মমতা সেনগুপ্ত
২৩শে জুন ২০২৫, নদীয়া জেলার কালীগঞ্জ বিধানসভার উপনির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরে তৃণমূলের বিজয় মিছিল থেকে ছুঁড়ে দেওয়া সকেট বোমায় মারা গেছিল ১০ বছরের ছোট্ট একটি মেয়ে। তখনো ২৩ রাউন্ডের গণনা সম্পূর্ণ হয়নি। তবুও আগাম জয়ের পূর্বাভাস পেয়ে কালীগঞ্জের রাস্তায় রাস্তায় তৃণমূলী সশস্ত্র বাহিনীর বিজয় মিছিল বেরিয়ে পরে। বিজয় মিছিলের আনন্দকে আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে নিতে সিপিআইএম সমর্থকের বাড়ির উঠান লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দেওয়া হয় সকেট বোমা। আর তাতেই গলার কাছের মাংস খুবলে বাড়ির উঠোনেই লুটিয়ে পড়ে ছোট্ট মেয়েটির নিথর দেহ।
আজ সেই ছোট্ট বাচ্চা মেয়ের দশ পেরিয়ে এগারো তে পা দেওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল বাবার এনে দেওয়া নতুন জামা পরে মায়ের হাতের রান্না করা তার পছন্দের খাবার খেয়ে তার এগারো বছরের জন্মদিন পালন করবার। কিন্তু জন্মদিনের এক মাস কয়েকদিন আগেই মা-বাবার বুক খালি করে চিরতরে হারিয়ে গেল ছোট্ট মেয়েটি।
তামান্না.. বাংলায় যার মানে দাঁড়ায় ইচ্ছে কিংবা আশা! অথবা মনের বাসনা! পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার মোলান্দি গ্রামের বাসিন্দা হোসেন শেখ আর সাকিনা বিবির অনেক সাধের একমাত্র কন্যা সন্তান। একটি উপনির্বাচনাকে কেন্দ্র করেও যে দশ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ের প্রাণ চলে যেতে পারে তা বোধহয় এই রাজ্যের সরকার আর সরকারে থাকা রাজনৈতিক দল তৃণমূল কংগ্রেসকে না দেখলে বোঝা যেত না।
প্রাইমারি স্কুল, চতুর্থ শ্রেণি, স্বাভাবিক বয়সের নিয়মেই ছটফটে প্রাণবন্ত ১০ বছরের মেয়েটি তার নিজের বাড়ির উঠোনে খেলছিল। স্বাভাবিকভাবেই সে জানতো না আর কিছুক্ষণ পরেই তার বাড়ির সামনে থেকে এমন একটি বিজয় মিছিল যাবে যা তার প্রাণ কেড়ে নেবে! ২৩শে জুন ২০২৫, সোমবার ছিল নদীয়া জেলার কালীগঞ্জ বিধানসভার উপনির্বাচনের ফল প্রকাশ। তাতে শাসকদলের প্রার্থী জয়ী হলেও এ কথা তাদের বুঝতে কোথাও বাকি থাকে না, যে সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্ক কে রাজ্যের সরকারে বসে থাকার তৃণমূল কংগ্রেস নিজেদের পৈত্রিক সম্পত্তি মনে করে সেই সংখ্যালঘু ভোটের বেশ কিছুভাগ এইবার বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী কাবিল উদ্দিন শেখের ঝুলিতে গেছে। আর ব্যাস এতেই প্রতিহিংসা পরায়ণ রাজনীতির ধারক বাহক তৃণমূল কংগ্রেস তাদের দাঁত নখ বার করে ফেলে। এ রাজ্যে থেকে রাজ্যের মুসলমান ভোটার তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে ভোট না দিয়ে বাম গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে ভোট দিচ্ছে এ কথা স্বাভাবিকভাবেই তাদের হজম হয় নি। আর তাই বাবা সিপিআইএম সমর্থক হওয়ার অপরাধে প্রাণ হারাতে হয় ছোট্ট তামান্না কে।
নির্বাচনে যে রাজনৈতিক দল জয়ী হয় খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা বিজয় মিছিল বার করে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই নির্বাচনে জয়লাভের পর বিজয় মিছিল করার অধিকার আছে। কিন্তু বিজয় মিছিল থেকে মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার অধিকার কোন রাজনৈতিক দলের নেই! অথচ এই কাজটাই রাজ্যের শাসক দল অবলীলায় করে ফেলতে পারে।
হোসেন শেখ ধর্মে মুসলমান অথচ সিপিআইএমের কর্মী। কালীগঞ্জ উপনির্বাচনে তৃণমূলের বিরুদ্ধে তার রাজনৈতিক কর্মসূচি তিনি পালন করেছেন। তার পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজনকে বুঝিয়েছেন কেন এই রাজ্যের সংখ্যালঘু মানুষকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়া দরকার। তিনি নির্বাচনের দিন ভোট দিয়েছেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে। আর তাই বিজয় মিছিল থেকে 'হোসেনের মেয়েকে ঝেড়ে দিতে হবে' এ কথা বলতে বলতে ছোট্ট মেয়ের দিকে বোমা ছুঁড়ে দেওয়া তৃণমূল কর্মীর কাছে খুব একটা কঠিন কিছু ছিল না।

তামান্না জানতো না রাজনীতির জটিলতা। জানতো না এ রাজ্যের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের মুসলমানদের দুধেল গাই মনে করেন। ছোট্ট ১০ বছরের মেয়েটি জানতো না ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাজ্যের শাসক দল বহুদিন আগেই এই রাজ্যের মানুষকে তার 'পরম মিত্র' আর এস এস- এর সাথে শলা পরামর্শ করে ধর্মের নামে বিভাজিত করার রাস্তায় পা বাড়িয়ে দিয়েছে। এরাজ্যের ৩০ শতাংশ মুসলমানের ভোট প্রথম থেকে শেষ অবধি তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে রাখার জন্য তারা মরিয়া। আর তাই গ্রামে গঞ্জে মফস্বলে যখনই সংখ্যালঘু মানুষ ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে দাঁড়ায়, তৃণমূলের লাগামহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে, বিজেপির সাথে সাথে তৃণমূলের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় তখন মমতা ব্যানার্জির দলের কাছে সেসব স্বাভাবিকভাবেই অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়ায়।
রাজ্যের শাসকদলের এহেন প্রতিহিংসা পরায়ণ মনোভাব নতুন কিছু নয়। রাজ্যের ক্ষমতার পালাবদলের আগে থেকেই তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এমনকি মাওবাদীদের সাথে একসাথে মিশে এ রাজ্যের লাল ঝাণ্ডার কর্মীদের মাজা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য যা যা করা দরকার তার সবই করেছে। জঙ্গলমহলের রক্তাক্ত অধ্যায় আমরা কেউ ভুলিনি। আমরা ভুলিনি শালকু সোরেনের লাশ, আমরা ভুলিনি কাকদ্বীপে নিজের বাড়িতে শুধুমাত্র ভোটের দিন সিপিআইএমের পোলিং এজেন্ট হয়ে বসার অপরাধে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া দম্পতির লাশকে। খুঁজলে উদাহরণ হাজার হাজার পাওয়া যাবে।
কিন্তু সবচাইতে ভয়ংকর এবং নৃশংস ঘটনা ঘটেছে এ রাজ্যের নারীদের সাথে। পশ্চিমবঙ্গের শহর, মফস্বল কিংবা গ্রাম কোথাও নারীর কোন সুরক্ষা নেই। ক্ষমতার পালাবদলের পর মুহূর্তেই এই রাজ্যের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী ধর্ষিতা নারীদের দাম বেঁধে দিয়েছিলেন। আর তখন থেকেই শুরুওয়াত! যতদিন গেছে এর রাজ্যের নারীদের উপর অত্যাচার বিভীষিকার আকার ধারণ করেছে। এমনকি এই রাজ্যের বুকে তৃণমূল কংগ্রেসের পরিবারের মেয়েরাও সুরক্ষিত নন। হসপিটাল থেকে কলেজ রাস্তাঘাট এমনকি নিজের বাড়ির উঠানেও মেয়েদের সুরক্ষা এ রাজ্যে আর কোথাও নেই! তার জলজ্যান্ত উদাহরণ ছোট্ট তামান্না।
