ইতিহাস উদ্ধার ,আমাদের ঋদ্ধতার ঋণ
রচনা সমগ্র( প্রথম খন্ড)
তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়
সম্পাদনা - পুলক চন্দ
দে'জ
৬৯৯ টাকা।
বর্তমান প্রজন্ম তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়(১৮৯৬- ১৯৬৮) কে প্রায় চেনে ই না। একটা সময় ছিল , যখন সদ্য কৈশোরে পড়া ছেলে মেয়েদের কাছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মানসিকতার উন্মেষে তপনমোহনের 'পলাশীর যুদ্ধ' এবং ' পলাশীর পর বক্সার ' ছিল অবশ্য পাঠ্য। ইতিহাস, লেখনী এবং ব্রিটিশের শয়তানি উন্মোচন- এই ত্রিবেণী সঙ্গমের ভিতর দিয়ে জাতীয় আন্দোলন কালে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নবযৌবনকে তপনমোহন যে ভাবে আলোকিত করেছেন, আলোড়িত করেছেন, সেইসময় কালে এমনটা অন্য কোনো মৌলিক বাংলা গ্রন্থের ক্ষেত্রে আর হয় নি।
তপনমোহনের নিজের জীবন ছিল অতিরঞ্জিত মোহজাল মুক্ত।তেমনভাবেই তিনি তাঁর কলম কে চিরদিন পরিচালিত করে গেছেন। শান্তিনিকেতন তখন যথার্থ ই আশ্রম।প্রাচীন ভারতের পরম্পরাকে বজায় রাখতে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত সেই আশ্রমে শিক্ষকতার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিয়েছিলেন সেযুগে ইউরোপ ফেরত তপনমোহন।তাই তাঁকে ১৩১৮ বঙ্গাব্দের ২০ শে কার্তিক রবীন্দ্রনাথ লিখছেন;" এই আশ্রমের গভীরতার মধ্যে তোদের হৃদয়ের একটি নোঙর ফেলে যাস্ যেন ঝড়ে তুফানে তোদের জীবনকে ছিন্ন করে নিয়ে উচ্ছ্বলতার মধ্যে ভাসিয়ে নিয়ে না যেতে পারে।"
বহুত্ববাদী ভারতের চিরন্তন চেতনাকে প্রবাহমানতার সঙ্গে সংযুক্ত করার যে লক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ নিজের সৃষ্টি এবং গঠনমূলক চিন্তার আকর' শান্তিনিকেতন' কে পরিচালিত করেছিলেন, সেই ধারার একজন সার্থক পরিবাহক ছিলেন তপনমোহন।আজ যখন গোটা ভারত জুড়ে বহুত্ববাদী চেতনাকে বিনষ্ট করে রাজনৈতিক হিন্দুত্বকে ভারতচেতনা হিশেবে ভ্রান্ত ভাবে উপস্থাপনে খোদ রাষ্ট্রশক্তি আত্মনিয়োগ করেছে, এইরকম একটি সময়ে , ম্যানহাটান থেকে রলো শ্যেল শক কিংবা হিন্দু আইনে বিবাহ সহ তপনমোহনের গ্রন্থিত , অগ্রন্থিত লেখাগুলি সঙ্কলিত করা একটি ঐতিহাসিক কাজ।এই কাজটি করে তপনমোহনের রচনাসমগ্রের পরিচালক ' দে'জ পাবলিশার্স' সত্যিই একটি বড় রকমের সমাজ সচেতনতার পরিচয় রেখেছেন।
এই গ্রন্থে সঙ্কলিত তপনমোহনের ' হিন্দু আইনে বিবাহ' এই মুহূর্তে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির কদর্যতার মোকাবিলায় ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির বৌদ্ধিক উপাচারের রশদ হিশেবে পরিগণিত হতে পারে।মনুসংহিতা কে অবলম্বন করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার শৃঙ্খলের ভিতর দিয়ে নারীকে পণ্য হিশেবে কি ভাবে পরিগণিত করা হয় হিন্দু বিবাহ আইনে, তপনমোহন সর্বসাধারণের বোধগম্য করে তা তুলে ধরেছেন।বর্ণবাদ কি ভাবে হিন্দুসমাজের সামাজিক ভিত্তিকে ক্রমশ ভয়াবহ সঙ্কীর্ণতার পথে ঠেলে দিয়েছে, নানা প্রাচীন বৈদিক গ্রন্থ থেকে সুললিত আলোচনার ভিতর দিয়ে তা তুলে ধরেছেন তপনমোহন। স্মৃতিশাস্ত্র ' সদাচারের বাধা' হিশেবে মনুষ্যত্বের অপমান কি ভাবে করেছে, দ্বিধাহীন ভাবে সেকথা তপনমোহন লিখেছেন।পুরুষের পক্ষে বড় ভাই য়ের বিয়ে না হলে অন্য ভাইদের বিবাহের অনূমোদন স্মৃতিশাস্ত্র দেয় নি।তেমন ই নারীর ক্ষেত্রেও বড় বোন অবিবাহিত থাকবে ছোট বোনেদের ও যে অনূড়াই থাকতে হবে ,আর সমাজে অনূড়া কন্যা র দায়ে , সেই পিতার কি দশা হবে- এ সম্পর্কে স্মৃতিশাস্ত্রের কদর্যতার কথা অকপটে তপনমোহন বলেছেন।তবে এই গ্রন্থটির রচনাকাল তাঁর রচনাসমগ্রের ভিতরে উল্লেখ থাকলে ভালো হতো।কারন, দেশ স্বাধীনতার পর ' হিন্দু কোড বিল' ঘিরে যে বিতর্ক, হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির, বিশেষ করে শ্যামাপ্রসাদ এই আইনের যে কদর্য বিরুদ্ধতা করেছিলেন, সেই প্রেক্ষিত স্মরণে রেখেই জানতে ইচ্ছে করে, হিন্দু কোড বিলের বিতর্ক কালেই কি তপনমোহন এই গ্রন্থ রচনা করেছিলেন?
তপনমোহনের অগ্রন্থিত লেখাগুলি এখানে সঙ্কলিত করে সারস্বত সমাজের কাছে কেবল অজানা তপনমোহনকেই পুনরাবিস্কারের সুযোগ করে দেওয়া হয় নি, আমাদের ঋদ্ধ অতীতের মেধা, মনন, অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক হীরকদ্যুতিকে নতুন করে বর্তমান প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা হয়েছে।এই পর্যায়ে তপনমোহনের লেখাগুলি, যেমন; রাজা রামমোহন রায়ের ব্রহ্মসভা , মহানির্বাণতন্ত্রে ব্রহ্মসাধনা এইসব তাত্ত্বিক রচনার পাশাপাশি অমর সেন, অবিনাশ মিত্তিরের মতো হাল্কাচালে গভীর তত্ত্ববাহী সন্দর্ভ বাঙালির মননশীলতার এক আশ্চর্য অনূভূতির স্পর্শে আমাদের পৌঁছে দেয়।
মহানির্বাণতন্ত্র ঘিরে সাধারণ ভাবে তান্ত্রিক আচার সর্বস্বতার একটা মোহমুগদারে আমরা খানিকটা ন যযৌ , ন তস্থৌ দশায় থাকি।বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের অবক্ষয় এবং আচার সর্বস্ব তান্ত্রিকবিধিবিধান যে জাতপাতের বর্তমান দৈন্যের একটা অন্যতম প্রধান কারন, এই পর্যায় টি জাতিবৈষম্য আলোচনার ক্ষেত্রে আমরা প্রায় অনালোচিত ই রেখে যাই।তান্ত্রিক আচারসর্বস্বতার যে ভয়াবহতা , সেটার বিচরণভূমি হিশেবে অধিক পরিচিত ছিল অতীতের পূর্ববঙ্গ বা আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।বরেন্দ্রভূমের একটা বিস্তীর্ণ পর্যায় এই তান্ত্রিক বিধিবিধানের বিষবাষ্পে আকীর্ণ ছিল।অবিভক্ত ফরিদপুর জেলার কোটালিপাড়া অঞ্চলের কথা এ প্রসঙ্গে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয়।তান্ত্রিক আচার সর্বস্বতার প্রভাব অবক্ষয়ী বৌদ্ধ সংস্কৃতির উপরেও জোরদার ভাবে পড়েছিল।এই সঙ্কটকেই পলাশীর যুদ্ধের(১৮৫৭) আগের থেকে ই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, নিজেদের অনুকূলে একটা সামাজিক প্রযুক্তির অঙ্গ হিশেবে খ্রিস্টান মিশনারীদের মাধ্যমে প্রয়োগ করে।যার ফলে উনিশ শতকের নবজাগরণে আলোকিত বাংলার যুব সমাজের ভিতরে প্রগতিশীলতার মানদন্ড স্বরূপ খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণের বিষয় টি উঠে আসে। এই বিষয়টি পরবর্তীতে একদিকে হিন্দু সংস্কারবাদী ভাবধারা গড়ে তোলে, যা তন্ত্র কে ভিত্তি করে প্রাথমিক ভাবে বিকশিত হলেও সমন্বয়ী চেতনার প্রবাহমান স্রোতেই শেষপর্যন্ত মিলিত হয় রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনের ভিতর দিয়ে। তন্ত্রের আচারসর্বস্বতাই যে শেষ কথা নয়, তপনমোহন সেটাই এখানে অত্যন্ত মানবিক সুরে দেখিয়েছেন। মহানির্বাণতন্ত্রের সুরের ভিতরেও একেশ্বরবাদী চেতনার যে সূত্র তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন, তা সর্বসম্মত কি না- এ নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে।কিন্তু তন্ত্রের আচারবিচারের ভিতরেও যে ভিন্ন সুরের দিশা তপনমোহন দিয়ে গিয়েছেন, তা কেবল ভারতীয় দর্শনের প্রেক্ষিত আলোচনাতেই নয়,ভারতীয় সমাজব্যবস্থা, বিশেষ করে বাঙালি জীবনের বারমাস্যার চিত্র অঙ্কণের ক্ষেত্রে একটা নতুন দিশা জোগাবে।
রিভিউ লিখেছেনঃ গৌতম রায়