গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে রাজ্যের প্রতিটি জেলায় ডি ওয়াই এফ আই – এস এফ আই’সহ ১২টি বামপন্থী ছাত্র যুব সংগঠন নবান্ন অভিযানের প্রচারে সামিল হয়েছিলেন। একটি ফর্ম তৈরি করা হয় সকল বেকারদের কাছে পৌঁছানোর জন্য, সেই ফর্মে নাম, ঠিকানা, যোগ্যতা ও কোন জায়গায় চাকরি করতে চায় ,তা পূরণ করতে হবে। দাবি ছিল মূলত দুটি, ১) সকল শুন্য পদে যোগ্যতা অনুযায়ী স্থায়ী চাকরী দিতে হবে, ২) যতদিন না চাকরী দিতে পারছে, ততদিন নূন্যতম ৬০০০টাকা মাসিক ভাতা দিতে হবে।
রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তে চাকরি প্রত্যাশী বেকার যুব’রা প্রতিকী ফর্ম পূরণ করেছিলেন। স্নাতকোত্তর ,ইঞ্জিনিয়ার হয়েও একটি মাত্র চাকরির আশায় উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ানো যুবক-যুবতী’রা সই করেছিলেন এই ফর্মে। সেই লক্ষ লক্ষ প্রতিকী ফর্ম বস্তায় ভরেই নবান্ন অভিমুখী মিছিলে সামিল হওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।এছাড়াও নবান্ন অভিযানের প্রচারের অংশ হিসেবে আগষ্টের ২৩,২৪,২৫ তারিখে ডি ওয়াই এফ আই রাজ্য কমিটির আহ্বানে সিঙ্গুরের বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলা তাদের কথা শোনা ও ফর্ম পূরণের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। বেশিরভাগ গ্রামবাসী ও বেকার যুবকের দাবি ছিল তারা সিঙ্গুরে আবার কারখানা চান।
১২ই সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে দশটা সিঙ্গুর স্টেশন চত্বর ভাসিয়ে বেকারত্বর যন্ত্রণা ও চাপা ক্ষোভ বুকে নিয়ে নবান্নর অভিমুখে মিছিল যখন শুরু হলো তখনই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি উপেক্ষা করে লাখো কালো মাথা কাক ভেজা হয়ে এগিয়ে গেলো।মিছিল যত এগিয়েছে প্রতিবাদের ঝাঁঝ ততই বেড়েছে। সিঙ্গুর বাজার, স্কুল মোড় হয়ে, ঘনশ্যমপুর পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে ১২ টি বাম ছাত্র-যুব সংগঠনের ঐতিহাসিক মিছিল তখন উঠেছে দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়েতে। মুর্হূর্তের মধ্যে ৪২ফুট চওড়া এক্সপ্রেসওয়ে-র একটি লেন যেন ভেসে গেলো ভরা কোটালের জনস্রোতের মত। এগোচ্ছে মিছিল মাথায় বৃষ্টি নিয়ে , কন্ঠে ধ্বনিত স্লোগান, কম খরচে পড়ুক সবাই,কারখানায় কাজ, বেকার ভাতা চাই। হাতে ভিজে যাওয়া সাদা পতাকা। যে দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়ে’তে মাচা বেঁধে রাজ্যের লক্ষ বেকারের কর্ম সংস্থানের সম্ভাবনা নস্যাত করে ছিলেন আজকের মুখ্যমন্ত্রী।
সেই জাতীয় সড়ক সাক্ষী থাকলো কাজের দাবিতে , কারখানার দাবিতে একই সঙ্গে পদযাত্রায় পা মেলানো ২০ বছরের কলেজ পড়ুয়া থেকে ৩৫ বছরের বেকারত্বের জ্বালায় ভুগতে থাকা যুবক। একই সঙ্গে জাতীয় সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে মিছিল কে সমর্থন জানিয়েছেন ওই চত্বরের প্রতারিত সিঙ্গুরের হাজার হাজার পরিবার। বিকাল সাড়ে চারটা নাগাদ এদিনের পদ যাত্রা শেষ হয় প্রায় ১৮ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ডানকুনি হাউসিং কমপ্লেক্সে। সেখান থেকেই বাসে করে হাওড়ায় সহযোদ্ধাদের বাড়িতে রাত্রি বাস।
