সহপথিক রবীন্দ্রনাথ

শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমাদের মুশকিলের অন্ত নেই। সবচেয়ে বড়ো অসুবিধে, তিনি আমাদের ভাষায় কথা বলেন, কিন্তু আমাদের অর্থে বলেন না। ভাষাটাই যদি আলাদা হত, তবে না হয় বুঝতাম ভাষাটা জানা নেই বলে আমরা বুঝে উঠতে পারছি না। বাউল যেমন প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের গন্ডীর ভেতরে ব্যবহৃত নানা শব্দাবলীকে শব্দার্থের কারাগার থেকে মুক্ত করে তাতে অন্যতর অর্থ যোগ করে, রবীন্দ্রনাথের গানেও তেমনভাবেই ঘটে শব্দের পুনর্জন্ম, বোধের নতুন ভাষ্য। তাঁর ভাষা ও আমাদের ভাষা অভিন্ন তবু অর্থ বুঝি না। কখনো ভুল বুঝি। তার প্রধান কারণ আমরা যে অর্থে শব্দগুলিকে চিনি রবীন্দ্রনাথের গানে অনেক সময়ই তার অর্থ আলাদা। একই কারণে তাঁর নাটকের সংলাপও সাধারণ্যে দুর্বোধ্য ঠেকে। তাঁর গান আমরা সর্বক্ষণ গুণগুণ করি, কিন্তু সবসময় সবটা বুঝে উঠতে পারি না। একটা সাধারণ আবেশের আচ্ছন্নতার মধ্যে দিয়েই তাঁর গানের সাথে আমাদের সংযোগ। রবীন্দ্রনাথের অথচ বিশ্বাস ছিল তাঁর অন্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে যাইহোক না কেন, বাঙালি তাঁর গানকে ভালো না বেসে পারবে না। তাঁর গান নিয়ে বিভ্রান্তির সবচেয়ে বড়ো দৃষ্টান্ত সম্ভবত ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ গানটি। গানটি সকলের কাছেই ভীষণ প্রিয়। এমনকী অন্য ভাষার মানুষদেরও যদি রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়, আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায় তবে তাঁরা প্রথমেই বলবেন এই গানটির কথা। বহু অ-বাংলা ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ এই গানটির অন্তত প্রথম লাইনটি নির্ভুল গেয়ে দিতে পারবেন। এত জনপ্রিয় গান কে ভুল বোঝা হয় কোথায়? সকলেই ভাবেন এটা সমষ্টিকে ভুলে একলা চলার গান। অথচ এই একলা চলার আহ্বান জানানোর কথাটির মধ্যে যে একটি ‘যদি’ এবং ‘তবে’ আছে তাকে গুরুত্ব দিই না কেন? একলা চলার কথা আসছে, ‘যদি’ হাজার ডাকার পরও কেউ সাড়া না দেয় ‘তবে’ই। এই গানের একার আহ্বানটি আকাশ থেকে আসে নি। আমাদের একটি জনপ্রিয় লোকগানকে ভেঙেই গানটি তৈরি হয়েছে। গানটি ছিল ‘হরিনাম দিয়ে জগৎ মাতালে আমার একলা নিতাই’। রবীন্দ্রনাথ ওই গানটির সুর আর তালই নেন নি শুধু। ওই গানের ‘একলা নিতাই’ কথাটি থেকে ‘একলা’ কথাটিকেও তুলে এনেছেন। আমরা সকলেই জানি নিতাই একটা বড় আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন বহু মানুষকে সঙ্গে নিয়ে। নিতাই একলা আহ্বান দিয়েছেন হয়ত, কিন্তু মাতিয়েছেন গোটা জগৎকেই। জগতের মেতে ওঠাটা একটা সমষ্টিগত আন্দোলন। ফলে ওই গানটি সেই সমষ্টিগত মেতে ওঠারই উদযাপন। রবীন্দ্রনাথও সেই সমষ্টির জাগরণকে বাস্তবায়িত করতেই ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ লিখেছেন। কখনো কখনো একটি বিশেষ সময়খন্ডে দেখা যায় মানুষ সাড়া দিচ্ছে না, তখন ওই সমষ্টিগত জাগরণকে বাস্তবায়িত করার জন্যেই  প্রয়োজনে একা এগিয়ে আসতে হবে। এতে একলা চলার কথা থাকলেও একক অগ্রগমনের আহ্বান নেই। এই একা চলায় সমষ্টির যোগদানের প্রত্যয় রয়েছে। প্রতীক্ষাও রয়েছে। গৌতমবুদ্ধ থেকে নিমাই, হজরত থেকে যীশুখ্রিস্ট, জিয়োদার্নো ব্রুনো থেকে কার্ল মার্ক্স- প্রায় সকলকেই কোনো একটা সময়ে একলা এগিয়ে আসতে হয়েছে। সাড়া না পেয়ে তাঁরা যদি নিজেদেও গুটিয়ে নিয়ে গৃহকোণের রমণসুখে ব্যাপ্ত থাকতেন তবে উত্তরকাল কী নিয়ে আজ উদযাপন করত সমষ্টিগতভাবে?

রবীন্দ্রনাথের গানের সংকলন ‘গীতবিতান’ এর প্রথম খন্ডের সবচেয়ে বড়ো অংশটির নাম পূজা। এই অংশের পূজা নামকরণটি আমাদের অনেককেই বিভ্রান্ত করে। আমরা ধরে নিই এই অংশের সবক’টি গানই ভগবৎ-বিষয়ক। সেখানে মাটির পৃথিবী, ব্যক্তি ও সামাজিক মানুষের বোধহয় কোনো স্পন্দন নেই। সবটাই গগনবিহারী ঈশ্বর আর তার উপাসকের কথা। একটি কথা বলা প্রয়োজন, রবীন্দ্রনাথের গানের সংকলনের এই নামকরণগুলি রবীন্দ্রনাথের নিজের করা নয়। তাঁর করা নামকরণ কিছুটা আলাদা ছিল। তবু যে কথাটি বলার ‘পূজা’ শব্দটিও সংগঠিত ধর্মের নিরিখে যেভাবে প্রয়োগ হয় রবীন্দ্রনাথের গানে তা সে অর্থে হয় না। রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়েরই একটি গান, ‘কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আসো’। এই গানে রয়েছে ‘সাধক ওগো, প্রেমিক ওগো, পাগল ওগো’। রবীন্দ্রনাথের গানে সাধক, প্রেমিক, পাগল শব্দগুলি কিন্তু ধর্মসাহিত্যের অর্থে ব্যবহৃত নয়। সাধক শব্দের অর্থ নিবেদিতপ্রাণ। প্রেমিক বিশ্বপ্রেমিক, ইংরেজি ফিলানথ্রোপিক অর্থে। আর পাগল শব্দের অর্থ বিদ্রোহী, যিনি আর সকলে যে পথ ধরে হাঁটে, তিনি সে পথে হাঁটেন না। নিবিড় পর্যবেক্ষণে দেখবো রবীন্দ্রনাথ এই শব্দগুলিকে ব্যবহার করেছেন লোকধর্মে যেভাবে ব্যবহৃত হয়, সে অর্থেই। আমাদের লোকায়ত ধর্ম আচারে বিশ্বাস করে না। সম্প্রদায় বিভাজন বা লিঙ্গবৈষম্যে বিশ্বাস করে না। ফলে সেখানে ব্যক্তি নরনারীর প্রেম, বিশ্বপ্রেম এবং ঈশ্বরপ্রেমের সাথে একাকার হয়ে যায়। ঈশ্বরকে খোঁজা হয় মানুষের মধ্যে। ঈশ্বর সেখানে ভক্তের অধীন। তাই লালন বলেন, দেবদেবতাগণ করে আরাধন জন্ম নিতে মানবে। রবীন্দ্রনাথের যে গানটি নিয়ে এখানে আলোচনা হচ্ছে সেই গান (‘কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আসো’) আসলে গগনবিহারী ঈশ্বরের আরাধন নয়। বরং যে সমস্ত সর্বত্যাগী সমাজকর্মী ও বিপ্লবীরা আত্মস্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজের জীবনকে উন্নত আদর্শের ব্রতে সঁপে দিয়েছেন, এ তাঁদেরই কথা।

রবীন্দ্রনাথের গানে যে ‘তুমি’ তাঁকে কী আমরা সরাসরি ঈশ্বর বলব? সাধারণভাবে রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের গানের ‘তুমি’কে ঈশ্বর এবং প্রেম পর্যায়ের গানের ‘তুমি’কে প্রেমাস্পদ ধরা হয়। স্বদেশ পর্যায়ের গানের ‘তুমি’ সেই যুক্তিতে হয়ত তবে স্বদেশ। কিন্তু বিষয়টি এতটা সাধারণীকৃত নয়। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন ‘দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা’ সেই অর্থে ‘তুমি’র যেমন ভূমিকা বদল রয়েছে। তেমনি এই ‘তুমি’ শব্দের রয়েছে বিচিত্র এবং গভীর দ্যোতনা। এই ‘তুমি’ই আসলে বিষমধাঁধা। কবির কাছে এই ‘তুমি’ একরকম, বিশ্বাসীর কাছে আরেকরকম। কে সে? বিশ্বাসী মানুষ চোখ বুঁজে বলে দেবে, আরে এ তো ঈশ্বরেরই প্রতিরূপ। আপাদমস্তক প্রেমিক হয়ত বলবে, না বাবা, এই তুমি, আমার প্রেয়সী, যার চোখে আমি স্বপ্ন দেখি, যার হাসিতে আমার বসন্ত আসে। এই সমস্ত বিতর্কের মধ্যে গুম হয়ে বসে থাকা কোনও ভাবুক হয়ত বলবে, যখন বাইরের পৃথিবীর কোনও সংকেত আমার বুকের গভীরে জমে ওঠা বিস্ময় আর জিজ্ঞাসার কোনও উত্তর দেয় না, তখন আমি নিজের সাথে কথা বলি এই ‘তুমি’-র রূপকে সামনে রেখেই। এই ‘তুমি’ আমার বুকের গভীরে লুকিয়ে থাকা আমার নিজেরই প্রতিরূপ, যে আমার কাজের দিনে লুকিয়ে থাকে, দিনান্তে চোখ মেলে তাকায় আমার দিকে অপলক। যুগ যুগ ধরে আমার এই প্রতিরূপের সাথে আমার সকল কথোপকথন লুকিয়ে আছে গানের ‘তুমি’র সাথে সমস্ত সংলাপে। একজন তথাকথিত বস্তুবাদী সংস্কৃতিকর্মী বলবেন, আরে, এত সব জটিল হয়ে গেল। আসলে রবীন্দ্রনাথের গানের ‘তুমি’কে চিনতে পারার মধ্যে রয়েছে তাঁর ধর্মবোধের সাথে পরিচিত হওয়ার চাবিকাঠি। লোকগানে যে ‘তুমি’, তার সাথে চিরন্তন বিরহ-মিলনের সম্পর্ক। সারাক্ষণ তার প্রতীক্ষা, সারাক্ষণ তাকে না-পাওয়ার রোদন। এই ‘তুমি’কে শুধু এক মানবী প্রেয়সী কিংবা ঈশ্বর হিসেবে না দেখে আরো গভীরতর অর্থে দেখার তো অবকাশ আছে। এই ‘তুমি’র সাথে সমস্ত কথোপকথন হয়ত জীবনের নিগূঢ় রহস্যে অভিভূত মানুষের জীবন জিজ্ঞাসা। পৃথিবীর শস্যবতী হওয়া আর নারীর মাতৃত্ব অর্জনকে একই বিস্ময়ে দেখে জন্ম হয়েছিল প্রজননশক্তির উপাসনার। এভাবে জীবন আর নারী একাকার হয়ে ওঠে বলেই হয়ত জীবনের সমস্ত রহস্যের উত্তর মানুষ খোঁজে নারীর কাছেই। কিংবা বলা যায় নারীর সাথে কথোপকথনের আদলেই তৈরি হয় ব্যক্তিমানুষের জীবনজিজ্ঞাসার বয়ান। তাই তাঁর সমস্ত কান্না সমস্ত আকুলতা নারীকে ঘিরে। যে নারী কখনো নদী হয়ে ওঠে। কখনো তরী। এই নারী সমস্ত জীবনরহস্যের আধার? ‘তুমি’ এভাবেই কখনো প্রেয়সী, কখনো ঈশ্বর, কখনো আবহমান, কখনো সমকালীন জীবন।

বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ নিরীশ্বর ছিলেন না। তবে তাঁর ঈশ্বরের রূপ জীবনের নানা পর্বে পরিবর্তিত হতে হতে এগিয়েছে। ব্রাহ্মসমাজের ভেতরের পরিসর থেকে তাঁর ঈশ্বরভাবনার যাত্রা শুরু হয়েছিল এক কল্যাণকামী বা যাবতীয় কল্যাণের প্রতিরূপ ‘তিনি’র মাধ্যমে। শিলাইদহে পৈতৃক জমিদারি দেখাশোনা করতে গিয়ে বাউলের দর্শন ও জীবনধারার সংস্পর্শ পেয়ে অনেকটাই বদলে গেল। প্রথাগত ধর্মবিশ্বাসের আচারের বেড়াজালের অনেক বাইরে বাউলের ধর্মবোধ দাঁড়িয়ে আছে এক গভীর বিচারবোধের ওপর। সেখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষ সমান। জাত-পাত-ধর্ম দিয়ে তাকে আলাদা করা যায় না। একতারার সুরে ছন্দে সহজ ভাষায় রচিত গানে সে তাঁর ঈশ্বরের আরাধন করে। বাউল বিশ্বাস করে প্রতিটি মানুষের দেহের ভিতরের অন্ধকার ঘরে এক আলোর মানুষ বাস করে, যাকে সে বলে ‘মনের মানুষ’। বাউলের এই ‘মনের মানুষ’ রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন দেবতা’-র রূপ নির্মানকে অনুপ্রাণিত করেছে। ১৯৩৬ সালে তাঁর এক আত্মজৈবনিক কবিতায়ও তিনি এই প্রেরণার কথা স্বীকার করেছেন, ‘ওরা অন্ত্যজ, ওরা মন্ত্রবর্জিত/ দেবালয়ের মন্দিরদ্বারে/ পূজা-ব্যবসায়ী ওদের ঠেকিয়ে রাখে/ ওরা দেবতাকে খুঁজে বেড়ায় তাঁর আপন স্থানে/ সকল বেড়ার বাইরে/ সহজ ভক্তির আলোকে/ নক্ষত্রখচিত আকাশে/  পুষ্পখচিত বনস্থলীতে/ দোসর-জনার মিলন-বিরহের/ গহন বেদনায়/ যে দেখা বানিয়ে-দেখা বাঁধা ছাঁচে/ প্রাচীর ঘিরে,দুয়ার তুলে/ সে দেখার উপায় নেই ওদের হাতে/... কবি আমি ওদের দলে/ আমি ব্রাত্য,আমি মন্ত্রহীন/ দেবতার বন্দীশালায়/ আমার নৈবেদ্য পৌঁছল না’।  কিন্তু এই বদলও ঘটল সম্পূর্ণ নিজস্ব এক পথে। তাঁর ঈশ্বরের স্বরূপ স্থাণু হয়ে থাকল না। জীবনের নানা ঘটনার ঘাত-অভিঘাতে তাতেও এল নানা পরিবর্তন। জীবনের শেষ পর্বে ‘সভ্যতার সংকট’-এ তাঁর তুমি ‘ওই মহামানব আসে’ গানে হয়ে ওঠে গণমানুষের প্রতিরূপ, যে মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানোকে তিনি পাপ মনে করেছেন।

১৮৯০ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ গ্রামবাংলার সাথে প্রাণের সম্পর্কে সম্পর্কিত হতে শুরু করেন। ঔপনিবেশিক কলকাতার কলরব থেকে মুক্তি পেতে তিনি আশ্রয় খুঁজলেন এবং পেলেন আবহমান বাংলার মায়াভরা প্রকৃতিতে, মানবজীবনে। নগরের কৃত্রিম আলোর ঝলকানির প্রতিকল্পে গ্রামবাংলার রাত্রির অন্ধকার তাঁর আরাধ্য হয়ে উঠল। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের অভ্যন্তরে তিনি আমাদের অন্তরের যে ব্যাধির দেখা পেয়ে দূরে সরে এসেছিলেন, তাঁর প্রতিকার খুঁজে পেলেন মন্ত্রহীন ব্রাত্য বাউলদের জীবনদর্শনে। সেখানেও তাঁর একটি গ্রহণ বর্জন সক্রিয় ছিল, অন্ধ ভক্তি বা আনুগত্য ছিল না। তিনি বাউলের দেহাত্মবাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন, কিন্তু কায়াসাধনার পথে যান নি। ব্যক্তিগত পারিবারিক সমাজ দেশ ও বিশ্বের নানা ঘটনা দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত ঈশ্বর তিনি থেকে তুমি, মঙ্গলময় ঈশ্বর থেকে জীবনদেবতা, জীবনদেবতার আরাধন থেকে মহামানবের জয়গানে ব্যাপ্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও তাঁর ঈশ্বরভাবনার এই সচলতার মধ্যেই তাঁকে আবিষ্কার করতে বলেছেন।

‘কয়েক বৎসর পূর্বে অন্য একটি কাগজে অন্য একজন লেখক আমার রচিত ধর্মসংগীতের একটি সমালোচনা বের করেছিলেন। তাতে বেছে  বেছে আমার কাঁচাবয়সের কয়েকটি গান দৃষ্টান্তস্বরূপ চেপে ধরে তিনি তাঁর ইচ্ছামত সিদ্ধান্ত গড়ে তুলেছিলেন। যেখানে আমি থামি নি  সেখানে আমি থেমেছি এমন ভাবের একটা ফোটোগ্রাফ তুললে মানুষকে অপদস্থ করা হয়। চলতি ঘোড়ার আকাশে-পা-তোলা ছবির থেকে প্রমাণ হয় না যে, বরাবর তার পা আকাশেই তোলা ছিল এবং আকাশেই তোলা আছে।’

রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠতম বৃত্তে থাকা বামপন্থী সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ আধ্যাত্মিক ছিলেন সত্যিই, তাঁর কাছে আধ্যাত্মিকতার অর্থ ছিল ভিন্ন। যে সময়খন্ডে ব্যক্তি-আমি বাস করি সেই খন্ডকাল যে চিরকাল বা অনন্ত সময়েরই অখন্ড অংশ কিংবা যে খন্ডিত ভুবনে আমার বসত সে যে অনন্ত ভুবনেরই অখন্ড অংশ, এই সম্পর্কিত চেতনাকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন আধ্যাত্মিক চেতনা। রবীন্দ্রনাথের মতে আধ্যাত্মিকতার প্রকাশ ত্যাগে। ‘ত্যাগ’ শব্দটিকেও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন সচরাচর অর্থের বাইরে গিয়ে। সচরাচর ত্যাগ কথাটিকে প্রায় শূন্যতার কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হয়। সমস্ত কিছু ছেড়ে এক রিক্ততার দিকে যাত্রাই যেন ত্যাগ। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ত্যাগ নিজেকে রিক্ত করার জন্যে নয়, পূর্ণ করার জন্যে। তিনি বলেছেন, আমি আংশিককে ত্যাগ সমগ্রের জন্যে, ক্ষণিককে ত্যাগ করি নিত্যের জন্যে, অহঙ্কারকে ত্যাগ করি প্রেমের জন্যে। ‘পাপ’ শব্দটির রবীন্দ্রনাথের ব্যাখ্যাটিও একজন সমাজ-রাজনৈতিক কর্মীর কাছে চিত্তাকর্ষক ও ভাবনা উদ্রেককারী বলেই মনে হবে। সাধারণভাবে ‘পাপ’ সম্পর্কে ধারণা যে কিছু সামাজিক বিধিনিয়মকে লঙ্ঘন করাই পাপ। রবীন্দ্রনাথের কাছে ‘পাপ’ এর এই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য