Site icon CPI(M)

Swami Vivekananda: The Memoir By A Marxist

“অত্যুজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিলেন কলকাতারই এক যুবক সন্ন্যাসী”

ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত

নরেন্দ্রনাথ দত্ত যিনি পরে স্বামী বিবেকানন্দ নামে পরিচিত হন, ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত তার ছোট ভাই। প্রথম জীবনে সশস্ত্র বিপ্লবপন্থী – ইংরেজ পুলিশের হাতে গ্রেফতার এবং কারাবাস। ১৯০৬ সালে যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক। দেশের মুক্তি সন্ধানে লড়াইয়ের সিদ্ধান্তে বিদেশ যাত্রা। আমেরিকার ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ , পরে জার্মানির হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃতত্ত্বে ডক্টরেট ডিগ্রি।

ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ গ্রন্থটি এই প্রবন্ধের প্রধান অবলম্বন। এই গ্রন্থে ভারতের মনীষীদের অন্যতম স্বামী বিবেকানন্দের একটি মুল্যায়ন নির্ভর জীবনী রচনা করেছেন ভূপেন্দ্রনাথ। স্বামী বিবেকানন্দ-কে আজকের ভারতে কেন স্মরণ করা হবে সেই প্রশ্নেরই উত্তর রয়েছে তার লেখায়, এক মার্কসবাদীর দৃষ্টিভঙ্গিতে।

মায়া এবং আধ্যাত্মবাদের বদ্ধ কিনারায় নিয়ে গিয়ে বিবেকানন্দের গোটা জীবনকেই যখন দক্ষিনপন্থী, গোঁড়া, পশ্চাদপদ মতবাদের হাতিয়ার হিসাবে দেশের মানুষের বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর দুষ্কর্ম চলছে সেই সময় ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা এই বইটি আজকের প্রজন্মের জন্য অন্ধকারের মাঝে এক আলোকবর্তিকা হতে পারে। ভারতের এবং আরও নির্দিষ্ট করে বললে ভারতবাসীদের দুর্দশা, নিপীড়ন দেখে যার হৃদয় আর্দ্র হয়েছিল এবং যে বিবেকানন্দ সেই দুঃখের মুক্তি সন্ধানে গুহাবাসী হবার পরামর্শ না দিয়ে ফুটবল খেলে শক্তসমর্থ হবার নির্দেশ দিয়েছিলেন, সাহস করে মাথা তুলে দাঁড়ানোর কথা বলেছিলেন সেই মানুষটি ঠিক কেমন ছিলেন সেকথা আজকের প্রজন্মের কাছে স্পষ্ট হতেই হবে।

“তোমাদের সামনে একটিমাত্র সমস্যা, জনসাধারণকে তাদের অধিকার দান … তোমরা জনগনকে অর্থহীন বাজে বুকনি দিয়ে ভুলিয়ে রেখেছ” … বিবেকানন্দ গ্রন্থাবলী (ইং), ৭ম খন্ড, পৃঃ ১৫৩

উক্তিটির সাথে যার সম্যক পরিচয় নেই, তার মনে হতেই পারে একথা কি করে একজন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী বলতে পারে? ২০২১ সালের ভারতে এধরণের উচ্চারণমাত্র বক্তাকে বিকাশ বিরোধী বলে তকমা দিয়ে দেওয়া হবে। আজ থেকে একশো বছরেরও বেশি সময় আগে বিবেকানন্দ এই কথা বলে গেছেন, যতই চেষ্টা হোক তার নামকে ব্যবহার করে মিস্টিসিজমকে জনমানসে ছড়িয়ে দেওয়ার – বিবেকানন্দের সন্ন্যাস আজও ভারতে দারিদ্রজর্জর, নিপীড়িত মানুষের দুঃখ কষ্টের সম্যক এবং বাস্তবসম্মত মুক্তির লক্ষ্যে এক প্রেরণা। সংসার ত্যাগ করে – বাস্তবের পৃথিবী থেকে মুখ ফিরিয়ে একা একক ব্যাক্তির উন্নতিকল্পে ধর্মাচরণের স্বার্থপর, নির্লজ্জ অভ্যাসের বিরুদ্ধে এক স্পষ্ট বিপ্লব।

বিবেকানন্দ নিজের সুখ ত্যাগ করেছিলেন, নিপীড়িত মানুষের দুঃখ কষ্ট লাঘব করার মানবিকতা ত্যাগ করেন নি।

আবহমানকাল থেকে ভারতের যে উচ্চশ্রেণীর লোকেরা শ্রমজীবী জনগনকে শোষণ করে এসেছেন স্বামীজি তাদের কাজ এবং চিন্তাধারার তীব্র নিন্দা করেছেন। তিনি দেখিয়েছিলেন যে, তাদের কৃতকর্মের প্রতিশোধ গৃহীত হয়েছে। উচ্চ থেকে নীচ সমস্ত ভারতবাসীই এখন বিদেশী শাসকের দাসে পরিণত। ভারতীয় সমাজের এই দুরবস্থা এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সর্বহারাদের অধঃপতিত দুর্ভাগ্যের কথা স্মরণ করে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ‘তবুও এমন একদিন আসবে যেদিন শূদ্রত্ব বিয়েই শুদ্রশ্রেণীর জাগরন হবে… তারা প্রত্যেক সমাজেই পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব লাভ করবে।’ ….

ভারতীয় জনগণের কানের কাছে সব সময়েইএই কথা বলা হয়ে থাকে যে, ভারতবর্ষ একটা আধ্যাত্মিক দেশ এবং আদিযুগ থেকেই ‘অহিংসা’ মন্ত্রে সে দীক্ষিত। কিন্তু রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক শোষণের বেলায় এই অহিংসা কোথায়? বর্তমান ভারতীয় সমাজে আধ্যাত্মিকতাই বা কোথায় সে সম্পর্কে স্বামীজি বলেছেন, “তোমরা কি দেখতে পাচ্ছ না যে সত্ত্বগুণের ধুয়া তুলে দেশ ধীরে ধীরে তমোগুণ বা অজ্ঞতার সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছে।”

ইতিহাস বলে যে অনেক হিন্দু সম্রাট ও বিজয়ী বীরই ছিলেন শুদ্র। কিন্তু তাদের সম্রাটত্ব প্রাপ্তির ফলেও ভারতের শ্রমজীবী জনগণের ভাগ্যের কোন উন্নতি হয় নি। অপরপক্ষে, বংশতালিকা প্রস্তুত করে তারা নিজেদের সূর্য কিংবা চন্দ্রবংশবতংস প্রতিপন্ন করবারই চেষ্টা করেছেন। শুদ্র বা নিম্নতরশ্রেণীর ব্যাক্তিদের নিছক ব্যাক্তিগত উন্নতির দ্বারা ভারতের শোষিত ও নিপীড়িত শ্রেণীর অবস্থার কোন উন্নতিসাধন হল না। সেই বিজয়ীরা নিজেদের বাহুবলে কেবলমাত্র নিজেদের উন্নতিসাধন করেছিলেন। তারা নিজেদের শ্রেণীকে উন্নত করেন নি।

স্বামী বিবেকানন্দ ভারতীয় সমাজের আমূল পরিবর্তন চেয়েছিলেন। তাঁর এই আকাঙ্ক্ষা তার লেখায় সর্বত্র ছড়িয়ে আছে।

তিনি ভৎসনার সুরে বলেছেন “বেদান্তের জন্মস্থান আমাদের দেশেই যুগযুগান্ত ধরে আমাদের জনগন মোহাচ্ছন্ন আছে। তাদের স্পর্শ করা অপবিত্রতা, তাদের সঙ্গে উপবেশন করা অপবিত্রতা। অন্ত্যজ হয়ে তারা জন্মেছে, অন্ত্যজ হয়েই তারা থাকবে।” পরিশেষে তিনি কার্যসূচী দিয়ে বলেছেন, “আমি আবার তোমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে ছাই এখানেই রয়েছে বাস্তব কাজের প্রয়োজনীয়তা এবং তার প্রথম অংশই হচ্ছে তোমাকে যেতে হবে ভারতের নিমজ্জমান লক্ষ লক্ষ জনগণের কাছে এবং তাদের তুলতে হবে হাত ধরে।”… তিনি আরও বলেছেন, “জনগণের কাছ থেকেই ভারতের একমাত্র আশা। উচ্চশ্রেনীর লোকেরা শারীরিক এবং নৈতিক উভয় দিক দিয়েই মৃত।” …. বিবেকানন্দ গ্রন্থাবলী (ইং), ৫ম খন্ড, পৃঃ ৮১

