ন হন্যতে - পৃথা তা...

৩০ অক্টোবর ২০২১, শনিবার

হুতমের ভাষায় বলতে গেলে "আজব শহর কলকেতায়" কালের নিয়মে গজিয়ে গিজগিজ করছে একগাদা খাবার দাবার খাওয়ার বা বসবার জায়গা, তার রকমফেরও নানান চালের। তেমন কোন ডাকসাইটে ঝা চকচকে জায়গায় যে কোন বৈশাখ বা জৈষ্ঠ্যমাস নাগাদ দুপুরে একবার ঢু মেরে একগ্লাস জল চাইলে সত্যি সত্যিই আপনাকে প্রথম যা জিজ্ঞেস করবে তা হল - বোতলবন্দি জল না তাদের তরফ থেকে গ্লাসে দেওয়া খাবার জল। তারপর একেবারে চিল্ড জল না সাধারণ উষ্ণতার, তারপর তা মেশালে ঠান্ডা ভাব টা বেশি থকবে না গরমটা। উর্দ্দি আটা মানুষটি খুবই অনুগতচিত্তে আপনাকে যখন এতগুলো অপশন দিয়ে জল আনতে যাবেন জীবন কি সত্যিই একবারের জন্যও বেশি জটিল হয়ে যাচ্ছে কিনা ভেবে একচিলতে হাসি রেশ রেখে যাবে না ঠোঁটের কোনে? মজা হচ্ছে এইখানে গল্পটা শেষ নয় বলা যেতে পারে শুরু। মানে ভালো করে ভাবতে গেলে সভ্যতার দস্তুরই তাই, একটা ক্ষেত্রের আরও নানান উপায় বের করা, একটা কাজের আরও নানা সমাধানের পন্থা আবিষ্কার করতে করতে এগিয়ে যাওয়া৷ তাতে জটিলতা বাড়বে না? হ্যা তো। কিন্তু উন্নত হওয়ার সাথে সাথে এটা অঙ্গাঙ্গী সম্পৃক্ত বা বলা ভালো ধারাপাত থেকে ইন্টিগ্রেশনে এগোনোর পন্থাটাই এমনতর। তা হলে এই পন্থা গ্রহণের যে ভার? যে চিন্তার ওজন সোজা কথায় এই জটিলতা কি জীবনকে ছুঁয়ে যাবে না, বাসে উঠে জানলার ধারের সিট পাওয়ার সোয়াস্তিটুকু কেড়ে নেবে না! এইখানেই হয়ত বেঁচে নেওয়ার গভীরতম ও কঠিনতম "একভাবনার অভ্যেস" নিহিত আছে, জটিলতার আস্বাদটুকু গ্রহণ করে তা অতি সহজচালে ব্যাখ্যা করা, যাপন করা। "সহজ কথা বলা"- এই আপ্তবাক্যের আড়ালে দ্বন্দের ছাত্রদের সদাসর্বদা সতর্কতা নিতে হবে - এর মানে সহজ করে "ভাবা" নয়, কঠিনের নির্যাসটুকু গ্রহন করে তার সহজ ব্যখ্যা। দ্বন্দমূলক বস্তুবাদের স্পাইরাল গতির এক চমৎকার উদাহরণ। আর এইখানে অদ্ভুত ভাবে হাজার একটা অত্যাশ্চর্য উদাহরণ যিনি তৈরী করে গেছেন তিনি সুকুমার রায়। এক স্বার্থকনামা লেখক।

এই "জনার"-কে কোনভাবেই "এবসার্ড লিটারেচার"- হিসেবে ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। উচিতও না। "নন্সেন্স" এর এসেন্সে তা সুরভিত হয়ে আছে। আরও কিছু দারুণ নতুনতর বিষয় আছে- একটি লাইনকে অকার্যকর বা কার্যকর করে তোলার জন্য ব্যবহৃত নানা শব্দকে নানাভাবে ঠোনা মেরে দেখা, ঠুকে দেখা; তার অর্থের দ্বারা তাকে ইচ্চেমত বেঁকিয়েচুরিয়ে ফেলা; তার মাধ্যমে নতুন ছবি আঁকা। খুব কঠিন কাজ। তবু এমন এক পদ্ধতিতে আঁকা অপূর্ব অনিন্দ্যসুন্দর ছবিতে ভরে আছে মূলত বাংলা সাহিত্য। ( বেশ কিছু অনবদ্য ইংরেজি প্রবন্ধও আছে, তা তথাকথিত ভাবে "সিরিয়াস" লেখা হলেও সেখানেও শব্দের নতুনভাবে প্রয়োগ লক্ষ্যনীয়)



"পূবদিকে মাঝরাতে ছোপ দিয়ে রাঙা রাতকানা চাঁদ ওঠে আধখানা ভাঙা।" এমন আরও কতশত উদাহরণ।

এ তো গেল লেখার চাল আর তা বেঁধে রাখার কিছু শব্দ নিয়ে কথা।
রয়ে গেছে তারপর এক দারুণ
অক্ষরিকভাবেই কালোত্তীর্ণ কিছু "মিথ" বা কালোত্তীর্ণ কিছু সত্য এমনভাবে তার লেখায় এসেছে যা যুগে যুগে সত্যি। বারে বারে নানা দেশে নানা রাজ্যে নানা কালে তার হাজারো প্রয়োগ হয়ে চলেছে। এমন লেখা বিরল না, তবে নিতান্ত ঠাট্টা-তামাশার মেজাজে আরও পাঁচটা কথা বলতে বলতে চট করে সেই দুয়োরাণীদের পাড়া দিয়ে টুক করে ঘুরে এসে আবার ঠাট্টাতামাশায় মশগুল হয়ে ওঠা এ এক অদ্ভুত প্রতিভা।
যে কবিতায় - শুরুর দিকের দুটো লাইন হল - "জল খায়, দুধ খায়, খায় যত পানীয় জ্যাঠা ছেলে বিড়ি খায়, কান ধরে টানিও" সেই কবিতারই পরের দিকের লাইন - "যুদ্ধে যে গুলি খায়, গুলিখোর সেও কি!" কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী ঘোষনা করলেন খবরে আসার জন্য দেশজুড়ে চাষারা আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে দলে দলে ......... তারপর এই লাইন দুটো পড়লে তার কি মানে দাঁড়ায়, আজকের ভারতে একবার ভাববেন।
ওইখানেই পরের দিকের একটি লাইন - "দিন আনে দিন খায় কত লোকে হায় রে!"। "হায়" শব্দটির ব্যাবহার লক্ষনীয়।
"জুতো খায়, গুঁতো খায়, চাবুক যে খায় রে! তবু যদি নুন খায় সেও গুণ গায় রে!" নাস্তানাবুদ হওয়া সরকারি মন্ত্রী বা আমলার "হের অমুক" শুনে জার্মানিতে, ভারতে, বাংলায় এমনদুটো লাইন মনে পরে বৈ কি!
"ধর্মতলায় কর্মখালি", বা "নাই মামা তাই কানা মামা" -র ব্যাখ্যায় আর গেলাম না। যুগের হুজুক টিভির ঘন্টাখানেক দিয়ে, ফেসবুকের ঢেউ দিয়ে চোখ ধাধিয়ে দিয়ে উত্ত্যক্ত করে তোলার পর, কোন এক সন্ধ্যায় "আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি", "যতদূর মনে পরে" কিম্বা "হেজিমনি এন্ড রিভলিউশন" খুলে খানিক্ষন মননিবেশ করলে কিছু পরে এক স্থিরতা অনুভব করা যায়। অনুভব করা যায় - "মন বসনের ময়লা ধুতে তত্ত্বকথাই সাবান".
অতি চমৎকার ভাবে ঠিক তার পরের দুটো লাইন আসে যা একান্ত সুকুমারসুলভ -
" বেশ হয়েছে, ঢের বলেছ, ওইখানে দাও দাড়ি! হাটের মাঝে ভাঙবে কেন, বিদ্যে বোঝাই হাঁড়ি" এই কলম চিত্তে আনন্দ দেবে, কিন্তু আনন্দ নিয়ে আড়ম্বরের লেশমাত্র দেখলেই থাবড়ে দেবে সজোরে। আনন্দ, প্রফুল্লতা অনুভবের বিষয় তা যেন কুচ্চিত উজ্জাপন হয়ে না উঠে তা নিয়ে অতি সহজ চালে জাগ্রত এই লেখনী।
শেষে উল্লেখ করা লাইনদুটো মাঝে মাঝে নির্মলা সীতারামনের ওমুক তো কিনি না তাই দাম বাড়ছে কি না বাজারে তা জানি না, ইত্যাদি রামধনুর মত রঙিন ব্যাখ্যা শুনে পার্লামেন্টর ভিতরে কোন অর্ধ-উলঙ্গ শিশু গিয়ে বলে আসুক মনে হয়। এমন উদাহরণ আর তার নানা বিচিত্র ব্যখ্যা বলে বলে ফুরাবে না। এতই সুন্দর এই জার্নি। জীবদ্দশায় প্রকাশিত হওয়া লেখা দেখার সুযোগ বেশ কম পেয়েছেন। সেসময় কালাজ্বরের চিকিৎসা হত না। একরকম চিকিৎসার সুযোগই পাননি! অবনীন্দ্রনাথের লেখা পড়ে জানা যায় তিনি স্টেজ থিয়েটার করেছিলেন বেশ কিছু। ব্রাহ্মণ্যধর্মের সূত্র ধরে ঠাকুরবাড়িতে ছিল বেশ যাতায়াত। তবু কি অদ্ভুত মৌলিক রয়ে গেছে তাঁর কলম। কি ত্রিকালদর্শী!

