নতুন তিনটি ফৌজদারি আইনবিধি - ফৌজদারি আইনকে পঙ্গু করার চক্রান্ত

কে এন উমেশ

১ জুলাই ২০২৪ থেকে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার দেশজুড়ে বিভিন্ন মহলের বিরোধিতা সত্ত্বেও নতুন তিনটি ফৌজদারি আইনবিধি লাগু করেছে। ১৮৬০ সালে তৈরি ‘ইন্ডিয়ান পেনাল কোড’ (ভারতীয় দণ্ডবিধি)-র পরিবর্তে হয়েছে ‘ভারতীয় ন্যায় সংহিতা’(BNS)। ১৮৯৮ সালের ‘ক্রিমিনাল প্রসিডিওর অ্যাক্ট’ (ফৌজদারি দণ্ডবিধি)-র নতুন রূপ ‘ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা’(BNSS) এবং ১৮৭২সালের ‘ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট’ (ভারতীয় সাক্ষ্য আইন)-র বদলে কার্যকর হচ্ছে ‘ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম’(BSA)। ১৪৮ জন বিরোধী সাংসদকে বহিষ্কার করে এই তিনটি ফৌজদারি আইন সংশোধনী ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সংসদে প্রায় কোনও আলোচনা ছাড়াই গৃহীত হয়েছিল।

বিলগুলি সংসদে উত্থাপনের সময় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দাবি করেছিলেন, এই নতুন আইনগুলি ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দেবে, বিচারব্যবস্থার ভারতীয়করণ হবে, শাস্তিকেন্দ্রিক ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা পালটে ন্যায়বিচার কেন্দ্রিক হবে। ‘ইন্ডিয়ান’-এর বদলে ভারতীয়, ‘পেনাল’-এর বদলে ন্যায়, ‘ক্রিমিনাল’-এর বদলে নাগরিক, ‘প্রসিডিওর’-এর বদলে সুরক্ষা, ‘এভিডেন্স’-এর বদলে সাক্ষ্য, এবং ‘কোড’-এর বদলে সংহিতা— এই শব্দের আলঙ্কারিক বা হিন্দিতে ভাষান্তর বদলই শুধু হলো, আর কিছুই হলো না, অথচ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তব্য অনুসারে এটাই নাকি ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার থেকে মুক্তি। এটাও দাবি করা হয়েছিল যে ‘রাজদ্রোহ’(sedition) অপরাধমূলক নয় এবং গণপিটুনিকে অপরাধের আওতায় আনা হয়েছে। যথারীতি তাদের কথা আর কাজের মধ্যে কোনও মিল নেই। প্রকৃতপক্ষে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সহ পূর্ববর্তী আইপিসি, সিআরপিসি এবং এভিডেন্স অ্যাক্টের বেশিরভাগ বিধানই বহাল রাখা হয়েছে।

ন্যায়বিচার শব্দটি অনুপস্থিত এবং হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা

আদালতের সংজ্ঞার ধারা যা পূর্ববর্তী বিধিতে ন্যায় বিচারের আদালত হিসাবে অভিহিত করা হয়েছিল, এখন তাকে কেবল আদালত হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে, যদিও এর পরবর্তী অংশে আদালতের সংজ্ঞা বহাল রাখা হয়েছে। যদিও আইনবিধির ভিতরের অংশগুলি ইংরেজিতে রয়েছে, কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিধিগুলির নামকরণ করা হয়েছে সংস্কৃত মিশ্রিত হিন্দিতে, যা অহিন্দিভাষী অংশের মানুষেরা তাদের ওপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে আপত্তি জানিয়েছেন। মিডিয়া রিপোর্ট অনুসারে মাদ্রাজ হাইকোর্টের একজন বিচারক বলেছেন যে, তাঁর আদালতে শুধুমাত্র পূর্বের ইংরেজি নামগুলিই ব্যবহার করা হবে।

কর্পোরেট স্বার্থের অপরাধ আর অপরাধ নয়, কিন্তু বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অপরাধ

একই সময়ে প্রণীত জন বিশ্বাস আইন ২০২৩-এর মাধ্যমে বিজেপি সরকার ৪২টি কেন্দ্রীয় ও রাজ্য আইনের অধীনে ১৯টি মন্ত্রক ও বিভাগ সম্পর্কিত ১৮২টি অপরাধকে আর অপরাধমূলক নয় বলে ঘোষণা করেছে। একইসাথে ড্রাগস অ্যান্ড কসমেটিকস অ্যাক্ট, ১৯৪০-কে সংশোধন করে ওষুধের উৎপাদন, বিতরণ এবং বিক্রয় সম্পর্কিত অপরাধকে ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে আর গণ্য (decriminalise) করা হবে না। কিন্তু এমন সব ফৌজদারি আইন নতুন করে প্রণয়ন করা হয়েছে, যাতে শ্রমজীবী জনগণ ও সাধারণ জনগণের বিক্ষোভ, অনশন, ঘেরাও এবং তাদের ন্যায়বিচারের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায়। যে কোনও আন্দোলন যা রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবেও সংগঠিত হতে পারে, ঘৃণ্য অপরাধ এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমের মধ্যে সেগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। BNS-এর ১১৩ নং ধারাটি হুবহু ইউএপিএ আইনের আওতায় সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের সংজ্ঞাটি থেকে টুকে দেওয়া হয়েছে। ১৫২নং ধারাটি পরিবর্তিত নামকরণ (হিন্দিতে রাজদ্রোহ থেকে দেশদ্রোহ) সহ IPC-এর মতো রাষ্ট্রদ্রোহের বিধানগুলি বজায় রাখা হয়েছে এবং সেখানেও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের কঠোর শাস্তির সংস্থানই রাখা হয়েছে।

কমিউনিটি সার্ভিস-নিঃসঙ্গ কারাবাস-ধর্ম শব্দটি বাদ দেওয়া-পরিচিতি দমন করা

BNS-এর ২৩নং ধারায় শাস্তিদানের ক্ষেত্রে কমিউনিটি সার্ভিস বা সমাজসেবামূলক কাজের উল্লেখ থাকলেও, তার কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। গোটা বিষয়টাই বিচারকের নিজস্ব বিচক্ষণতার উপর নির্ভরশীল। BNS-এর ১১ নং ধারায় নিঃসঙ্গ কারাবাসের বিধান রয়েছে। BNS-এর ধারা ১০৩(২) ও ১১৭(৪) অনুসারে “জাতি, বর্ণ বা সম্প্রদায়, লিঙ্গ, জন্মস্থান, ভাষার ভিত্তিতে পাঁচ বা ততোধিক ব্যক্তির একটি দল দ্বারা হত্যার দিকে পরিচালিত করা এবং গুরুতর আঘাত করা” কর্মকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করা হয়েছে। ‘মব লিঞ্চিং’ শব্দটিকে বিশেষ অপরাধ হিসাবে উল্লেখ না করে, ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা অন্য কোনও অনুরূপ ভিত্তির ওপর নির্ভর করে একটি পৃথক ধারা যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্যণীয়ভাবে ধর্ম শব্দটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, অথচ বাস্তবে ধর্মের ভিত্তিতে ‘মব লিঞ্চিং’বা বিদ্বেষপূর্ণ হত্যার ঘটনা বেড়েছে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে বিজেপি সরকারের অভিপ্রায় অনুসারে সংসদে প্রস্তাবিত আসল বিলটিতে হত্যার জন্য নির্ধারিত শাস্তির চেয়ে লঘু শাস্তির বিধান ছিল, যদিও চূড়ান্ত আইনে হত্যার জন্য নির্ধারিত শাস্তির বিধান যুক্ত করেই সংশোধন করা হয়েছে, তবে ধর্ম শব্দটি বাদ দিয়ে। BNS-এর ৬৯নং ধারায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে ‘প্রতারণামূলক উপায়ে’ বিয়ে করার প্রতিশ্রুতিকে অপরাধ গণ্য করে নতুন আইন। তার মধ্যে ‘পরিচয় গোপন রেখে বিয়ে করা’-কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা আসলে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলিকে ‘লাভ জিহাদ’ তত্ত্বকেই স্বীকৃতি দেয়। ফলে ভিন্ন ধর্ম বা ভিন্ন জাতির মধ্যে বিয়ে যারা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বিদ্বেষমূলক অপরাধ আরও বৃদ্ধি পাবে।

হাতকড়া-পুলিশ হেপাজত-অভিযোগ নথিভুক্ত করা- বিচার না পাওয়া

পূর্বের আইনে সূর্যাস্তের পরে মহিলাদের গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক শর্তগুলিকে বর্তমান আইনে শিথিল করা হয়েছে এবং মহিলা পুলিশ দিয়ে যে কোনও সময়ে তাঁদের গ্রেপ্তারের বিধান চালু হয়েছে। শুধুমাত্র কুখ্যাত অপরাধীদের এবং গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের হাতকড়া পরানোর যে নির্দেশিকা সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল, তাকে অগ্রাহ্য করে ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা বা BNSS-এর ধারা ৪৩(৩) অনুযায়ী প্রত্যেক অভিযুক্তকে হাতকড়া পরানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। BNSS এর ১৮৭ নং ধারা অনুযায়ী ১৫ দিনের পুলিশ হেপাজতের সংস্থান বাড়িয়ে ৬০ বা ৯০ দিন করা হয়েছে। নয়া বিধানগুলিতে চার্জশিট দাখিলের জন্য সর্বোচ্চ সময়সীমা ৯০ দিন থেকে বাড়িয়ে ১৮০ দিন করা হয়েছে, যা অতীতে কেবলমাত্র সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের অভিযোগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। এখন সাধারণ অপরাধের ক্ষেত্রগুলিতেও তা প্রসারিত করা হলো। BNSS এর ১৭২নং ধারা পুলিশকে যে কোনও ব্যক্তিকে আটক করার অনুমোদন দিয়েছে, গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে যে সুরক্ষাবিধি থাকার কথা তা এখানে প্রযোজ্য হবে না, কারণ এটি গ্রেপ্তার বলে গণ্য হয় না। ১৭৩ নং ধারা অনুসারে পুলিশকে প্রাথমিক তদন্ত করার এবং ৩ থেকে ৭ বছরের শাস্তিযোগ্য অপরাধের অভিযোগ সংক্রান্ত এফআইআর নথিভুক্ত করার আগে প্রাথমিক তদন্ত করার এবং একটি আদৌ গ্রহণযোগ্য অপরাধ কিনা তা নির্ধারণ করার একটি সুযোগ পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে পুলিশকে মরজিমাফিক চলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে এবং এর ফলে অনেক অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি পাবে, কারণ অভিযোগ নথিভুক্ত করতে (এফআইআর) অস্বীকার করার সুযোগ পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। BNSS-এর ৩৭ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতিটি থানা ও জেলার পুলিশ সদর দপ্তরে গ্রেপ্তার হওয়া আসামীদের নাম, ঠিকানা এবং অপরাধের প্রকৃতির বিবরণ ছেপে ও ডিজিটালভাবে প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করতে হবে। এটা আসলে বিচারের আগে এবং আইনানুসারে দোষী সব্যস্ত হওয়ার আগেই নির্দোষ অভিযুক্তদের অপরাধী হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া হবে, যা মানবাধিকার বিরোধী। BNSS-এর ৩৫৬ ধারায় বিচারের অধিকার রদ করার সুযোগ রয়েছে এবং আসামীর অনুপস্থিতিতে আদালতকে বিচার চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এক অভিযুক্ত ব্যক্তি শারীরিকভাবে উপস্থিত, আবার অন্য একজন অভিযুক্ত বিচার এড়াতে পালিয়ে গেলেও, তার বিচার চালানো যাবে। শুধু তাই নয়, দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই অভিযুক্তের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যাবে। ফলে সম্পূর্ণ বিচারের প্রক্রিয়ার মধ্যে অবাধ ও সুষ্ঠু বিচারের অধিকার খর্ব করা হয়েছে। ৪৭৯ ধারা অনুসারে বিচারাধীন বন্দির জামিনের সময়সীমা এক তৃতীয়াংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। নয়া আইনে ব্যক্তিগত অভিযোগ থেকে সরকারি কর্মচারীদের যে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে, তা সরকারি পর্যায়ে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হতে পারে।

দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত নিরপরাধ-এই মৌলিক নীতির লঙ্ঘন

দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত নিরপরাধ, এই অনুমান, যেটা ভারতীয় ফৌজদারি বিচারের মূল ভিত্তি, যা আদালতগুলিও বারবার সমর্থন করেছে, যা ফৌজদারি আইনশাস্ত্রের ভিত্তি; নতুন তিনটি ফৌজদারি আইন সেই মৌলিক নীতিকেই দুর্বল করেছে। ২০২৪ সালের ১ জুলাই এবং তার পরে সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে এই আইনগুলি প্রযোজ্য হওয়ার পরেও, ৩.৪ কোটি ফৌজদারি মামলা যা নিম্ন আদালতে বিচারাধীন এবং ৬৬% বিচারাধীন বন্দিদের বিচার পূর্বের ফৌজদারি আইনের ভিত্তিতেই হবে। যার অর্থ বিচারের দুটি ভিন্ন বিচারব্যবস্থা আদালতে সমান্তরালভাবে পরিচালিত হবে, যা অবশ্যই দুটি ভিন্ন মৌলিক এবং পদ্ধতিগত আইনের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে এবং আগামী বেশ কিছু বছরের জন্য এই ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে। এই বিচিত্র পরিস্থিতি তৈরি করেছে বিজেপি সরকারের এই আইনগুলি এনে।

মুছে ফেলা-বর্জন-অন্তর্ভুক্তি এবং বিবেচনা ক্ষমতা

সবমিলিয়ে সুবিধাজনক ভাবে শব্দ মুছে দেওয়া, শব্দের রদবদল, আরও নতুন দমনমূলক ধারা যোগ করা হয়েছে। যেমন রাজদ্রোহের (sedition) এর বদলে দেশদ্রোহ বলা এবং আরও বেশি দমনমূলক ধারা যোগ করা, ন্যায়বিচারের আদালতের বদলে শুধুমাত্র আদালত বলা, কায়দা করে লাভ জিহাদের মতো বিতর্কিত বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি, হিন্দি শব্দের অত্যধিক প্রয়োগ, ধর্না-অনশন এর মতো প্রতিবাদের পদ্ধতিকে অপরাধমূলক তকমা দেওয়া (criminal act) ইত্যাদি পরিবর্তন করার এই গোটা প্রক্রিয়াটাই আসলে কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্যে থাকা বিজেপি’র সরকার ও আরএসএসের হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান পরিকল্পনারই অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিজেপি শাসনে দেশের সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা হলো, ক্রমবর্ধমান গণপিটুনি ও হত্যা, লাভ জিহাদ এর অভিযোগ, গোরক্ষা বাহিনীর তাণ্ডব, সম্মানের নামে হত্যা এইসব। অন্যদিকে ইউএপিএ-এর অধীনে জামিন ছাড়াই জেলবন্দি ফাদার স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু হয়েছে, আনন্দ তেলতুম্বে সহ বহু নাগরিক অধিকার সুরক্ষাকর্মীরা বছরের পর বছর ধরে জেলবন্দি। ইউএপিএ একটি বিশেষ আইন ছিল, তাতেই এই ধরনের দমণমূলক আগ্রাসন চালানো হয়েছে। এখন একই বিধানগুলি সাধারণ অপরাধের আইনবিধিতে আনা হলে সেটার ভয়াবহতা সহজেই অনুমেয়।

নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির সাথে সাযুজ্য রেখে উপরিকাঠামোকে ধ্বংস করা

নরেন্দ্র মোদী সহ সব বিজেপি নেতারা দাবি করেছিলেন সাধারণ নির্বাচনে ৪০০ আসন চাই। এই আবেদনের মধ্য দিয়ে আসলে বিজেপি এবং তার পরামর্শদাতা আরএসএস-এর আসল উদ্দেশ্য পূরণ অর্থাৎ সংবিধান পরিবর্তন করার জন্যই ৪০০ আসন চেয়েছিল। কোনও সামগ্রিক ও বিস্তারিত আলোচনা ছাড়াই ফৌজদারি আইনের এই ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনগুলি আনা হলো তাড়াহুড়ো করে। এর থেকেই আরএসএস-বিজেপি’র প্রকৃত মনোভাব স্পষ্ট হয়ে যায়। এটাও স্পষ্ট, যে উদ্দেশ্য নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যে বিজেপি সরকারের নীতি ও ক্রিয়াকলাপগুলি পরিচালিত হচ্ছিল তা ছিল নয়া উদারনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং সেই নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে জনগণের যে কোনও প্রকারের প্রতিরোধ, বিরোধিতা বা লড়াই সংগ্রামকে দমন করা। এই উদ্দেশ্য সাধনে তারা ফ্যাসিবাদী আরএসএস ও তার শাখা সংগঠনগুলোর বিভেদমূলক নকশাকেই প্রয়োগ করেছে ঘৃণার বিষ ছড়িয়ে মানুষের ঐক্যকে ভাঙতে। তারা নিজেদের ইচ্ছামত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পুনর্গঠনকে আরও এগিয়ে নিতে এবং নয়া উদারনৈতিক অর্থনৈতিক ভিত্তির সাথে সাযুজ্য রেখে সমাজের কাঠামোকে আক্রমণ করে ধ্বংস করতে সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্তৃত্ববাদের প্রতিটি উপায়কে কাজে লাগিয়েছে।

রায় দান হবে কিন্তু ন্যায়বিচার হবে না

বিজেপির পরিকল্পনা অনুসারে দেশের ফৌজদারি আইনশাস্ত্রের (Jurisprudence) মৌলিক এবং পদ্ধতিগত ফৌজদারি আইনগুলিতে যে পরিবর্তনগুলি আনা হয়েছে, তা শুধুমাত্র রায় দানের জন্য, কিন্তু ন্যায়বিচারের উদ্দেশ্য নয়। ঠিক যেমনটা বাবরি মসজিদ মামলার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের রাযদান সম্পর্কে সিপিআই(এম) সঠিকভাবেই বলেছিল— রায় দান হলো কিন্তু ন্যায় বিচার হলো না।

কর্পোরেট সাম্প্রদায়িক আঁতাতের স্বার্থে সাংবিধানিক লক্ষ্যকে খর্ব করা

আইনবিধির পরিবর্তনগুলিকে আমাদের দেশের সংবিধানের মূল উদ্দেশ্যের নিরীখেই পর্যালোচনা করা উচিত। সংবিধানের উদ্দেশ্য হলো, দেশের সকল নাগরিকের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা; চিন্তা, মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, আস্থা এবং উপাসনার স্বাধীনতা; মর্যাদা এবং সুযোগের সমতা এবং ব্যক্তির মর্যাদা সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্বের বিস্তার।

সংবিধানের এই মূল উদ্দেশ্যের আলোকে এই তিনটি ফৌজদারি আইনবিধি দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, এগুলি নয়া উদারবাদী শাসনের অধীনে জনগণের অধিকারের ওপর আক্রমণ নামানোর জন্য ব্যবহৃত হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্তৃত্ববাদের অধীনে পুলিশ রাজ প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে ক্রমাগত ফ্যাসিবাদী প্রবণতাকেই সক্রিয় করবে। সামগ্রিকভাবে শাসন ব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িক কর্পোরেট আঁতাতের মাধ্যমে বর্তমান শাসক শ্রেণির আধিপত্যকে আরও দৃঢ় করতে আইনশাস্ত্রের মূল উদ্দেশ্যগুলিকে ধ্বংস করাই এই আইনগুলির মূল লক্ষ্য।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন