১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২,
প্রথম পর্ব
রাজ্যের মুখে ‘আলকতারা’ মাখাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই!
তখন মমতা ব্যানার্জি কংগ্রেসে। ১৯৮৬ সালের ১২ জানুয়ারি।
বেকার যুবদের বিভ্রান্ত করতেই বেহালায় শুরু হয় ঋণমেলা। কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মূসচী হলেও সাংসদ হিসাবে ঐ ঋণমেলার দখল নেন মমতা ব্যানার্জি। তিনি ও তাঁর বাহিনী প্রচার করলো হাজার হাজার মানুষকে কোটি কোটি টাকা পাইয়ে দেওয়া হবে। সেই মত তৎকালীন কংগ্রেসের তরফে পাড়ায় পাড়ায় জাল ফর্ম বিলি করা হলো।


যদিও স্টেট ব্যাঙ্কের বেহালা শাখা থেকে সীমিত পরিমান টাকা সীমিত সংখ্যক যুবক যুবতীকে দেওয়ার কথা। ভুয়ো প্রচারের ফাঁদে পড়ে নির্দিষ্ট দিনে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা। বেগতিক দেখে মমতা ব্যানার্জি পালাবার পথ খুঁজছেন, ধাক্কাধাক্কিতে পড়ে গিয়ো চোট পেলেন এক মহিলা। মুহুর্তের মদ্যে রটে গেলে মহিলাকে মারা হয়েছে। কে মারলো, কারা মারলো কেউ জানতে পারলেন না। ততক্ষনে হাজার বেকার যুব লাইনে- মেলা থেকে পালিয়ে দলবলদহ মমতা ব্যানার্জি বেহালা থানা ঘেরাও করলেন। আবার নতুন করে রটে গেলো- ‘মমতা প্রহৃত’! ব্যস, চুলোয় গেলে ঋণমেলা, বেকার যুবকদের ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। হারিবে গেলেন সেই ‘আক্রান্ত’ মহিলাও। সংবাদমাধ্যে প্রচারের আলোয় শুধু মমতা ব্যানার্জি আর তাঁর আক্রান্ত হওয়ার খবর!
গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। ৩৬বছর পেরিয়েছে। এখন উনি মুখ্যমন্ত্রী। তবে এখনও ‘ভুয়ো’ র সঙ্গ ছাড়েননি তিনি। এখন তিনি নিজেই সরকারি অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে বেসরকারি সংস্থার হয়ে ভুয়ো নিয়োগপত্র বিলি করছেন!

