আগামী ২৭শে সেপ্টেম্বর দেশ জুড়ে ধর্মঘটের আহ্বান জানানো হয়েছে দেশের ৫০০টি কৃষক সংগঠনের জাতীয় মঞ্চ ‘সংযুক্ত কৃষাণ মোর্চার’ পক্ষ থেকে। ২৬শে নভেম্বর ২০২০ দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলি একদিনের ধর্মঘট আহ্বান করেছিল – ঐ দিন বিভিন্ন রাজ্য থেকে যাত্রা শুরু করে ২৭শে নভেম্বর দিল্লির সন্নিহিত রাজ্যের সীমান্তে অবস্থান শুরু করে দেশের কৃষকরা। তাঁদের প্রধান দাবী - তিনটি কৃষি আইন বাতিল এবং বিদ্যুৎ (সংশোধনী) বিল, ২০২০ সংসদে পাশ করানোর প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ রদ করা। তিনটি কৃষি আইনের প্রয়োগের সম্ভাব্য পরিণতি কৃষক সমাজ বুঝবেন - এটি স্বাভাবিক। কিন্তু বিদ্যুৎ আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনী যার মধ্যে তিনটি জটিল বিষয় –
১) ভারতের সংবিধানে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক এবং কেন্দ্রীয় রাজ্য ও যুগ্ম তালিকা,
২) কৃষি উৎপাদন ও অর্থনীতি এবং
৩) দেশের মানুষের বিদ্যুতের অধিকার সহ বিদ্যুৎ উৎপাদন, সংবহন ও বিতরণের প্রযুক্তিগত দিকগুলির বিষয় বুঝে নিয়ে তার বিরোধিতা করার মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের কৃষক সমাজ যে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন – তার প্রতি দেশের প্রগতিপন্থী মানুষের পক্ষ থেকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
২৭শে নভেম্বর কৃষক আন্দোলনের সূচনা দিবসে থেকে ১০ মাস পূর্ণ করার দিনে ২৭শে সেপ্টেম্বরের এই ধর্মঘট একদিকে যেমন দেশের মানুষের খেয়ে বাঁচার অধিকার রক্ষার সংগ্রাম অপরদিকে দেশের মানুষের বিদ্যুতের অধিকার বজায় রাখার সংগ্রাম। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা জানান মানুষ না খেয়েও দেহে পুঞ্জিত জ্বলীয় পদার্থগুলির নির্ভরতায় কয়েকদিন বেঁচে থাকতে পারেন। প্রাণবায়ু বা অক্সিজেন ছাড়াও কয়েক মিনিট বেঁচে থাকা সম্ভব – কিন্তু আধুনিক মানুষ বিদ্যুৎ ছাড়া এক মুহুর্তও বাঁচতে পারে না। এই নিরিখেই বুঝতে হবে ২৭শে সেপ্টেম্বরের ধর্মঘটের গুরুত্ব।
স্বাধীনতার পরে দেশের মানুষের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে গতি সঞ্চার করতে বিদ্যুৎ (সরবরাহ) আইন, ১৯৪৮ পাশ করা হয়। কেন্দ্রে বিদ্যুৎ প্রাধিকরণ ও রাজ্যগুলিতে বিদ্যুৎ পর্ষদগুলি গঠন করার জন্য প্রণীত এই আইনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসাবে লেখা হয়েছিল – একটি সদ্য স্বাধীন যুদ্ধ বিধ্বস্ত অনুন্নত দেশে দ্রুত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়েই এই আইন প্রণীত হল। যেহেতু আর্থ-সামাজিক উন্নয়নই প্রধান লক্ষ্য, তাই বিদ্যুৎ পর্ষদগুলিকে লাভ করতে হবে – এমন নির্দেশ দেওয়া হয়নি। সাড়ে তিন দশক পরে এই আইনের খানিকটা সংশোধন করে বলা হয়েছিল – বিদ্যুৎ পর্ষদগুলিকে তিন শতাংশ উদ্বৃত্ত রাখতে হবে। তখনও মুনাফার প্রশ্ন আসেনি।
আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে বিদ্যুৎ পর্ষদগুলি ৫০ বছরে কি করতে পেরেছিল – তার সাফল্য, ব্যর্থতার বিচার করতে হলে প্রথম যেটা বলতে হবে সেটা হল দেশের মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, পরিবহন ইত্যাদির নিরিখে উন্নয়ন ছাড়াও উন্নত কৃষি সরঞ্জাম ও বিদ্যুতায়িত সেচ পাম্প ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদনে উন্নতি ঘটিয়ে নিরন্ন দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলতে পেরেছিল। কিন্তু দেশের সরকার বিদ্যুৎ পর্ষদগুলিকে অপবাদ দিয়ে বলল, এরা ৫০ বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি পূঞ্জীভূত করেছে। তাই বিদ্যুৎ পর্ষদ তুলে দিয়ে বিদ্যুৎ কোম্পানী করার জন্য প্রণীত হল বিদ্যুৎ আইন, ২০০৩। ঐ আইনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসাবে বলা হল – বিদ্যুৎ ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ থেকে সরকারকে দূরে সরাতে এবং প্রাইভেট কোম্পানীকে সুযোগ করে দেবার উদ্দেশ্যেই এই আইন প্রণীত হচ্ছে। এই আইন প্রণীত হলে বেসরকারী কোম্পানী আসবে – প্রতিযোগিতার পরিবেশ এবং দক্ষতার বৃদ্ধির ফলে বিদ্যুৎ মাশুল কমে যাবে। গত দুই দশকে বিদ্যুতের গড় মাশুল ৫/৬ গুন বেড়েছে এবং বিদ্যুৎ কোম্পানীগুলির সামগ্রিক ক্ষতি এবং অনাদায়ী ঋণের যোগফল হয়েছে ১৫ লক্ষ কোটী টাকারও বেশী। এখানে বুঝতে হবে টাকার অঙ্কে লাভ/ক্ষতি এবং দেশের সামগ্রীক অর্থনীতির নিরীখে অগ্রসর হওয়া এক নয়। রাষ্ট্রায়ত্ত্ব বিদ্যুৎ কোম্পানী বিদ্যুতের ক্রয়, উৎপাদন, সংবহন ও বিতরণ করে এক কোটি টাকা ক্ষতি করল – কিন্তু দেশের মানুষের জন্য সুলভে খাদ্য সরবরাহ করে কৃষক সমাজ যে পুষ্টি দিয়ে মানব সম্পদ কে স্বাস্থ্য সবল নীরোগ করে সামাজিক কাজের সাথে দেশের অর্থনীতিকে সফলতার দিকে নিয়ে গেল, সামাজিক দৃষ্টিতে তার মূল্য কিন্তু অনেক গুন বেশী।
পুরনো আইনে বিদ্যুৎ ছিল আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যম। আর প্রস্তাবিত আইনে হবে বাজারী পণ্য। যার অর্থ - টাকা থাকলে পাবে, না থাকলে পাবে না। সকলের জন্য বিদ্যুৎ দেবার লক্ষ্যে বিদ্যুৎ মাশুল নির্দ্ধারণে একটি উপাদান আছে যার নাম ক্রস সাবসিডি বা পারস্পরিক ভর্তুকি। বেশী বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী গ্রাহক গড় ব্যয়ের একটু বেশী দেবে। সেই অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে কম বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী গরীব গ্রাহক এবং দেশের কৃষি উৎপাদনের জন্য কৃষি কাজে স্বল্প মূল্যে বিদ্যুৎ জোগানো হবে। প্রস্তাবিত আইনে এই প্রথা বাতিল হয়ে যাবে। কৃষি কাজেও বাজারের দামে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। কৃষি পণ্যের দাম বাড়বে – যার বোঝা পড়বে আবার সেই গরীব মানুষের উপরে।
প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ বিলে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা হবে। আমরা সকলেই জানি বিদ্যুৎ একটি পূঁজি নিবিড় শিল্প – অর্থাৎ এই শিল্পের পরিকাঠামো এবং কাঠামো গড়ে তুলতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। কিন্তু প্রস্তাবিত বিলে সংস্থান রাখা হয়েছে বিদ্যুৎ বিতরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কোন ব্যয় না করেই বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের দিকে লোলুপ আগ্রাসী দৃষ্টি নিবদ্ধ ব্যবসায়ীদের কাছে সম্পূর্ণ সরকারী ব্যয়ে গড়ে তোলা ব্যবস্থা ব্যবহারের জন্য দেওয়া হবে। কি পদ্ধতিতে এটা হবে?
