দেশের মানুষের শৃঙ্খলমুক্তির লড়াই এবং সুভাষচন্দ্র বসু

অতন্দ্র দেশপ্রেমিক সুভাসচন্দ্র বসু

সোমনাথ ভট্টাচার্য

এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অবিসংবাদি নেতা ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। আন্দোলনে অংশ নেবার পর ভারতের স্বাধীনতাই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান-স্বপ্ন। জন্ম ১৮৯৭ এর ২৩শে জানুয়ারি। মৃত্যু নিয়ে ঘোর সংশয়। ১৯৪৫-র ১৭ই আগস্ট সায়গনের যে বিমানটিতে সুভাষ উঠে ছিলেন তারপর যা হলো, এর সুস্পষ্ট উত্তর নেই। জাপানের রেনকোজি মন্দিরে রাখা চিতাভস্ম সত্যিই সুভাষচন্দ্রের কি না - এনিয়েও নানা মুনির নানা মত। কিন্তু যে প্রশ্ন নিয়ে কারো কোন দ্বিমত নেই তা হল সুভাষের দেশপ্রেম। সেখানে তিনি অনন্য, ১০০% খাঁটি। তার মৃত্যু নিয়ে যতই সংশয় থাকুক না কেন, প্রতিটি দেশপ্রেমিক ভারতবাসীর হৃদয়ে তিনি অমরত্ব লাভ করেছেন। সেখানে সুভাষের জন্য তারা সোনার সিংহাসন পেতে দিয়েছে।

যখন দেখি ১২৫-তম জন্মবর্ষ উপলক্ষে বিজেপি এবং কেন্দ্রীয় সরকার সুভাষচন্দ্র-কে দখল করার চেষ্টা করছে বাংলার আসন্ন ভোটে সুভাষ-আবেগকে কাজে লাগানোর জন্য তখন লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। সারা জীবন ব্রিটিশের তাঁবেদারী করা, মুচলেকা লিখে জেলখানা থেকে নিজেদের বীর সদস্যদের ছাড়িয়ে আনা আরএসএস কখনো সুভাষচন্দ্রের মতো দেশপ্রেমিকের মূল্যায়ন করতে পারে!

ওদের সুভাষ প্রেমের একটাই উদ্দেশ্য, পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন বিধানসভা ভোটে সুভাষ সেন্টিমেন্টকে বিজেপির পক্ষে কাজে লাগানো। কারণ ওরা জানে, তাদের প্রাণের প্রিয় সুভাষচন্দ্রের প্রতি কিঞ্চিৎ বিরূপতা ব্যক্ত করার প্রতি বরাবর কৃপণতা দেখিয়েছে বাঙালি। এ ব্যাপারে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও কম বলেননি। তাই সুভাষকে কব্জা করতে পারলে বাংলার ভোটে লাভ বেশি। আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করতে হবে সুভাষ-কে নিয়ে রাজনীতি করার এই ঘৃণ্য প্রচেষ্টা কে।

আজাদ হিন্দ ফৌজের মহড়া চলাকালীন - সাথে ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগল

সুভাষ আইসিএস পড়তে ইংল্যান্ডে যান। কিন্তু পরীক্ষায় পাশ করার পর সিদ্ধান্ত নেন, এ চাকরি তিনি করবেন না। কারণ ব্রিটিশের গোলামী করার জন্য তার জন্ম হয়নি। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, মানবজাতির উন্নতি সাধনে জীবন উৎসর্গ করবেন। সংকল্প করে ব্রিটিশের শৃংখল থেকে মুক্ত করবেন প্রিয় স্বদেশ কে। তাই বিদেশ থেকে ফেরার সময় ১৯২১ - এর ১৬ জুলাই জাহাজ যখন বোম্বাই বন্দরে নোঙ্গর করল সুভাষ সোজা চলে গেলেন গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে। দেশজুড়ে তখন অসহযোগ আন্দোলন, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন গান্ধীজি।

মহাত্মা গান্ধী এবং সুভাষচন্দ্র বসু

গান্ধীর কাছে সুভাষ তিনটি প্রশ্ন রেখেছিলেনঃ

ক) কংগ্রেস পরিচালিত বিভিন্ন কাজ কিভাবে শেষ হবে?

খ) কেবলমাত্র কর দিতে অস্বীকার করলে আর অসামরিক ক্ষেত্রে অসহযোগিতা করলেই সরকার চলে যাবে?

গ) এক বছরের মধ্যে স্বরাজ লাভের আশায় গান্ধী দিলেন কি করে?

গান্ধীজী তার সুভাষ সুলভ ভঙ্গিমায় প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য প্রথম প্রশ্নে গান্ধীর উত্তরে সুভাষ সন্তুষ্ট হলেও দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রশ্নের উত্তরে তিনি মোটেই খুশি হলেন না। কবে তার পরামর্শে সুভাষ কলকাতায় এসে চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে দেখা করেন এবং চিত্তরঞ্জন এর মধ্যে তিনি তার প্রকৃত নেতাকে খুঁজে পান। এর আগে তিনি বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ ও অরবিন্দের চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হন। এছাড়াও কয়েকজন ইউরোপীয় চিন্তাবিদদের ভাবনা ও তাকে প্রভাবিত করে যার মধ্যে অন্যতম দাঁতে (Dante)।

দেশের মধ্যে সুভাষের রাজনৈতিক কার্যকাল মোটামুটি কুড়ি বছর। ১৯২১ থেকে ১৯৪১ - এর ১৬ ই জানুয়ারি কলকাতার বাসভবন থেকে মহানিষ্ক্রমণ পর্যন্ত। কিন্তু এই সময়ের মধ্যেই তাকে এগারো বার গ্রেফতার করেছে ব্রিটিশ পুলিশ। ব্রিটিশের চোখে এতটাই বিপদজনক ছিলেন সুভাষচন্দ্র সেকথা ইংরেজ সরকারের মিনিটের ইন্টেলিজেন্স দপ্তর একটি গোপন রিপোর্টে অকপটে স্বীকার করেছে!

সুভাষচন্দ্র ও তার আজাদ হিন্দ ফৌজ যদি আর কিছুদিন আগে অভিযান শুরু করতে পারতো, অন্তত ১৯৪২ - এর আগস্ট আন্দোলনের সময় যদি এই অভিযান করা হতো, তাহলে ইংরেজ সরকার নিঃসন্দেহে ভীষণ বেকায়দায় পড়ে যেত।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলিকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে ব্রিটিশ সরকার কি গান্ধীজীর ভয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল? উত্তরের অ্যাটলি বলেছিলেন: না, গান্ধীজী নন; সুভাষচন্দ্র।

এটাই ভারতের ইতিহাসে সুভাষচন্দ্র স্থান।

যদি প্রশ্ন করা হয় সুভাষের কি সীমাবদ্ধতা ছিল না? ত্রুটি ছিল না? নিঃসন্দেহে ছিল। হিটলার, মুসোলিনি, তোজোর হাত ধরা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। ফ্যাসিবাদ ও সমাজবাদের ধারণার স্পষ্টতা না থাকায় এই দু দিক তিনি মেলাতে চেয়েছিলেন। তার মত প্রাজ্ঞ ব্যক্তির কাছে শিল্প বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছিল কিনা, তা জানা যায় না। কারণ ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তার কোন নিদর্শন পাওয়া যায়নি।

এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে কোন ব্যক্তি বা ঘটনার ওপর সময়ের ছায়া পড়লে তবেই তার প্রকৃত ঐতিহাসিক মূল্যায়ন করা সম্ভব হয় এবং সেই উপলব্ধি অনেক বেশি অর্থবহ হয়ে ওঠে। সুভাষ চন্দ্রের ক্ষেত্রে সেই ঐতিহাসিক মূল্যায়ন আমাদের দেখিয়ে দেয় পূর্বোক্ত সীমাবদ্ধতাগুলি সত্বেও তার অসমাপ্ত অবদান ছিল অনেক অনেক বেশি, যার জন্য আধুনিক ভারত তার কাছে ঋণী। কংগ্রেসের মধ্যে শ্রমিক-কৃষক মেহনতী মানুষের স্বার্থে লড়াইকে গুরুত্ব দেবার কথা বলে বামপন্থী আদর্শকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে যারা সচেষ্ট ছিলেন, তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য সুভাষচন্দ্র।

কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকে লেনিনের সাথে মানবেন্দ্রনাথ রায়

অক্টোবর - ১৯২০ তে প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পর কমিউনিস্ট পার্টি ১৯২১ সাল থেকে পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলে আসছে।

কংগ্রেসের মধ্যে এই দাবী বছরের-পর-বছর প্রত্যাখ্যাত হলেও, যারা সেই দাবিতে সোচ্চার ছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম সুভাষ।

