বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্কটের মূলে রয়েছে একটি নব্য উদারনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে কেবলমাত্র রপ্তানি-র উপর নির্ভর করে জিডিপি বৃদ্ধির কৌশল।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক উত্থান-পতনের কারণ হিসাবে বেশীরভাগ বিশ্লেষণই শেখ হাসিনার সরকারের উচ্ছৃঙ্খলতা এবং কর্তৃত্ববাদের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে! এই ধরণের বিশ্লেষণগুলি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনকে উপেক্ষা করে বা সাধারণভাবে অবমূল্যায়ন করে।
মাত্র কয়েক মাস আগে একটি অর্থনৈতিক ‘অলৌকিক ঘটনা’ হিসাবে সমাদৃত একটি দেশ এখন একটি আর্থিক সংকটে নিমজ্জিত যা হঠাৎ করে বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবনযাত্রার অবস্থাকে আরও খারাপ করেছে। এই অবনতির কারণেই শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি বিদ্বেষ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর জন্য হাসিনা সরকারকে দায়ী করা হয় এবং এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ পায় রাস্তার প্রতিবাদে।
২০২১ সাল পর্যন্ত, বাংলাদেশকে একটি নব্য উদারনীতির মধ্যে রপ্তানি-কেন্দ্রীক বৃদ্ধির সাফল্যের গল্প হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল। এর রপ্তানির প্রায় ৮০% ছিল গার্মেন্টস, এবং এর গার্মেন্টস রপ্তানির বৃদ্ধি এতটাই দ্রুত ছিল যে, এমনকি এটি মনে করা হচ্ছিল যে খুব অল্প সময়ের মধ্যে, বাংলাদেশ বিশ্বের পোশাকের চাহিদার ১০% পূরণ করবে।
ব্রেটন উডস প্রতিষ্ঠানগুলো ‘লক্ষ লক্ষ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে উদ্ধার করে আনার জন্য’ বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করে; এবং এমনকি ২রা এপ্রিল, ২০২৪ এর শেষের দিকে, বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি (মোট দেশীয় পণ্য-র মূল্যমান) বৃদ্ধি হবে ৫.৬%, যেটা যে কোনও মানদণ্ডে একটি দারুণ পরিসংখ্যান!
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটে যখন পোশাক রপ্তানি কোভিড মহামারী দ্বারা প্রভাবিত হয়। যদিও এই অবনতি অস্থায়ী হওয়ারই কথা ছিল (বিশ্বব্যাংকের ২০২৪-২৫ সালের জন্য একটি আশাজাগানো পূর্বাভাসে এমনটাই বলা হয়েছিল)। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্রমাগত স্থবিরতার কারণে এটি আরও স্থায়ী হয়েছে, যেটা আদৌ আশ্চর্যজনক নয়।
একই সময়ে, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশীদের পাঠানো টাকা, যেটা সেই দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার আরেকটি প্রধান উৎস, নিঃসন্দেহে একই কারণে আঘাত হানে। এবং যেহেতু বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আমদানি করা জ্বালানির উপর নির্ভর করে, তাই রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই আমদানি করা জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার একটি মারাত্মক ঘাটতিতে অবদান রেখেছে। এই সমস্ত কারণেই বিদ্যুতের দামের বৃদ্ধি হয়েছে। সব মিলিয়ে এগুলোই সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে।
আরও দুটি কারণ মূল্যস্ফীতির অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে যা আগস্ট মাসে ৯.৫২% এ পৌঁছেছে, যা বিগত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ, কিন্তু এখনও অনেকে এই সংখ্যাকে কম করে দেখনো হয়েছে বলে মনে করেন। প্রথমটি হল ডলারের বিপরীতে বিনিময় হারের অবমূল্যায়ন, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতি বিরোধী পদক্ষেপের অংশ হিসাবে সুদের হার বৃদ্ধির কারণে ডলারের শক্তিশালী হওয়ার ঘটনা। বাংলাদেশ তার অ্যাকাউন্টে বৈদেশিক মুদ্রার সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে।
দ্বিতীয়টি হল ক্রমবর্ধমান ব্যয় সংকোচনের চাপ যেটা একটি নব্য উদারনীতির পথ অনুসরণ করার জন্য বাংলাদেশের সরকার অর্থনীতির ধীরগতির কারণে প্রয়োগ করতে বাধ্য হয়। মনে রাখতে হবে, নব্য উদারনীতি জনগণকে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব থেকে দূরে রাখার যে কোনও প্রচেষ্টাকে বাতিল করে, কারণ মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব থেকে জনগণকে মুক্ত করার যেকোও প্রচেষ্টার জন্য ভর্তুকি বিল বৃদ্ধির প্রয়োজন, আর ভর্তুকি শব্দটি নয়া উদারনীতিতে অবশ্য পরিহার্য্য। রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের বৃদ্ধির ধীরগতি, এর বহুমুখী প্রভাবের সাথে, ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের জন্য দায়ী যা বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। একই সাথে বিশ্বব্যাপী তেলের মূল্য বৃদ্ধি এবং বিনিময় হারের ক্রমাগত অবমূল্যায়নের ফলে যে ব্যয়বৃদ্ধির প্রভাব ফেলেছিল, সেটাও মুদ্রাস্ফীতির ত্বরণের জন্য দায়ী।
মুদ্রাস্ফীতির মুখে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের মাধ্যম হিসেবে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধিও নব্য উদারনীতির প্রেক্ষাপটে একেবারেই প্রশ্নাতীত নয়, কারণ এটি বিদ্যমান রপ্তানি বাজারকে ধরে রাখা আরও কঠিন করে তুলেছে। এবং ন্যূনতম মজুরির এই ধরনের বৃদ্ধি যদি রপ্তানিকে প্রতিকূলভাবে প্রভাবিত করা থেকে এই বৃদ্ধিকে রোধ করার জন্য আরও বিনিময় হারের অবমূল্যায়নের সাথে থাকে, তবে এটি জ্বালানির আমদানিকৃত দাম আরও বাড়িয়ে দিয়ে মুদ্রাস্ফীতি ধাক্কা সমস্যাটিকে আরও জটিল করে তুলবে।
এসবের মাঝে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আই.এম.এফ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের কাছে ঋণের জন্য যোগাযোগ করেছিল, কিন্তু যে ঋণগুলি এটি সুরক্ষিত করেছিল তা ঋণ সেবার বোঝা যোগ করে পরিশোধের ক্ষমতাকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছিল; এমনকি সরকারের সীমিত পরিমাণ জনকল্যাণ নীতি তৈরী করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে কারণ আই.এম.এফ ঐদেশের নীতিগুলি কড়া নজরদারির মধ্যে রাখে। এছাড়া, আই.এম.এফ কর্তৃক আরোপিত “ব্যয় সংকোচন নীতি”, বেকারত্ব পরিস্থিতিকে আরও তীব্র করে তুলেছে।
এমনকি যারা শেখ হাসিনার শাসনের অবসান ঘটানোর জন্য এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য পরিস্থিতি তৈরি করার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সংকটের গুরুত্ব স্বীকার করে তারাও এই অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে প্রধানত তার শাসনের দ্বারা প্রদর্শিত ব্যাপক ‘ক্রোনিজম’-কে দায়ী করে।
একইভাবে, মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরদের জন্য চাকরির ‘সংরক্ষণ’ নীতির বিরোধিতাকে সাধারণত শাসক বিরোধী হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়। কিন্তু যুক্তির এই লাইন, আসল সমস্যাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যায়। বাংলাদেশে বেকারত্ব সংকটের তীব্রতার কারণেই ‘সংরক্ষণের’ বিরোধিতা এতটা প্রকট হয়ে উঠেছে, এবং অর্থনীতির সঙ্কটের মূলে ছিল নিওলিবারাল সেটিং-এর মধ্যে রপ্তানি-নেতৃত্বাধীন বৃদ্ধির কৌশল। সংক্ষেপে, এটা ‘ক্রোনিজম’ নয় বরং অর্থনৈতিক সংকটের মূলে নিহিত কৌশলের ফল মাত্র।
এমনকি যখন এই ধরণের শর্টকাট পদ্ধতি কিছু সময়ের জন্য নাটকীয়ভাবে সফল ফলাফল দেয়। বিশ্ব অর্থনীতির যে কোনো ধীরগতি যা রপ্তানিকে প্রভাবিত করে, বা বাহ্যিক ফ্রন্টে অন্য কোনো প্রতিকূল পরিবেশ অর্থনীতিকে এমন একটি সংকটের দিকে ঠেলে দেয় যা সময়ের সাথে এর সাফল্যের পরিবর্তে অনেক কিছুরই উল্টো ফল ফলতে থাকে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন থেকে যে দুটি অসামান্য পাঠ শিখতে হবে তা হল: - প্রথমত, তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ আকস্মিকতার সাথে ‘সফল’ থেকে ‘ব্যর্থ’ হতে পারে; এবং দ্বিতীয়ত, এটা বাস্তব যে কোনও একটি ফ্রন্টে দেশটি প্রাথমিকভাবে যে অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিল সেটা অন্য আরও কয়েকটি ফ্রন্টে অসুবিধা ডেকে আনতে পারে।
কেউ কেউ বলবেন যে বাংলাদেশের সমস্যাটি তার সমস্ত ডিম এক ঝুড়িতে রাখার মধ্যে নিহিত, কারণ এটি রপ্তানির বৈচিত্র্যময় পণ্যসম্ভারের পরিবর্তে প্রায় একচেটিয়া ভাবে কেবলমাত্র পোশাক রপ্তানির উপর নির্ভর করার ফল।
অন্যরা পরামর্শ দেবেন যে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে তার সাফল্য ব্যবহার করা উচিত ছিল তার অর্থনীতিকে ভার্সাটাইল করার জন্য শিল্পের একটি সম্পূর্ণ পরিসরের বিকাশের মাধ্যম তৈরী করা যা দেশীয় বাজার পূরণ করবে।
এই ধরণের সমালোচনাগুলি অবশ্য একটা মূল বিষয়কে গুরুত্ব দেয় না। একটি নব্য উদারনৈতিক অর্থনীতিতে, রাষ্ট্র বাজারের উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে না ; এটা প্রমাণিত সত্য যে দেশীয় বাজারের কিছুটা সুরক্ষা ছাড়া দেশীয় শিল্পায়নকে উন্নীত করা যায় না। আর এই ধরণের সুরক্ষানীতিকে আন্তর্জাতিক পুঁজি (যে পুঁজির সাহায্য ছাড়া রপ্তানি বৃদ্ধি করা সম্ভবই নয়) দ্বারা কঠোর ভাবেই সমালোচিত করা হয় ।
একইভাবে, কোন বিশেষ রপ্তানি আন্তর্জাতিক বাজারে সফল হবে তা আন্তর্জাতিক পুঁজি দ্বারা নির্ধারিত বিষয়, দেশের রাষ্ট্র নয়। তাই, নব্য উদারনীতিবাদের অধীনে রপ্তানি-নেতৃত্বাধীন বৃদ্ধির ক্ষতির জন্য রাষ্ট্রকে দোষারোপ করা সম্পূর্ণরূপে অযৌক্তিক।
মুহাম্মদ ইউনূস এবং ছাত্রদের উদ্দেশ্য যাই থাকুক না কেন, আওয়ামী লীগকে যদি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না দেওয়া হয়, তাহলে রাজনৈতিক উত্থানের প্রধান সুবিধাভোগী হিসেবে ডানপন্থী দলগুলো আবির্ভূত হবে। বাংলাদেশকে সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় কর্পোরেট কুলীনতন্ত্রের অন্ধকার অধিকারের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে।
এই ঘটনা বিশ্বজুড়ে যে নতুন দৃশ্যপট উদ্ঘাটন করছে, সেটা চিত্রিত করে। বিশ্ব পুঁজিবাদী সঙ্কটের কারণে, নব্য উদারনীতি অনুসরণ করে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশ অর্থনৈতিক স্থবিরতা, তীব্র বেকারত্ব এবং বর্ধমান বৈদেশিক ঋণের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, যা তাদের বিরাজমান কেন্দ্রবাদী শাসনব্যবস্থা তৈরি করতে চলেছে যা সাম্রাজ্যবাদের তুলনায় স্বায়ত্তশাসনের একটি অভূতপুর্ব ভারসাম্য বজায় রাখে, জনপ্রিয় নয় কিন্তু, এরকম ব্যবস্থা সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা সমর্থিত দক্ষিণপন্থী শাসনের জন্য এই কেন্দ্রবাদী শাসনব্যবস্থাগুলিকে পতনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার শর্ত তৈরি করে।
এই নতুন শাসনব্যবস্থাগুলো তাদের পূর্ববর্তী শাসনের চেয়ে কম স্বৈরাচারী হবে না; কিন্তু নিওলিবারেলিজম অনুসরণ করতে গিয়ে এবং সাম্রাজ্যবাদী লাইনকে অনুসরণ করার সময়, তারা ধর্মীয় স্লোগানের মাধ্যমে বা কিছু অসহায় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর (যারা সঅন্য) দ্বারা জনগণের মনোযোগ বিভ্রান্ত করবে। এটি সাম্রাজ্যবাদের “মাথায় যেহেতু আমি জিতেছি, লেজ তুমি হারাবে” ধরণের কৌশল গঠন করে যা নিশ্চিত করে যে নিওলিবারেলিজমের সংকট দ্বারা জনগণের উপর যে দুর্দশা দেখা দিয়েছে তা নব্য উদারবাদকে অগ্রাহ্য করার সাহস করে না, বরং একটি ডানপন্থী বা নব্য-ফ্যাসিবাদী শাসনের অধীনে এর সুসংহতকরণের দিকে নিয়ে যায়। নিওলিবারেলিজমের দুঃস্বপ্ন কে জয় করা কঠিন, এমনকি যখন এর নিপীড়ন স্পষ্ট হয়, তখনও।
নিওলিবারেলিজমকে উচ্ছেদ করার জন্য একটি বিকল্প অর্থনৈতিক কৌশলের স্বপক্ষে জনগণকে সংগঠিত করা প্রয়োজন যা রাষ্ট্রকে একটি বৃহত্তর জনকল্যাণকর ভূমিকা প্রদান করে, দেশীয় বাজারের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এবং খনিজ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের উপর জাতীয় নিয়ন্ত্রণের অধিকার দেয়।
বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ নয়, যে একে একটি নব্য উদারনীতির অধীনে রপ্তানি-নেতৃত্বাধীন বৃদ্ধির কৌশল অনুসরণ করার জন্য চাপ দেওয়া যেতে পারে। ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশকে কোনোভাবেই ‘ছোট’ বলা যায় না। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, একটি বাড়ি-বাজার-ভিত্তিক উন্নয়ন কৌশল অনুসরণ করা সহজ নয়; কিন্তু, তৃতীয় বিশ্ব যে এখন বিশ্ব পুঁজিবাদী সংকটের পরিণতির মুখোমুখি হচ্ছে, তার জন্য অন্য কোনো বিকল্প নেই।