রিগিং, অনলাইন ভোটে ব্যাপক কারচুপি সত্ত্বেও রুশ সংসদের নিম্নকক্ষ দুমার নির্বাচনে তাক লাগিয়ে দেওয়া সাফল্য পেল কমিউনিস্ট পার্টি। সমর্থনের হার সাড়ে পাঁচ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৮.৯৩ শতাংশ। আসন সংখ্যা পনেরটি বেড়ে এখন ৫৭। এবং এবারেও দুমায় কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিতীয় বৃহওম দল। ইলেকট্রনিক ভোটের ফল মানতে অস্বীকার করে তদন্তের দাবি জানিয়েছেন পার্টির চেয়ারম্যান গেন্নাদি জুগানভ। গণনার রাতেই মস্কোতে বিক্ষোভে নেমেছেন কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী-সমর্থকরা।
অন্যদিকে, দুই-তৃতীয়াংশের গরিষ্ঠতা পেলেও কমেছে পুতিনের পার্টি ইউনাইটেড রাশিয়ার আসন সংখ্যা। ৪৫০-সদস্যের সংসদে উনিশটি আসন কমে ৩২৪। কমেছে সমর্থনও। চার শতাংশের বেশি কমে হয়েছে ৪৯.৮২ শতাংশ। আরও তাৎপর্যপূর্ণ হলো, ভ্লাদিমির ঝিরিনোভস্কির উগ্র দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপিআর) আসন সংখ্যা আঠারোটি কমে হয়েছে ২১, যেখানে দশবছর আগেও ছিল ৫৬। পাঁচবছরে দলের সমর্থনের হার সাড়ে পাঁচ শতাংশ কমে হয়েছে ৭.৫৫ শতাংশ। আর জাস্ট রাশিয়া, যারা তেল শিল্পের জাতীয়করণ এবং সরকারি কর্মীদের বেতন তিনগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে, তাদের আসন সংখ্যা তেইশ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৭। পাঁচ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে এবারে দুমায় প্রতিনিধিত্ব করবে নতুন দল নিউ পিপল। তাদের আসন সংখ্যা ১৩।
সাইবেরিয়া ও দূর প্রাচ্যের একাধিক প্রদেশে কমিউনিস্টরা জিতেছেন। ইয়াকুটিয়ার ইয়াকউটস্ক কেন্দ্রটি তারা দখল করেছে ৩৫ শতাংশ ভোট পেয়ে, পৃথিবীর বৃহত্তম যে কেন্দ্রের আয়তন প্রায় ভারতের মতো! লেনিনের জন্মস্থান উলিয়ানোভস্কেও জয়ী হয়েছেন কমিউনিস্টরা। যেখানে ইলেকট্রনিক ভোটের ব্যবস্থা নেই, সেখানেই ভালো ফল করেছে পার্টি। ই-ভোটের গণনা শুরু হতেই দেখা যায় বদলে যাচ্ছে ফলাফল। অস্বাভাবিক ব্যবধানে এগিয়ে যাচ্ছে পুতিনের দল। যেমন মস্কোয়। একটি কেন্দ্রে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী মিখাইল লোবানভ এগিয়ে ছিলেন ১০ হাজারের বেশি ভোটে। ই-ভোটের গণনার পরে দেখা যায় তিনি ২০ হাজার ভোটে হেরে গিয়েছেন। মস্কোয় পার্টির সম্পাদক ভ্যালেরি রাসকিনও জিতছিলেন। ই-ভোটের গণনার পরে তাঁকেও পরাস্ত বলে ঘোষণা করা হয়। মস্কোয় অন্তত ৮টি আসনে এমন ঘটনা ঘটেছে। যে মস্কোতে দু’বছর আগে পৌরসভা নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির আসন সংখ্যা আটটি বেড়ে হয়েছিল ১৩। অন্যদিকে, ইউনাইটেড রাশিয়ার ন’টি আসন কমে ২৫।
এই রাশিয়া সেই রাশিয়া না। সমাজতন্ত্র থেকে ধান্দার ধনতন্ত্রে! ২০১৬, দ্য ইকনমিস্ট পত্রিকার ‘ধান্দার ধনতন্ত্রের’ সূচকে এক নম্বরে রাশিয়া। ‘স্বাভাবিক’ বাজার অর্থনীতিও রূপায়িত হয়নি রাশিয়ায়। বরং, পরিণত হয়েছে এক অদ্ভূতুড়ে ধান্দার-রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদে। বলেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোশেফ স্টিগলিৎজ। ব্রিটিশ গার্ডিয়ান পত্রিকায় ‘রাশিয়া কেন উন্নতি করতে পারল না’ শিরোনামে লেখা নিবন্ধে।
বিশ্বের প্রধান অর্থনীতিগুলির মধ্যে সবচেয়ে অসম সমাজ!
সাতের দশকের শেষের দিকেও, মাত্র ০.২ শতাংশের আয় ছিল গড়পরতা মজুরির চেয়ে চারগুণ বেশি। আর এখন ধনীশ্রেষ্ঠ ১০ শতাংশ— দেশের ৮৭ শতাংশ সম্পদের মালিক। বিশ্বের প্রধান অর্থনীতিগুলির সবচেয়ে অসম সমাজ রাশিয়ায়। জানাচ্ছে ২০১৬’র ক্রেডিট সুইসের গ্লোবাল ওয়েলথ রিপোর্ট। যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই হার ৭৬ শতাংশ। আর ভি টি বি ক্যাপিটালের হিসেবে, রাশিয়ার ধনীশ্রেষ্ঠ ১ শতাংশের হাতে রয়েছে দেশের তাবৎ ব্যক্তিগত আমাতনের ৪৬ শতাংশ (গার্ডিয়ান, ২৫ এপ্রিল, ২০১৭)।
নোবেলজয়ী ফরাসি অর্থনীতিবিদ, ‘ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’ গ্রন্থের লেখক টমাস পিকেটি দেখিয়েছেন রাশিয়াতে আবার ফিরে এসেছে জার-জমানা! তিনি দেখিয়েছেন, জার-জমানায় দেশের মোট আয়ের ৪৫-৫০ শতাংশ ছিল মাত্র ১০ শতাংশের কবজায়। সোভিয়েত-পর্বে তা ১৫-২০ শতাংশে নেমে এলেও, এখন আবার তা ফিরে গিয়েছে ৪৫-৫০ শতাংশে। ‘ফর্ম সোভিয়েত টু অলিগার্কস: ইনইকোয়ালিটি অ্যান্ড প্রপার্টি ১৯০৫-২০১৬’তে পিকেটি বলছেন, রাশিয়ায় ১ শতাংশের হাতে এখন মোট আয়ের ২০-২৫ শতাংশ। যা পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির তুলনায় অনেকটা বেশি, যেখানে ১ শতাংশের হাতে ১০-১৪ শতাংশ।
১৯৯১, একজনও বিলিওনেয়ার ছিলেন না রাশিয়াতে। আর এখন, বিলিওনেয়ারের সংখ্যা ২০২০ সালে ৯৯ থেকে বেড়ে হয়েছে ১১৭। এই মহামারির সময়েও যেখানে তাঁদের মিলিত সম্পদের পরিমাণ ৩৮,৫০০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৮,৪০০ কোটি ডলার (ফর্বস)। যেখানে গড়পরতা মাসিক মজুরি মাত্র ৬৯৭.৩৫ ডলার!
১৯৮৯, রাশিয়ায় দারিদ্র্যসীমার নিচে মানুষের সংখ্যা ছিল মাত্র ২ শতাংশ (দৈনিক ২ ডলার ধরে)। ১৯৯৮’র শেষে তা একলাফে বেড়ে দাঁড়ায় ২৩.৮ শতাংশ (বিশ্বায়ন ও তার অসন্তোষ, জোশেফ স্টিগলিৎজ)। এখন ১ কোটি ৯৬ লক্ষ রুশ, জনসংখ্যার ১৩.৩ শতাংশ রয়েছেন দারিদ্র্যসীমার নিচে। যদিও, এটি একেবারেই কমিয়ে দেখানো হিসেব। এই সময়ে ভারতের মতোই বদলে দেওয়া হয়েছে দারিদ্র্যের সংজ্ঞা। আজকের দারিদ্র্যের এই সূচক, ২০০০ সালে রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের প্রথম মেয়াদের গোড়ার চেয়ে অনেক কমিয়ে আনা হয়েছে, যখন জনসংখ্যার ২৯ শতাংশ ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে। সেকারণে প্রকৃত দরিদ্র্যের সংখ্যা অনেক বেশি। রসস্ট্যাটের কিছু বিশেষজ্ঞ যেমন এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, দরিদ্র অথবা দারিদ্র্যের মুখে থাকা মানুষের সংখ্যা অন্তত ৭০ শতাংশ!
কারা তৈরি করল এই ভুঁইফোড় বিলিওনেয়ারদের? কোন্ ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনল সম্পদের এহেন কেন্দ্রীভবন? কে হারল রাশিয়ায়?
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে রাশিয়ার অংশে ১৯৯১-তে গড় আয়ু ছিল ৭০। পরে আর গড় আয়ু বাড়েনি। ‘মুক্ত বাজার’ অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার পরে ১৯৯৪-তে গড় আয়ু বরং নেমে আসে মাত্র ৬৫-তে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এই প্রথম কমতে শুরু করে মোট জনসংখ্যা। জন্মহারের চেয়ে বেড়ে যায় মৃত্যু হার। বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবাকে ভেঙে তছনছ করে দেওয়া হয়। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় কর্মসংস্থান, অবসরকালীন ভাতা-সহ সোভিয়েত শ্রমিকদের অন্যান্য সামাজিক নিশ্চয়তা। মহিলা ও মাদক পাচার হয় মুনাফার নতুন ক্ষেত্র। শুরুতে রাশিয়া ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘বন্ধু’।
ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল দ্য ল্যানসেটে অসহায় আর্তনাদ। জানুয়ারি, ২০০৯— ল্যানসেটে প্রতিবেদন, কাজ করতে সক্ষম এমন ১০ লক্ষের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে এক দশকে, ‘গণ হারে বেসরকারিকরণের অর্থনৈতিক আঘাত এবং শক থেরাপির কারণে’।
বেসরকারিকরণ ‘বাড়িয়েছে মৃত্যু-হার’। ল্যানসেটের সমীক্ষা ধরে শিরোনাম বি বি সি-তে।
পুতিনের হাতে এখন জারের চেয়েও বেশি ক্ষমতা! যেমন লিখেছেন এই মুহূর্তে নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেজিঙ ব্যুরোর চিফ স্টিভেন লি মায়ারস্। ‘দ্য নিউ জার: দ্য রাইস অ্যান্ড রেইন অব ভ্লাদিমির পুতিন!’