১৯২৯ সালে লাহোর কংগ্রেসের যখন পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপিত হয় তখন সুভাষচন্দ্র বলেন পূর্ণ স্বাধীনতা কেবল চাইলেই হবে না, এমন কর্মসূচি নিতে হবে যাতে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করা যায়।

১৯২৯ সালে লাহোর কংগ্রেস অধিবেশনে পূর্ণ স্বরাজের প্রস্তাব

১৯৩৮ সালে হরিপুরা সম্মেলনে সুভাষ প্রদত্ত সভাপতির ভাষণ বিশেষভাবে স্মর্তব্য। সেখানেই তিনি তুলে ধরেন, দারিদ্র দূরীকরণ, শিক্ষার প্রসার এবং উৎপাদন ও বন্টন এর বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির কথা। বলেন ভূমি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা ও জমিদারি প্রথা বিলোপের কথা। সেই সঙ্গে বলেন কৃষককে ঋণমুক্ত করার কথা, সমবায় স্থাপনের কথা, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ভারী শিল্প গড়ে তোলার কথা। যা ছিল ভবিষ্যৎ ভারত গড়ে তোলার রোড ম্যাপ।

সুভাষচন্দ্র ঘোষণা করলেন, স্বাধীনতা বলতে আমি সর্বাঙ্গীণ স্বাধীনতা বুঝি। ব্যক্তির ও সমাজের, নর ও নারীর, ধনী ও দরিদ্রের, সকল লোকের ও সকল শ্রেণীর স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার অর্থ কেবল রাজনৈতিক বন্ধনমুক্তি নয়, এই স্বাধীনতা সম্পদ কে সমভাবে বন্টন করবে, বর্ণ বিভাগ ও সামাজিক বৈষম্যের অবসান ঘটাবে, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা কে ধ্বংস করবে।

সুভাষচন্দ্র ছিলেন একান্ত ধর্মপ্রাণ মানুষ আবার একই সঙ্গে আপাদমস্তক সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী। সম্প্রীতির প্রশ্নে তিনি ছিলেন সদা জাগ্রত। সেই কারণে তার বিশ্বস্ত সহযোদ্ধাদের তালিকায় ছিলেন আবিদ হাসান, হবিবুর রহমান প্রমূখ।

আজাদ হিন্দ ফৌজের বিশ্বস্ত সহযোদ্ধাদের সাথে সুভাষচন্দ্র বসু

জাতিভেদ সম্পর্কেও তিনি ছিলেন সোচ্চার। ১৯২৯, মার্চে, রংপুরে তিনি বললেন, বর্ণাশ্রম প্রথা ভেঙে দিয়ে সকলেই হয় ব্রাহ্মণ হোন না হয় শূদ্র হোন।

সমতার প্রশ্নটিতে সুভাষ বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। পুনে বক্তৃতায় তিনি বললেন, এমন একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে যেখানে জন্ম, বর্ন, ধর্ম বিচার না করে প্রত্যেকে সমান অধিকার পাবে। অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা সমানভাবে দেওয়া হবে।

আজাদ হিন্দ ফৌজের বিশ্বস্ত সহযোদ্ধাদের সাথে সুভাষচন্দ্র বসু

ভগৎ সিং এর ফাঁসির আদেশ রদ করার ব্যাপারেও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন সুভাষ। যদিও তা কার্যকর হয়নি।

প্রায় দুশো বছর পরাধীন ভারতে নানা ধরনের লড়াই হয়েছে। কিন্তু বিদেশের মাটিতে একটা অস্থায়ী স্বাধীন ভারত সরকার স্থাপন করে শত্রু ইংরেজ সরকারকে নোটিশ দিয়ে আন্তর্জাতিক আইন মোতাবেক সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করার মতো ঘটনা আজাদ হিন্দ ফৌজ ও তার সর্বাধিনায়ক সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বেই প্রথম সম্ভব হয়েছিল। আজাদ হিন্দ ফৌজ স্থায়ী হয়নি কিন্তু তাদের লড়াই, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ ভারতবর্ষের ইতিহাসে সুদূর প্রসারী ছাপ ফেলেছিল।

এ ধরনের আরও অসংখ্য কাজ তিনি করেছেন, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাই তিনি - অনন্য। তার স্থান আমাদের মনের মনিকোঠায়।

ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া সুত্রে প্রাপ্ত


শেয়ার করুন

উত্তর দিন