দীধিতি রায়
"আমি ইউনিভার্সিটি টপার, রাজ্যপালের থেকে গোল্ড মেডেল নিয়েছি। এখন কিভাবে প্রমাণ করব আমি যোগ্য' - হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলছেন এক শিক্ষিকা। এমনই অবস্থা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একটা বড় অংশের। যারা নিজের যোগ্যতার পরিচয় দিয়েই চাকরি পেয়েছিলেন তাদের এক রাতের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের এক নির্দেশে যেভাবে চাকরি চলে গেল, তার ফলে অনিশ্চিত ভবিষ্যতে কার্যত এই যোগ্য শিক্ষকরা দিশেহারা।
২০১৬ সালে WBSSC এর যে পরীক্ষা হয়েছিল তাতে তিনটি ভাগের পরীক্ষা হয়েছিল। আপার প্রাইমারি অর্থাৎ পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি, নবম-দশম, একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক এবং তার সাথে গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি। সেই সময় আপার প্রাইমারি রিক্রুটমেন্ট বন্ধ থাকলেও নবম দশম, একাদশ দ্বাদশ এবং গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি কর্মীরা নিয়োগ হয়। এবং গত ৩ রা এপ্রিল নিয়োগ হওয়া এই ২৫৭৫৩ জনের চাকরি বাতিল হয় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে,যার মধ্যে ১১৬০০ জন নবম দশম শ্রেণির শিক্ষক,৫৫৯৬ জন একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক। এবং সোমা দাস ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার কারণে মানবিক কারণেই তার চাকরি বহাল রাখে কোর্ট। সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না ও বিচারপতি সঞ্জয় কুমার এই মামলার রায় দিতে গিয়ে বলেন, এস এস সি এর এই দুর্নীতি সংবিধানের ১৪ এবং ১৬ নং অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। বৃহৎ অর্থে কারচুপির কারণেই এখন আর কে যোগ্য আর কে অযোগ্য তা পৃথক করা যাচ্ছে না। কমিশন সব জানা সত্ত্বেও কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এবং সিবিআই যে ৬২৭৬ জনকে টেন্টেড বলে জানিয়েছে তাদের সুদ সহ বেতনও ফেরত দিতে হবে কারণ তারা জালিয়াতি করে চাকরি পেয়েছে। মূলত যারা প্যানেলের বাইরে থেকে চাকরি পেয়েছে, মেধাতালিকার পেছন থেকে সামনের দিকে এগিয়ে এসে চাকরি পেয়েছে, যাদের নিয়োগের খবর কমিশনের কাছে ছিল না অর্থাৎ যারা টাকা দিয়ে কারচুপি করেছে তাদের আলাদা করা গেছে এবং তাদের টেন্টেড বলে চিহ্নিত করাও হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ও এম আর শীট এ কারা কারচুপি করেছে তা ধরা যাচ্ছে না। কারণ ও এম আর শীটের কোনো মিরর ইমেজ কমিশনের কাছে নেই, এবং তা পরিকল্পনা মাফিক ধ্বংস করা হয়েছে। যেকোনো পরীক্ষার পর ২০ বছর উত্তরপত্র সংরক্ষিত করার নিয়ম থাকলেও এস এস সি তা মানে নি। কার্যত সংগঠিত ভাবেই পরিকল্পনা করে চাকরি বিক্রি করে তৃণমূল, আর যার বলি হল যোগ্য শিক্ষকরাও।
কেবল শিক্ষকরা বলি হয়েছে তা নয়, বলি হয়েছে পড়ুয়ারা, বলি হচ্ছে স্কুল শিক্ষা।