রাশিয়া এখন একটি সুপার রাষ্ট্রপতি-কেন্দ্রিক সাধারণতন্ত্র। একনম্বর ব্যক্তির হাতে জার ও সাধারণ সম্পাদকের মিলিত ক্ষমতার চেয়ে বেশি ক্ষমতা। শেষ একুশ বছরে ক্রেমলিনে ক্ষমতার কোনও পরিবর্তন হয়নি। একটা পুরো প্রজন্মই বেড়ে উঠেছে একজন রাষ্ট্রপতি (অথবা প্রধানমন্ত্রী) এবং একটি শাসকদলের অধীনে। অথচ, এই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স দেখেছে পাঁচ-পাঁচজন রাষ্ট্রপতিকে।
পুতিন, যিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে বলেন, ‘বিশ শতকের মহোত্তম ভূ-রাজনৈতিক বিপর্যয়’, তিনিই ক্ষমতায় থাকতে খর্ব করেছেন নাগরিক স্বাধীনতা। জেলে পুরেছেন সমালোচকদের, সংবাদ মাধ্যম এবং সোস্যাল মিডিয়ার উপর চাপিয়েছেন বিধিনিষেধ।
২০০০, ক্ষমতায় আসার পরেই তিনটি প্রধান টেলিভিশন চ্যানেলের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেন পুতিন। রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন চ্যানেল আর টি আর (এখন রাশিয়া ওয়ান) আগে থেকেই ছিল ক্রেমলিনের নিয়ন্ত্রণে। ২০০১ এবং ২০০২, পুতিন কবজা করেন দু’টি বৃহত্তম টেলিভিশন চ্যানেল— ও আর টি (এখন চ্যানেল ওয়ান) এবং এন টি ভি-কে। দেশের তিনটি বৃহত্তম সংবাদ সংস্থার মধ্যে দু’টি সরাসরি ক্রেমলিনের নিয়ন্ত্রণে। ক্রেমলিনের বিশ্বস্ত এডিটোরিয়াল টিম বসিয়ে তৃতীয়টির নিয়ন্ত্রণও নিয়েছেন তিনি। রাষ্ট্রপতির প্রশাসনের সঙ্গে নিয়মিত সাপ্তাহিক বৈঠকে বসতে হয় সম্পাদক ও ডিরেক্টরদের। সেখানে আলোচনা হয় পরবর্তী সপ্তাহের জন্য কোন বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্ব পাবে, কোনটা প্রশাসন প্রচার করতে চায়।
এই মুহূর্তে রাশিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থার মুখ্য বৈশিষ্টগুলি কী? প্রথমত, রাষ্ট্রপতি ও তাঁকে ঘিরে ক্ষুদ্র চক্রের হাতে একচেটিয়া ক্ষমতা। মুখ্য সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রশ্নে চরম গোপনীয়তা। দ্বিতীয়ত, শাসকদল ইউনাইটেড রাশিয়া মিশে গিয়েছে আমলাতন্ত্রের সঙ্গে। দল এখন নিছকই ‘ড্রাইভার বেল্ট’, মুখ্য সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেই কোনও এক্তিয়ার। তৃতীয়ত, বিরোধীরা আছেন সংসদের ভিতরে-বাইরে, তবে ক্ষুদ্র পরিসরে। চতুর্থত, প্রধান মিডিয়া গোষ্ঠীগুলির একচেটিয়া কারবার। শুরু হয়েছে রাজনৈতিক সেন্সরশিপ। পঞ্চমত, নেই স্বাধীন বিচারব্যবস্থা। আদালতগুলি এখন দুর্নীতি আর রাজনীতির নিয়ন্ত্রণে।
এই পরিস্থিতিতে বাড়ছে কমিউনিস্ট পার্টির জনপ্রিয়তা আর প্রভাব। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সংখ্যা এখন ১ লক্ষ ৬২ হাজারের বেশি। রয়েছে ৮১-টি প্রাদেশিক কমিটি। পার্টি শাখার সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি।
জনপ্রিয়তার শীর্ষে স্তালিন
গতবছর লেভাদা সেন্টারের জনমত সমীক্ষায় প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজনই (৭৫ শতাংশ) বলেছেন, দেশের ইতিহাসে ‘সবচেয়ে ভালো সময় ছিল সোভিয়েত যুগ’! জনপ্রিয়তার শীর্ষে স্তালিন। আর এবছর লেভাদা সেন্টারের জনমত সমীক্ষায় ৫৬ শতাংশ তাঁদের ‘মহান নেতা’ হিসেবে বেছে নিয়েছেন স্তালিনকে। পরে লেনিন, পুশকিন।
শেয়ার করুন