ছিল না। তিনি বলেছেন, সামাজিক বিধিনিয়ম তো যুগে যুগেই পরিবর্তিত হচ্ছে। পাপ আর কিছু নয়, অংশ যখন বিদ্রোহ করে সমগ্রের বিরুদ্ধে সেইটিই পাপ। সমগ্রের ক্ষতি করে একটি প্রবৃত্তি যদি স্ফীত হয়ে ওঠে স্বরাজ্য বিস্তার করে, সেইটি পাপ। আশ্চর্যের বিষয় ‘পাপ’ শব্দটিকে এভাবে সমগ্রের মঙ্গলআকাঙ্ক্ষার সাথে যুক্ত করে দেখার ব্যাপারটি আমরা সুদূর লাতিন আমেরিকার একটি রাজনৈতিক ধারার মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছি। লিবারেশন থিওলজি নামে রোমান ক্যাথলিক চার্চের একটি ধারা তাদের ধর্মচর্চাকে যুক্ত করেছিল দরিদ্র নিপীড়িত মানুষের অধিকার অর্জনের রাজনৈতিক লড়াইয়ের সাথে। তাঁরা যিশু খ্রিস্টের শিক্ষাকে ব্যাখ্যা করেছেন বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার থেকে মুক্তির সংগ্রামের আলোকে। লিবারেশন থিওলজির প্রবক্তারা দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়তে চান এর উৎস, ‘পাপ’ এর বিরুদ্ধে লড়াই করে। এটা আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, লিবারেশন থিওলজিস্টদের রোমান ক্যাথলিক চার্চের মূলধারা মার্কসবাদ-ঘেঁষা বলে অভিযুক্ত করে মূল চার্চ থেকে বহিষ্কৃত করেছিল। লিবারেশন থিওলজিস্টদের প্রবক্তারা বলেন, যিশু খ্রিস্ট মর্ত্যলোকে শান্তি নিয়ে আসেন নি, এসেছেন তরবারি হাতে। এই তরবারি এনেছেন দারিদ্র ও ‘পাপ’ এর হাত থেকে মুক্ত করে বিশ্বে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যে। এই ব্যাখ্যার মাধ্যমেই তাঁরা মানুষকে আহ্বান জানান ন্যায়ের জন্যে রাজনৈতিক লড়াইয়ে যোগ দিতে। বলা বাহুল্য, দীর্ঘদিন ধরেই এই দেশগুলিতে ধর্মযাজকদের এই অংশ সেখানকার মূলধারার বামপন্থীদের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবেই থেকেছেন। আমাদের বাংলার লোকায়ত ধারার কিছু সাধকদের মধ্যেও দরিদ্র নিপীড়িত মানুষের বাঁচার সংগ্রামের সাথে তাঁদের ধর্মচর্চাকে যুক্ত করতে দেখেছি আমরা। আচারের ঘেরাটোপের বাইরে গিয়ে তাঁরা বলেন, গরিবের অধিকার আদায়ের কথা।

এই সমস্ত আলোচনার পর এবার যদি নতুন করে রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান’ বা ‘গীতাঞ্জলি’ নিয়ে বসি, দেখবো রবীন্দ্রনাথের ধর্মবোধ কিংবা রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর মানুষের ঐতিহাসিক অভিযাত্রায় প্রতিপক্ষে নয়, কেমন স্বাভাবিক সহ-পথিক হয়ে উঠেছেন।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন