আট বছর পর রক্ষণশীলদের হারিয়ে নরওয়েতে ব্যাপক জয় পেলেন মধ্য-বামপন্থীরা। ফলে নরওয়ে-সহ ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড— স্ক্যান্ডেনেভিয়ার পাঁচটি দেশের সবক’টিতেই এখন মধ্য-বামপন্থী সরকার। নির্বাচনের এই ফল দেশের তেল শিল্পের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
১৬৯-সদস্যের সংসদে লেবার পার্টি ও তার দুই শরিক সেন্টার পার্টি এবং সোস্যালিস্ট লেফট মিলে পেয়েছে ৮৯টি আসন। যেখানে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ছিল ৮৫টি আসন। তাক লাগিয়ে দেওয়া সাফল্য পেয়েছে বামপন্থী কমিউনিস্ট রেড এবং গ্রিনরা। দুই দলের মিলিত আসন সংখ্যা দুই থেকে বেড়ে হয়েছে ১১। লেবার পার্টির সরকারে এই দুই দল শেষ পর্যন্ত যোগ দেবে কি না, এখনও নিশ্চিত নয়। তবে লেবার পার্টির নেতা জোনাস গার স্টোর বলেছেন, ‘অন্যান্য দলগুলির সঙ্গে আলোচনার জন্য আমরা অনেকটা সময় নেব। কোনও কিছু ঠিক হওয়ার আগে আমরা অন্তত কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে বসব না।’
২০১৩ থেকে নরওয়ের ক্ষমতায় কনজারভেটিভ নেত্রী অ্যারনা সোলব্যর্গের নেতৃত্বাধীন জোট। আট বছর পর তাদের ক্ষমতাচ্যূত করলেন মধ্য-বামপন্থীরা। নির্বাচনে জয়ের পর জোনাস বলেছেন, ‘আমরা এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম, আশায় ছিলাম, আমরা খুবই পরিশ্রম করেছি। শেষ পর্যন্ত আমরা পেরেছি।' প্রধানমন্ত্রীও হয়েছেন তিনি। তবে তাঁর দল লেবার পার্টির আসন সংখ্যা কমেছে। একটি আসন কমে হয়েছে ৪৮। কমেছে সমর্থনের হারও। এক শতাংশের ওপর কমে হয়েছে ২৬.৪ শতাংশ। গত শতকের দুইয়ের দশকের পর থেকে অন্যতম খারাপ ফল। স্বাভাবিক। লেবার পার্টি এখন নামেই ‘লেবার’। ইউরোপের অন্যান্য সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির মতোই সমর্থনের মূল ভিত্তি আর শ্রমজীবী মানুষ নন। পার্টি এখন মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্ত-কেন্দ্রিক। পার্টি অনেক বেশি মুক্ত বাজারমুখী, ইউরোপীয় ইউনিয়নপন্থী। যেমন দলের নেতা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জেনস স্টেলটেনবার্গ (২০০১-১৩) দেশের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেসরকারিকরণকে পর্যন্ত সমর্থন করেছিলেন। স্টেলটেনবার্গ এখন মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর মহাসচিব। আর লেবারের সরকার থাকাকালীনই নরওয়ের ন্যাটো-তে যোগদান। এবং প্রথম দিন থেকেই। আর এভাবেই দল হারিয়েছে তার চিরায়ত জনভিত্তি। শিল্পাঞ্চলের সঙ্গেই গ্রামাঞ্চলের। একদলীয় সরকার গড়ার সেই দিনও আর নেই। ২০০৫ থেকে।
তবে এবারে পরিস্থিতি সামলে দিয়েছে লেবার পার্টির দুই শরিক। সেন্টার পার্টির আসন ন’টি বেড়ে হয়েছে ২৮। সোস্যালিস্ট লেফটের দু’টি আসন বেড়ে ১৩। এবং এই দুই দলেরই বেড়েছে সমর্থনের হার। পরিস্থিতি আঁচ করে লেবার নেতা জোনাস বলছেন, ‘নরওয়ের মানুষ একটা বার্তা দিয়েছেন। তারা ন্যায্য সমাজ চান, যেখানে কোনও বিভেদ থাকবে না।’
অন্যদিকে, কমিউনিস্ট রেড পার্টির আসন সংখ্যা এক থেকে বেড়ে হয়েছে ৮। সমর্থনের হার দ্বিগুন বেড়ে ৪.৭ শতাংশ। ২০০৭ সালে নরওয়ের মাওবাদীরা এই পার্টি তৈরি করলেও জানিয়ে দেন তাঁরা সংসদীয় পথকে বেছে নেবেন। পাশাপাশি গ্রিনদের আসন এক থেকে বেড়ে হয়েছে ৩। বেড়েছে সমর্থনের হারও।
বিপরীতে কনজারভেটিভ পার্টির আসন ৪৫ থেকে কমে হয়েছে ৩৬। কমেছে শরিক দল উগ্র দক্ষিণপন্থী প্রগ্রেস পার্টির আসন সংখ্যা। সাতাশ থেকে কমে হয়েছে ২১। দুই দলেরই কমেছে সমর্থন। যথাক্রমে ৪.৭ শতাংশ এবং ৩.৫ শতাংশ। একইসঙ্গে কমেছে শরিক দল খ্রিস্টান ডেমোক্রেটিক পার্টির আসন সংখ্যা। আট থেকে কমে হয়েছে ৩। লিবারেল পার্টির রয়েছে একই আসন, আটটি।
মানব উন্নয়ন সূচকে নরওয়ে শীর্ষে থাকলেও বেড়ে চলেছে অসাম্য। ১ শতাংশের হাতে মোট আয়ের ২০ শতাংশ। বেড়ে চলেছে বিলিওনেয়ারের সংখ্যা আর তাঁদের সম্পদের পরিমান। কমিউনিস্ট রেড পার্টি, সোস্যালিস্ট লেফট-সহ বামপন্থীদের স্লোগান ‘অল্প কয়েকজনের জন্য নয়, অধিকাংশের জন্য’ তাঁদের মন কাড়ছে। তাঁরাই পেয়েছেন সাফল্য।
পশ্চিম ইউরোপের বৃহত্তম তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদক দেশ নরওয়ে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য নয়। দেশের জিডিপি’র ১৪ শতাংশ, রপ্তানির ৪০ শতাংশই আসে তেল ক্ষেত্র থেকে। ১,৬০,০০০ মানুষ সরাসরি যুক্ত। এবারের নির্বাচনে মুখ্য ইস্যু ছিল জলবায়ু পরিবর্তন। এবং দেশের জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্প। বামপন্থীরা বলেছেন, তেলভিত্তিক অর্থনীতি থেকে ধীরে ধীরে নরওয়েকে সরে আসতে হবে। গ্রিন পার্টি অবিলম্বে তেল খোঁজার কাজ বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে। কম ও মধ্য আয়ের মানুষদের কর কমিয়ে ধনীদের ওপর বেশি কর আরোপের কথা বলেছেন বামপন্থীরা।
এখন দেখার নরওয়ের কতটা পরিবর্তন আসে! লেবার পার্টি আদৌ নিজেকে পরিবর্তন করতে পারে কি না!
শেয়ার করুন