মাষ্টার’দা- আদর্শে অবিচল, দৃঢ় ও নির্ভিক যোদ্ধা

অয়নাংশু সরকার

ছোট বড় পাহাড়ের সমাবেশ চট্টগ্রামের বুকে। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে কর্ণফুলী নদী। করলডাঙ্গা পাহাড় - অরণ্যে ঘেরা নির্জন জায়গা। ঠিক হলো অস্ত্র প্রশিক্ষণ হবে এখানেই। শহরের মধ্যে দুটি অস্ত্রাগার একটি পুলিশ অস্ত্রাগার আর অন্যটি অক্সিলিয়ারি ফোর্সের অস্ত্রাগার। শহরের টিলার মাথায় টেলিফোন ভবন। যোগাযোগের মাধ্যম রেলপথ। মাস্টারদা, অম্বিকা চক্রবর্তী, নির্মল সেন, অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষ সিদ্ধান্ত নিলেন -পুলিশ অস্ত্রাগার ও অক্সিলিয়ারি ফোর্সের অস্ত্রাগার দখল করতে হবে, টেলিফোন ভবন ধ্বংস করতে হবে, ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করতে হবে, চট্টগ্রামের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে - এর সাথেই বিদ্রোহের খবর প্রচার করতে হবে। দিন ঠিক হল ১৮এপ্রিল ১৯৩০। ১৮ তারিখ সন্ধ্যায় লাইনচ্যুত হল মালবাহী ট্রেন - বিপ্লবীরা আগে থেকেই খুলে রেখেছিল লাইনের ফিসপ্লেট। পরিকল্পনামাফিক উড়িয়ে দেওয়া হলো রেললাইন। চট্টগ্রাম শহরের মাঝখানে টিলার উপরে টেলিফোন ভবন। অম্বিকা চক্রবর্তীর নেতৃত্বে অফিসের যন্ত্রাংশে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। ধ্বংস করা হলো গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যম।

Surya Sen

রাত্রি দশটা। বিপ্লবীরা হাজির হলেন পুলিশ লাইনে। রিভলবার থেকে চলতে লাগল গুলি। অস্ত্রাগার আক্রমণের সাথে সাথেই বিপ্লবীরা স্লোগান দিতে শুরু করলেন ইনকিলাব জিন্দাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক ও বন্দেমাতরম। কিছুক্ষণের মধ্যে হাজির হলো ব্রিটিশ ফৌজ। রিভলবার হাতে নিয়ে ঝড়ের গতিতে প্রত্যুত্তর দিতে আরম্ভ করলো বিপ্লবীরা। চুরমার হলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঔদ্ধত্য।  চার দিন ধরে ব্রিটিশদের নাজেহাল করে ছেড়েছিল বিপ্লবীরা। চট্টগ্রাম জুড়ে বিদ্রোহের মশাল জ্বলেছিল, সারাভারত জুড়ে মুক্তিকামী মানুষ উদ্বেলিত হয়েছিল মাস্টারদার নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির লড়াইয়ে।অবশেষে ২২ শে এপ্রিল ট্রেন বোঝাই মিলিটারি পৌঁছায় জালালাবাদ পাহাড়ে।চারদিক থেকে বিপ্লবীদের ঘিরে চলতে থাকে মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ।অদম্য জেদ আর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে চরম ঘৃণা থেকে গর্জে ওঠে বিপ্লবীদের মাস্কেট্রি।এই গৌরবের যুদ্ধে প্রাণ হারান ১২ জন বিপ্লবী। চট্টগ্রাম তথা দেশের সাধারণ মানুষের কাছে সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামের প্রতীক হয়ে ওঠেন মাস্টারদা ও তার সহযোগিরা।

ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে শুরু হয় ব্যাপক ধরপাকড় , তল্লাশি। স্বাভাবিকভাবেই বিপ্লবী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া হয়ে পড়ে আরও কঠিন। সূর্য সেনের মাথার দাম ধার্য করা হয়।অনেক বিপ্লবী এসময় পুলিশের জালে ধরা পরেন। আত্মগোপনে যেতে হয় অনেক বিপ্লবীকে। প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও বিপ্লবী  কর্মকাণ্ড থেমে থাকেনি , ঢাকার ব্রিটিশ জেলা শাসক হত্যা , কুমিল্লার পুলিশ কর্তাকে হত্যা করা হয়।

 ১৮ এপ্রিল, ১৯৩০ টেলিফোন ভবন, রেল, অস্ত্রাগার আক্রমনের সাথেই ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা ছিল কিন্তু সেদিন গুড ফ্রাইডে উপলক্ষে ইউরোপিয়ান ক্লাব বন্ধ থাকায় সে পরিকল্পনা তখন বাস্তবায়িত হয়নি।বিপ্লবী শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ১০ই আগস্ট ৭জন বিপ্লবী ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। এরপর মাস্টারদা সূর্য সেনের উদ্যোগে বিপ্লবীরা পুনরায় ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। সূর্যসেন তাঁর অনুগামী বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নেতৃত্বে কয়েকজন বিপ্লবীকে ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের দায়িত্ব দেন। কিন্তু এদের মধ্যে কল্পনা দত্ত আক্রমণ শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগেই গ্রেপ্তার হন। প্রীতিলতার নেতৃত্বে শান্তি চক্রবর্তী, বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস, কালীকিংকর দে, মহেন্দ্র চৌধুরী, সুশীল দে, পান্না সেন সহ একদল বিপ্লবী -  রাইফেল, বোমা প্রভৃতি আগ্নেয়াস্ত্র সজ্জিত হয়ে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে সেপ্টেম্বর ইউরোপীয় ক্লাবে আক্রমণ চালায়, কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিপ্লবীরা একজনকে নিহত ও ১২ জনকে গুরুতর আহত করে। পুলিশ ও পাল্টা আক্রমণ চালালে বিপ্লবীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পুলিশের গুলি এসে প্রীতিলতার পায়ে লাগে। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগে ২১ বছর বয়স্কা বিপ্লবী প্রীতিলতা পটাসিয়াম সায়ানাইড (KCN)খেয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মাস্টারদার কাছে বিপ্লবের শিক্ষা নিয়ে মেয়েদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা জাগ্রত করেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও কল্পনা দত্ত, তাদের টানে অনেক মেয়েরা এগিয়ে এসেছিলেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কুসংস্কার কে পিছনে ফেলে প্রগতিশীল ভাবনায় নিজেদেরকে গড়ে তুলেছিলেন আয়েশা বানু, সাবিত্রী দেবী, ইন্দুমতি সিংহ, সুহাসিনী গাঙ্গুলি, কুন্দপ্রভা সেনগুপ্তের মত নারীরা। মাস্টারদা বলেছিলেন- ‘বাংলায় বীর যুবকের আজ অভাব নাই। বালেশ্বর থেকে জালালাবাদ, এদের দৃপ্ত অভিযানে দেশের মাটি বারে বারে বীর যুবকের রক্তে সিক্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে মায়ের জাতিও যে শক্তির খেলায় মেতেছে, ইতিহাসে সেই অধ্যায় আজও অলিখিত রয়ে গেছে। মেয়েদের আত্মদানে সে অধ্যায় রচিত হোক এই আমি চাই। ইংরেজ জানুক, বিশ্ব জগত জানুক, এদেশের মেয়েরাও মুক্তিযুদ্ধে পিছিয়ে নেই’।

বিশ্বাসঘাতকতার চক্রান্তে ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সূর্য সেন গ্রেপ্তার হন। সূর্যসেন ও তরকেশ্বর দস্তিদারের মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ হয়। ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বেঙ্গল চিফ সেক্রেটারি কর্তৃক লন্ডনে ব্রিটিশ প্রশাসনের কাছে পাঠানো রিপোর্টে লেখা হয় "The outstanding event of the fortnight is the arrest on 17 February of surya Sen of Chittagong armoury raid notoriety,who,as the leader and brain of absconders, has been giving constant anxiety over the last three years. It was unfortunate that when Surya Sen and his companion were arrested, 4 others made good their escape...But luck enters very largely into these night operations end it certainly was a great stroke of luck that surya Sen was secured"।জেলের ভিতর তাদের উপর চলে নির্মম অত্যাচার। ১৯৩৪ সালের ১২ ই জানুয়ারি ফাঁসির দিন ধার্য হয়।ফাঁসির আগের দিন ব্রিটিশ পুলিশ সাঁড়াশি দিয়ে হাত ও পায়ের ২০ টি আঙ্গুলের নখ উপড়ে নেয়।হাতুড়ির আঘাতে ভেঙে দেওয়া হয় হার। অকথ্য অত্যাচারে জ্ঞান হারান মাস্টারদা। অচৈতন্য অবস্থায় ফাঁসি দেওয়া হয় মাস্টারদা ও তারকেশ্বর দস্তিদার কে। সাম্রাজ্যবাদের অমানবিকতার, বর্বরতার সীমা থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। বস্তায় মৃতদেহ ভোরে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়। ব্রিটিশ শাসকেরা জীবিত সূর্য সেনকে যেমন ভয় পেত, তেমনি ভয় পেত মৃত সূর্য সেন কেও।  তাইতো ওই মৃতদেহ গুম করা হয়েছিল। কিন্তু দমানো যায়নি সূর্য সেনের চেতনার মশালকে। সাম্রাজ্যবাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা আর মানুষের মুক্তির আদর্শ কে সামনে রেখে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই এর উদ্দেশ্যে শোষণহীন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে সূর্য সেনের চেতনার মশাল কে সম্বল করে অনন্ত সিং , সুবোধ রায় , গণেশ ঘোষ, সুবোধ চৌধুরী, কল্পনা দত্তরা এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে যোগদান করেন।

জালালাবাদের যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সশস্ত্র যুবরা ধরা পরে যান ফলে আন্দোলনের গতি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল ঠিকই কিন্তু যুব বিদ্রোহের এই ঘটনা গোটা ভারতবর্ষকে চমকিত করেছিল। বাংলার যুব মননে এই ঘটনা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির যুবক যুবতীদের সাম্রাজ্যবাদের প্রতি ঘৃণা ও ক্রোধ ছিল অসীম যার ফলে এই অসম সাহসী বিপ্লবী যুবক যুবতীরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক অসম - মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত হতে পেরেছিল। সচেতন ভাবেই তারা তাদের সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। মাস্টারদার অনুমতি নিয়ে সবাই কাজ করতো এ কথা ঠিক  কিন্তু মাষ্টার দা একা কোনো সিদ্ধান্ত নিতেন না , ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির সাংগঠনিক পদ্ধতি অনুসারে সম্মিলিত আলোচনার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হতো। সব ধর্ম, জাতির মানুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণ ছিল ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির অভ্যন্তরে। সূর্যসেন ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও লাজুক প্রকৃতির, কথা কম বলতেন। তাকে বাইরে থেকে দেখে বোঝা যেত না তিনি কি চরিত্রের মানুষ বা কোন ঘটনায় তার প্রতিক্রিয়া ঠিক কি?। ফাঁসির আদেশ তখন হয়ে গেছে অর্থাৎ মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও মাস্টারদা তার সহযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বার্তা দিয়েছেন ‘এই আনন্দময়, পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্য কি রেখে গেলাম? মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার স্বপ্ন - একটি সোনালী স্বপ্ন। স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন.... প্রিয় আমার বন্ধুরা, এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো - কখনো পিছিয়ে যেও না। বন্ধনের দিন চলে যাচ্ছে। ওই দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার নবারুণ। উঠে পড়ে লাগো। কখনো হতাশ হয়ো না। সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত’। মাস্টারদার সহযোদ্ধা বিপ্লবী নিরঞ্জন সেন লিখেছেন ‘সাধারণ লোকের চোখে পড়ার মতো কোনো বৈশিষ্ট্য তার ছিল না। তিনি অন্তরালে থেকে কাজ করতেন, সভা সমিতিতে গরম গরম বক্তৃতা দিয়ে বাহবা নেবার চেষ্টা তার ছিল না।  নেতৃত্ব সুলভ কর্তৃত্ব দেখানো থেকে তিনি বিরত থাকতেন’। বিপ্লবী নিরঞ্জন সেন ও মাস্টারদা একই সঙ্গে রত্নগিরি জেলে বন্দী ছিলেন। নিরঞ্জন সেন 'বীর বিপ্লবী সূর্যসেন' বইতে লিখেছেন " রবীন্দ্র সাহিত্যের প্রতি তার তখন থেকেই ছিল গভীর অনুরাগ, ....রবীন্দ্রনাথের কথা বলতে তিনি গর্বিত হয়ে উঠতেন। রবীন্দ্রনাথের ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতার প্রাণস্পর্শী উদ্ধৃতি তার মুখ থেকে মাঝে মাঝে শুনতে পেতাম ....

এই সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে

দিতে হবে ভাষা,

এইসব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে

ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা.....।

বিপ্লবী আনন্দ গুপ্তের ভাষায় ‘মাস্টারদা তার অনুগামীদের শ্রদ্ধা অর্জন করতেন কোন বাহ্যিক চাকচিক্য দিয়ে নয়, তার ভিতরে এমন এক স্বচ্ছ আন্তরিকতা ছিল যা কর্মীদের মুগ্ধ করত’। পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির মানুষের সঙ্গেও নিবিড় সম্পর্ক ছিল মাস্টারদার। জালালাবাদ যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষেরা অনেক বিপ্লবীদের আত্মগোপনে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন আন্তরিকতার সাথে। আক্রান্ত অবস্থায় অম্বিকা চক্রবর্তীকে উদ্ধার করে সেবা সুশ্রুষার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন হোসেন আলী, ব্যাপক পুলিশি ধরপাকরের সময় কামাল উদ্দিন তার বাড়ির বাঁধানো কবরের মধ্যে লুকিয়ে রাখেন মাষ্টারদাকে। সম্প্রীতির নজির গড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে আপোষহীন লড়াই লড়েছিলেন সূর্য সেনরা তার থেকে শিক্ষা নিয়েই বর্তমানে যারা সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদারি করে এদেশের মাটিতে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি করছে তাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। মাস্টারদার ইতিহাস সংগ্রামের ইতিহাস। পরাধীনতা থেকে মুক্তি, শোষণ থেকে মুক্তি ছিল তার অন্যতম লক্ষ। মাস্টারদার নেতৃত্বে দৃঢ়তা নির্ভীকতা ও আত্মবলিদানের যে নজির বীর বিপ্লবীরা স্থাপন করেছেন তা স্বাধীনতা সংগ্রামের ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের এক অনন্য মাইল ফলক।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন