china virus

ট্রাম্পের ‘চীনা-ভাইরাস’ ঘোষণার নেপথ্যে রাজনীতি কি? - সত্য জানুন

শান্তনু দে

পর্ব ১ঃ

বছরের শুরুতেও চীনের সরকারের প্রতি ট্রাম্পের বার্তা ছিল: দুরন্ত কাজ করছে চীন!

Donald Trump And Xi Jinping

‘করোনাভাইরাস মোকাবিলায় কঠোর পরিশ্রম করছে চীন। তাদের কাজ ও স্বচ্ছতাকে খুবই প্রশংসা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।’ টুইট করেছিলেন ট্রাম্প। জানুয়ারির ২৪ তারিখ। ‘ওরা সব ঠিকঠাকই করবে, মার্কিন জনগণের পক্ষ থেকে আমি ধন্যবাদ জানাই রাষ্ট্রপতি শি-কে।’

এমনকি ফেব্রুয়ারিতেও, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চীন সরকারের কাজে প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি। গত বছরের শেষে ইউহানের একটি পশুবাজার থেকে যে ভাইরাসের সংক্রমণের শুরু। দরাজ গলায় ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিআক্রমণে জোরের সঙ্গে, তীক্ষ্ণতার সঙ্গে, জোরালোভাবে এগিয়ে চলেছেন’ শি জিনপিঙ। সেইসঙ্গেই জানিয়েছিলেন, এই রোগ প্রতিরোধে চীনের সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে’ মার্কিন সরকার।

রক্ষণশীল কিছু মিডিয়া মার্চের গোড়া থেকে ‘ইউহান ভাইরাস’ বা ‘চীনা ভাইরাস’ বলতে শুরু করলেও, মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্তও ট্রাম্প এই রোগকে বলে আসছিলেন করোনাভাইরাস। ১৬ মার্চ, প্রথম ট্রাম্প নিজে একে বলতে শুরু করেন ‘চীনা ভাইরাস’। এবং শুরু করেন মহামারি নিয়ে বর্ণবিদ্বেষী রাজনীতি, কুৎসার রাজনীতি। বিদেশসচিব মাইক পম্পিও বলেন, ‘ইউহান ভাইরাস’। হোয়াইট হাউসের একজন কর্তা বলেন ‘কুঙ ফ্লু’ (ওয়াশিংটন পোস্ট, ১৭ মার্চ)।

Pompeo and Trump
Mike Pompeo with Donald Trump

শুরুতে ট্রাম্প তেমন আমল দেননি। করোনাভাইরাসের আক্রমণকে বরং ছোট করে দেখেছিলেন। গড়িমসি দেখিয়েছিলেন। বলেছিলেন এনিয়ে মার্কিন নাগরিকদের অযথা উদ্বেগের কোনও কারণ নেই।

৫ ফেব্রুয়ারি, টুইটে বলেছিলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ৫ জন আক্রান্ত। প্রত্যেকেই সুস্থ হয়ে উঠছেন।’ ক’দিন বাদেই ২২ ফেব্রুয়ারি টুইটে বলেছিলেন: ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস একেবারেই নিয়ন্ত্রণে।’ তার আগে ২২ জানুয়ারি সিএনবিসি-কে বলেছিলেন, ‘পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে’। এমনকি মার্চের ৯ তারিখও তিনি একে হালকা চালে দেখেছিলেন। সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। বলেছিলেন মার্কিন নাগরিকদের এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনও কিছু নেই। ‘গতবছরও ৩৭,০০০ মার্কিন নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জায়— এই মুহূর্তে মাত্র ৫৪৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন বলে খবর, মারা গিয়েছেন ২২ জন। এবার ভেবে দেখুন!’ পরের দিন ১০ মার্চ, একেবারে দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো দাবি করেন, ‘এটা চলে যাবে। শুধু শান্ত হয়ে থাকুন। এটা চলে যাবে।’

কিন্তু ততদিনে মার্কিনমুলুকে ভয়াবহ আকার নিয়েছে করোনাভাইরাস। মার্চের মাঝামাঝিতে সবমিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার মানুষ আক্রান্ত। প্রাণ হারিয়েছেন ৮৭ জন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করতে হয়। আর তারপরেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া নিয়ে যাবতীয় গড়িমসির অভিযোগ ঝেড়ে ফেলতে উদ্যত হন তিনি।

নিজের অপদার্থতা ঢাকতে ফাটান বর্ণবাদী শব্দবোমা ‘চীনা ভাইরাস’। করোনাভাইরাস মোকাবিলার ব্যর্থতা ঢাকতে ট্রাম্পের বর্ণবিদ্বেষী-ভাইরাস।

যেমন বলেছেন ট্রাম্পের প্রাক্তন উপদেষ্টা স্টিভ ব্যানন। ‘আমি চাই ওরা প্রতিদিন জাতি-বর্ণ (বিদ্বেষ) নিয়ে কথা বলুক। যদি জাতি আর পরিচিতিসত্ত্বার দিকে ফোকাস করে এবং আমরা অর্থনৈতিক-জাতীয়তাবাদ নিয়ে এগিয়ে যেতে পারি, তবে আমরা সহজেই গুঁড়িয়ে দিতে পারব ডেমোক্র্যাটদের।’

Steve Banon With Donald Trump

নভেম্বরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হওয়ার কথা। ভোটবাক্স ভরাতে মেরুকরণের লক্ষ্যে ঘৃণার রাজনীতির এই তো সময়। চীনা ভাইরাস বলে ট্রাম্পের বার্তা আসলে ‘অপরাধী বিদেশীরা’, ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির সঙ্গে যা খাপ খেয়ে যায়। অন্যান্য জরুরি ইস্যুগুলিকে ছাপিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রচারকে তুঙ্গে তোলা যায়। আড়াল করা যায় যাবতীয় অপদার্থতা (সিবিএস নিউজ)। 

পর্ব ২ঃ

২৫ মার্চ, জি-সাতের বিদেশমন্ত্রীদের বৈঠক ব্যর্থ হয় কোনও বিবৃতি দিতে।

খসড়া তৈরির দায়িত্বে ছিল জি-সাতের সেইসময়ের প্রেসিডেন্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র— যা দেখে বেশকিছু সদস্য মেনে নিতে পারেননি। স্বাভাবিক। খসড়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করেছিল বর্ণবাদী শব্দবন্ধ ‘ইউহান ভাইরাস’, দাবি করেছিল বিশ্ব মহামারির দায়িত্ব চীন সরকারের। ট্রাম্প ‘চীনা ভাইরাস’ বলার পর ফক্স নিউজ তো সুর চড়িয়ে বলেই বসে, ‘চীনে শুরু কেন, কারণ ওদের ওখানে আছে এমন বাজার, যেখানে ওরা খায় বাদুড় আর সাপের কাঁচামাংস।’

যদিও, ঘটনা হলো চীনের মানুষ বাদুড় খান না। যে পাঁচ-ছ’টি ভিডিও বাজারে ঘুরছে, তার মধ্যে পাঁচটি খতিয়ে দেখে ফ্রান্স টিভি ২৪’র সাংবাদিকরা বলেছেন: এই ভিডিওগুলি আদৌ ইউহান, কিংবা চীনে তোলা হয়নি। এগুলি তোলা হয়েছে ইন্দোনেশিয়ার পালাউ অঞ্চলে, যেখানে বাদুড় খাওয়ার ট্র্যাডিশন রয়েছে। এবং যেখানে ট্র্যাডিশানাল খাবার দিয়ে বিদেশী পর্যটকদের স্বাগত জানানো হয়।

যাইহোক, এসব আঁচ করেই হয়তো বহু আগে ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ হু’র প্রধান ডাক দিয়েছিলেন, ‘কুৎসা নয়, সংহতি’।

ঠিক কোথায় এই ভাইরাসের উৎপত্তি, এনিয়ে দৃঢ় সহমত না থাকলেও, একটি মত হলো, হুবেই প্রদেশের ইউহানের একেবারে পশ্চিম প্রান্তে হুয়ানান পাইকারি ফুড মার্কেট থেকেই শুরু। যেখানে বিক্রি হয় বন্য পশুপাখি।

ভাইরাসটির সরকারি নাম সার্স-কোভ-২। এটিই একমাত্র ভাইরাস নয়। যদিও, মানুষের জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে বিপজ্জনক ভাইরাস। আমরা এই সময়ে দেখেছি বেশ কয়েক ধরনের অ্যাভিয়েন ফ্লু। এইচ১এন১, এইচ৫এনএক্স, এইচ৫এন৬, এইচ৫এন২ এবং এইচ৫এন৬।

H1N1 Virus
H1N1 Virus

এইচ৫এন২ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উৎপত্তি হলেও কেউ একে ‘আমেরিকান ভাইরাস’ বলে না। বা কুৎসা করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে না।

যে কোনও ভাইরাসকে ডাকার জন্য দেওয়া হয় বৈজ্ঞানিক নাম। কোভিড-১৯ নাম দিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেমন বলেছে, কোনও একটি বিশেষ ভৌগলিক এলাকা, কোনও জীবজন্তু, কোনও ব্যক্তি, কিংবা কোনও জনগোষ্ঠীর নাম এড়াতে চায় তারা। বস্তুত, হু-র ডিরেক্টর জেনারেল টেড্রস আধানম গেব্রিয়েসাস বলেন, রোগের একটি নাম দেওয়ার অর্থ, অন্যান্য নাম যাতে ব্যবহার করা না হয়, যা ভুল হতে পারে, ব্যবহার করা হতে পারে কুৎসার জন্য।

১৮৩২, ব্রিটিশ ভারতে কলেরা শুরু হলেও, একে ডাকা হতো ‘এশিয় কলেরা’ বলে।

Cholera Virus
CholeraVirus

স্প্যানিশ ফ্লু-তে স্পেনের নাম জড়ানো থাকলেও, এটা এসেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। যখন অধিকাংশ দেশের সংবাদমাধ্যম ছিল সেনসরের শিকার। স্পেন যুদ্ধে ছিল না। স্পেনের মিডিয়া তাই এনিয়ে প্রচুর প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই থেকেই মহামারির নাম হয়ে যায় দেশের নামে। যদিও তথ্যপ্রমান বলে স্প্যানিশ ফ্লু’র শুরু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রৃ। কানসাসের একটি সামরিক ঘাঁটিতে। মুরগির থেকে সেনাদের শরীরের সংক্রামিত হয় সেই ভাইরাস। ছড়িয়ে পড়ে ব্রিটিশ ভারতে, নিহতের ৬০ শতাংশ ছিল ভারতে।

spanish flu virus

কিন্তু, তাই বলে কখনও একে ‘আমেরিকান ফ্লু’ বলা হয় না! (টাইম: ট্রাম্পস ‘চাইনিজ’ ভাইরাস ইস পার্ট অব দি লঙ হিস্ট্রি অব আদার কান্ট্রিস ফর ডিজিস)।

গত শতকের সাতের দশকে এইডস ছড়িয়ে পড়ে মার্কিনমুলুকের লস এঞ্জেলস থেকে। ১৯৯২-তে লস এঞ্জেলস টাইমস পত্রিকার প্রতিবেদনে, সেখানে প্রতি ২০০ জনে একজন এইডসে আক্রান্ত।

তাই বলে এইভআইভি’র জন্য কেউ আমেরিকাকে দায়ী করে না।

Aids Virus
Human Immunodeficiency Virus (HIV) The virus that causes AIDS

পর্ব ৩ঃ

ডা: ঝাঙ জিসিয়ান। হুবেই প্রদেশ হাসপাতালের রেসপিরেটরি ও ক্রিটিক্যাল বিভাগের অফিকর্তা। করোনা নিয়ে যারা প্রথম সতর্কঘণ্টা বাজিয়েছিলেন, তিনি তাঁদের একজন।

২৬ ডিসেম্বর, তিনি দেখলেন বয়স্ক একজন দম্পতি প্রচণ্ড জ্বর ও সর্দিকাশি নিয়ে এসেছেন। লক্ষণ অনেকটাই ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো। পরীক্ষা করে দেখা যায় সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা নয়। সাধারণ ওষুধে কাজ হচ্ছে না। তাঁদের ছেলের ফুসফুসে স্ক্যান করে দেখা যায়, কিছু একটা ভর্তি রয়েছে ফুসফুসের ভিতরে। তাঁরা তখনও ভাবেননি এটা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার কথা ভাবা তো দূরঅস্ত। ওই দিনই আরেকজন রোগী আসেন একই লক্ষণ নিয়ে। সিফুড মার্কেটের বিক্রেতা তিনি। সন্দেহ হয় ডা: ঝাঙের। রোগের কারণ বুঝতে না পারার কথা ডা: ঝাঙ জানান হাসপাতালের ভাইস প্রেসিডেন্ট সিয়া ওয়েনগুয়াঙকে। একইসঙ্গে হাসপাতালের অন্যান্য বিভাগকে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সঙ্গে সঙ্গে ওই চারজন রোগীর কথাই জানান হুয়ানানের জিয়াঙহান জেলার সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনকে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে। পরের দু’দিন ডা: ঝাঙ ও তাঁর সহকর্মীরা দেখেন আরও তিনজন রোগী একই লক্ষণ নিয়ে এসেছেন, যাঁরা গিয়েছিলেন ওই সিফুড মার্কেটে। তাঁদের ফুসফুসে বড় রকমের ড্যামেজ। স্পষ্ট হয়, ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার উৎস সিফুড মার্কেট। ২৯ ডিসেম্বর হুবেই প্রদেশের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন বিশেষজ্ঞদের পাঠায় ওই সাতজন রোগীকে দেখে আসার জন্য। প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষ ওই দিনই ওই নতুন ভাইরাসটির কথা জানতে পারে। পরের দিনই তারা তা জানায় চীনের ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল (সিডিসি)-কে। তার পরের দিন, ৩১ ডিসেম্বর জানায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-কে।

৭ জানুয়ারি, চীন চিহ্নিত করে অজানা রোগের জন্য দায়ী একটি নতুন করোনা ভাইরাস। ২১ জানুয়ারি, হু নিশ্চিত করে মানুষের থেকে মানুষের শরীরের করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কথা। ২৩ জানুয়ারি, দেশের অধিকাংশ অঞ্চল ‘শাটডাউন’ করে দেয় চীন। ইউহানকে কোয়ারেন্টিন করে। যখন দেখা যায় দেশে ৫০০ জন আক্রান্ত, মারা গিয়েছেন ১৭ জন।

china corona

ইতালি কখন করে? চীনের জনসংখ্যার মাত্র ৪ শতাংশ হলেও, তখন লকডাউন ঘোষণা করে, যখন দেশে ১২,৪৬২ জন আক্রান্ত, মারা গিয়েছেন ৮২৭ জন।

কোথায় তথ্য চাপলো চীন? যেই মাত্র তারা জেনেছে এটি একটি অপরিচিত ভাইরাস, তখনই তারা জানিয়েছে সিডিসি-কে এবং পরে হু-কে।

প্রটোকল না মেনে তথ্য প্রকাশ করার জন্য কয়েকজন ডাক্তারকে তিরস্কার করা হয়। বিশেষজ্ঞ টিম আসার আগেই ডা: এই ফেন রহস্যজনক ভাইরাসটি নিয়ে তাঁর হতাশার কথা কিছু মেডিক্যাল ছাত্রকে জানান। ডা: ফেন দেখেছিলেন রিপোর্টে লেখা অজ্ঞাত নিউমোনিয়া। তিনি ‘সার্স করোনাভাইরাস’ অংশটি লাল কালিতে গোল করে ছবি তুলে তা পাঠিয়েছিলেন কয়েকজনকে। রিপোর্টটি ছড়িয়ে পড়ে ডা: লি ওয়েনলিয়াঙ (কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য-ও বটে)-সহ সাতজন ডাক্তারের মধ্যে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ডা: ফেনকে সতর্ক করে।

৩০ ডিসেম্বর, ডা: লি এই রহস্যজনক নিউমোনিয়ার বিষয়টি প্রাইভেট উইচ্যাট গ্রুপে বন্ধুদের মধ্যে শেয়ার করেন। বলেন ২০০৩-র সার্স ভাইরাস আবার ফিরে এসেছে। অপ্রকাশিত ‘সরকারি রিপোর্টের’ কথা উল্লেখ করেন তিনি। বন্ধুদের চুপ করে থাকতে বলেন। ৩ জানুয়ারি, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তাঁর প্র্যাকটিসের লাইসেন্স সাসপেন্ড করে। ৭ জানুয়ারি, নতুন ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার পর তাঁকে কাজে ফিরতে বলা হয়। তিনি কাজে যোগ দেন। যদিও, শীঘ্রই করোনাভাইরাসে নিজে আক্রান্ত হন।

২ এপ্রিল, ডা: লি ওয়েনলিয়াঙ এবং আরও ১৩ জন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মারা যান। তাঁদেরকে জানানো হয় শহীদের সম্মান। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ও গণ সাধারণতন্ত্রী চীনের সর্বোচ্চ সম্মান।

ডা: লি’কে ‘হইসেলব্লোয়ার’ হিসেবে কর্পোরেট মিডিয়া দেখাতে চাইলেও, আসলেই তিনি এখন চীনের ‘জাতীয় নায়ক’।

Dr. Li Wenliang
Dr. Li Wenliang

পর্ব ৪ঃ

আসলে চীনকে ‘বলির পাঁঠা’ করা হচ্ছে।

ব্রিটিশ গার্ডিয়ান পত্রিকায় উত্তর-সম্পাদকীয় পাতায় শিরোনাম: ‘ব্লেমিং চায়না ফর করোনাভাইরাস ইস নট জাস্ট ডেঞ্জারাস, ইট মিসেস দি পয়েন্ট’। নিবন্ধে অভিমত স্পষ্ট: ‘কোনও একটি দেশ নয়, এই মহামারি পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের সৃষ্টি। চীনা সংস্কৃতিকে কেবল সুবিধাজনক বলির পাঁঠা করা হচ্ছে।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপের রাজনীতিকরা তাদের নিজস্ব বিপর্যয়কর ব্যবস্থাপনা থেকে নিজেদের আড়াল করতে চাইছে। তাঁদের কাছে সুবিধাজনক ‘বলির পাঁঠা’ হলো চীন। চীনকে দোষারোপের মধ্যে রয়েছে তাদের অভিপ্রায়ের অস্পষ্টতা, অনিশ্চয়তা।

‘ট্রাম্প ইস ইনডিকটিং এ করোনাভাইরাস কালচার ওয়ার টু সেভ হিমসেলফ’। শিরোনাম শতাব্দীপ্রাচীন মার্কিন পত্রিকা দ্য আটলান্টিকে। মার্কিন অনলাইন পত্রিকা স্টেটে শিরোনাম: ‘দ্য রিয়েল রিজন ট্রাম্প স্টার্টেড কলিং দি ভাইরাস ‘চাইনিজ’।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের নিয়মিত কলাম-লেখক নিকোলাস ক্রিস্তফ যেমন বলেছেন: ‘কোনও রোগের জন্য বিদেশীদের দায়ী করার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে দীর্ঘ ও বর্বর বর্ণবাদী ইতিহাস। বস্তুত, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় আমাদের এতটাই বিশৃঙ্খল অবস্থা যে আমাদের কাউকে বলির পাঁঠা করা উচিত নয়।’

তবে প্রথমে ট্রাম্প নন। প্রথমে ইজরায়েল।

ইজরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রাক্তন কর্তা ড্যানি শোহামই প্রথম দাবি করেন, চীনের হুবেই প্রদেশের ইউহান শহরের একটি সামরিক গবেষণাগারে করোনাভাইরাস তৈরি করা হয়েছে। এরপর সেখান থেকে ভুল করে ভাইরাসটি বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। চীন এই জৈবাস্ত্র তৈরি করেছে বিশ্ববাণিজ্য দখলে নিতে। এবং দুনিয়াজুড়ে নিজের কর্তৃত্ব বাড়াতে। শোহামের পরে ট্রাম্প তাতে যুক্ত হন।

 Dany Shoham israel

Dany Shoham

কে না জানে শুরুতে মানুষ গুজবে একটু বেশিই আস্থা রাখেন। গুজব তাই ছড়ায়ও ঝড়ের গতিতে, যুক্তিবোধকে উড়িয়ে।

এবং পোস্ট-ট্রুথ জমানার কর্পোরেট মিডিয়ায় এটাই দস্তুর।

একইসঙ্গে দু’ধরনের সেন্সরশিপ।

এক ধরনের সেন্সরশিপ— কিছুই দেখানো হল না, বলা হল না।

আরেক ধরনের সেন্সরশিপ— অনেক কিছু দেখানো হল, কিন্তু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মিথ্যা কথাটা দেখানো হল সত্য হিসাবে।

উত্তর আধুনিক শব্দবন্ধে পোস্ট-ট্রুথ। উত্তর সত্য।

চলছে দু’টোই। একযোগে। চলছে সমানতালে।

আসলেই কন্সপিরেসি থিওরি। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব।

আর তা দেখে চীনের বাইরে নামকরা ২৭ জন জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানী এতটাই উদ্বিগ্ন, যে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে একটি বিবৃতি দিয়ে এই ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বের’ কড়া নিন্দা জানিয়েছেন।

‘জীবজন্তুর শরীর থেকেই এই করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব শুধুই ভয়, গুজব ও ঘৃণা ছড়াবে। যাতে এই সঙ্কট মোকাবিলায় ব্যাহত হবে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।’

বিশ্বের বড় বড় বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ভাইরাসের যে জিন রহস্য (জীবন রহস্য), তা পর্যালোচনা করে বোঝা যাচ্ছে, এটি গবেষণাগারে তৈরি কোনও ভাইরাস নয়।

পর্ব ৫ঃ

ট্রাম্প এখন নিজের অযোগ্যতা ঢাকতে বলির পাঠা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’-কে। চীনের সঙ্গেই এবারে হু-কে তোপ ট্রাম্পের। অর্থ সাহায্য বন্ধের হুঁশিয়ারি দিয়েছে।

ইতিমধ্যেই করোনাভাইরাসের হানায় আমেরিকায় মৃত্যু ২০,০০০ ছাড়িয়েছে। যে কোনও দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আক্রান্ত হয়েছেন ৫,২৪,৯০৩ জন (সিএনএন, ১২ এপ্রিল)।

ট্রাম্পের শিশুসুলভ অভিযোগ, হু যদি তাঁদের সঠিক বার্তা দিত, তা হলে এত লোকের মৃত্যু হত না দেশে। কিন্তু তারা সেটা করেনি। তাঁর আরও অভিযোগ, গোটা বিশ্বের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয় যাদের দেখার কথা, সেটা না করে চীনের হয়ে কাজ করেছে হু। যার জেরে গোটা বিশ্বে অতিমারির আকার নিয়েছে করোনা। 

হু-র বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়ে ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, যে টাকা আমেরিকা তাদের দেয়, সেই টাকা বন্ধ করে দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘হু-কে টাকা দেওয়া বন্ধ করব। তারা যে কাজটা করেছে সেটা অত্যন্ত ভুল।’ তাঁর মন্তব্য, ‘অনেক ভুল বার্তা দিয়েছে হু। অনেক আগে থেকে তারা সব কিছু জানত, কিন্তু সেটা জানায়নি।’

ট্রাম্পের কুৎসিত আক্রমণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অত্যন্ত পরিশীলিত ভাষায় তাঁকে স্পষ্ট জবাব দিয়েছে হু।

কফিনের সারি দেখতে না চাইলে ‘করোনা-রাজনীতিকে কোয়ারেন্টিনে রাখুন’, বলেছেন হু’র ডিরেক্টর জেনারেল টেড্রস আধানম গেব্রিয়েসাস।

গেব্রিয়েসাস বলেছেন, ‘করোনাভাইরাসের মতো মারাত্মক মহামারী মোকাবিলায় বিশ্বজুড়ে হাতে হাত মিলিয়ে লড়াই করুন। মানবসমাজের এই চরম বিপদের সময়ে করোনা নিয়ে রাজনীতি করবেন না। কোভিড রাজনীতিকে দয়া করে কোয়ারেন্টিনে রাখুন। নতুবা আরও অনেক মৃতদেহ বইতে হবে বিশ্বকে।’

ট্রাম্পের অভিযোগের জবাবে নাম না করে গেব্রিয়েসাস বলেছেন, ‘গত ৩১ ডিসেম্বর চীনে সর্বপ্রথম অজানা কারণের নতুন ধরনের নিউমোনিয়া সংক্রমণের খবরটি পায় হু। তারপর থেকে প্রতিদিন নিয়মিতভাবে করোনা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য, গবেষণা রিপোর্ট এবং প্রমাণ বিশ্বের সামনে হাজির করে চলেছি আমরা।’

মার্কিন রাষ্ট্রপতি হু’কে ‘চীন-ঘেঁষা’ আখ্যা দেওয়ায় গেব্রিয়েসাস পালটা বলেছেন: ‘আমরা সব দেশেরই ঘনিষ্ঠ। আমরা কালার-ব্লাইন্ড।’

হু’র প্রধানের আর্তি: ‘দয়া করে এই ভাইরাসের রাজনীতিকরণ বন্ধ করুন। আগুন নিয়ে খেলবেন না।’

‘দয়া করে এই ভাইরাসের রাজনীতিকরণ বন্ধ করুন। আগুন নিয়ে খেলবেন না।’ বিশ্বজুড়ে বিপুল মৃত্যু এবং সংক্রমণের তথ্য মনে করিয়ে তিনি বলেছেন: ‘এই সংখ্যাও কি যথেষ্ট নয়? আরও মৃতদেহ না চাইলে দয়া করে সংযত হোন এবার।’

WHO Cheif for Trump

তথাকথিত ঠাণ্ডাযুদ্ধের সেই সময়েও গুটিবসন্ত নির্মূলে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬৭ থেকে টানা দশ বছর বিশ্বজুড়ে প্রচার অভিযান চালিয়েছিল।

এখন সেই পথই অনুসরণ করা উচিত।

Pictures: Google Images


শেয়ার করুন

উত্তর দিন