ও এম আর বিকৃত করেছে উত্তরপ্রদেশের নয়ডার সংস্থা নাইসা কমিউনিকেশন প্রাইভেট লিমিটেড। নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগে থেকেই ও এম আর নষ্ট করা শুরু হয়েছিল। কেবল শিক্ষকদের না, শিক্ষাকর্মীদেরও ও এম আর নষ্ট করা হয়। এবং এর ভাইস প্রেসিডেন্ট নিলাদ্রী দাসই দায়িত্ব নিয়ে ও এম আর শীট বিকৃত করেছে, পুড়িয়েছে, প্রাপ্ত নম্বর সংরক্ষিত করার বদলে তা বদলে দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ২২,৩৫ নং অনুচ্ছেদে এ সম্পর্কে রাজ্য সরকারকে কড়া সমালোচনা করেছে আদালত। আরো অদ্ভুত ব্যাপার, এই কোম্পানির মাধ্যমেই লোকসভা ভোটের আগে ৮০০ কোটি টাকা তুলেছে তৃণমূল। এবং এই নাইসাকেই রাজ্য সরকার ও এস এস সি পরবর্তী বেশ কিছু পরীক্ষার বরাত দেয়। নাইসা এমনভাবে ও এম আর কে বিকৃত করেছে যার ফলে ৫৫ তে যে ব্যক্তি পেয়েছে ৯ তার নম্বর বদলে দেওয়া হয়েছে ৪৫ এ। কয়েক লাখ টাকার বিনিময়ে এই দুর্নীতি হয়েছিল। গ্রেফতার হয়েছে ২৮ জন। এই অপরাধের দায় যতটা মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর, ততটাই শুভেন্দু অধিকারীর। বিজেপি-তৃণমূল নেতারাই লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে চাকরি বিক্রি করল।
গত কয়েকবছর ধরে তৃণমূলের শাসনে গ্রাম বাংলা জুড়ে এক নব্য ধনী শ্রেনির উদ্ভব ঘটেছে যাদের আয়ের মূল উৎস দুর্নীতি-কাটমানি এবং তাদের সাথে গুণ্ডারাজের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। এই করাপশন-ক্রিমিনাল নেক্সাসই তৃণমূলের কর্মীবাহিনীর মূল পুঁজি। তাই একে ভর করেই গ্রাম বাংলার ব্লক ধরে ধরে চাকরি বিক্রি চলেছে।
৩ রা এপ্রিলের পর বাংলার স্কুল শিক্ষা প্রবল সংকটের মুখোমুখি হয়। এমনিই পশ্চিমবঙ্গের ৮২০৭ টি সরকারি স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে কয়েক বছরে। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক এ হাজার হাজার ড্রপ আউট এখন বাংলার এডুকেশন সেক্টরের নিউ নর্ম্যাল।
উত্তর দিনাজপুরে বেশ কিছু ব্লকে আর ইলেভেন টুয়েলভ এর কোনো শিক্ষক রইলো না। যারা এখন ইলেভেনে পড়ে বা উচ্চমাধ্যমিক দেবে তাদের ভবিষ্যৎ কী তা সম্পর্কে সরকারের কোনো ভাবনাই নেই। কেবল উত্তর দিনাজপুরেই ৮৩২ জনের চাকরি বাতিল হল। মুর্শিদাবাদের কোনো ব্লকে ৩৬, কোনো ব্লকে ২১ জনের চাকরি গেছে। কলকাতা শহরের বন্দর এলাকার বেশ কিছু স্কুলে বিজ্ঞান শিক্ষকদের চাকরি বাতিল হয়েছে। দক্ষিণ কলকাতার যোধপুর পার্ক বয়েজ, যাদবপুর বিদ্যাপীঠের মত স্কুলেও শিক্ষক শিক্ষাকর্মীর নিয়োগ বাতিল হল। এই বাংলার বহু স্কুলে শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল হওয়ার প্রধান শিক্ষককেই স্কুলের গেট খোলা,ঘন্টা বাজানোর মত কাজ করতে হচ্ছে।
এই মরশুমে মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের খাতা দেখা চলে ৷ মাসখানেক এর মধ্যে রেজাল্ট বেরোনোর কথা! কিন্তু সে কথা কতটা বাস্তবায়িত হবে তার কোনো ধারণাই মধ্যশিক্ষা পর্ষদের কাছে নেই। এবং স্কুলশিক্ষার এই ভয়াবহ সঙ্কট, যেখানে স্কুল উঠে যাওয়ার জোগাড় সেখানে দাঁড়িয়ে বাংলার লক্ষ লক্ষ ছাত্র ছাত্রীর ভবিষ্যৎ কী হবে কেউ জানে না।
