অর্কপ্রভ সেনগুপ্ত
রুশ বিপ্লব ও আনাতোলি লুনাচার্স্কির শিক্ষাচিন্তা
এই বিতর্কের মধ্যেও গ্রামাঞ্চলে সমন্বিত শ্রমস্কুল-কে কিভাবে জনপ্রিয় করা যায়, তা নিয়ে লুনাচার্স্কি যথেষ্ট ভাবনা চিন্তা করেছিলেন। তিনি বলেন গ্রামে গ্রামে জনশিক্ষাকর্মীদের মতাদর্শিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। কৃষকদের মধ্যে থেকে বাধা আসবে, কিন্তু তাঁদেরকে যেন জনশিক্ষাকর্মীরা প্রতিদ্বন্দ্বী মনে না করেন। সোভিয়েত সরকার আদতে কি চায়, তা সঠিক ভাবে বুঝতে পারলে এই কৃষক শ্রেণিই হয়ে উঠবে গ্রামাঞ্চলের গণশিক্ষার বিস্তারের সর্ববৃহৎ সহায়ক শক্তি। তিনি এই প্রসঙ্গে বলেছেন – ‘জনগণের মধ্যে আমাদের মতামত পৌঁছানোর জন্য আমরা চাই অবিরাম প্রচার চলুক। এভাবে আমরা আমাদের শত্রুদের বিশ্বস্ত সহকর্মীতে পরিণত করব।’ এমনকি খ্রিস্টান যাজকরাও যে সকলে বলশেভিক শক্তির বিরোধী হবে, এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। লুনাচার্স্কি এই প্রসঙ্গে এক বক্তৃতায় বলেন, – “…আমি জনকয়েক পাদ্রির সঙ্গে একটি বিতর্কে অংশ নিই এবং শুনে সুখী হই যে তাঁরা বলছেন – প্রাক্তন সরকার খ্রিস্টধর্মের অনুষঙ্গী ছিল না এবং সমাজতন্ত্র হল ‘খ্রিস্টধর্ম ও এর ভাবাদর্শের সত্যিকার উপলব্ধি’।”
তবে ক্রুপস্কায়ার অভিজ্ঞতা থেকে লুনাচার্স্কি এই বাস্তব উপলব্ধি করেন, নারকমপ্রোস নিচুতলা থেকে শিক্ষা সোভিয়েতের মাধ্যমেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রামাঞ্চলে উঠে আসবে, এমন যে আশা করছিল, তা অতিরিক্ত আদর্শবাদী। সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলেও গ্রামীণ শিক্ষার বিকাশের জন্য পূর্বতন আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর কিছু পুনরুজ্জীবন প্রয়োজন। এই প্রয়োজনীয়তার বাস্তবতা উপলব্ধি করেই ১৯১৮ সালের এপ্রিল মাসে তিনি নারকমপ্রোস-কে একটি কেন্দ্রীভূত মন্ত্রক হিসেবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। এইপ্রকার আমলাতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তোলা নারকমপ্রোসের নেতৃত্বের কারোরই পছন্দ ছিল না। এটিকে তাঁরা সাময়িক পশ্চাদপসারণ হিসেবেই প্রাথমিক ভাবে ধরে নেন। শিক্ষা সোভিয়েতগুলি-কে ভেঙে ফেলার প্রস্তাব অবশ্য লুনাচার্স্কি মেনে নেন নি, ক্রুপস্কায়াও এর তীব্র বিরোধী ছিলেন। লুনাচার্স্কি তাই এই নির্দেশ জারি করেন, প্রদেশে ও জেলায় যে শিক্ষা দপ্তরের শাখা গড়ে উঠবে শিক্ষা সোভিয়েতগুলো তার পরামর্শদাতা সংগঠন হিসেবে কাজ করবে। পরিস্থিতি ভেদে তাদের হাতে প্রশাসনিক বিভিন্ন দায়িত্বও শিক্ষাদপ্তর ন্যাস্ত করা যেতে পারে এই মর্মেও তিনি বক্তব্য রাখেন। আশা করে হয়েছিল, গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতির অবসানে, শিক্ষা দপ্তরের