১৩ তারিখ সকালে ফের হাওড়া স্টেশন রেল মিউজিয়াম চত্বর থেকে মিছিল শুরু হয় দুপুর ১২টায়। রাষ্ট্র শক্তির মুখোমুখি হতে গন্তব্য নবান্ন। মিছিল শুরুর সময় ১২টার সময় নির্দিষ্ট থাকলেও ১৩ তারিখ সকাল ৯ টা থেকেই হাওড়া স্টেশন মিউজিয়াম চত্বরে বিভিন্ন জায়গা থেকে মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা আসতে শুরু করে। শুরু হয় গান, কবিতা, পথ নাটিকা, সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জমায়েতের ভিড় বাড়তে থাকে। হাওড়া রেল মিউজিয়াম থেকে দুপুর প্রায় ১টা নাগাদ লাখো ছাত্র যুবর সুসজ্জিত রঙিন উদ্দীপিত মিছিল বঙ্কিম সেতু ভাসিয়ে বঙ্গবাসী মোড় হয়ে বাঁদিকে জিটি রোডে এসে পৌঁছয়।মল্লিক ফটকের সামনে একতলা বাড়ির সমান উঁচু পুলিশের স্টিলের ব্যারিকেড, গোটা এলাকার দোকান পাট, পুলিশ আগেই বন্ধ করে দিয়েছিল। পুলিশ, র্যাফ, কমব্যাট ফোর্স রোবো কপ, জল কামান,টিয়ার গ্যাসের সেল কি নেই, যেন রাজ্যের ছাত্র-যুব সমাজের বিরুদ্ধে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের অঘোষিত যুদ্ধ।
কাজের দাবিতে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে লাখো ফর্ম পৌঁছে দিতে চাওয়া লাখো ছাত্র যুবর সেই মিছিল জিটি রোডে ওই ব্যারিকেডের সামনে পৌঁছানো মাত্রই বেধড়ক লাঠি চালাতে শুরু করে পুলিশ। আলোচনা কথা বার্তার কোনই কিছুরই সময় বা সুযোগ দেয়নি পুলিশ প্রশাসন। ওপর মহলের নির্দেশে নির্বিচারে নিরস্ত্র ছাত্র-ছাত্রী, যুব-যুবতীদের ওপর চললো পেটানোর অভিযান। ঠিক ছিল বেকার যুবকদের মিছিলে সামিল হওয়া লাখো যুবকের পক্ষ থেকে পাঁচ জন ছাত্র-যুব’র এক প্রতিনিধি দল নবান্ন-এ যাবে তাদের দাবি সনদ সরকারের কাছে পৌঁছে দিতে। কিন্তু তার বদলে মিললো উন্মত্ত পুলিশের নৃশংস আক্রমণ। জিটি রোডের ওপরে পাঁচ তলা একটি বাড়ির ছাদ থেকে ও তার উল্টোদিকে নির্মিয়মান একটি বাড়ির ছাদ থেকে পুলিশেরই আশ্রয়ে জমায়েত কে ছত্র ভঙ্গ করতে থান ইট ছোড়ার দায়িত্ব পালন করলো তৃণমূলী দুর্বৃত্ত বাহিনী। এই চিত্র মুদ্রার একটি পিঠ। মুদ্রার অন্য পিঠে ছিল স্পর্ধা অকুত ভয় আর অদম্য জেদ। টানা ১ ঘন্টা ২০মিনিট ধরে লাঠি চার্জ, জলকামান, টিয়ার গ্যাসের সেল ফাটিয়েও জমায়েত’কে এক ইঞ্চি নড়ানো যায়নি।
পুলিশী হামলায় রক্ত ঝরিয়ে ১২টি বামপন্থী ছাত্র-যুব সংগঠনের ২২ জন গ্রেপ্তার বরণ করেন। পরেরদিন রাজ্যজুড়ে প্রতিরোধের মেজাজেই পালিত হয় প্রতিবাদ কর্মসূচী। রাজ্য জুড়ে কালা দিবস পালন করা হয়। পুলিশের বর্বরোচিত আক্রমণে ৯০ জন ছাত্র ছাত্রী যুবক যুবতী রক্তাত্ব হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।
শেয়ার করুন