তাঁর লেখা বিজ্ঞান বিষয়ক অনেক গম্ভীরচালের প্রবন্ধ আছে বিশেষ করে উল্লেখ করা যায় মহাকাশ বিজ্ঞান ও ছায়াপথ নিয়ে লেখা৷ আছে আরও নানা বিষয়ে নিয়ে এমন ধরনের লেখা যা সমৃদ্ধ করবে পাঠককে। আসলে হাসির দিকে আনন্দের দিকে নানা ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে এগোন আমাদের প্রতিজনের প্রতিক্ষেত্রের উদ্দেশ্য হলেও আমরা হাসি বিষয়টি কোথাও যেন লঘু করে দেখি। কখনো এই বিষয়ের উন্নতমানের কোন বই বুকারের জন্য মনোনীত হতে দেখা যায় না, এমন কোন ছবি সিলভার বিয়ার বা অস্কারের জন্য দৌড়ে থাকে না। কমেডিয়ানকে ভাঁড় ডাকা বা অকর্মাকে কমেডিয়ান ডাকা আমাদের অভ্যেস। আর এই কুঅভ্যেসের যাত্রাপথেই হিমালয়ের মত দাঁড়িয়ে থাকা শিল্পীদের সেনাপতি সুকুমার রায়, যা তথাকথিত আচ্ছা আচ্ছা সিরিয়াসদের মিছিলকে নানা ছলে নানান আরও সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কান ধরে নীলডাউন করে রাখতে পারেন অবলীলায়। তাঁর ভাষাতে ই বলা যেতে পারে - "মামাদের" দলকে বেশ বেগ পাইয়ে দিয়ে পারেন। "মামা" বিষয় নানাভাবে বারে বারে এসেছে তাঁর সাহিত্যে। কখনো "পাওয়ার" হিসেবে তো কখনো "তাবেদার" হিসেবে। এমন গোষ্ঠমামা, মেজোমামা, মেসো (অদ্যনাথের বা নন্দলালের), খুড়োরা এক এক তাবড় প্রতিষ্ঠানের ভার নিয়েছেন। কখনো লোভ দেখিয়ে কাজ করানো তো কখনো চোখ রাঙিয়ে বোবা বানানো এমন আরও অনেককিছু। উন্নত প্রিন্ট এর ব্যাপারে তিনি ছিলেন নতুন দিশারি। বাইরে থেকে মেশিন আনিয়ে তখন শুরু হয় সন্দেশের কাজ। আলাদা করে উল্লেখের দাবী রাখে তাঁর ছবি। এ ব্যাপারে এক চমৎকার বিষয় উল্লেখযোগ্য। "চোর ধরা" কবিতাটা ছবিটা ছাড়া পরলে মানেই বদলে যায়। একজন সতর্কভাবে চুরি আটকাবে এটুকুই কবিতায় বলা। ছবি বলে যেদিকে সে ঢাল নিয়ে দাঁড়িয়ে চুরি হচ্ছে তার উল্টো দিক দিয়ে। পাঠানকোট, পুলওমা, ছাপান্ন ইঞ্চি ছাতি সব কেমন "ছবির মত"! তাই না! এরই সাথে এই কবিতার শুরুর দুটো লাইন "আরে ছি ছি রাম রাম, বোল না হে বোল না চলছে যা জুয়োচুরি নেই তার তুলনা"। সারদা নারদা, ডিমানিটাইজেশন, নীরব মোদি, বিজয় মালিয়া মনে আসিলে কর্তৃপক্ষ দায়ী নহে! রাম রাম প্রসঙ্গ যখন এলোই লক্ষ্মণের শক্তিশেল এ নবরামায়নের যে চিত্র চিতে আসে তা আজকের অযোধ্যার রায় বা রামরাজত্ব -এর চিত্র। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর "ছেলেদের রামায়ণ" তার ছেলের রামায়ণ আকারে এক নতুন ছবি উপহার দেয় আমাদের৷
রয়ে গেল একগাদা ছোট গল্প। চিনেপটকা, পাগলাদাশু, বা বাজে গল্প। ছবিটা কর্ত্তার ভেবে সবাই যখন আকুল তখনই খবর এলো এটা অন্য কারো, তাঁর চাকরের উক্তিতে জানা যায় - এর আগে ঘরে ঢুকে যাকে সে সেলাম করেছিল তাকে আগাগোড়াই তার চোরের মত লাগছিল নাকি! চলুন একবার আফগানিস্তান দিয়ে ঘুরে আসি! কি মিল! হযবরল-এর ন্যাড়া, কমতি বয়েস আজ ও আগামীতেও ঘুরবে ইতিউতি। দাশুকে কেমন যেন ছোটবেলার ফ্যাতাড়ু বললে বেমানান লাগে না। অন্তত সবসময় ছ্যাবলামি করা ছেলেটা আত্মসম্মানের জন্য যখন ছাগল ডেকে মিহিদানা খাইয়ে দেয় তখন তেমনই লাগে বটে!



কন্যাভ্রুণহত্যায় সরকারি বাধা শিথিল হয়েছে। প্যান্ডামিক বাড়িয়ে দিয়েছে ছেলে মেয়ের তফাৎ আরও বেশি। বেড়েছে নারিপাচার। এমন সময় কোন এক গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দেওয়ালে জুড়ে যদি এমন ছবি ফুটে ওঠে?

" ছোট ছোট ছেলেগুলো কিসে হয় তৈরি, -কিসে হয় তৈরি, কাদা আর কয়লা ধুলো মাটি ময়লা, এই দিয়ে ছেলেগুলো তৈরি।

ছোট ছোট মেয়ে গুলি কিসে হয় তৈরি। কিসে হয় তৈরি?
ক্ষীর ননী চিনি আর ভাল যাহা দুনিয়ার মেয়েগুলি তাই দিয়ে তৈরি।।"

কোন অস্তিত্ব ছোট করতে না কোন অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়া রোধ করতে শুধু শেষের চারটে লাইন বললে হবে না। ফাঁকি দেওয়া হয় তাতে, শুরুর লাইন চারটে বলতে হবে!"

এইভাবেই ছোটবেলার আনন্দমুখর দিন, কবিতা প্রতিযোগিতার দিন গুলি কখন যেন বড়বেলার পুজি হয়ে গেছে!

বোম্বাগড়ের রানীর লাইন বাই লাইন তো আলাদা আলাদা কান্ডে ব্যাখা দেওয়া যায় এই রাজ্যে।

এইজীবনে "তোর গানে পেঁচি রে, সব ভুলে গেছি রে!" এমন প্রেমের লাইন এই ক্ষুদ্র জানাবোঝার জগতে আর কোন গানে কোন সাহিত্যে পেলাম না।

জোছনায় ভেসে যাওয়া কলকাতার ফুটপাতে ফুটন্ত ভাতের হাড়ির পাশে প্যাংলা নাকে সর্দি ফোকলা ছানাকে যখন ছিন্ন বস্ত্র মা আদর করে কোল থেকে আকাশের দিকে ছুড়ে দেয় আর লোফে তখন পান্তভূতের জ্যান্তছানা কেমন খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে জোছনা ম্লান করে- "ওরে আমার হামানছ্যাচা যষ্টিমধুর মিষ্টি রে!".

অবাক মুগ্ধতায়, প্রেমে, স্নেহে, আয় রে ভোলা-র উদার ডাকে, অসম্ভবের ছন্দেতে সবেতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে সুকুমারমতি। এই সহজ হওয়ার নিরন্তর পথচলা কালের নিয়মে প্রবাহিত হোক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন