Deucha 3

'আমরা যাবো না। দেখি পুলিশ কী করে? সরকার কী করে?'

'কয়লা খুনি' বিরোধী গ্রাম

গণতন্ত্র রক্ষার মশাল হয়েছে

মথুরাপাহাড়ির দেওয়ালে লেখা হয়েছিল —‘কয়লা খুনি চাই না।’ খনিকে ‘খুনি’ লেখা হয়েছিল। কালো রঙে। পুলিশ ব্রাশ জোগাড় করেছে। সেই লেখা মোছার চেষ্টা করেছে পুলিশ। পোঁচ দিয়েছে অনেকগুলি।
লেখা মোছা যায়নি। স্বাভাবিক।

তৃণমূল প্রথমে ভেবেছিল তারা চাইলেই জমি দখল হয়ে যাবে। তারা অপ্রতিরোধ্য, বিরোধিতার কেউ নেই — তৃণমূল ভেবেছিল। মানুষ মুখ বুজে এলাকা ছেড়ে চলে যাবেন। কিন্তু বিরোধিতা শুরু হল। তখন পুলিশ দিয়ে, ভয় দেখিয়ে কাজ সারতে চাইল তৃণমূল। কখনোই মানুষের সঙ্গে কোনও আলোচনা করেনি প্রশাসন। গ্রামবাসীরা উচ্ছেদ বিরোধী কমিটি করেছেন। প্রতিবাদ সভা করেছেন। মিছিল করেছেন। এখন যখন প্রতিরোধ প্রবল হয়েছে, তখন পুলিশী অত্যাচার আরও বাড়াতে চাইছে তৃণমূল।
ফলে পাঁচামীর উচ্ছেদ-বিরোধী আন্দোলন গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রামের অংশও হয়ে উঠেছে। একদিকে পুলিশ। পিছনে পুলিশের আশ্রিত তৃণমূল। মুখোমুখি প্রতিরোধে মেজাজে উদ্দিপ্ত গ্রামবাসীরা।
দেউচা পাঁচামীর ছবি এখন এটাই।

পুলিশ রাতে আসছে। টহল দিচ্ছে। মথুরাপাহাড়ির যুবক সুকু কিসকুর কথায়,‘‘আমরা চোর, ডাকাত না খুনি। পুলিশ এসে ভয় দেখাচ্ছে। কারও সাথে কথা বলা যাবে না। হুমকি কেন দেবে ওরা? আমরা এই গাঁ, মাটি ছেড়ে যাবো না। এখানেই জন্মেছি। এখানেই মুরব।’’ যে বৃদ্ধা ভর দুপুরে উঠোনে ভাত খাচ্ছিলেন এনামেলের থালায়, তাঁরও কথা —‘‘ইখান থেকে যাবো না কুথাও। স্বামী, শ্বশুরের ভিটে। ইখান থেকে সরাস না মোরে।’’
মোদীর সমর্থন আছে এই প্রকল্পে। মমতা ব্যানার্জি কার্যকর করতে চাইছেন। প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, পিডিসিএল-এর তরফে প্রাথমিক ভাবে বোরিংয়ের জন্য ষোলোটি জায়গা চিহ্নিত হয়েছে দেওয়ানগঞ্জ মৌজায়। প্রশাসন মরিয়া, যত দ্রুত সম্ভব বোরিংয়ের কাজ শুরু করতে। কিন্তু বাদ সেধেছে মানুষের মেজাজ। তাই কে তৃণমূলকে, কে বিজেপি’কে কিংবা বামফ্রন্টকে ভোট দিয়েছিলেন, সে সব অপ্রাসঙ্গিক এখন। বর্তমানে তৃণমূল-বিজেপি বিরোধী সব মানুষের সম্মিলিত ইচ্ছার প্রতীক হয়ে উঠেছে দেউচা পাঁচামী।

হরিণশিঙা, কেন্দাপাহাড়ি, মথুরাপাহাড়ির মত গ্রামগুলিতে সোমবার থেকেই রাস্তা আটকানো শুরু করেছেন গ্রামবাসীরা। চড়কা পুঁতে দেওয়া হয়েছে। মানে যাওয়া আসা বন্ধ। মানুষ পুলিশকে বিশ্বাস করেন না। প্রশাসনে ভরসা নেই। তৃণমূল মানে উচ্ছেদের দালালি করতে আসা একদল ঘৃণ্য
রবিবার মথুরাপাহাড়িতে ঢুকেছিলেন কয়েকজন তৃণমূল নেতা। গ্রামবাসীদের ‘কয়লা খনির পক্ষে’ আনতে। তাড়া করে তাদের এলাকাছাড়া করেছেন গ্রামবাসীরা। কয়েকজনকে বেঁধে রেখেছিলেন গাছে। তাদের উদ্ধার করে পুলিশ। শর্তসাপেক্ষে ‘আটক দালাল’দের ছেড়েছেন গ্রামবাসীরা। পুলিশ তার আগে কয়েকজন গ্রামবাসীকে আটক করেছিল। তাঁদের মুক্তির বদলে ‘দালাল’দের ছেড়েছে মথুরাপাহাড়ি।

আদিবাসীরা জায়গা ছাড়বেন না — গ্রামে গ্রামে এই বার্তা রটে গেছে ক্রমশঃ। এবং প্রবল বিক্রমে। ‘জমি আমরা ছাড়বো না’ — এই কথা এখন হাজারও গ্রামবাসীদের মনের কথা। তাঁদের কেউ আদিবাসী। কেউ সংখ্যালঘু মুসলমান। কেউ হিন্দু। তেঁতুলবান্দির আদিবাসী দিনমজুর বাবুলাল সরেনের মুখে শোনা গেছে,‘‘কোয়লা খুনি আমরা তো চাই না। আমরা খুনি হতে দিব না। আমরা ইখান থেকে কুথাও যাব না।’’ দেওয়ানগঞ্জের পাথর শ্রমিক সেখ মন্টুর কথাও স্পষ্ট, ‘‘তিন ভাই, এক বুন ও মা-বাপ পাড়া প্রতিবেশী নিয়ে আমরা একসাথে আছি। গতরে খেটে খাই। এখান থেকে উঠিয়ে কে কোথায় যাব তার কোনও ঠিক আছে? তাই গাঁয়ের সবাই মিলে যেমন আছি তেমনই থাকতে চাই।’

সর্বাধিক সোচ্চার মহিলারা।

প্রমাণ? কেন্দাপাহাড়ির আশা লোহার। গ্রামের ছেলেদের থামিয়ে মুখর মহিলা বলছিলেন,‘‘কাজ কি শুধু পুরুষরা হারাবে নাকি? আমাদেরও কাজ যাবে। মাঠে কাজ করি। পাহাড়েও। ঘরে কিছু টাকা আনি। এখন বলছে ঘরদোর, পাহাড়, কাজ সব ছাড়তে হবে? একি ইয়ার্কি নাকি? এখান থেকে কেউ সরাতে পারবে না আমাদের।’’ তাঁর সঙ্গে গলা মেলালেন শান্তি রায়। আশা রায়। গলা মিলে গেল পুরুষদেরও। লিচু রায় বললেন,‘‘এই যে পোস্টার দেখছেন, সব মহিলারা লিখেছেন। নিজেদের আলতা দিয়ে। আমরা যাবো না। দেখি পুলিশ কী করে? সরকার কী করে?’’
মমতা ব্যানার্জি চাপে পড়ে সোমবার নবান্নে ঘোষণা করেছেন — শুধু পুলিশেই নয়, সরকারি পদেও নিয়োগ করা হবে, যাঁরা জমি দেবেন। অথচ রাজ্যের সরকারে কয়েক লক্ষ শূণ্যপদ। এতদিন সেগুলি পূরণ করেননি তিনিই।

হরিণশিঙার যুবতী স্মিতা কিস্কুর অভিজ্ঞতা কী? বললেন,‘‘আমি প্রাথমিক স্কুল শিক্ষকের চাকরির প্রশিক্ষণ পাশ করেছি। ২০১৩-তে আমার নাম উঠেছিল। আমাকে ডেকে বলা হলো, টাকা দে। চাকরি পাবি। আমি এমএ পাশ। টাকা দিইনি। আমরা চারবোনই ডেড পাশ। জমি বিক্রি করার টাকায় পড়াশোনা করেছি। এখন বসে আছি। পাশ করেও টাকা দিইনি বলে চাকরি পাইনি। আর এখন বলছে সব ছেড়ে চলে যাও। চাকরি দেবো। কী চাকরি দেবে? লাঠি ধরা পুলিশের? সবাইকে? আমাদের চার বোনকেই? মিথ্যা কথা বলছে। জায়গা আমরা ছাড়ব না।’’ তাঁর কথা শুনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন সোনামণি বাস্কে। তাঁরও এক কথা — ‘‘কেন উঠব? কিছুতেই যাবো না।’’

হাটগাছার একতার শেখ সাইকেলে পাথর খাদান থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। তিনি বললেন,‘‘বলে পুলিশে চাকরি দেবে? সবাইকে? ওই যে সিভিক গ্রামে গ্রামে ভয় দেখাচ্ছে, কত পায়? ৯ হাজার টাকা। আর এই যে আমি সাইকেলে বাড়ি ফিরছি, একদিনে পাথর ভেঙে কত পাই? অন্তত ৬০০ টাকা। আমি কাজ ছেড়ে ইখান থেকে চলে যাবো? ঘরবাড়ি সব হারাবো? কাজ দেবে সরকার — ঘরের সব ছেলেকে? আমাদের কি মূর্খ ভাবে? যাবো না ইখান থেকে। দেখি পুলিশ কী করে।’’

পাঁচামির আদিবাসী প্রধান গ্রামগুলি স্পষ্ট জানান দিচ্ছে — সরকার ভয় পেয়েছে। মমতা ব্যানার্জি প্যাকেজের ‘লোভ’ বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বৃদ্ধির ঘোষণা তার প্রমাণ।
খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষের ভরসা নেই সরকারের উপর। উচ্ছেদের পর কোনও নিশ্চয়তা নেই ভবিষ্যত রুটি রুজির, বুঝে গিয়েছেন এলাকার সাধারণ মানুষ। তাই খনি হলে দেদার টাকা লোটার ধান্দায় মশগুল তৃণমূলের নেতারা রীতিমত ধাক্কা খাচ্ছেন হরিণশিঙা, চাঁচপুর, দেওয়ানগঞ্জ, কেন্দপাহাড়ি, মথুরাপাহাড়ি, গাবারবাথান সহ প্রত্যেকটা জনপদে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন