বেশ কিছু দিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়াতে একটা কথা খুব ছড়াচ্ছে - নিপা, করোনা ও বিজেপি এই তিনটে ভাইরাসকেই সফল ভাবে আটকে দিয়েছে কেরালার এলডিএফ সরকার। কিন্তু এখন এইসব বিতর্কিত কথা বলা যাবে না - এটা তো রাজনীতি করার সময় নয় ! তা বলে সঠিক তথ্য দেওয়া যাবে না এটা তো হতে পারে না । করোনা মোকাবিলায় গোটা দেশের মধ্যে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হিসাবে কেরালার কথা তাই বলতেই হয়।
সাড়ে তিন কোটি জনসংখ্যার একটি রাজ্য কেরালা- আয়তন ৩৮৮৬৩ বর্গ কিলোমিটার গোটা দেশের মধ্যে বহরের দিক থেকে উত্তরপ্রদেশ,গুজরাট, মধ্যপ্রদেশের তুলনায় অনেকটাই ছোট।কিন্তু ছোট হলেও জনঘনত্ব অনেকটাই বেশি - ৮৬০/বর্গ কিলোমিটার। ভারতের প্রথম করোনা আক্রান্তের খোঁজ মেলে কেরালাতেই - ৩০ জানুয়ারি। ২০১৮ সালে কেরালা সম্মুখীন হয় শতাব্দীর ভয়াবহতম বন্যার । একের পর এক ধাক্কা সামলে করোনা মোকাবিলাতেও ভারত সহ গোটা দুনিয়ার কাছে ঈর্ষনীয় ও শিক্ষনীয় হয়ে উঠেছে 'কেরালা মডেল' ।
প্রথম নিদর্শন, গোটা দেশ জুড়ে যখন উত্তরোত্তর নতুন করে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে সেখানে কেরালাতে নতুন রোগীর সংখ্যা শুধু মাত্র কমছে না , শূন্য থেকে ৫ এর মধ্যে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ঘোরাফেরা করছে। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে কেরালাতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৩৮৭, সুস্থ হয়েছেন ২১১ জন ও মৃত ৩ ! দেশের প্রথম করোনা আক্রান্তের সন্ধান মিলেছিল যে রাজ্যে , মার্চের মাঝামাঝি অবধি যে রাজ্যে ছিল দেশের মধ্যে সর্বাধিক আক্রান্ত আজ সেই রাজ্যের স্থান দশম !
দ্বিতীয় নিদর্শন, গোটা বিশ্বের কাছে আকর্ষণীয় কেরলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য । প্রত্যাশিত ভাবেই গোটা দুনিয়া থেকে বহু বিদেশি পর্যটক আসেন এই রাজ্যে। করোনার সংক্রমণ তাদের মধ্যেও ছড়ায়। এরকম ৯ জন করোনা আক্রান্ত বিদেশি পর্যটক ইতিমধ্যেই কেরালায় চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ হয়েছেন। তারা ভূয়সী প্রশংসা করেছেন কেরালার চিকিৎসা পদ্ধতির। (1)
তৃতীয় নিদর্শন, থমাস এবং মেরিয়াম্মা ৯৩ এবং ৮৮ বছরের দম্পতি করোনা মুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরলেন। ইতালী থেকে ছেলে আসার পর ওনারা রোগাক্রান্ত হন। এত বয়সে ভালো হয়ে যাওয়াটা একটা রেকর্ড। (2)
আসলে 'কেরালা মডেল' রাতারাতি তৈরি হওয়া কোন ব্যবস্থা নয় পিনারাই বিজয়নের নেতৃত্বে কেরালার এলডিএফ সরকার নিরন্তর পরিকাঠামো উন্নয়ন ঘটিয়ে আজ এই পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। ১৮ জানুয়ারি যখন করোনাভাইরাস নিয়ে হু’র প্রথম সতর্কবার্তা এল, তৎক্ষণাৎ তাকে যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে কেরলের সমস্ত জেলার রোগ-নজরদারি টিমকে তাদের কর্তব্য জানিয়ে দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য পরিষেবায় যুক্ত প্রত্যেককে নজরদারি আর সংক্রমণ-যোগ চিহ্নিত করার কাজে লাগিয়ে দেওয়া হল। তাই চিন থেকে সে সময়ে ছুটিতে বাড়ি আসা প্রায় কয়েকশো মানুষের প্রত্যেককে নিয়মিত নজরে রাখাও সম্ভব হয়েছিল। এয়ারপোর্টেই বিশেষ সুরক্ষা-অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা রাখা হয়। সামান্য জ্বরের লক্ষণ দেখলেই সোজা আইসোলেশনের ব্যবস্থা। কেরল এমন এক রাজ্য যার প্রতিটি জেলায়, প্রত্যন্ত গ্রামেও বিদেশ প্রত্যাগত মানুষ ঘরে ঘরে। সরকারের তৎপরতার ইঙ্গিত পাওয়া যায় স্বাস্থ্য দফতরের ওয়েবসাইটটিতে চোখ বোলালেই । প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তিত সংখ্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব দেওয়া হচ্ছে সেখানে। আটকে পড়া পরিযায়ী এবং অন্য কাজ-হারানো শ্রমিকদের জন্য খাবারের ব্যবস্থার বিস্তারিত হিসেবও নিয়মিত তুলে দেওয়া হচ্ছে।
এই লড়াইয়ের শুরু হয়েছিল 'নিপা'ভাইরাসের সংক্রমণের সময়েই। নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয় ২০১৮ সালে, মূলত কেরলের দুটি জেলায়। আক্রান্ত উনিশ জনের মধ্যে সতেরো জনকেই বাঁচানো যায়নি। কিন্তু সংক্রমণও আর ছড়ায়নি। দ্রুত পরীক্ষার ব্যবস্থা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে রাতারাতি যোগাযোগ করার। নিপার সদ্য আবিষ্কৃত অ্যান্টিবডির সাহায্যে ভাইরাসকে হারানো সম্ভব হয়েছিল। এই কাজ কোন কড়া লকডাউন মডেল করে বাস্তবায়িত হয়নি। হযেছিল মানুষকে বুঝিয়ে, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে লোকশক্তির সমর্থনে । আজকেও কেরালা একই ভাবে সেই লোকশক্তির সমর্থনেই করোনার বিরুদ্ধে সাফল্য অর্জন করছে ।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই কেরালা করে ফেলেছিল ১৩০০০ এর বেশি টেস্ট। ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত ১৫৬৮৩টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়ে গেছে যার মধ্যে ১৪৮২৯টি নমুনা নেগেটিভ এসেছে। ১১২১৮৩ জনকে রাখা হয়েছে নজরদারিতে। বর্তমানে ৭৫১ জন হাসপাতালে ভর্তি। দৈনিক পরীক্ষার সংখ্যা প্রায় ১০০০ এর কাছাকাছি ! গোটা রাজ্য জুড়ে বিস্তার ঘটানো হচ্ছে Walk-In Sample Kiosks এর যেখানে মানুষের লালারসের নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে পরীক্ষার জন্য ।
করোনা মোকাবিলায় শুরুতেই ২০হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করে পিনারাই বিজয়ন সরকার। লকডাউনের ফলে গোটা দেশের নানান প্রান্ত থেকে এসে আটকে পড়া পরিযায়ি শ্রমিকদেরকে আস্বস্ত করে পিনারাই বিজয়ন বলেন এই মানুষগুলো কেরালার কাছে অতিথি শ্রমিক , তাঁদের নিরাপত্তা ও চিকিৎসার দায়িত্ব সরকারের। গত ২৭ মার্চ গোটা কেরালা জুড়ে ১৪৪১৪৫ জন পরিযায়ী শ্রমিকের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে ৪৬০৩ টি ত্রাণ শিবির। গৃহহীনদের জন্য খোলা হয়েছে ৩৫ টি ক্যাম্প, ১৫৪৫ জন মানুষ আপাতত সেখানে আছেন। এই সব কটি ত্রাণ শিবিরে খাবার, মাস্ক ,সাবানের ব্যবস্থা করা হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন জানিয়েছেন , আরো বেশকিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ত্রাণ শিবিরে পরিণত করার কাজ চলছে। দক্ষিণ ভারতে খাবার খেতে অসুবিধা হলে ,উত্তর ভারতের খাবারের ব্যবস্থার ও আশ্বাস দেয়া হয়েছে।পরিযায়ী শ্রমিকদের উদ্দ্যেশে এই বার্তা পৌঁছে দেয়ার জন্য বিভিন্ন ভাষায় তৈরি অডিও ক্লিপ সারা কেরালায়, বৈদ্যুতিন মাধ্যমে ও সোশ্যাল মিডিয়ায় মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
১২৫১ টি কমিউনিটি কিচেন থেকে গোটা রাজ্যে ২৮ লক্ষ মানুষের কাছে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে রান্না করা খাবার। রেশন থেকে দেওয়া হচ্ছে সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী । দুমাসের পেনশন সহ অন্যান্য ভাতা আগাম দেওয়া হয়ে গেছে সরাসরি উপভোক্তাদের ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্টে। বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য জোমাটো সহ বিভিন্ন সংস্থার সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে কেরালা সরকার।
কেন্দ্রের সরকারের থেকে নামমাত্র অর্থ সাহা্য্য পেয়েছে কেরালা সরকার। আছে আর্থিক ও সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতাও । কিন্তু তারই মধ্যে অভাবনীয় এই সাফল্য নজর কেড়েছে গোটা বিশ্বের। ওয়াশিংটন পোস্ট হাজার হাজার শব্দ ব্যয় করছে উন্নয়নশীল দেশের একরত্তি এই রাজ্যটার জন্য। গাল্ফ নিউজ-এ সাক্ষাৎকার ছাপা হচ্ছে কেরালার স্বাস্থ্য মন্ত্রী তথা সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কে কে শৈলজার। দেশের মধ্যে ৬টা রাজ্য পরামর্শ চাইছে কেরালা সরকারের থেকে । গোটা দেশের রাজ্যগুলোর মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বাজেটের সর্বাধিক অর্থ বরাদ্দ করা , দেশের মধ্যে মানবোন্নয় সূচকে প্রথম স্থানে থাকা এলডিএফ সরকারের নেতৃত্বাধীন কেরালাই আজ পথ দেখাচ্ছে করোনা মোকাবিলায়- সাফল্য আসবেই ।