মাত্র এক বছর আগের স্মৃতি আজও আমাদের মনে তাজা। কলকাতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি হাসপাতাল আরজিকর মেডিকেল কলেজে কর্মরত অবস্থায় নৃশংস ভাবে ধর্ষিতা হয়ে খুন হতে হয়েছিল অভয়াকে। অভয়ার ঘটনা গোটা দেশের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল এই রাজ্যে নারীদের অবস্থা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে। একটি সরকারি হাসপাতালের একজন মহিলা ডাক্তারকে যখন ডিউটি আওয়ার্সে ধর্ষিতা হয়ে খুন হতে হয় তখন মানুষের বুঝতে বাকি থাকে না যে আসল গলদ কোথায়! এরাজ্যের সাধারণ মানুষ সেদিন বুঝতে পেরেছিল চুপ থাকার সময় অতিক্রান্ত, এটাই গলার স্বর তীব্র করার প্রকৃত সময়। দীর্ঘ কয়েক মাসের লড়াই আন্দোলন, রাজ্যের লাখ লাখ মানুষের সম্মিলিত গলার স্বর, রাত দখল, মিছিল, স্লোগান সবকিছুর পরেও রাজ্যের এবং কেন্দ্রের সরকারের অলিখিত সেটিং এর কারণে অভয়ার সঠিক বিচার এক বছরেও হয়নি। প্রকৃত দোষীরা আজও অধরা।
তৃণমূল কংগ্রেসের দুষ্টু দামাল ছেলেরা বুঝে গেছে। যতদিন তাদের মাথার উপর এই দলের ছায়া আছে ততদিন এই রাজ্য তাদের জন্য উর্বর ভূমি। তারা চাইলে হাসপাতালের ভেতরে, কলেজের ভেতরে, এমনকি বাড়ির ভেতরে ঢুকেও ধর্ষণ করতে পারে। আর তাই তৃণমূল কংগ্রেসের পরিবারের মেয়েরাও এই রাজ্যে সুরক্ষিত নয়। তার উদাহরণ আমরা কিছুদিন আগেই কসবা ল কলেজের ঘটনায় দেখতে পেয়েছিলাম। রাজ্যের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে 'দুষ্টু দামাল' তৃণমূলের ছাত্র নেতারা অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে টিকিয়ে রাখা ছাত্র সংসদের মাথায় বসে ইউনিয়ন রুমগুলো দখল করে সেখানে বছরের পর বছর ধরে আমোদ প্রমোদ চালিয়ে যাচ্ছে। আর সেই আমোদ প্রমোদের বলি হচ্ছে সেখানে পড়তে আসা সাধারণ পরিবারের মেয়েরা। ইউনিয়ন রুম গুলোতে জোর করে টেনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হচ্ছে ছাত্রীদের। এখানেই শেষ নয়, সেই সব ভিডিও ফোনে রেকর্ড করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায় পর্যন্ত!
রাজ্যের বুকে এমন একটা দিন আসতে পারে কিছু বছর আগেও এ রাজ্যের মানুষ স্বপ্নেও ভাবেনি। তবে এখন বর্তমানে কোন কিছুই আর অসম্ভব নেই। পার্কস্ট্রিট থেকে কামদুনি হয়ে বর্তমানের আরজিকর কিংবা কসবা ল কলেজ পশ্চিমবঙ্গের নারীদের অবস্থান একটু একটু করে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছে রাজ্যের সরকারে বসে থাকা তৃণমূল কংগ্রেস।
কালিগঞ্জ উপনির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর প্রায় স্পষ্ট হয়ে গেছিল সেখানকার ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতন্ত্র প্রিয় মানুষ ক্রমশ তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি থেকে সরে আসছে। এবং তারা আপন করে নিচ্ছেন মানুষে মানুষে সম্প্রীতির কথা বলা, রুজি রুটির পক্ষে সওয়াল করা বাম ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে। অতএব মজা চাখাতে হবে 'তৃণমূলের বিপক্ষে থাকা সংখ্যালঘু' কে!