আমলাতান্ত্রিক শাখার স্থান পরিপূর্ণ ভাবে শিক্ষা সোভিয়েতগুলি নিতে পারবে, যদিও তা বস্তবে সম্ভবপর হয়নি। কেন্দ্রীভূত আমলাতান্ত্রিক দপ্তর হিসেবে নারকমপ্রোস-এর পুনর্গঠন আদর্শিক দিক দিয়ে কিছুটা পিছু হটে যাওয়া বলে লুনাচার্স্কি বা ক্রুপস্কায়া মনে করলেও আদতে এতে ইতিবাচক কিছু পদক্ষেপ দ্রুততার সঙ্গে নিতে তাঁরা সক্ষম হয়েছিলেন এইকথাও সত্যি। এই কেন্দ্রীকরণের ফলেই সমগ্র রাশিয়ায় অত্যন্ত দ্রুত সমন্বিত শ্রম স্কুলে সকল আট থেকে সতেরো বছর বয়সী শিশুর জন্য বিনামূল্যে, বাধ্যতামূলক, ধর্মনিরপেক্ষ, সহ-শিক্ষার আদর্শ বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়। লুনাচার্স্কি ঘোষণা করেন, এই জনশিক্ষা প্রচেষ্টাকে বলশেভিকরা একটি সামরিক ফ্রণ্টের মতোই মনে করবে। জনশিক্ষাকর্মীরা নারকমপ্রোস-এর নীতি যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সমগ্র রাশিয়ায় ছড়িয়ে দেবে। সর্বত্র ক্লাব গড়ে তোলা হবে শিশুদের জন্য, অনাথ শিশুদের জন্য বিশেষ প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হবে, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গরম প্রাতরাশ দেওয়া হবে। বাড়ির কাজ, স্কুলে শাস্তি আর পরীক্ষা বাতিল করা হয়। বলা হয় স্কুল চালনা করা হবে শিক্ষক, স্থানীয় জনতার প্রতিনিধি ও উঁচু ক্লাসের ছাত্রদের মধ্যে থেকে নেওয়া প্রতিনিধিদের নিয়ে। শিক্ষকদের তাঁদের কাজের মানের ভিত্তিতে নির্বাচিত করবেন অভিভাবক ও ছাত্ররা।
ভি.ইউ.এস বা সর্ব রাশিয়া শিক্ষক সংগঠন এই ঘোষণার তীব্র বিরোধিতা করে। যে সব শিক্ষকরা সোভিয়েতের নতুন শিক্ষানীতির পক্ষে ছিলেন, তাঁদের সংগঠন থেকে বহিষ্কার ও সামাজিক ভাবে বয়কট করা হয়। লুনাচার্স্কি-র আলোচনার আপিলে তাঁরা বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করতে রাজি ছিলেন না। এই প্রেক্ষিতে প্রস্তাব ওঠে এই ইউনিয়ন ভেঙে দেওয়া হোক। কিন্তু ক্রুপস্কায়া এর বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন রাশিয়ার সর্ববৃহৎ শিক্ষক সংগঠন হিসেবে এই সংগঠনকে ভেঙে দেওয়া বা অবজ্ঞা করা যায় না। আর তা ছাড়া এই প্রকার পদক্ষেপ সোভিয়েত গণতন্ত্রের আদর্শের পরিপন্থী হবে। এই সংগঠনে অনেক ভালো, প্রগতিশীল, সচেতন শিক্ষক আছে। বলশেভিকদের দায়িত্ব হল, তাঁদেরকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসা। শুধু কাদেতপন্থী নেতৃত্বের কার্যকলাপ দেখে সামগ্রিক সংগঠনের প্রকৃতি বিচার করা অনুচিত। তাঁর এই ধীরে চলো নীতিতে কাজ হয়। খুব দ্রুত ভি.ইউ.এস-এর সদস্যপদ শুধু শহরকেন্দ্রিক কাদেতপন্থী শিক্ষকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ শিক্ষকরাই সোভিয়েত শক্তির পক্ষে চলে যান। এমন নয়, তাঁরা সব বিষয়ে সহমত ছিলেন, কিন্তু ভি.ইউ.এস-এর অনন্তকাল ধরে নতুন শক্তিকে বয়কট করে শ্বেত বাহিনীর বিজয়ের আশায় বসে থাকা তাঁদের কাছে বিরক্তিকর বলে ধরা দিয়েছিল।
শিক্ষানীতি সংক্রান্ত আরেকটি চ্যালেঞ্জ আসে বলশেভিক নেতৃত্বের তরফ থেকেই। গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষিতে নতুন সোভিয়েত নেতৃত্বের একটি বড়ো অংশ এই মত পোষণ করতেন, কেবলমাত্র প্রযুক্তিগত শিক্ষার দিকেই বর্তমান পরিস্থিতিতে জোর দেওয়া জরুরি। রাষ্ট্রের হাতে সম্পদ খুব সীমিত। যেটুকু সম্পদ রয়েছে, তা নারকমপ্রোস প্রকৌশল ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার দিকেই খরচ করুক। লুনাচার্স্কির সমন্বিত শ্রমস্কুলের বিকল্প হিসেবে এফ. এফ. শু তুলে ধরেন সমন্বিত প্রকৌশল বিদ্যালয়ের মডেল, যেখানে মাধ্যমিক স্তর থেকেই প্রকৌশল ও প্রযুক্তিগত শিক্ষা প্রদানের কথা বলা হয়। লুনাচার্স্কি ও ক্রুপস্কায়া উভয়েই এর তীব্র বিরোধিতা করেন। লুনাচার্স্কি বলেন, ‘আমরা একথা বুঝি, ধ্বংসপ্রাপ্ত রুশ অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন।…কিন্তু আমরা, মার্কসবাদী হিসেবে কঠিন সময়ের দোহাই দিয়ে সর্বহারা শ্রেণির আশার প্রথম পুষ্পগুলিকে দলিত হতে দিতে পারি না, পারি না সর্বহারা শ্রেণির যুবসম্প্রদায়কে তাদের বহুমুখী মানবিক বিকাশের প্রথম সুযোগ থেকে বঞ্চিত করতে।’ একই সুর শোনা যায় ক্রুপস্কায়ার বক্তব্যে, ‘আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, পেশাদারি শিক্ষা যেন কখনই একজন মানুষের জ্ঞানকে অল্প বয়সেই সংকীর্ণ পেশাদারি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ না করে ফেলে। আমাদের তার বিকাশকে বেঁধে ফেললে চলবে না, বরং তার বিকাশ যাতে পরিপূর্ণ ও সুষম হয় সেইদিকে মনযোগী হতে হবে।’ দুজনেই জোরালো ভাবে বলেন, একথা সত্যি, পেশাদারি নানা শিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্রদের প্রয়োজন যারা নতুন সোভিয়েত রাষ্ট্রের শিল্পের বিকাশের সহায়ক হবে। কিন্তু এর পাশাপাশি এও সত্যি যান্ত্রিক প্রকৌশলিদের দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ করা সম্ভব হবে না, যদি না তাদের মননে এর পাশাপশি সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধেরও বিকাশ না ঘটে। প্রযুক্তিগত শিক্ষা দিয়ে ছাত্রদের শুধুমাত্র অর্থনীতিরি জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্র তৈরি করলে চলবে না, তাদেরকে সমাজতান্ত্রিক দেশের উন্নত মূল্যবোধ সম্পন্ন নাগরিক হিসেবেও গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁদের এই অবস্থান ‘সোভনারকম’ মেনে নিতে রাজি ছিল না। লেনিন যদি সেইদিন তাঁদের পাশে না দাঁড়াতেন তাহলে নতুন মডেল স্কুল হিসেবে বলশেভিক পার্টি ‘সমন্বিত প্রকৌশল বিদ্যালয়’-কেই গ্রহণ করত ‘সমন্বিত শ্রম স্কুল’-এর পরিবর্তে। ভবিষ্যতেও সোভিয়েত শিক্ষানীতি নির্ধারনে দুই অবস্থানের মধ্যে বিতর্ক দেখা দেবে, যদিও তা বর্তমানের আলোচনার পরিসরের বাইরে।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ‘নারকমপ্রোস’-কে আরও কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবার্গ কেন্দ্রিক উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা কাদেতপন্থী অধ্যাপকদের হাতেই ছিল। এঁদের নেতা ছিলেন পূর্বতন শিক্ষামন্ত্রী ওল্ডেনবার্গ। কারপিন্সকি, ওল্ডেনবার্গ পক্রোভস্কি, ই. জ. শাপিরো, প. ক. শ্রেৎরেনবার্গ প্রমুখ উচ্চশিক্ষার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা পদে পদে ‘বর্বর’ বলশেভিকদের শিক্ষানীতির বিরোধিতা করেন। তাঁরা উচ্চশিক্ষাকে বিনামূল্য করে দেওয়ার নীতির বিরোধিতা করেন, শ্রেণি নির্বিশেষে সকলের উচ্চশিক্ষা লাভের অধিকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন। কারপিন্সকি তো সরাসরি বলেই দেন, উচ্চশিক্ষা কখনও জনমুখী উচ্চশিক্ষা হতেই পারে না। কারণ সাধারণ জনগণশ্রমজীবী জনগণের মধ্যে প্রকৃতিগত ভাবেই বৌদ্ধিক চর্চার বিরোধী। তারাজন্য প্রয়োজনীয় মেধা নেই। তাদের জন্য উচ্চশিক্ষার মূল নীতিগুলিরই বিরোধী। দ্বার উন্মুক্ত করলে শিক্ষার মান ভয়ংকর পড়ে যাবে। কাদেতপন্থী অধ্যাপকরা শুধু কমিউনিস্টদের সঙ্গে মতবিরোধেই লিপ্ত হননি, কমিউনিস্ট অধ্যাপক ও ছাত্রদেরকে তাঁরা একঘরে করে দেন। সাম্যবাদী মনোভাবাপন্ন ছাত্রদের ঘর থেকে বের করে দেওয়া হত। অধ্যাপকদের নানাভাবে অপমান করা হত। অনেকেই মনে করেছিলেন সোভিয়েত সরকার ধ্বংস হয়ে যাবে, বিজয়ী শ্বেত বাহিনীর আগমনের জন্য শুধু তাঁদের অপেক্ষা করতে হবে মাত্র। বলশেভিক পার্টির মধ্যে অনেকেরই মত ছিল এইরকম প্রকাশ্যেই প্রতিবিপ্লবী কার্যকলাপে মদত প্রদানকারী অধ্যাপকদের ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বের করা প্রয়োজন। লুনাচারস্কি লেনিনের সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারী হস্তক্ষেপের ও বলপ্রয়োগের এই প্রস্তাব প্রতিহত করতে সক্ষম হন। স্কুল শিক্ষার ক্ষেত্রে ক্রুপস্কায়া যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রেও সেই একই নীতি গ্রহণ করা হয়। ‘ডিপ্লমার কারখানা’ থেকে লুনাচারস্কি এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে ধীরে, কিন্তু স্থির ভাবে নতুন সমাজতান্ত্রিক মানুষ নির্মাণের প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করতে অগ্রসর হন। প্রবেশিকা পরীক্ষা তুলে দেওয়া হয়, বিশ্ববিদ্যালয় করা হয় অবৈতনিক, ১৬ বছরের ঊর্ধ্বে যে কোনও সোভিয়েত নাগরিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠলাভের জন্য আবেদন করতে পারত। শ্রমিক শ্রেণি থেকে আগত ছাত্রদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। বিশেষ শ্রমিক ফ্যাকাল্টি (রাবফ্যাক) নির্মাণ করা হয়, যার কাজই ছিল শ্রমিক শ্রেণি থেকে আগত ছাত্রদের বিশেষ ক্লাসের মাধ্যমে তাদের সহপাঠিদের সমান ভিত্তি প্রদান করা। এই রাবফ্যাকের পড়াশোনা তিন থেকে চার বছর হত। তবে এতেও অধ্যাপকদের তরফ থেকে নানাপ্রকার অসহযোগিতা আসতে থাকে। নতুন ছাত্রদের প্রতি প্রবল শ্রেণিবিদ্বেষ তাঁরা প্রদর্শন করেন। রাবফ্যাক-কে অনেক সময়েই প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান করা হতো না, রাবফ্যাকের ছাত্রদের অধ্যাপকরা সময় দিতেন না, তাঁদের অনেকক্ষেত্রে গবেষণাগার ব্যবহার ও করতে দেওয়া হত না। এই পরিস্থিতিতে রাবফ্যাকের ছাত্ররা, যাঁরা অনেকেই শ্রমিক-কৃষক পরিবার থেকে এসেছিলেন, তাঁরা উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলিতে সরকারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ দাবি করতে শুরু করেন। বলশেভিক পার্টির মধ্যেও এই দাবির পক্ষে জোরালো সমর্থন ছিল। লুনাচার্স্কি অধ্যাপকদের এই আচরণের তীব্র নিন্দা করলেও উচ্চশিক্ষায় প্রত্যক্ষ ভাবে পার্টির হস্তক্ষেপের বিরোধী ছিলেন, সরকারও খুব কড়া ভাবে প্রতিষ্ঠানে হাত দিক এও তিনি চাননি। পরবর্তীকালে কিছুটা বাধ্য হয়েই তিনি ভদ্রলোকের দস্তানা খুলে ফেলতে বাধ্য হন এবং কড়া হাতে ‘নারকমপ্রোস’-এর নীতি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াসী হন।
১৯১৭ থেকে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লুনাচার্স্কি অসাধ্য সাধন করেন। তিনি ‘নারকমপ্রোস’-এর দায়িত্ব গ্রহণ করার পরেই ঘোষণা করেছিলেন, নতুন সোভিয়েত রাষ্ট্র শুধু ক্ষমতার জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেনি। সমাজের আমূল পরিবর্তন সাধনই ছিল তাদের রাষ্ট্রক্ষমতা অধিকারের প্রধান উদ্দেশ্য। বলশেভিকদের মহানতম স্বপ্ন এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা হল সমাজতান্ত্রিক শিক্ষার সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে এমন একপ্রকার নতুন মানুষ গড়ে তোলা, যারা দায়িত্বের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের পথে অগ্রসর হতে পারবে। তিনি বারে বারে একথা জোর দিয়ে বলেছেন, ‘বাস্তব সীমাবদ্ধতা’-এর দোহাই দিয়ে থেমে গেলে আমাদের চলবে না, আমরা বলশেভিক, আমাদের কাজই হল অসম্ভব-কে দাবি করা এবং তাকে সম্ভব করা। এই অসম্ভবকে দাবি করতে হলে চাই সেই বৈপ্লবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা যা জন্মলগ্ন থেকেই সোভিয়েত পরীক্ষার সঙ্গী। এই উচ্চাকাঙ্ক্ষাতে ভর করেই লুনাচার্স্কি যখন ব্রিটেন, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইতালির মতো দেশের সেনাবাহিনী ও তাদের সমর্থিত শ্বেতফৌজ শিশু সোভিয়েতকে তার সূতিকাগৃহেই গলা টিপে হত্যা করতে আগ্রহী, তখন গণশিক্ষার আদর্শ ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন রাশিয়ার গ্রামে গ্রামে, নির্মাণ করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন ‘নতুন মানুষ’-এর সুউচ্চ ইমারতের ভিত। তিনি বিশ্বাস করতেন, সমাজতান্ত্রিক সমাজ ‘বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়’-এর আদর্শে পরিচালিত হলেও তার সঙ্গে ব্যক্তির সত্ত্বার পরিপূর্ণ বিকাশের কোন সংঘর্ষ নেই। বরং দুটি একে অপরের পরিপূরক। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা চাই একজন মানুষকে এই শিক্ষা দিতে, যাতে সে মানসিক ও আত্মিক দিক থেকে সম্ভাব্য সর্বোত্তম সমন্বয়ে উত্তীর্ণ হয়, যথাসম্ভব পরিপূর্ণ শিক্ষা প্রাপ্তির মাধ্যমে…যে কোন একটি ক্ষেত্রে সহজেই উচ্চ দক্ষতা লাভ করতে সক্ষম হয়। আমাদের লক্ষ্য, এমন এক ধরণের মানুষ তৈরি করা, যে হবে সহনাগরিকদের সত্যিকারের সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ী, অন্য সকল মানুষের একজন কমরেড আর সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শের জন্য সংগ্রামে প্রস্তুত একজন যোদ্ধা।’
আলোচ্য নিবন্ধটি শেষ করা যেতে পারে শিক্ষাবিদ সোফিয়া সুখোরেতস্কায়ার একটি স্মৃতিচারণা দিয়ে। , ১৯২০ সালের ৭-ই নভেম্বর, জনামেনস্কায়া স্কুলে বিপ্লবের তৃতীয় বার্ষিকী পালন করা হচ্ছে, প্রথমবার বিদ্যুৎ পৌঁছেছে স্কুলে। কিন্তু অনুষ্ঠান শুরু হলেও জেনারেটর চালু করা যায় নি। কেরোসিনের আলোয় মিটিং হচ্ছে। নাটকের নাম হল, ‘পুরনো বিদ্যালয়ের বিচার’। এতে ছাত্ররা পুরনো শিক্ষাব্যবস্থা আর বিদ্যালয়কে কাঠগোড়ায় তুলছে। ভায়োলিনের মুর্ছনায় এক ছাত্র ভীষণ আবেগ দিয়ে নিজের সংলাপ বলছে, ‘আমাদের এই স্কুল এখন একটা গলিত শবে পরিণত হয়েছে, কমরেড বিচারকরা, বিপ্লবের অগ্নিতে এই শব পুড়ে যাক, যে সমাজব্যবস্থা এই স্কুলের জন্ম দিয়েছে, আপনারা তাকে দোষী সাব্যস্ত করুন।’ কাকতালীয় ভাবে এই দৃশ্যের পরেই ‘ইলিচের লন্ঠন’ (বৈদ্যুতিন আলোকে গ্রামীণ রাশিয়া ওই নামেই চিনত) জ্বলে উঠল দপ করে। সোল্লাসে হাত তালি দিয়ে উঠল জনগণ। করতালির আওয়াজ ভেদ করে বহু মানুষের কন্ঠে ধ্বনিত হল, ‘জাগো জাগো জাগো সর্বহারা, অনশন বন্দী ক্রীতদাস…’
আমাদের এই অন্ধকার সময়ে ‘ইলিচের লন্ঠন’ প্রায় নির্বাপিত। তার নিভু নিভু স্ফুলিঙ্গ মাঝে মাঝে দেখা যায়। আমরা ভুলে গেছি শিক্ষাব্রতী লুনাচার্স্কির কথা, ক্রুপস্কায়া পর্যবসিত হয়েছেন নিছক ‘লেনিনের স্ত্রী’-তে। নভেম্বরে তাঁদের আবার যেন আমরা স্মরণ করি। আবার যেন তাঁদের থেকে শিখি অসম্ভবকে দাবি করতে। মনের মধ্যে এই আশা যেন ধরে রাখি, একদিন ‘ইলিচের লন্ঠন’-এর স্ফুলিঙ্গ থেকেই আবার গণচেতনায় অগ্নিশিখা জ্বলবে।