অথচ এই কঠিন পরিস্থিতিতেই সরকারের তরফে মুখ্যমন্ত্রী একটি মিটিং ডাকলেন। ৭ ই এপ্রিল নেতাজী ইন্ডোরে আরেকটি মিটিং হল, চাকরিহারা যোগ্য শিক্ষকদের নিয়ে। মজার ব্যাপার রাতারাতি একটি সংগঠন তৈরী হয়ে গেল, এবং তারা "পাস" ও সরবরাহ করল, তবে সেই "পাস" যোগ্য স্কুল শিক্ষকদের থেকে বেশি পেল ওয়েবকুপার সদস্যরা। সেই ওয়েবকুপা যাদের মিটিং এর দিন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিয়েছিল ব্রাত্য বসু, ওমপ্রকাশ মিশ্ররা। ৭ ই এপ্রিলের মিটিং চলাকালীন বেশিরভাগ যোগ্য চাকরিপ্রার্থী বাইরে রইলেন, পুলিশের দ্বারা আক্রান্ত হলেন। আর তৃণমূলের কর্মীরা ভেতরে রইলো। যদিও মিটিং এর মেজাজ কেমন ছিল তা ভিডিও দেখলেই বোঝা যায়! মমতা ব্যানার্জী এইদিন সবথেকে বড় প্রতারণা করলেন যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের সাথে,বলে দিলেন আগে যোগ্যদের টা দেখে নিই, তারপর অযোগ্যদের নিয়ে বসব। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সবকিছুর দায় দিলেন একজন আইনজীবীর ওপর। এবং তারপর আবারও প্রতারণা করে বললেন, যাতে শিক্ষকরা ভলেন্টিয়ারি সার্ভিস দেন স্কুলগুলোতে।
যে পরিবার কখনো অসততা করেনি, লেখাপড়া শিখে চাকরি পেল নিজ যোগ্যতায়, তারপর তৃণমূলের দুর্নীতির কারণে চাকরি হারালো, যারা জানে না আগামীদিন গুলোয় খাবে কী? জানে না আগামীতে সমাজে সসম্মানে থাকতে পারবে কিনা? তাদের সাথে মুখ্যমন্ত্রী যে প্রতারণা করলেন তাতে রাজ্যের মানুষের কাছে আরোও একবার স্পষ্ট হয়ে গেল যে তৃণমূলই চাকরি বিক্রি করেছে। এবং যারা টাকা দিয়েছিল, তারা রেগে গিয়ে নাম যাতে বাইরে বলে না দেয় তাই মুখ্যমন্ত্রী ড্যামেজ কন্ট্রোল করছে।
তার একদিন পর জেলায় জেলায় ডি আই অফিসে চাকরিহারা যোগ্য শিক্ষকদের পুলিশ যেভাবে আক্রমণ করে তা দেখে প্রশাসনের শিক্ষকদের সম্পর্কে মনোভাব কী তা বোঝা যায়!
পরিস্থিতিটা অত্যন্ত উদ্বেগের। যোগ্যদের নিজেদের বিচারের লড়াই। সমাজে নিজেদের সম্মান টিকিয়ে রাখার লড়াই। আর স্কুলগুলোকে বাঁচানোর লড়াই। একটা প্রজন্ম যারা এখন স্কুলে পড়ে তারা জানে না তাদের যে শিক্ষক অঙ্ক শেখাচ্ছেন তিনি আদৌ যোগ্য কিনা..! শিক্ষক সম্পর্কে শ্রদ্ধার বদলে মনের মধ্যে আসছে সংশয়, সন্দেহ। ছাত্র শিক্ষক এক শ্রদ্ধা-স্নেহের সম্পর্ককে এই রাজ্যের সরকার এক পরস্পরবিরোধী সম্পর্কে নিয়ে গেল। শিক্ষক জানেন তার ছাত্রদের কোন কোন সিলেবাস বাকি, আর তাই বেতন পাবেন না জেনেও স্কুলে গিয়ে পড়াচ্ছেন- এ চিত্র গত কয়েকদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে। কিন্তু এটা কোনো সমাধান হতে পারেনা। সরকারকেই শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির দায় নিতে হবে। চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ করে অথবা অবসারপ্রাপ্ত বা চাকরিহারা শিক্ষকদের ভলিন্টিয়ার সার্ভিস দিয়ে এই কাজ হবে না।
বামপন্থী দল ও ছাত্রসংগঠনগুলো প্রথম থেকেই স্কুল বাঁচানোর লড়াইতে এবং যোগ্য শিক্ষকদের স্কুলে ফেরানোর লড়াইতে আছে এবং থাকবেও। এই পরিস্থিতি আসলে দাবী করে সংগঠিত হওয়া। তৃণমূল এবং বিজেপি কর্মীরা , নেতারা সংগঠিত হয়েছিল চাকরি চুরি করে অযোগ্যদের শিক্ষাব্যবস্থা চালিয়ে গোটা শিক্ষাক্ষেত্রকে ধ্বংস করার জন্য, আর ছাত্র যুব শিক্ষক অভিভাবকদের সংগঠিত হতে হবে এই দুর্নীতির ঘুঘুরবাসা ভাঙার জন্য, যারা হকদার তাদের অধিকার আদায়ের জন্য। সংগঠিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা তাই এখন ভীষণ তীব্র।