ধর্মমত সম্পর্কে ১৮৯৪ সালে বিবেকানন্দের চিঠিতে উল্লেখ “আমিষাশী ক্ষত্রিয়দের কথা তুমি বলছ; আমিষ কিংবা নিরামিষ যাই হোক না কেন, হিন্দুধর্মের যা কিছু মহৎ এবং সুন্দর তারাই তার স্রস্টা! কে উপনিষদ প্রনয়ন করেছিল? রাম কে? কৃষ্ণ কে ? কে-ই বা বুদ্ধ এবং জৈন তীর্থঙ্করবৃন্দ? ক্ষত্রিয়রা যখনই ধর্মপ্রচার করেছেন তখনই তারা তা’ সর্বসাধারণের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছেন। ব্রাহ্মনেরা যখনই কিছু প্রনয়ন করেছেন, অন্যদের সে জ্ঞান থেকে তারা বঞ্চিত করে রেখেছেন। গীতা কিংবা ব্যাসদেবের সুত্রগুলো পাঠ করো। গিতায় সমস্ত নরনারীর জন্যই দ্বার উন্মুক্ত, জাতিবর্ণ ভেদাভেদ সেখানে নেই। কিন্তু ব্যাসদেব বেদের এমন ভাষ্য করেছেন যাতে দরিদ্র শুদ্রগন প্রতারিত হয়। ভগবান কি তোমার মতো নির্বোধ যে এক টুকরো মাংসের দ্বারা তার করুনা ধারায় গতি ব্যাহত হবে? যদি তিনি তাই হন তাহলে তাঁর মূল্য কানাকড়িও নয়!” …… সমাজ থেকে ধর্মকে দূরে থাকবার নির্দেশ প্রচার করো। তাহলেই সমস্ত অন্যায় দূর হবে”।

“আমার আন্দোলনের পরিকল্পনা” বক্তৃতায় স্বামীজি বলেছেনঃ সংস্কারকদের আমি বলবো, আমি তাদের যেকোনো জনের চেয়ে বড় সংস্কারক। তাঁরা কিছু কিছু সংস্কার করতে চান। আমি চাই আমূল সংস্কার। আমাদের পার্থক্য হলো কর্মপদ্ধতিতে।

গীতার চেয়ে ফুটবলের মধ্য দিয়ে স্বর্গের কাছাকাছি তোমরা যেতে পারবে “

ভারতের অভ্যন্তরে জাতীয় আদর্শ নিয়ে সংশয় রয়েছে। সৃজনশীল নব-ভারতের সুস্পস্ট ভাবাদরশ কেউ তুলে ধরতে পারছেন না। কেউ বলেন, আমরা সুদূর প্রাচীন জীবনের সমাজ ব্যাবস্থায় ফিরে যাব ; কেউ বলেন ভারতবর্ষ হবে সোভিয়েট রাশিয়ার একটি অনুকৃতি; কেউ-বা বলেন, আমেরিকার। এই বুদ্ধি বিভ্রান্তির প্রতিক্রিয়াস্বরূপ নব ভারতীয় জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে জীবন বিসর্জন দিতে হল ধর্মান্ধ রাজনীতিক আততায়ীর হস্তে।

বাংলাদেশে যুব – আন্দোলন যখন ছিল প্রবল, সে সময়ে আমার তরুন সহকর্মীদের অনুরোধে ১৯২৮-২৯ খৃষ্টাব্দে তাদের কার্যে সহায়তা ও পরিচালনার উদ্দেশ্যে ইংরেজিতে সোশ্যালিস্ট বিবেকানন্দ নামে একটি ছোট্ট বই লিখেছিলাম। ১৯০২-১৯১৬ খৃষ্টাব্দে বাংলার ও বাংলার বাইরের তরুন বিপ্লবীদের প্রেরণার উৎসই ছিল স্বামীজির বিভিন্ন বানী। তাই গণসমূহের উন্নতিসাধন ও তাদের সেবাকার্যের জন্য স্বামীজি ভারতের তরুন সমাজের প্রতি যে আবেদন জানিয়ে গেছেন তা উৎসাহী তরুন কর্মীদের শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনের কার্যেও অনুপ্রাণিত করতে পারে। এই উদ্দেশ্য নিয়েই গণ – আন্দোলন সম্পর্কে তার বানী ও উক্তিসমূহ একত্র করে উপরোক্ত নামে পুস্তকটি প্রকাশ করা হয়; উক্ত নামকরণ দেখে প্রাচীনপন্থীরা ব্যঙ্গোক্তি করেন, কারন তারা স্বামীজিকে মরমী (মিস্টিক) ও রক্ষনশীল প্রাচীনপন্থী হিন্দু বলেই মনে করতেন। কিন্তু বইটি গণ – আন্দোলনে নিযুক্ত তরুণ কর্মীদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। তারা স্বামীজির উক্তির মধ্যে নিজেদের কর্মপন্থার সমর্থন পেয়েছিলেন – যে রকম প্রেরণা পেতেন এর আগেকার দশকের জাতীয় বিপ্লবীরা।

ভারতীয় চিন্তাজগতে আমরা এক ধরণের রহস্যবাদ থেকে যাচ্ছি অন্য এক রহস্যবাদে, এক কুসংস্কার থেকে অন্য কুসংস্কারে, এক ধরণের ধর্মোন্মত্ততা থেকে আরেক ধরণের ধর্মোন্মাদনায়, এক গোঁড়ামি থেকে ওপর গোঁড়ামিতে। ভারতের সমাজের কাঠামোতে প্রতিনিয়তই যে বস্তুবাদী পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে সে সম্পর্কে কেউ সচেতন নন। বেদান্তের দেশে জ্ঞানবাদ কেউ বুঝল না! তাই সকলেই সনাতনের বুলি আওড়াচ্ছেন।

স্বামীজি অতঃপর আমাদের আহ্বান জানালেন দরিদ্র, অবহেলিত, নিপীড়িত নরনারীর সেবাকার্যে আত্মনিয়োগের জন্য। সমস্ত অবনতির অবসান চাই। অস্পৃশ্যতা মহাপাপ। একে দূর করতে হবে। পৃথিবীতে ম্লেচ্ছ বলে কেউ থাকতে পারে না। তাঁরা সকলেই নারায়ন। তিনি আমাদের চার দফা কর্মসূচী দিয়েছিলেনঃ ‘জনসাধারনের সেবা করা, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ, ব্যায়ামাগার প্রতিষ্ঠা এবং গ্রন্থাগার আন্দোলন।’

ভারতীয় জাতীয়তাবাদ-এর নামে যে সমস্ত ভারতীয় জাতীয়তাবাদী স্বামীজির নাম ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে থাকেন তারা ভারতের সমস্যাবলী সম্পর্কে স্বামীজির বক্তব্য স্মরণে রাখবেন; অভিজাতশ্রেনীর দ্বারা ভারতীয় জনগণের শোষণ ব্যবস্থাকে স্বামীজি তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছেন এবং যারা জনতাকে পদদলিত রাখতে যুক্তিতর্কের অবতারনা করেছেন তাদের বক্তব্যকে তিনি ‘দানবীয় ও বর্বর’ আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “দেশপ্রেমিক হবার প্রথম সোপান হল ক্ষুধার্ত জনগণের প্রতি সহমর্মিতা।” তিনি সুস্পস্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছিলেন “কারো জন্য বিশেষ সুবিধা থাকবে না, সকলের সমান সুযোগ। তরুণ সমাজকে এই সামাজিক জাগরনের বানী, সাম্যের বানী প্রচার করতে হবে”।

ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা “স্বামী বিবেকানন্দ” বইটির সবটুকু ওয়েবপেজের পরিসরে প্রকাশ করার সুযোগ নেই – সাধারণ পাঠক, পার্টি কর্মী, সমর্থক এবং সর্বোপরি মানুষের পাশে থাকতে চান যারা তাদের উৎসাহ দিতেই বইটির বিভিন্ন পাতা থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ বাছাই করে একজায়গায় সাজিয়ে দেবার প্রচেষ্টায় এই প্রবন্ধ। মূল বইটি পড়ার উৎসাহ ছড়িয়ে দিতে হবে সকলের মধ্যে, এটাও আমাদেরই কাজ।

শেয়ার করুন