোদন শিল্পের সাতে যুক্ত রয়েছেন প্রায় ৬০লাখ মানুষ। জুনের শুরুতেই কাজ হারিয়েছেন প্রায় ৬-৮ লাখ মানুষ। বিজ্ঞাপন ও অন্যান্য আয়ের উৎসগুলো ক্রমশ কমে যাওয়ায় এইক্ষেত্রও ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছে। বিভিন্ন নিউজ চ্যানেল,সংবাদপত্র ও মিডিয়া সংস্থাগুলোতে ব্যাপকহারে ছাঁটাই এখন নিত্যদিনের ঘটনা। নির্মাণ,গাড়ি সহ অন্যান্য ক্ষেত্র লোকসানের মুখ দেখায় তার প্রবাব পড়েছে ইস্পাত শিল্পেও। এই শিল্পের সাথে যুক্ত ২০লাখ মানুষের মধ্যে ২-২.৫ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছেন লকডাউনের মাঝে। টেলিকম ক্ষেত্রে পরিষেবা ও উৎপাদন মিলিয়ে প্রায় ২০লাখ মানুষ সরাসরি যুক্ত। লকডাউনের ফলে ৭০হাজার কাজ হারিয়েছেন। হ্যান্ডসেট তৈরিতে সবথেকে বেশি মানুষ যুক্ত থাকেন, যদি চাহিদা না বাড়ে তাহলে অন্তত আরো ৭লাখ মানুষ কাজ হারাতে পারেন। Foxconn সংস্থার দিকে অনেকে তাকিয়ে আছেন কারণ এই ক্ষেত্রে সবথেকে বড় নিয়োগকারী এই সংস্থাটিই।

CMIE এর সমীক্ষাতে ফুটে উঠেছে ভারতের ৮টি মূল শিল্প ক্ষেত্র - বিদ্যুত,ইস্পাত,সংশোধিত পণ্য, খনিজ তেল,কয়লা,সিমেন্ট,প্রাকৃতিক গ্যাস ও সার- এই সময়ে উৎপাদন অতীতের সমস্ত রেকর্ডকে পেছনে ফেলে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমশ কমছে। অমর্ত্য সেন, অভিজিত বিনায়ক থেকে রঘুরাম রাজনের মত অর্থনীতিবিদরা বলছেন মানুষের হাতে নগদ টাকা না দিলে কোনভাবেই চাহিদার গ্রাফকে ঊর্দ্ধমুখী করা সম্ভব নয়। বিস্কুট,দেশলাই এর মত ন্যূনতম ভোগ্যপণ্যের চাহিদাও তলানিতে।

Image Source: CMIE Twitter handle

২০লাখ কোটি টাকার প্যাকেজের নামে অসংখ্য ঋণ প্রকল্প মানুষের কাছে কোন ভরসাযোগ্য সুরাহা হতে পারে না। উল্টে বহু ব্যবসায়ী এই ঋণের সুযোগ নেবে আর দেশে মেহুল চোকসী, বিজয় মাল্য, নীরভ মোদিদের মত ঋণখেলাপীদের তালিকায় আরো কিছু নাম যুক্ত হবে। Non Performing Asset বা অনাদায়ী ঋণের পরিমান বাড়বে ব্যাঙ্কগুলোর যা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার পরিবর্তে আরো বড় এক সঙ্কটর মুখে দেশকে ঠেলে দেবে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন