পর্ব - ১
তখন সন্ধ্যা ৮টা বেজে গেছে। সূর্য্য ডুবেছে, কিন্তু শেষ আলোর ছটায় তখন শিকাগো শহরের নীল আকাশের রঙ পাল্টে লাল হয়ে যাচ্ছে। আলো আঁধারির মাঝে হিমেল হাওয়ায় সারি সারি কালো মাথা দাঁড়িয়ে। একটা গাড়ির উপরে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছেন জর্জ এঞ্জেলস। পেটানো চেহারা কিন্তু আজ খানিকটা ক্লান্ত লাগছে তাঁকে। সূর্য্য তাঁর পেছনে ডুবেছে, আলো-আঁধারিতে তাই মুখটা অস্পষ্ট। কিন্তু এই কন্ঠস্বরকে খুব ভালো চেনে শিকাগোর এই মানুষগুলো। খানিকটা দূরেই ম্যাককরমিক রিপার কারখানার গেটে একটা জটলা। ৮ঘন্টা কাজের দাবীতে ১৮৮৬ সালের ১লা মে থেকে শুরু হয়েছে ধর্মঘট আমেরিকা জুড়ে। তারই সমর্থনে চলছিল এই সভা। হঠাৎই পুলিশ এল ঘোড়া ছুটিয়ে। সভা বন্ধ করার হুকুম জারি হল। ভাষণ থামিয়ে এঞ্জেলস নেমে এলেন। পুলিশকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন - সভা তো শান্তিপূর্ণ ভাবেই চলছে, কোনও অসুবিধা তো কারোরই হচ্ছে না। ততক্ষণে আর এক শ্রমিক নেতা এ্যালবার্ট পারসনস গাড়ির উপরে উঠে বক্তৃতা শুরু করেছেন। কিন্তু পুলিশের হুকুম - বন্ধ করতেই হবে সভা। এরই মাঝে রিপার কারখানার গেটের মুখে হঠাৎই পুলিশের হামলা শুরু হল, গুলিও চললো। তারপরেই হঠাৎই বোমা বিস্ফোরণ। কেউ পুলিশের দিকে বোমা ছুঁড়েছে। শুরু হয়ে গেল নির্বিচার গুলি বর্ষণ। চলল লাঠি। নিরস্ত্র অসহায় শ্রমিকরা প্রাণ বাঁচাতে ছুটলো। গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়ল অনেকে। ঘোড়ার পায়ের তলায় পিষ্ট, লাঠির আঘাতে রক্তাক্ত মানুষ। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে, আর ভীড় থেকে শুধুই গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসছে। নিজের দপ্তরে ফিরে গিয়েই এঞ্জেলস লিখে ফেললেন এই অত্যাচার বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রচার পত্র। সকালের সূর্য্য ওঠার আগেই আবার কারখানার গেটগুলোতে জটলা, ভীড়। একজন কালো একটা ঘোড়ায় চেপে ভীড়গুলোতে ছড়িয়ে দিয়ে গেল সেই প্রচারপত্র - 'লড়াই থামবে না, গড়ে তোল প্রতিরোধ'।বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে
শুরু হল রাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র - সেই কুখ্যাত ‘হে মার্কেট ট্রায়াল’। একে একে ৮জন শ্রমিক নেতাদের গ্রেপ্তার করা হ'ল। অগাস্ট স্পাইস, এ্যডল্ফ ফিশার, এ্যলবার্ট পারসনস, জর্জ এঞ্জেলস, ল্যুই লিঙগ, স্যামুয়েল ফিলডেন, মাইকেল সোয়াব, অস্কার নীব - এই ৮ জনের বিরুদ্ধে ডিনামাইট বোমা ছুঁড়ে পুলিশ কর্তাসহ মোট ৮জন পুলিশকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়। এই অভিযোগ এনে ২৭শে মে পুলিশ এই ৮জনের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে। বিচারের জন্য মোট ৯৮১ জনের ইনটারভিউ নিয়ে গঠিত হয় জ্যুরি বোর্ড এবং আশ্চর্যজনকভাবে যারা হে মার্কেট ঘটনায় শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মত পোষণ করেন, কেবলমাত্র তাদেরই বোর্ডে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং এটা ঘোষণা করেই জ্যুরি বোর্ড গঠন করা হয়। একইভাবে সদ্য গজানো পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত খবরের কাগজগুলোতেও প্রবলভাবে শ্রমিক বিরোধী লেখা প্রকাশিত হতে থাকে, যার বেশিরভাগই ছিল মনগড়া। বিচার শুরু হল ২১শে জুন, ১৮৮৬ এবং শেষ হল ১১ই আগষ্ট, ১৮৮৬। মাত্র ৫১দিনে মামলা শেষ ক’রে প্রত্যাশিতভাবেই এই ৮ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হল এবং ৭জনকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হল। ১১ই নভেম্বর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হল। স্পাইস, ফিশার, এঞ্জেলস, পারসনসকে ফাঁসির দঁড়িতে ঝোলানো হল। ল্যুই লিঙগ আত্মহত্যা করেন আগের রাতে। মাইকেল সোয়াবকে ১০ই নভেম্বরই ফাঁসি দেওয়া হয় এবং নীবকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অভিযুক্তদের আইনজীবীরা প্রশ্ন তুলেছিলেন একসাথে ৭ জন মিলে একটা বোমা কিভাবে ছুঁড়তে পারে? এরা যে বোমা ছুঁড়েছিলেন, তার প্রমাণ কি? পুলিশ অন্য একজনকে গ্রেপ্তার করেছিলো বোমা ছোঁড়ার অভিযোগে, তাঁকে আবার ছেড়েও দেওয়া হ'ল কেন? ৭ জন পুলিশ গুলিতে নিহত এবং সাক্ষ্যে সবাই বলেছে গুলি শুধু পুলিশই চালিয়ে ছিল আত্মরক্ষার্থে। তাহলে আত্মরক্ষার নামে ৭জন পুলিশকে কি পুলিশই গুলি করেছিল? এমন অনেক প্রশ্নের জবাব না দিয়েই, বিচিত্র এই বিচারে অভিযোগ করা হ'ল যে, এরা বোমা ছোঁড়েনি ঠিকই, কিন্তু এরা বিশৃঙখলা তৈরী করার জন্যই ওখানে বোমা ছোঁড়ার সুযোগ পেয়েছিল আততায়ী। আর এদের মধ্যে একজনের বাসস্থানের ডেরা থেকে নাকি একটা ডিনামাইট বোমা পাওয়া যায়, সেটা নাকি হুবহু ৪ই মে ছোঁড়া বোমার মতো। শুধু বোমা ছোঁড়াই নয়, আসলে বিশৃঙখলা তৈরী করে সরকার ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল এই অভিযুক্তরা। জ্যুরি বোর্ডের প্রধান গ্যারি বলেন - জ্যুরি বোর্ডের সবাই যদি সন্দেহাতীতভাবে মনে করেন অভিযুক্তরা দোষী, তাহলে তারা দোষী। যুক্তি-প্রমাণ-সাক্ষ্য এইসব বিচার্য নয়, জ্যুরিদের বিশ্বাসবোধই বিচারের ভিত্তি। আমাদের দেশে সাম্প্রতিক কোনও রায়ের সাথে মিল পাচ্ছেন, পাঠক? এই বিচার প্রক্রিয়ার প্রতিবাদ জানিয়ে, এই অন্যায় বন্ধ করার দাবী উঠেছিল সেই সময়ে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকেই। প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক উইলিয়াম ভিল হ'লওয়েলস, অস্কার ওয়াইল্ড, বার্ণার্ড শ', ফ্রেডরিক এঙ্গেলস প্রমুখ ব্যক্তিরা প্রবল প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এই সাজানো অন্যায় বিচারপ্রক্রিয়ার। পরবর্তীতে ১৮৯৩ সালে ২৬শে জুন খোদ ইলিয়নয় প্রদেশের গভর্নর জন অল্টগেড, হে মার্কেট বিচার প্রক্রিয়াকেই অভিযুক্ত করে বলেন - ঐ মানসিক বিকারগ্রস্ত এবং পক্ষপাতদুষ্ট বিচারকরা একবারের জন্যও খুঁজে দেখলেন না যে, কে বোমা ছুঁড়েছিল! বোমা ছোঁড়ার সাথে এই শ্রমিক নেতাদের কোনও যোগাযোগও প্রমাণ করতে পারে নি পুলিশ বা আদালত।সংবাদমাধ্যম সেদিনও একই চেহারায়
রায় ঘোষণার পরের দিন প্রবল উচ্ছাস ব্যক্ত করেছিল সেই দেশের পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত সব মার্কিন সংবাদমাধ্যম। বলা হয়েছিল এইবার জব্দ হবে শ্রমিকরা, বন্ধ হবে নৈরাজ্য আর বিশৃঙ্খলা। আসলে উচ্ছ্বাস ছিল এই ভেবে যে ৮ঘন্টা কাজের দাবীসহ শ্রমিকদের অন্যান্য দাবীর লড়াই শেষ হয়ে যাবে। ইচ্ছে মতো শ্রমিকদের খাটানো যাবে, ছাঁটাই করা যাবে - এই ভাবনায় আবিষ্ট পুঁজি নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম সেদিনও মানুষের মনকে প্রভাবিত করার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েছিল। ফাঁসির আগে অগাস্ট স্পাইস বলেছিলেন - আজ তোমরা আমাদের কন্ঠ রুদ্ধ করছো, কিন্তু সেইদিন আসবেই যখন আমাদের কথার চাইতেও অনেক বেশী জোরালো হয়ে উঠবে আমাদের নিস্তব্ধতা। এই সৈনিকদের সমাধিফলকে লেখা আছে স্পাইসের এই অমোঘ বাণী। লেখাটি দুটি পর্বে প্রকাশিত...শেয়ার করুন