বোমার আঘাতে তামান্নার শরীর মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পরেও তৃণমূলের বিজয় উল্লাস এতটুকু কমেনি। উল্টে বেড়েছে! উপনির্বাচনে জেতার আনন্দের সাথে যুক্ত হয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের একটি পরিবারকে শেষ করে দেওয়ার আনন্দ! ১০ বছরের ছোট্ট মেয়েটির মৃত শরীর তখনো বাড়ির উঠোনে, মৃতদেহের পাশেই সন্তান হারানোর বেদনা নিয়ে বুক চাপড়িয়ে কাঁদছেন তামান্নার মা সাকিনা বিবি। তাদের বহু প্রার্থনার ফসল ছিল ছোট্ট মেয়েটি। একমাত্র সন্তান, সে আর নেই এ কথা যেন তাদের বিশ্বাসই হচ্ছিল না। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বারবার বলছিলেন "আমার মেয়েকে ওরা কেড়ে নিল। আমরা সিপিএম করি। সেই কারণে ওরা আমার বাড়িতে বোমা মারলো। আমার ছোট্ট মেয়েটির কি দোষ ছিল? এখন আমরা কি নিয়ে থাকবো?" সন্তান হারানো বাবা-মায়ের এই হাহাকার তৃণমূল সুপ্রিমোর কাছে পৌঁছায় না। যেমন পৌঁছায় না যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের হাহাকার।
আজ এক মাসের অল্প কিছু বেশি সময় অতিক্রান্ত। এই এক মাস ধরে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় তামান্নার জন্য সাধারণ মানুষ স্লোগানে মুখরিত হয়েছে। রাজ্যের বামপন্থী ছাত্র যুবরা বারংবার তামান্না খুনের বিচার চেয়ে লড়াই আন্দোলন সংঘটিত করেছেন। লাল ঝাণ্ডার পার্টিও তামান্নার খুনিদের এক ইঞ্চি জমি না ছাড়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
মাত্র কিছুদিন আগে তামান্নার খুনের বিচারের দাবিতে তার পরিবার এবং গ্রামের লোককে সাথে নিয়ে লাল ঝান্ডার লোকেদের আন্দোলন কর্মসূচিতে তৃণমূলের লেঠেল বাহিনী এবং দলদাস পুলিশের যৌথ আক্রমণে ঝরেছে রক্ত। তবুও আন্দোলন থামেনি। ২৩ শে জুনের পর থেকে বামপন্থী ছাত্র যুব শ্রমিক সমস্ত নেতৃত্বরা বারবার গেছে নদীয়ার মোলান্দি গ্রামে তামান্নার বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়াতে। এই লড়াই তে তারা যে একা নন এ কথা বারবার বোঝাতে।
এরাজ্যের প্রতিটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রপ্রিয় খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ বহু বছর ধরে এক অসম লড়াই লড়ছে। এই অসম লড়াই চোরেদের বিরুদ্ধে, ধর্ষকদের বিরুদ্ধে, খুনিদের বিরুদ্ধে। এই লড়াইতে বামপন্থী ছাত্র যুবদের কারো মাথা ফাটছে, কাউকে যেতে হচ্ছে জেলে। এই লড়াইতে কারুর ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আবার কারোর বুক খালি হয়ে যাচ্ছে তামান্নার বাবা মায়ের মত। তারপরেও এই লড়াই চলবে..
এই লড়াই চলবে তামান্নার জন্য। তামান্না কে স্মরণ রেখে। এই লড়াই চলবে যাতে দ্বিতীয় কোন তামান্নাকে এভাবে চলে না যেতে হয়।
আজ তামান্নার ১১ বছরের জন্মদিনে তামান্না কে মনে রেখে এই লড়াইয়ে এক ইঞ্চি জায়গা না ছাড়ার শপথ আমরা গ্রহণ করলাম। এই লড়াই চলবে.. এ লড়াই আরও দৃঢ় হবে..