অর্কপ্রভ সেনগুপ্ত
খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৪ অব্দ। রোম নগরীর নিকট একটি ছোটো টিলা ‘মন্স সাকের’ (পবিত্র পাহাড়)-এ কাতারে কাতারে জড়ো হয়েছে মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে রোমের রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থেকে অভিজাত প্যাট্রিশিয়ানদের হাতে। খাতায় কলমে রোম নগরী প্রজাতন্ত্র হলেও নিরবে অনেক দিন ধরে অপমান অনাচার সহ্য করেছে সাধারণ রোমবাসী প্লেবিয়ানরা। কিন্তু ধৈর্যেরও একটা সীমা আছে। সেই সীমা লঙ্ঘিত হয়েছে। মন্তে সাক্রোতে প্লেবিয়ানরা জড়ো হয়েছে তাদের অধিকার বুঝে নিতে। তাঁদের নেতা গাইয়াস লাইসিনিয়াস আর লুসিয়াস সিসিনিয়াস তাঁদের বুঝিয়েছেন – ‘ভয় পাবেন না নাগরিকরা, আমরা সংখ্যাগুরু আর প্যাট্রিশিয়ানরা সংখ্যালঘু। আমাদের রক্ত ঝরিয়েছি বলেই রোম বহিঃশত্রুর হাত থেকে সুরক্ষিত থেকেছে। আমরা শ্রম দিয়েছি বলেই রোম ছোট্ট একটা গ্রাম থেকে আজ সমৃদ্ধশালী নগররাষ্ট্র হয়েছে। আমরা যদি হাত তুলে নিই, প্যাট্রিশিয়ানরা খাবে কি ?’ তাই প্লেবিয়ানরা তাঁদের নেতাদের নেতৃত্বে স্থির করেছেন প্যাট্রিশিয়ানরা তাঁদের একই শহরের নাগরিক হিসেবে অধিকার না দেওয়া অবধি তাঁরা রোমে পদার্পন করবে না। রাত নামে। প্লেবিয়ানরা অস্ত্র সজ্জিত হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে প্যাট্রিশিয়ানরা কি পদক্ষেপ নেয় দেখার জন্য। দুই পক্ষে দূত চালাচালি হয়। দুই শ্রেণির মধ্যে চলতে থাকে দর কষাকষি। শেষ অবধি আপোষ করতে বাধ্য প্যাট্রিশিয়ানরাই। প্লেবিয়ানদের অধিকাংশ দাবিই মেনে নেয় তারা।
ইতিহাস এই ঘটনাকে মনে রেখেছে, ‘Secessio Plebis’ নামে। প্রাচীন রোমের ইতিহাসে শ্রেণি সংঘাতের একটি অন্যতম নিদর্শন হিসেবে বিখ্যাত এই ঘটনা। খুব চিত্তাকর্ষক, সন্দেহ নেই। কিন্তু রচনার শিরোনাম দেখার পর, এই বিষয়ে আলোচনা কেন করছি, পাঠকের মনে সেই প্রশ্নের উদয় হওয়া খুব স্বাভাবিক। গৌরচন্দ্রিকা না করে উত্তর দেওয়া যাক। আসলে ইতিহাসের পাঠক মাত্রেই জানেন, এই দেবী ক্লিওর রসবোধ অসামান্য। যে ‘মন্স সাকের’-এ একদিন প্লেবিয়ানরা সমবেত হয়ে তাদের অধিকার আদায়ের ঐতিহাসিক শপথ নিয়েছিল, সেই ‘মন্স সাকের’ পাহাড়ই এই ঘটনার প্রায় দুই হাজার তিনশো বছর পর সাক্ষী হয়েছিল আরেক ঐতিহাসিক শপথের। ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫-ই আগস্ট এই পাহাড়ে দাঁড়িয়েই এক বাইশ বছরের যুবক শপথ নিয়েছিল আরেক অধিকার আদায়ের - ‘আমি আমার পিতৃপুরুষদের ঈশ্বরের নামে শপথ নিচ্ছি, তাঁদের সমাধির শপথ নিচ্ছি, আমার দেশের নামে শপথ নিচ্ছি, যতদিন স্প্যানিশ শক্তির যে শিকল আমাদের বেঁধে রেখেছে তা আমি চূর্ণ না করছি, ততদিন আমার শরীর বা আত্মাকে একমুহূর্তের জন্যও বিশ্রাম নিতে দেব না।’ প্রখ্যাত ভেনেজুয়েলান কবি আগুস্তো মিহারেস একদা মন্তব্য করেছিলেন, এই যুবক, সিমন বলিভারের জন্মদিন ইতিহাসে লেখে ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের ২৪-শে জুলাই আর জন্মস্থান লেখে অধুনা ভেনেজুয়েলার কারাকাস। সে হতে পারে। কিন্তু যে ‘মুক্তিদাতা’-র নাম আজও পানামা থেকে ভেনেজুয়েলা আর কলম্বিয়া হয়ে পেরু ও বলিভিয়ার মানুষের মুখে মুখে ফেরে, যার ভাবনা ও আদর্শ আজও অর্ধ-মহাদেশের রাজনীতি পরিচালনা করে – এই ‘এল লিবের্তাদোর’-এর জন্মদিন ১৫-ই আগস্ট, ১৮০৫ আর জন্মস্থান রোমের ‘মন্স সাকের’।
পরের কথা বড়ো আগে বলে ফেলছি। বরং শুরু থেকে গুছিয়ে শুরু করা যাক। ইউরোপে তখন জ্ঞানদীপ্তির আলো ক্রমশঃ বৈপ্লবিক আকার ধারণ করছে। পুরনো সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর সদর দপ্তরে কামান দেগে তার জায়গায় নতুন কিছুর স্বপ্ন ভেসে উঠছে রুশো, ভলতেয়ার, মন্তেস্কুর আগুন রাঙা অক্ষরে। ফ্রান্স অগ্নিগর্ভ, যদিও বিপ্লবের নীল-সাদা-লাল ওড়ার দেরি আছে কিছু। সাগর পাড়ে জাগছে আমেরিকাও। উত্তর আমেরিকায় সফল স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষে আত্মপ্রকাশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র – আধুনিক পৃথিবীর প্রথম প্রজাতন্ত্র হিসেবে। দক্ষিণ আমেরিকায় ক্রমশঃ ক্ষোভের আঁচ ধুঁইয়ে উঠছে। কয়েক বছর পরেই, প্রখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী ও অভিযাত্রী ল্যাটিন আলেকজান্ডার ফন হুমবোল্ড ল্যাটিন আমেরিকা ভ্রমণের সময় নিজের চোখে দেখবেন সেই ক্ষোভ। কিন্তু তারপরেও মত দেবেন, এখানে বিপ্লব সম্ভব না, কারণ এই সব ‘অ-সংস্কৃত’ ‘অসভ্য’ দেশের মাটি থেকে কোনও ওয়াশিংটন বা নেপোলিয়ঁর জন্ম নেওয়া অসম্ভব। দেবী ক্লিও হয়তো বা তাঁর অভিমত শুনে মুচকি হেসেছিলেন।
এইরকম আলো-আঁধারিতে, দুই যুগের সন্ধিক্ষণে স্প্যানিশ নিউ গ্রানাডা উপনিবেশের কারাকাস শহরে ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের ২৪-শে জুলাই জন্মগ্রহণ করেন সিমন বলিভার। বালক ওয়াশিংটনের চেরি গাছ কেটে মিথ্যা না বলার মতো, কালক্রমে বালক বলিভারকে নিয়েও নানা কাহিনী প্রচলিত হবে। কেমন তিনি ছোটোবেলা থেকেই মানুষের দুঃখকষ্ট বুঝতেন, কেমন তিনি দল পাকিয়ে স্প্যানিশ সৈন্যদের ঢিল ছুঁড়তেন ইত্যাদি। আজও সেই সব কাহিনী ল্যাটিন আমেরিকায় প্রবল জনপ্রিয়। বলাই বাহুল্য, এই সকল কাহিনীর ঐতিহাসিক ভিত্তি অতি সামান্যই। আদতে, অল্প বয়েস থেকেই স্প্যানিশ শাসনের প্রতি বিরূপ হওয়ার বলিভারের কোনও কারণ ছিল না, সাধারণ মানুষের প্রতি যে সহমর্মিতা তাঁকে পরবর্তীকালে প্রভূত জনপ্রিয়তা প্রদান করেছিল তাও বাল্যকাল থেকে প্রাপ্ত নয়। বলিভারের পরিবার ছিল প্রভূত বৈভবশালী এবং বিশাল জমিদারীর মালিক। তাঁদের অধীনে দাসও ছিল অনেক, ছিল বেশ কয়েকটি খনিও। অর্থচিন্তা বলিভারকে বাল্যকালে করতে হয়নি কখনই, আর সেই আর্থিক সুরক্ষার ভিত্তি ছিল স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার শোষণ এবং দাসদের শ্রম।
তবে আর্থিক বৈভব থাকলেও, বাল্যের ব্যক্তিগত জীবন বলিভারের খুব সুখের ছিল, এমনও বলা চলে না। যখন তিনি একেবারেই বালক, তখনই তাঁর পিতা হুয়ান ভিন্সেন্তে বলিভার এবং মা মারিয়া পালাসিওস প্রয়াত হন। বলিভার বড়ো হন তাঁর মামা এস্তাবান পালাসিওসের কাছে। ভয়ংকর রকম কড়া মামার শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে বলিভার একবার পালিয়েছিলেন বাড়ি থেকেও। এর মধ্যে বন্ধু বলতে ছিল তাঁর ব্যক্তিগত শিক্ষক, সিমন রডরিগেজ। মুক্তচিন্তক দার্শনিক, জ্ঞানদীপ্তির আদর্শের উৎসাহী সমর্থক ও স্প্যানিশ শাসনের বিরোধী রডরিগেজ তাঁর ছাত্রটিকে পুত্রসম ভালোবাসতেন। রডরিগেজের সৌজন্যেই বলিভার ইউরোপে যে বৈপ্লবিক মতাদর্শের অগ্নি প্রজ্বলিত হয়েছে কয়েক বছর আগে, তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান। তাঁর তরুণ হৃদয় এই অগ্নিকে আপন করে নিতে আকুল হয়।
রডরিগেজের সান্নিধ্য অবশ্য বেশিদিন লাভ করা বলিভারের পক্ষে সম্ভব হয় নি। ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে স্প্যানিশ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাঁকে নির্বাসিত করা হয়। রডরিগেজ প্রথমে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, সেখান থেকে ইউরোপে। বলিভারের মধ্যেও ক্রমশঃ কৈশোরের বৈপ্লবিক উত্তেজনা ঠান্ডা হয়ে আসে। তৎকালীন স্প্যানিশ উপনিবেশগুলির উচ্চবিত্ত ‘ক্রিয়য়ো’ সমাজের সব ছেলেদের মতোই বলিভার উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি দেন স্পেনে। মাদ্রিদে তাঁর কার্যকলাপে কোনও বিপ্লবী বা বিদ্রোহী মানসিকতার ছায়া দেখা যায়নি। এই সময় ‘পেনিনসুলারেস’ (যাঁদের স্পেনেই জন্ম) বন্ধুদের ‘গাঁইয়া’ বলে হাসি ঠাট্টার খোঁচা উপেক্ষা করে পড়াশোনা, অস্ত্রশিক্ষা ও সামরিক বিদ্যার অনুশীলনেই বলিভার মন দেন। একজন উচ্চশিক্ষিত যুবক, যাঁর সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ - এই হিসেবেই বলিভারের খ্যাতি গড়ে ওঠে মাদ্রিদের অভিজাত সমাজে। এখানেই বলিভারের পরিচয় হয় মারিয়া টেরেসা রডরিগেজ দেল তোরোর সঙ্গে। পরিচয় শেষে গড়ায় প্রেমে এবং পরিণতি পায় বিবাহে। বলিভার নতুন স্ত্রী নিয়ে যখন ১৮০২ সালে নিউ গ্রানাডার সান মাতিওতে নিজের পৈত্রিক খামার বাড়িতে ফিরলেন, তাঁর মন বিপ্লব থেকে অনেক দূরে ছিল। ইউরোপ প্রবাসে বিপ্লবের আদর্শ অধ্যয়ন করার তাঁর আরও সুযোগ হয়েছে। ইউরোপীয় বিপ্লবের কেন্দ্র পারি শহরও ঘুরে এসেছেন তিনি একবার। তবে সেসব নিছক বৌদ্ধিক কৌতূহল এখন। তিনি ব্যক্তিগত ভাবে নতুন যে উদারপন্থী বিপ্লবী সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে তাকে সমর্থন করেন। বিশ্বাস করেন, রাজতন্ত্র নয়, প্রজাতন্ত্রেই নিহিত মানুষের ভবিষ্যৎ। তাঁর বিদুষী স্ত্রীরও রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা সেই অভিমুখেই। কিন্তু ওই পর্যন্তই। রডরিগেজের কাছে পাঠ লাভের সময় পুরো ল্যাটিন আমেরিকায় বিপ্লবের অগ্নি প্রজ্বলনের যে স্বপ্ন একদা সিমন দেখতেন, আর দেখেন না। স্ত্রী-কে ভালোবাসেন প্রাণাধিক। সম্পত্তি আছে, সম্মান আছে। কি দরকার ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে ?
মানুষ চিন্তা করে এক, আর হয় অন্যরকম। দেশে ফিরে বলিভার যে সুখের সংসারের স্বপ্নে ডুবে ছিলেন, তা ভেঙে গেল কয়েক মাস পরেই। পীত জ্বরের কবলে মারিয়া চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন। সিমনের হৃদয় গেল ভেঙে। সংসারে আর মন বসল না। পরবর্তী কালে তিনি নিজেই বলেছিলেন, মারিয়া যদি না চলে যেত, তাহলে বড় জোর সান মাতিও-এর মেয়র – এই অবধিই আমার রাজনৈতিক কর্মকান্ড থাকত। পরবর্তী কালে ফ্রাঙ্কোর স্পেন থেকে নির্বাসিত সাহিত্যিক সালভাদোর দে মাদারিয়াগা ছোট ছোট ঘটনা ইতিহাসের গতি কিভাবে ঘুরিয়ে দেয়, তার এক উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন মারিয়ার মৃত্যুকে। লিখেছিলেন, এই একুশ বছরের তরুণীর মৃত্যুতে পুরো পৃথিবীর ইতিহাস পাল্টে গেছিল। অতিকথন, নিঃসন্দেহে। ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় ব্যক্তির ভূমিকা অস্বীকার না করেও বলা যায়, সিমন না থাকলেও ইতিহাসের যুক্তিতেই একদিন স্পেন দক্ষিণ আমেরিকা থেকে বিদায় নিত। তবে এও ঠিক, দক্ষিণ আমেরিকা থেকে স্পেনের ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের সেই বিকল্প গাথায় সিমন বলিভারের মতো মহাকাব্যিক চরিত্র হয়তো অনুপস্থিত থাকত।
অবশ্য মারিয়ার মৃত্যুর পরেই বলিভার বিপ্লবী কর্মকান্ডে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, এমন না। কিছুদিনের জন্য তিনি আবার ইউরোপে ফিরে গেলেন। বল নাচের আসরে যান, উচ্চ সমাজের লোকজনের সঙ্গে মেলা মেশা করেন। পাগলের মতো বই পড়া তো রয়েইছে। ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে নেপোলিয়ঁ সম্রাট উপাধি গ্রহণ করেছেন। যে অনুষ্ঠানে তিনি রাজমুকুট মাথায় নিয়েছিলেন, সেখানে বলিভার উপস্থিত ছিলেন। নেপোলিয়ঁর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধ ছিল, কিন্তু প্রজাতন্ত্রের সমর্থক হিসেবে ফরাসী প্রজাতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে তাকে সাম্রাজ্যে পরিণত করাকে বলিভার বরদাস্ত করতে পারেননি। প্রকাশ্যেই পারিতে থাকাকালীন একদিন সম্রাটকে স্বৈরাচারী আর দ্বি-চারক বলে বসলেন। বলাই বাহুল্য পারি থেকে একরকম ঘাড়ধাক্কাই দেওয়া হচ্ছিল তাঁকে আরেকটু হলে। ঘুরতে ঘুরতে বলিভার ফ্রান্স থেকে এসে উপস্থিত হলেন ইতালিতে। এখানে দেখা হয়ে গেল এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে। তাঁর কৈশোরের শিক্ষক, যাঁর হাত ধরে প্রথম রুশো আর মন্তেস্কুর সঙ্গে পরিচয়, সেই সিমন রডরিগেজ তখন ইতালিতে। বহুদিন বাদে একে অপরের সঙ্গে সাক্ষাতে দুজনেই উৎফুল্ল। শিক্ষকের সঙ্গে দেখা হওয়ায় বহুদিন পূর্বে যে ইচ্ছা, যে আবেগ, যে আদর্শ ছাই চাপা পড়েছিল সিমনের মনে, তা আবার দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। এরই মধ্যে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছে আলেকজান্ডার ফন হুমবোল্ডেরও। হুমবোল্ড এই তরুণ নিউ গ্রানাডার যুবকের আদর্শবাদকে সম্মান করেন, আর স্পেনের ঐ উপনিবেশের মুক্ত শিরা থেকে অবিরত কি প্রকার রক্তপাত হচ্ছে, তা তো তিনি নিজের চোখেই দেখেছেন। তবে ওই অঞ্চলে যে ফ্রান্সের মতো বা মার্কিন দেশের মতো প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, এ’কথাও হুমবোল্ড বলিভারকে শোনাতে ভোলেননি। ‘তোমাদের ওয়াশিংটন কে ?’, তাঁর এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি বলিভার। উত্তর দিয়েছিলেন তাঁর শিক্ষক রডরিগেজ, ‘তুমি, সিমন, তুমি আমাদের ওয়াশিংটন।’ হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন বলিভার। কিন্তু যত দিন যায়, তত সেই কৌশরের স্বপ্ন তাঁকে অশান্ত করে তোলে। ‘চেষ্টা করতে দোষ কি ? হারানোর তো কিছুই নেই আমার।’ এই ভাবনা ক্রমে জাঁকিয়ে বসে মনের মধ্যে। অবশেষে ১৮০৫ সালের ১৫-ই আগস্ট সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব টানাপোড়েন পরিত্যাগ করলেন বলিভার। রোমের নিকট ‘মন্স সাকের’ (স্প্যানিশ ভাষায়, ‘মন্তে সাক্রো’) পাহাড়ে বলিভার তাঁর বিখ্যাত শপথ গ্রহণ করলেন। একুশ শতকের ল্যাটিন আমেরিকার আরেক প্রবাদ প্রতিম নেতা এই ঘটনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, পাহাড়ে উঠেছিলেন ডন সিমন বলিভার – দাস-মালিক জমিদার, বল নাচে তুফান তোলা ধনীর দুলাল, শখের দর্শন চর্চা করা অভিজাত, মুখে বড়ো বড়ো আদর্শের কথা বলে কার্যক্ষেত্রে স্প্যানিশ সাম্রাজ্যবাদী কাঠামোর অংশ হয়ে থাকা দ্বিচারক আর নেমে এলেন ‘এল লিবের্তাদোর’ – আমাদের মুক্তির তরবারি যিনি অর্ধ-দক্ষিণ আমেরিকাকে স্প্যানিশ শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করলেন, যাঁর সেনাবাহিনী দাসদের দিল স্বাধীনতা আর যাঁর কলম স্বীকৃতি দিল স্প্যানিশ কঙ্কিস্তোদোরদের দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসীদের পিষ্ট করে রক্তাক্ত বর্বর বিজয়রথ চালানোর ঐতিহাসিক অন্যায়ের সত্যতাকে।
১৮০৭ সালে নিজের দেশে ফিরে এলেন বলিভার। পৃথিবীর রঙ পাল্টাচ্ছিল দ্রুত। স্পেন নিজে তখন নেপোলিয়ঁর সঙ্গে লড়াই করতে ব্যস্ত। নিজের উপনিবেশের দিকে তাকানোর তার সময় নেই। আঘাত করার এই তো প্রকৃষ্ট সময় ! তিনি দ্রুত রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলতে শুরু করলেন। সুযোগ এলো ১৮১১ সালে। কারাকাস দ্বিধা বিভিক্ত। মধ্যপন্থীরা চাইছে বোঝাপোড়া আর স্ব-শাসন। আর বলিভার নেতৃত্ব দিচ্ছেন র্যাডিকালদের, যাঁরা চাইছেন পূর্ণ স্বাধীনতা। নতুন জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন ডাকা হল। ১৮১১ সালের ৪-ঠা জুলাই, তাতে দাঁড়িয়ে বলিভার আবেগমথিত বক্তৃতা দিলেন স্বাধীনতার পক্ষে। বললেন স্বাধীনতা শুধু ঘোষণা করলেই হবে না, তা ঘোষণা করতে হবে এখনই, ‘দ্বিধার অর্থ ধ্বংস আহ্বান করা’। পরের দিন, নিউ গ্রেনাডার ভেনেজুয়ালার ক্যাপ্টেন্সি জেনেরাল ঘোষণা করল স্বাধীনতা। জন্ম নিল প্রথম ভেনেজুয়েলান প্রজাতন্ত্র।
প্রথম প্রজাতন্ত্র জন্ম নিলেও, তার আয়ু বেশিদিন রইল না। যে ‘ক্রিয়োয়ো’ অভিজাত সম্প্রদায় নতুন প্রজাতন্ত্রের মাথায় বসলেন, তাঁরা না দাসদের জন্য কিছু করতে রাজি ছিলেন, না দেশের হত-দরিদ্র মেস্তিজো, মুলাটো এবং আদিবাসী জনতাকে নতুন প্রজাতন্ত্রের শরিক করতে তাঁদের উৎসাহ ছিল। গণভিত্তির অভাবকে সুচারু ভাবে কাজে লাগালো স্প্যানিশ বাহিনী। তাদের হয়ে লড়লে স্বাধীনতা পাওয়া যাবে, এই আশ্বাসে বহু দাস লড়াই করল স্প্যানিশদের পক্ষ নিয়ে, নতুন প্রজাতন্ত্রের পক্ষে নয়। ১৮১২ খ্রিস্টাব্দের মার্চে এক ভয়ংকর ভূমিকম্প হাজার হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিল সমগ্র ভেনেজুয়েলায়। চার্চ জনগণের মধ্যে প্রচার শুরু করল, রাজদ্রোহের পাপের শাস্তি দিচ্ছেন ঈশ্বর। প্রজাতন্ত্রের অনেক পাকা মাথারই তখন ‘স্বাধীনতা’-র শখ মিটে গেছে। স্বয়ং প্রকৃতিও যার বিরুদ্ধে মনে হচ্ছে, সেই লড়াই কে-ই বা লড়তে চায় ? বলিভার, দেখা গেল, সেই লড়াইও দরকার পড়লে লড়তে আগ্রহী। হোসে ডমিনিগো দিয়াজ ভূমিকম্পের পরে বলিভারকে কারাকাসে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে গেছিলেন। তাঁকে দেখে বলিভার বলেছিলেন, ‘যদি প্রকৃতি আমাদের বিরুদ্ধে থাকে, আমরা প্রকৃতির বিরুদ্ধেও লড়ব। প্রকৃতিকেও আমাদের সামনে মাথা নত করতে হবে।’ দিয়াজ ছিলেন রাজতন্ত্রী। তাঁর কাছে বলিভারের এই উক্তি শূন্য কলসির ফাঁকা আওয়াজ বলে মনে হয়েছিল। যদিও পরবর্তী কালে ইতিহাস প্রমাণ করে, এই ভয়ংকর শপথ ফাঁকা আওয়াজ ছিল না। মুক্তির সংগ্রামে আমাজনের জঙ্গল থেকে আন্দিজ পর্বত – প্রকৃতির সকল দুর্গমতাকেই বলিভার অতিক্রম করেছেন বারে বারে।
সাফল্য সহজে আসেনি। ব্যর্থতা ছিল বলিভারের নিত্যসঙ্গী। প্রথম ভেনেজুয়েলান প্রজাতন্ত্র অচিরেই ধ্বসে পড়ে। বিপ্লবী বাহিনী নিউ গ্রানাডায় কলম্বিয়া অঞ্চলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। যখন বিপ্লবী বাহিনীর মধ্যে প্রবল হতাশা, যখন বাহিনীর নেতা মিরান্ডা স্প্যানিশদের সঙ্গে আপোষ করতে আগ্রহী, তখনও বলিভারের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ইতিবাচক। তাঁর মত ছিল, কোনও ভালো কাজই একবারে হয় না। তবে প্রথমবারের ব্যর্থতা, পরের সাফল্যের মতোই জরুরি, কারণ তার শিক্ষা থেকেই আদতে সাফল্যের ভিত তৈরি হয়। তাই হতাশায় ডুবে না থেকে বলিভার এই সময় রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত ‘কার্টাগানা ম্যানিফেস্টো’। প্রথম প্রজাতন্ত্র কেন টিকল না, তার এক গভীর বিশ্লেষণ এই ম্যানিফেস্টোতে ছিল। তার ব্যর্থতা থেকে কি শিক্ষা নেওয়া যায়, তারও একটি বিশ্লেষণ এতে ছিল। তিনি বললেন, বহুধাবিভক্ত কোনও দেশ কখনও ঔপনিবেশিক শক্তিকে প্রতিহত করতে পারে না। প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের। একমাত্র সেইপ্রকার সংগ্রামরেই সফল হওয়ার সম্ভবনা আছে। এরজন্য দরকার এমন এক শক্তিশালী সরকারের যা দেশের সকল নাগরিকদের প্রতিনিধিত্ব করবে। তিনি মত প্রদান করেন, এই অনৈক্যের সুযোগ নিয়েই স্প্যানিশ বাহিনী বিজয়ী হয়েছে। এই ইস্তেহারে তীব্র নিন্দা করা হয় চার্চেরও। ভূমিকম্পের সুযোগ নিয়ে চার্চ কিভাবে সাধারণ মানুষের কু-সংস্কারকে উস্কে দিয়েছে এবং তাকে প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে চালনা করেছে, তার বিশ্লেষণ করেন সিমন। এর বিরুদ্ধে লড়তে গেলে, বিপ্লবীদের চার্চ-বিরোধী অবস্থান নিতেই হবে, তাঁদের ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস যা-ই হোক না কেন।
বলিভার শুধু ব্যর্থতা থেকে শিক্ষাই নিলেন না, সেই শিক্ষার হাতে কলমে প্রয়োগেরও সুযোগ এসে গেল অচিরেই । তাঁর নেতৃত্বে বিপ্লবী বাহিনী পর পর ছ’টি যুদ্ধে স্প্যানিশ বাহিনীকে পরাজিত করে কারাকাসে প্রত্যাবর্তন করল ১৮১৩-এর ৬-ই আগস্ট। মাত্র তিরিশ বছর বয়সে বলিভার দ্বিতীয় ভেনেজুয়েলার প্রজাতন্ত্রের দায়িত্ব নিলেন। কিন্তু তিনি ভালো করে গুছিয়ে বসার আগেই স্প্যানিশ নেতৃত্ব তাঁর প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ভেনেজুয়েলার তৃণভূমি অঞ্চলের বাসিন্দা ‘ল্যানেরোস’-দের খেপিয়ে তুললেন। হোসে টমাস বোভেসের নেতৃত্বে ‘ল্যানেরোস’-এর এই বাহিনী দেশের সর্বত্র প্রজাতন্ত্র বিরোধী রাজনৈতিক সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিল। দ্রুত জনভিত্তি হারালেন তরুণ বলিভার। দ্বিতীয়বারের বিপ্লব প্রচেষ্টাও অচিরেই ব্যর্থ হল। বলিভার প্রথমে আবার কলম্বিয়া আশ্রয় নিলেন, তারপর সেখান থেকে নির্বাসন নিলেন জামাইকা-তে। এখানেই তিনি রচনা করলেন তাঁর বিখ্যাত ‘জামাইকান পত্র’। তাঁর বিপ্লবী ভাবনা কতটা পরিণত হয়েছে, তার প্রমাণ এই চিঠি। এতে তিনি লিখলেন, আধুনিক ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে ল্যাটিন আমেরিকার রক্ত শোষণ করে চলেছে একের পর এক ঔপনিবেশিক শক্তি। স্প্যানিশ ‘কঙ্কিস্তোদর’দের তরবারির আঘাতে এই মহাদেশের মাটি যখন থেকে আদিবাসীদের রক্ত সিঞ্চিত হয়েছে, তখন থেকেই এই শোষণ চলছে। তিনি ঘোষণা করেন, আমরা ইউরোপীয় নই, আমাদের ঐতিহ্য ‘কঙ্কিস্তোদর’-দের ঐতিহ্য নয়। আমরা একটি আলাদা জাতি, যে জাতি সৃষ্টি হয়েছে এই মহাদেশে আগত দাস, আদিবাসী এবং ইউরোপীয়দের মিশ্রণে। আমাদের সংস্কৃতি একটি মিশ্র সংস্কৃতি, আমাদের ঐতিহ্য একটি মিশ্র ঐতিহ্য। আমাদের ধমনীতে যে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে, তাও মিশ্র রক্ত। ইউরোপের দিকে আমাদের তাকানোর কোনও প্রয়োজন নেই, স্পেনকে আমাদের মাতৃভূমি ভাবা মূর্খতা। আমাদের জন্মভূমি এই মহাদেশই। আর এই সকল জনজাতির শৃঙ্খলা মোচনের জন্যই আমাদের সংগ্রাম।
জামাইকা থেকে বলিভার যাত্রা করেন হাইতি-তে। এখানে কিছুকাল আগেই আধুনিক যুগের প্রথম সফল দাস বিদ্রোহ অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রখ্যাত ‘ব্ল্যাক জ্যাকোবিন’-দের নেতৃত্বে। হাইতির প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি আলেকজান্দ্র পেতিয়ঁ সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন বলিভারকে। তিনি উৎসাহিত করলেন এই তরুণকে। বললেন, আমরা দাসরা পেরেছি হাইতি থেকে প্রবল পরাক্রমশালী নেপোলিয়ঁ-র বাহিনীকে বিতাড়িত করতে আর তুমি দুর্বল স্প্যানিশ, যাদের নিজেদের সিংহাসনই এখন নড়বড়ে, তাদের পারবে না তোমার দেশ থেকে বিতাড়িত করতে ? পেতিয়ঁ শুধু উৎসাহই দিলেন না, তার সঙ্গে তিনি বলিভারকে তাঁর বিপ্লব প্রচেষ্টার জন্য প্রদান করলেন অর্থ ও অস্ত্রও। শুধু শর্ত ছিল একটি। কোনও দাস বলিভারের বাহিনীর সামনে আসলে, বলিভার তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য থাকবেন। বলিভার সানন্দে মেনে নিলেন এই শর্ত এবং ইতিহাস সাক্ষী, তিনি এই শর্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। ১৮১৬ সালে ভেনেজুয়েলায় প্রত্যাবর্তনের পরেই বলিভার যে ডিক্রি জারি করেছিলেন, তা ছিল তাঁর অধীনে থাকা তিন প্রদেশের দাসদের মুক্তি প্রদান।
বলিভারের জেদের কাছে প্রকৃতিও যেন হার মানল। বারবার মুক্ত প্রান্তরের যুদ্ধে স্প্যানিশদের কাছে তাঁর বাহিনী আমাজনের জঙ্গলে আশ্রয় নিল। ওরিনকো নদীর তীরে বলিভার গড়ে তুললেন তাঁর মুক্তিবাহিনীর নতুন মুক্তাঞ্চল। সেখান থেকে স্প্যানিশ বাহিনীকে তিনি নানাভাবে আক্রমণ করতে থাকলেন। যে ‘ল্যানারোস’-রা একদা তাঁর নির্বাসনের কারণ হয়েছিল, তাঁদেরই একজন হোসে আন্তনিও পায়েজ হয়ে দাঁড়ালেন তাঁর দক্ষিণ হস্তের মতো। বলিভার আন্দিজ পর্বত অতিক্রম করলেন তাঁর বাহিনী সহ ১৮১৯ সালে। প্রকৃতি সত্যিই তাঁর সামনে মাথা নত করল। তাঁর অতর্কিত আক্রমণে বোজাকার যুদ্ধে স্প্যানিশ বাহিনী হল পরাজিত। এই ঠিক দুই বছর বাদে কারাবোবোর যুদ্ধে স্প্যানিশ বাহিনীর পরাজয় বলিভারের সামনে উন্মুক্ত করল তাঁর জন্মস্থান কারাকাসের রাস্তা। ভেনেজুয়েলা মুক্ত হল আবার বিপ্লবের তরবারির হাত ধরে। বলিভার এখানেই থেমে থাকলেন না। তুষারাবৃত আন্দিজ পর্বত অতিক্রম করার সময় তিনি সৈনিকদের সামনে শপথ নিয়েছিলেন, পুরো মহাদেশ মুক্ত করা হবে তাঁর ব্রত। সেই ব্রত পালনে দক্ষিণ আমেরিকার বাকি উপনিবেশগুলো থেকে স্প্যানিশদের বহিষ্কার করতেও সচেষ্ট হলেন বলিভার। তাঁর বাহিনী ১৮২২ সালে কুইটো নগরীতে প্রবেশ করল, ইকুয়েডর মুক্ত হল ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে। এর পর পেরুর পালা। হুনিন আর আয়াকুচোর যুদ্ধে স্প্যানিশ বাহিনী আবার পরাজিত হল বলিভারের কাছে। এই সময় তিনি পেলেন আরেক বিপ্লবী আন্তনিও হোসে দে সুক্রের অঢেল সহায়তা ও বন্ধুত্ব। সুক্রে পেরুর পার্বত্য অঞ্চল স্প্যানিশ শাসন মুক্ত করলেন। নতুন এই পার্বত্য পেরুর নাম রাখা হল সিমন বলিভারের নামে – ‘বলিভিয়া’।
সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকা স্প্যানিশ শৃঙ্খল মুক্ত। এইবার গড়ার পালা। অত্যন্ত উৎসাহ নিয়ে সেই কাজে ঝাঁপ দিলেন বলিভার। ইকুয়েডর আর পেরু অভিযানের সময় তাঁর জীবনে আবার প্রেমও এসেছে। বিপ্লবী ম্যানুয়েলা সাঞ্চেজের প্রেমে পড়েছেন তিনি। সাঞ্চেজকে অবশ্য বিবাহ করেননি তিনি, মারিয়ার মৃত্যুর পর শপথ নিয়েছিলেন বিবাহ তিনি আর করবেন না। কিন্তু সাঞ্চেজেরও তাতে আপত্তি ছিল না। সেই সময়ে ও সেই সমাজে নারীবাদের উগ্র সমর্থক সাঞ্চেজ প্রাতিষ্ঠানিক বিবাহকে খুব উঁচু চোখে দেখতেন না। বলিভারের সঙ্গে প্রেমের বন্ধনই যথেষ্ট বলে তিনি মনে করতেন। ইতিহাস পরবর্তীকালে দীর্ঘকাল ভুলে ছিল ম্যানুয়েলাকে। কিন্তু বর্তমানে ঐতিহাসিকরা বলেন সাঞ্চেজ বলিভারের চিন্তাকে আরও বিপ্লবী অভিমুখে চালিত করেছিলেন। গুপ্তহত্যা প্রচেষ্টা থেকে তিনি বলিভারের প্রাণ রক্ষাও করেন একবার। তাঁকে একদা বলিভার স্বয়ং উল্লেখ করেছিলেন ‘মুক্তিদাতার মুক্তিদাতা’ হিসেবে।
সব ইতিবাচক অবশ্য ছিল না। ভেনেজুয়েলা, কলম্বিয়া আর ইকুয়েডর নিয়ে এক নতুন দেশ আত্মপ্রকাশ করল। ‘গ্রান কলম্বিয়া’ নামের এই নতুন দেশের প্রেসিডেন্ট হলেন বলিভার। কিন্তু শুরুতেই তিনি তাঁর কর্মসূচীর বাস্তবায়নে ধাক্কা খেলেন। অভিজাত সম্প্রদায় দাসমুক্তিতে রাজি নয়। রাজি নয় বলিভারের ভূমিসংস্কার কর্মসূচীর বাস্তবায়নে। বলিভার যখন ঘোষণা করলেন প্রত্যেক নাগরিককে ৪৪ হেক্টর জমি দিতে হবে, তা নিয়ে রীতিমত হৈ চৈ পড়ে গেল। তাঁর প্রাণনাশের প্রচেষ্টা হতে থাকল। চার্চ আবার বলিভারের বিরুদ্ধে জনতার মধ্যে জোরালো প্রচার শুরু করল। বলিভার বিপ্লবী যুদ্ধের সময় লাগাতার চার্চের বিরুদ্ধে লিখেছিলেন, চার্চের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। সেই অপমান চার্চ ভোলেনি।
এদিকে উত্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ভুঁইফোড় নতুন প্রজাতন্ত্রকে মোটেই ভালো চোখে দেখছিল না। এমনকি স্প্যানিশরা যখন দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলির স্বাধীনতা স্বীকার করে নিয়েছিল, তখনও তাঁরা এই দেশের স্বাধীনতা স্বীকার করেননি। বলিভার বারংবার সতর্ক করেন, নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলি যদি এক না হয়, তাহলে অচিরেই ‘উত্তরের শক্তি’ আমাদের আবার দাসে পরিণত করবে। তাঁর সোজাসাপ্টা উক্তি ছিল, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভবিতব্যই হচ্ছে ‘স্বাধীনতা’-র নামে প্লেগের মতো সর্বত্র দুর্দশা ছড়িয়ে দেওয়া।” ইতিহাস বলিভারের এই পর্যবেক্ষণকে সঠিক প্রমাণ করেছে। কিন্তু ল্যাটিন আমেরিকার সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশগুলি এক হওয়া দূরে থাক, গ্রান কলম্বিয়ার মধ্যেই ঐক্য রক্ষা করা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছিল। ভেনেজুয়েলা আর কলম্বিয়ার নেতৃত্ব একে অপরের সঙ্গে স্বাধীনতার পর থেকেই সংঘাতে লিপ্ত ছিল। ভেনেজুয়েলায় পায়েজ আর কলম্বিয়ার সান্তানদেরের মধ্যে বিরোধ এমন জায়গায় পৌঁছল, যে শেষে গ্রান কলম্বিয়ায় লেগে গেল গৃহযুদ্ধ। বলিভারের আপ্রাণ চেষ্টায় একরকম সাময়িক মিটমাট হল। কিন্তু লড়াই চলতেই থাকল। যে পেরু বলিভারের প্রচেষ্টা ছাড়া স্বাধীনতাই পেত না, তারা গ্রান কলম্বিয়ার ইকুয়েডর আক্রমণ করে বসল। বলিভারের সুহৃদ ও সহ-বিপ্লবী সুক্রের প্রচেষ্টায় এই আক্রমণ প্রতিহত হল বটে, কিন্তু বলিভারের মন ভেঙে গেল। তাঁর বিরুদ্ধে সর্বত্র গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্র চলছে, দেশে এক মুহূর্ত শান্তি নেই। তাঁর কোনও কর্মসূচীই বাস্তবায়িত হচ্ছে না। শেষ আঘাত ছিল তাঁর পুরনো সেনাপতি হোসে মারিয়া কর্ডোবার সামরিক ক্যু-এর প্রচেষ্টা। ক্যু প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও, বলিভারের মন গেল ভেঙে। তিনি স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ত্যাগ করে ইউরোপ যাত্রা করলেন ম্যানুয়েলার সঙ্গে। ইউরোপে পৌঁছেই আবার দুঃসংবাদ। যাঁকে তিনি নিজের উত্তরাধিকারী বলে ভেবেছিলেন, সেই সুক্রে গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হয়েছেন। তড়িঘড়ি আবার দেশে ফিরলেন বলিভার। কিন্তু পরপর এই সমুদ্র যাত্রা তাঁর দুর্বল অসুস্থ শরীরকে আরও দুর্বল করে দিল। যে লৌহদৃঢ় মন বহু প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁর দেহকে ভাঙতে দেয়নি, তা তো ভেঙে পড়েছিল আগেই। সুক্রের মৃত্যুর কয়েক মাসের মধ্যেই ১৮৩০ সালের ১৭-ই ডিসেম্বর মাত্র সাতচল্লিশ বছর বয়সে বিপ্লবের তরবারি সিমন বলিভার সান্টা মার্তায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। না, একথা বলা সম্ভবতঃ ভুল হলো। ডন সিমন বলিভার, দাসমালিক ও জমিদার, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলে তাঁর অন্ত্যেষ্টি হত ধুমধাম করে বিপুল অর্থের বিনিময়ে। আদতে প্রয়াত হলেন ‘এল লিবের্তাদোর’, যিনি ছিলেন কপর্দক শূন্য, যাঁর মৃত্যুর সময় পরনের জামাটি অবধি ছিল ধার করা।
মৃত্যুকালে বলিভার নিজের কৃতিত্ব সম্পর্কে ছিলেন সন্দিহান। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, আমার সারা জীবনের প্রচেষ্টা বকলমে সাগরে হাল চষা ছাড়া কিছুই হয়নি। তাঁর নিজের হিসেবে, তাঁর পুরো জীবনের প্রচেষ্টাই ছিল ব্যর্থ। আপাত দৃষ্টিতে তাই। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলি একে অপরের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত, দাসদের তখনও পরিপূর্ণ মুক্তি আসেনি, আদিবাসীরা নতুন প্রজাতন্ত্রে সমমর্যাদা লাভ করেননি, সামরিক বাহিনী খুবই শক্তিশালী এবং নতুন প্রজাতন্ত্রগুলিতে ক্যু-এর সম্ভবনাও প্রবল। কিন্তু তাঁর এই মূল্যায়ন সঠিক নয়। বলিভার আদতে সূর্য ছুঁতে চেয়েছিলেন। তাই হাতে চাঁদ পেয়েও তিনি খুশি হননি। প্রায় অর্ধ-মহাদেশে ইউরোপীয় শৃঙ্খল মুক্তিতে তাঁর অবদানের কথা যদি সরিয়েও রাখা যায়, বলিভারের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উত্তরাধিকার ছিল তাঁর বিপ্লবী ভাবনা, যে ভাবনায় জ্ঞানদীপ্তির আদর্শের সঙ্গে মিশেছিল দক্ষিণ গোলার্ধের মানুষদের বিশেষ আকাঙ্খা। সর্বজনীন শিক্ষা, নারী স্বাধীনতা, দাসমুক্তি, ভূমি সংস্কার, মিশ্র জাতি ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে লালন – বলিভারের এই সকল আদর্শ তাঁর মৃত্যুর বহু পরেও প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে গেছে। ল্যাটিন আমেরিকায় জন্ম দিয়েছে একের পর এক বিপ্লবী নেতার। যতদিন ল্যাটিন আমেরিকার উন্মুক্ত ধমনী থেকে সেই মহাদেশের মানুষকে শোষণ করার প্রচেষ্টা থাকবে, ততদিন বলিভারের মুক্তির তরবারি খুঁজে নেবে তার উত্তরাধিকারীকে।
পাবলো নেরুদা ঠিক এই কারণেই বলিভারকে স্মরণ করে লিখেছিলেন –
"Yo conocí a Bolívar una mañana larga,
en Madrid, en la boca del Quinto Regimiento,
Padre, le dije, eres o no eres o quién eres?
Y mirando el Cuartel de la Montaña, dijo:
"Despierto cada cien años cuando despierta el pueblo".
ইংরেজিতে যার অর্থ হয়-I met Bolivar one long morning,
in Madrid, at the entrance to the Fifth Regiment.
Father, I said to him: are you or are you not, or who are you?
And looking at the Mountain Barracks, he said:
‘I awake every hundred years when the people awake.’