গীতা, গ্রন্থ সাহিব নয়।
ফাঁসির ঠিক আগে তিনি পড়ছিলেন লেনিন। ক্লারা জেটকিনের লেখা ভ্লাদিমির লেনিনের স্মৃতিকথা।
তবে কি ভগৎ সিংয়ের দেশপ্রেমে খামতি ছিল?
‘বধিরকে শোনাতে’ আজকের সংসদ, সেদিনের সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলিতে ভগৎ সিং আর বটুকেশ্বর দত্ত যখন নির্বিষ বোমা ছুড়েছিলেন, তখন একইসঙ্গে ছড়িয়েছিলেন প্রচারপত্র। আর সেই প্রচারপত্রে ছিল ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’ স্লোগান।
বন্দে মাতরম্ থেকে ইনকিলাব জিন্দাবাদ।
তাহলে কি দক্ষিণ এশিয়ার ‘চে গুয়েভারা’ দেশপ্রেমিক ছিলেন না?
নাহলে কেন ‘স্বদেশী’ বন্দে মাতরম্ ছেড়ে ‘বিদেশী’ ইনকিলাব জিন্দাবাদ?
বন্দে মাতরম্ তখন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্লোগান। ক্ষুদিরাম বসুসহ বিপ্লবীরা ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি তুলে যাচ্ছেন ফাঁসির মঞ্চে। বিনয় চৌধুরী, সরোজ মুখার্জিরা বর্ধমানের রাস্তায় বন্দে মাতরম্ ধ্বনি তুলে যাচ্ছেন জেলে। দমদম জেলে বঙ্কিম মুখার্জির সঙ্গে আনন্দমঠ নাট্যানুষ্ঠান করছেন।
এদিকে শুরু হয়েছে বিতর্ক। মুসলিমরা বললেন এতে হিন্দু মূর্তি পূজার সপক্ষে প্রচার রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সুভাষ চন্দ্র বসু ও কংগ্রেসের সভাপতি জওহরলাল নেহরু দু’জনেই চাইলেন রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর অভিমত জানিয়ে চিঠিতে লিখলেন: ‘বন্দে মাতরম্ গানের কেন্দ্রস্থলে আছে দুর্গার স্তব। একথা এতই সুস্পষ্ট যে এনিয়ে তর্ক চলে না। অবশ্য বঙ্কিম এই গানে বাংলাদেশের সঙ্গে দুর্গাকে একাত্ম করে দেখিয়েছেন, কিন্তু স্বদেশের এই দশভূজা-মূর্তিরূপের যে পূজা সে কোনো মুসলমান স্বীকার করে নিতে পারে না।… আনন্দমঠ উপন্যাসটি সাহিত্যের বই, তার মধ্যে এই গানের সুসংগতি আছে। কিন্তু যে রাষ্ট্রসভা ভারতবর্ষের সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের মিলনক্ষেত্র সেখানে এ গান সর্বজনীনভাবে সংগত হতেই পারে না।’
শেষ পর্যন্ত ১৯৩৭ সালে কবিগুরুর পরামর্শ মেনেই গোটা গানটি নয়, প্রথম দু’টি স্তবক জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে গাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বলা হয়, যার ইচ্ছা সে উঠে দাঁড়াবে, গাইবে। যার ইচ্ছা নয়, গাইবে না।
২.
আসলে ‘দেশপ্রেম’ আর ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দ দু’টিকে সাধারণভাবে সমার্থক মনে হলেও, মোটেই এক নয়।
আবার দেশপ্রেম আর ‘দেশভক্তি’এক নয়।
‘প্রেমে’র মধ্যে থাকে দ্বন্দ্ব-বিরোধ। অন্যদিকে, ‘ভক্তির’ মধ্যে থাকে নিঃশর্ত আনুগত্য, প্রশ্নহীন সমর্পণ। আমরা প্রেমের পক্ষে। ভক্তিতে নেই।
একজন দেশপ্রেমিক ভালোবাসেন দেশকে। কিন্তু তাকে ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে দেখেন না।
এখন ভারত পাকিস্তানের ক্রিকেট আর খেলা থাকে না। যেন যুদ্ধ। ভারত হারলে, টিম-ইন্ডিয়া যেন যুদ্ধে হেরে রণাঙ্গন থেকে ফেরে। কে বলবে খেলায় জয়-পরাজয় আছে। অথচ, এই সহজ সত্য চাপা পড়ে যায় আহত রক্তাক্ত জাতীয়তাবাদের আস্ফালনে।
আগেও খেলা ছিল। জয়ের আনন্দ ছিল। পরাজয়ে বেদনা ছিল। কিন্তু কখনও তা জাতিগত ব্যর্থতার পরিচয় হয়ে ওঠেনি। সুনীল গাভাস্কার, কপিলদেবের মতোই ইমরান, আক্রমরা ছিলেন ‘হিরো’।
এখন পাকিস্তান হারলে অমিত শাহের টুইট: আরেকটি সফল ‘স্ট্রাইক’, টিম-ইন্ডিয়াকে অভিনন্দন। ইঙ্গিত সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের দিকে। সোস্যাল মিডিয়াতে প্রচার: ভারত হারলে কাশ্মীরে বাজি পোড়ে, কাশ্মীরে ওড়ে পাকিস্তানের পতাকা। পুলওয়ামার পরে ভারতীয় ক্রিকেটাররা প্র্যাক্টিসে নামেন সেনা-টুপি পরে। বিশ্বকাপের একটি ম্যাচে ধোনির দস্তানায় শোভা পায় সেনার চিহ্ন।
দেশপ্রেমকে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার চেষ্টা আজ প্রথম নয়। বহুদিন থেকেই। তবে আজ তা এসে ঠেকেছে সামরিকআস্মিতায়।
এক বিদঘুটে জাতীয়তাবাদ। দেশপ্রেমের জিগির তুলে ক্ষমতা দখলের রাজনীতিই মুখ্য উদ্দেশ্য। পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা মানে আরেকটা কার্গিল, বালাকোট।
ক্রিকেট বোল্ড বাই সামরিক জাতীয়তাবাদ।
৩.
যে কারো কাছেই দেশপ্রেম এক মহৎ গুণ। পরম গর্ব আর অহংকারের বিষয়। দেশপ্রেমে নিবেদন থাকে। থাকে না অন্যের প্রতি বিদ্বেষ কিংবা হিংসা।
বিপরীতে, জাতীয়তাবাদ হিংসা ও বিদ্বেষের জন্ম দেয়। নিজেকে ‘শ্রেষ্ঠ’ প্রমান করতে গিয়ে অন্যকে অবজ্ঞা করতে শেখায়। ঘরের মধ্যেই খোঁজে শত্রু। এনিমি ইনসাইড। শত্রু ভিতরে।
নিজের দেশ, তার জনগণের প্রতি ভালোবাসাই দেশপ্রেম। একজন দেশপ্রেমিক মানুষের স্বার্থ ও চিন্তার পরিসর কখনও সংকীর্ণ ব্যক্তিসত্তার পরিধির মধ্যে বন্দি থাকে না। ব্যক্তি ও পরিবারের গণ্ডি ছাপিয়ে সে দেশ ও দেশবাসীর স্বার্থ ও সত্তার সঙ্গে নিজেকে একাকার করে ফেলে। এই গ্রহে তিনি তখন আর ‘একক’ একজন থাকেন না। হয়ে ওঠেন সমষ্টির একজন। সমষ্টির বোধ তাকে স্বাভাবিক ধারায় পৌছে দেয় বিশ্ব মানবতার চেতনায়।
সেকারণে তাঁর দেশপ্রেম কখনোই অন্য আরেক দেশ ও জাতির মানুষের দেশপ্রেমের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে না। বরং হয়ে ওঠে একে অপরের পরিপূরক।
৪.
প্রকৃত দেশপ্রেমিকের কাছে স্বদেশ ও স্বজাতি হয়ে ওঠে বিশ্বলোকের মহামানবের একটি অংশ।
যেমন বলেছেন চীনের বিশিষ্ট কমিউনিস্ট তাত্ত্বিক লিউ শাও চি।
‘প্রকৃত দেশপ্রেম মানে, কারো কাছে তাঁর নিজের পিতৃভূমি, তাঁর জনগণ, ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও অনিন্দ্যসুন্দর পরম্পরা, যার নেপথ্যে রয়েছে হাজারো বছর এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মাতরের ঐতিহাসিক অগ্রগতির প্রতি এক ঐকান্তিক ভালোবাসা।’
একইসঙ্গে লিউ শাও চি যোগ করেছেন, ‘এই দেশপ্রেমের সঙ্গে আর যাই হোক আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর এবং অন্য দেশ-বিরোধী বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের কোনও সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক নেই স্বাতন্ত্রবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, প্রাদেশিকতার সংকীর্ণমনা জাতীয়তার সঙ্গে।’
দেশপ্রেম আর জাতীয়তাবাদ যে দু’টি পরস্পরবিরোধী ধারণা তা আরও স্পষ্ট করে বলেছেন ব্রিটিশ লেখক ও মানবতাবাদী জর্জ অরওয়েল। তাঁর ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত ‘নোটস অন ন্যাশনালিজম’ শীর্ষক নিবন্ধে।
‘জাতীয়তাবাদকে দেশপ্রেমের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা মোটেই উচিত নয়। সাধারণত, এই শব্দ দু’টিকে খুবই আলগাভাবে ব্যবহার করা হয়। ফলে শব্দদু’টির যে কোনও সংজ্ঞারই বিরোধিতা করা যায়। কিন্তু, এই দু’টির মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য করা দরকার। কারণ, শব্দদু’টির সঙ্গে দু’টি পৃথক ও পরস্পরবিরোধী ধারণা জড়িয়ে আছে। ‘দেশপ্রেম’ বলতে আমি বোঝাতে চাইছি, কোনও বিশেষ জায়গা ও বিশেষ ধরনের জীবনযাপনের প্রতি একনিষ্ঠতা। যে জায়গায় জীবনযাপনের পদ্ধতিকে কেউ পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করেন। কিন্তু অন্য কারো উপর তা চাপিয়ে দেন না। …অন্যদিকে, ‘জাতীয়তাবাদ’ আর ক্ষমতার আকাঙ্খা অবিচ্ছেদ্য। প্রত্যেক জাতীয়তাবাদের উদ্দেশ্য হলো আরও বেশি শক্তি ও আরও বেশি সম্মান নিশ্চিত করা। তবে নিজের জন্য নয়। বরং, সেই জাতির জন্য, অথবা অন্য কোনও কাঠামোর মধ্যে, যেখানে তিনি নিজের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যকে ডুবিয়ে দিতে চেয়েছেন, তার জন্য।’
৫.
এবং এই দেশপ্রেমের সঙ্গে প্রলেতারিয় আন্তর্জাতিকতাবাদের কোনও বিরোধ নেই।
ব্যাখ্যা করেছেন লিউ শাও চি: এটা স্পষ্ট যে সমস্ত দেশের জনগণের সঙ্গে প্রলেতারিয় আন্তর্জাতিকতাবাদের কোনও বিরোধ নেই, বরং একে-অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।
‘একজন কমিউনিস্ট যিনি একজন আন্তর্জাতিকতাবাদী, একইসময়েই কি আবার দেশপ্রেমিকও হতে পারেন?’
প্রশ্ন তুলে মাও নিজেই তার জবাব দিয়েছেন: ‘আমরা মনে করি, তিনি শুধু হতেই পারেন না, তাঁর হওয়া উচিত।’ জাপান-বিরোধীযুদ্ধের সময় যেমন মাও লিখেছেন: ‘আমাদের জন্য, দেশপ্রেম ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত আন্তর্জাতিকতাবাদের সঙ্গে। আমাদের স্লোগান— লড়াই করো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, রক্ষা করো আমাদের পিতৃভূমিকে।’
৬.
তাহলে, কারা দেশদ্রোহী? কারা দেশপ্রেমিক?
সাভারকার, বাজপেয়ীর মতো যাঁরা মুচলেকা দিয়েছিলেন, যাঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ধরিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁরা দেশপ্রিমক?
না কি ভগৎ সিং, লক্ষী সায়গলরা দেশপ্রেমিক?
স্বাধীনতা সংগ্রামে যাদের ন্যূনতম কোনও অবদান নেই, উলটে ব্রিটিশরাজকে সহযোগিতা করেছে— তারা দেশপ্রেমিক?
না কি ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন, কল্পনা দত্তরা দেশপ্রেমিক?
যে সঙ্ঘ পরিবার ব্রিটিশ শাসকদের দালালি করেছে, তারা দেশপ্রেমিক?
না কি যে মুসলিমরা ব্রিটিশ জমানার বিরোধিতা করেছেন, রক্ত ঝরিয়েছেন, তাঁরা দেশপ্রেমিক?
দেশের সরকারি কলকারখানা যারা জলের দরে বিদেশীদের হাতে তুলে দিচ্ছে, জল-জঙ্গল-খনির অবাধ লুটের সুযোগ করে দিচ্ছে, তারা দেশদ্রোহী নয় তো কারা দেশদ্রোহী?
যারা বিপুল অঙ্কের করের টাকা গায়েব করে দিচ্ছে, যারা কালোটাকা লুকিয়ে রেখে পিঠটান দিচ্ছে, তারা জাতীয়তা-বিরোধী নয়তো, কে জাতীয়তা-বিরোধী?
৭.
হিন্দুত্বের এই জাতীয়তাবাদে রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী তো রীতিমতো ‘দেশদ্রোহী’! নিশ্চিত জেলে যেতেন, অথবা নির্বাসন।
যে দেশে লেখা হয়েছিল ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’, সে দেশের এক বিরাট অংশের মানুষকে না কি এখন চলতে হবে ফতোয়া মেনে, ‘নত শিরে’।
ঘরে বাইরে উপন্যাসে নিখিলেশ এক জায়গায় বলছেন, ‘দেশকে সাদা ভাবে দেশ বলে জেনে যারা সেবা করতে উৎসাহ পায় না, চিৎকার করে মা মা বলে, দেবী বলে মন্ত্র পড়ে, তাদের সেই ভালোবাসা দেশের প্রতি তেমন নয়, যতটা নেশার প্রতি।’
কিংবা বিমলার আত্মকথনে স্বামী নিখিলেশের যে মনোভাব রবীন্দ্রনাথ ব্যক্ত করেছেন: ‘তিনি (নিখিলেশ) বলতেন, দেশকে আমি সেবা করতে রাজি আছি, কিন্তু বন্দনা করব যাঁকে তিনি ওর চেয়ে অনেক উপরে। দেশকে যদি বন্দনা করি তবে দেশের সর্বনাশ হবে।’
রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেম হলো তাঁর মানবতাবাদ। সব ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের মানুষকে অকৃত্রিম ভালোবাসা। পক্ষান্তরে এই পৃথিবীর সকল মানুষকে ভালোবাসা।
আমরা তাই দেশপ্রেমিক। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিকতাবাদী।
‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া
বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া।’