প্রাইমারি টেট থেকে এসএসসি দূর্নীতি- হাজার হাজার মেধাবী, বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের ভবিষ্যত খুন করা হয়েছে। এখনও এই শহরের রাস্তায় স্বচ্ছ্ব নিয়োগের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীরা। উৎসবের কার্লিভাল,ঢাকের আওয়াজ কেবল উনি-ই শুনছেন। মাসের পর মাস খোলা আকাশের নীচে, রাস্তায় বসে, শুয়ে থাকা বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের কাছে এসবই এখন বিলাসিতা, বাড়িতে অসুস্থ মা-বাবা কিংবা বিবাহযোগ্য বোন হয়তো অপেক্ষায়!
সেই নিয়োগ দুর্নীতিতে খোদ রাজ্যের মন্ত্রী বমাল গ্রেপ্তার হওয়ার মাত্র ৭২ ঘন্টার মধ্যেই নজরুলমঞ্চে দাঁড়িয়ে গত ২৫ জুলাই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি- ‘সরকার ও দল এর সঙ্গে কোনভাবে জড়িত থাকবে না। কিন্তু আমারা গায়ে জালি ছেটানোর চেষ্টা করলে,আলকাতরা কিন্তু আমার হাতেও আছে’।
ঠিকই তো! ‘আলকাতরা’ ওনার হাতেই থাকার কথা।
তা টের পাওয়া হলো ১২ সেপ্টেম্বর। সেই আলকাতার আসলে মাখানো হলো বেকার যুবকদের মুখে, গায়ে। সরকারি শিক্ষক নিয়োগের কেলেঙ্কারির মাঝেই এবার এখন বেসরকারি সংস্থার নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে জড়ালেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী নিজেই।
সরকারি অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে রাজ্যের মুখমন্ত্রী বেসরকারি সংস্থায় নিয়োগের জাল, ভুয়ো নিয়োগপত্র বিতরন করলেন! স্বাধীন ভারতে এঘটনা ঘটেনি আগে।
শারদোৎসবের প্রাক্কালে নিয়োগ দূর্নীতি, বীর অনুব্রত এফেক্ট একটু ধামাচাপি দিতে পুজোয় চাই নতুন জুতোর মত, পুজোয় চাই নতুন চাকরি –স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তা দিচ্ছেন! বাংলা থেকে প্রকাশিত প্রায় সব সংববাদপত্রে( গণশক্তি বাদে) বড় বড় বিজ্ঞাপন। মুখ্যমন্ত্রী দাবি করছেন ৩০হাজার চাকরি রেডি আছে।
১২ সেপ্টেম্বর নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ১০ হাজার নিয়োগপত্রও তুলে দেন। তবে সেই চাকরি আসলে ফুড ডেলিভারি বয়, বেসরকারি ব্যাঙ্কের ঋণ আদায়কারী, ড্রাইভারের কাজ। এগুলো কোনটাই সরকারি চাকরি নয়। তবে নিয়োগপত্র বিলোচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী! তাও সই।
কিন্তু ঠিক চব্বিশ ঘন্টা বাদেই ধরা পড়লো সেই নিয়োগপত্রও ভুয়ো! ভুয়ো নিয়োগপত্র দিয়ে তৃণমূল সরকারের আমলে চাকরি পাওয়া যায় কিন্তু বেসরকারি সংস্থায় তো আর চাকরি মিলবেনা ভুয়ো নিয়োগপত্র দিয়ে! ফলে প্রত্যাখ্যান।
আর মুখ্যমন্ত্রী সেই জাল নিয়োগপত্র বিলিয়ে ‘উৎকর্ষ বাংলা’ অনুষ্ঠানে বলছেন- আজকে আমি গর্বিত! হাজার হাজার বেকার যুবকের সঙ্গে কী নৃশংশ জালিয়াতি!
রাত জুড়ে বিলি করা হলো চাকরির নিয়োগ পত্র। হুগলীর নোডাল অফিসে গত ১৩ তারিখে পৌছায় তিন হাজারের বেশি চাকরি প্রার্থীর নিয়োগপত্র। হুগলী ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি কলেজে অফার লেটার নিতে আসে অনেকেই। চিঠিতে লেখা গুজরাটের মারুতি সুজুকি কোম্পানিতে দুই বছরের আইটিআই প্রোগ্রামে ভেহিকেল টেকনিক্যালের ট্রেনিং দেওয়া হবে। ১১ হাজার টাকা করে ভাতা দেওয়া হবে। সেন্টার ফি বহন করবে সুজুকি মোটরস গুজরাট প্রাইভেট লিমিটেড। যদিও তারপরে ফোন করে প্রার্থীরা জানতে পারে এই প্রশিক্ষণের ব্যাপারটাই ভূয়ো। যেভাবে কোম্পানির প্যাড ব্যবহার করা হয়েছে তাতে স্পষ্ট তা ভুয়ো। শুধু তাই নয়- ঐ সংস্থার মুম্বাইয়দের সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে- সরকার যেভাবে তাদের সংস্থার লেটারহেড ব্যবহার করে জাল অফার লেটার তৈরি করেছে তার বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ নেওয়া হবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধেই!
পার্থর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, ফার্ম হাউস, অনব্রতর চালকল তো দূর অস্ত, খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বেসরকারি সংস্থার ‘প্রতিনিধি’ হয়ে ফেক অ্যাপয়নমেন্ট লেটার বিলি করছেন!
বাস্তবিকই এখন উনি রাজ্যের মুখে, রাজ্যবাসীর মুখে আলকাতার মাখাচ্ছেন।

***************************
ঘন্টায় ঘন্টায় বাড়ছে টাকার অঙ্ক। রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা। টিভির পর্দায় স্থির চোখ, হাতের রিমোটে বদলে যাচ্ছে চ্যানেল।
৫ কোটি থেকে ১০কোটি, ১৫কোটি শেষে গিয়ে দাঁড়ালো ২১কোটি ৯০ লক্ষ টাকা। স্রেফ একটি ফ্ল্যাট থেকে। ২২জুলাই। পাঁচদিন বাদে আবারও প্রাক্তন মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর বেলঘড়িয়ার ফ্ল্যাটে থেকে উদ্ধার হলো। ঘন্টায় ঘন্টায় বাড়ছে টাকার পরিমান, প্রায় একই উত্তেজনা টিভির পর্দায়। বাড়তে বাড়তে তা গিয়ে দাঁড়ালো ২৭কোটি ৯০ লক্ষে! টিভির পর্দায় হরিদেবপুর বনাম বেলঘড়িয়ার টি-টোয়েন্টির ধারাভাষ্য!

তার মাঝেই আবার গার্ডেনরিচে খাটের তলা থেকে,রান্নাঘরের হাঁড়ি থেকে মিললো ১৭কোটি ৩২লক্ষ!নগহদ টাকা।ভোটের গণনাকে যেন হারা মানাচ্ছে নগদ টাকার গণনার উত্তেজনা!এই শহর, এই রাজ্যে আগে কখনও দেখেনি এমন ধারাবাহিকভাবে টাকা বাড়িতে, ফ্ল্যাটে নগদ টকা উদ্ধারের এমন কুৎসিত দৃশ্য।
প্রাক্তন মন্ত্রীর বান্ধবীর বাড়িতে টাকা, নিয়োগ কেলেঙ্কারি থেকে হাত ধুয়ে নেওয়ার চেষ্টা সরকার মায় মুখ্যমন্ত্রীর। ২০১২ সালের প্রাইমারি টেট থেকে শুরু কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি, টাকার বিনিময়ে চাকরির খেলা। মন্ত্রী, আমলা, প্রশাসন একযোগে দুর্নীতির চক্র চালাচ্ছে।

ধরা পড়া নেতাদের সম্পত্তির তালিকা দেখে চক্ষু চড়কগাছ খোদ তদন্তকারী সংস্থারই। বিপুল বৈভব, প্রাচুর্য, কালো টাকার এক অশ্লীল ছবি! সর্বাঙ্গে দুর্নীতির কাদা মেখেই ‘ফাইল লোপাট, আলমারি হারিয়ে’ যাওয়ার মিথ্যাচারও চলছে সোচ্চারে। স্বাধীনতার পরে এরাজ্যের বুকে সর্ববৃহৎ নিয়োগ কেলেঙ্কারির দায় কতটা পার্থ চ্যাটার্জির ওপরে, কতটা অর্পিতা মুখার্জির ওপরে কতটা বা এস পি সিনহা বা কল্যানময় গাঙ্গুলির ওপরে বর্তায় তা নিয়ে মিডিয়ার মৃদু-মন্দ সমালোচনার মাঝেই ফের একবার উনি নিজেই স্পষ্ট করলেন- এই সরকার, এই শাসক দল, এই প্রশাসনের যাবতীয় দুর্নীতির উৎসমুখ শেষ পর্যন্ত তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত।
’মাথা’ মানে উনি নিজেই -সরকারের, দলের এবং দুর্নীতিরও। সোজা কথা সহজভাবেই বলা এবং বোঝা প্রয়োজন।
একইসঙ্গে ফাঁদ এখানেই পাতা। দুর্নীতির উর্বর জমি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা— সবই আসলে আপনাকে জোগাবে শাসক শ্রেণিই। দুর্নীতির সারেই পদ্ম চাষের চেষ্টা!
চলবে......
( তৃণমূলের দুর্নীতির পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনটি আগামী বেশ কয়েকটি পর্বে প্রকাশিত হবে......।