বর্তমানে বিদ্যুৎ বিতরণ কাজের জন্য ভৌগলিক এলাকা ভিত্তিক লাইসেন্স নিতে হয়। যাকে বলা হয় লাইসেন্সড এরিয়া। এই ব্যবস্থা রদ হয়ে যাবে। নতুন ব্যবস্থায় লাইসেন্স থাকবে না। তাই একটি পৌরসভা / কর্পোরেশন এলাকা অথবা সমগ্র জেলাকে বলা হবে সাপ্লাই এরিয়া। একই সাপ্লাই এরিয়ার জন্য একাধিক কোম্পানী রেজিষ্ট্রেশনের আবেদন করতে পারবে ঐ রাজ্যের বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের কাছে। আবেদনের পরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কমিশন রেজিষ্ট্রেশন না করলে ধরে নেওয়া হবে রেজিষ্ট্রেশন হয়ে গেছে। এই প্রক্রিয়ায় রেজিষ্ট্রেশন করার পরে যে কোনও আগ্রহী গ্রাহককে ঐ কোম্পানী বিদ্যুৎ দিতে পারবে। সরকার ঢাক ঢোল পিটিয়ে বলছে বিদ্যুৎ গ্রাহকদেরও মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের মত কোম্পানী পছন্দ করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এই ব্যবস্থা ভারতের মুম্বাই শহরের একটি অংশে চালু আছে। সেই গ্রাহকদেরও অনেক অভিযোগ আছে। কিন্তু তার সুরাহা হচ্ছে না। প্রচারে আকাশ ফাটানো হচ্ছে। আরও যে কথাটি গোপন করা হচ্ছে তা হ’ল এই এলাকাগুলিতে বর্তমান মিটারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ হবে না। কয়েকশো টাকার মিটারের বদলে কয়েক হাজার টাকার স্মার্ট মিটার লাগাতে হবে। এই পাল্টানোর খরচ কে দেবে? বিদ্যুৎ কোম্পানী, গ্রাহক কেউ দেবে না। এই টাকা খরচ করবে সরকার। অর্থাৎ জনগণের টাকা খরচ হবে ব্যবসায়ীর মুনাফার স্বার্থে। আত্মনির্ভর ভারতের নামে ২২,৫০০ কোটি টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থ বর্ষে বাজেটে বিদ্যুৎ উন্নয়ন খাতে ৩.০৬ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে।
এবার আসা যাক সম্পূর্ণ জেলাকে এরিয়া অব সাপ্লাই ঘোষনা না করে পৌর নিগম / পৌরসভা আলাদা রাখা হ’ল কেন – এর কারণ পরিষ্কার। অলাভজনক গ্রামীণ এলাকায় এই মুনাফালোভী কোম্পানীগুলি যাবে না। তাদের পছন্দ শহর এবং শিল্প এলাকা যেখানে লাভ বেশি। এবার প্রশ্ন – তাহলে গ্রামের কি হবে? উত্তর হল বর্তমান সরকারী কোম্পানীকে গ্রামের দায়িত্ব নিতে হবে। বর্তমান সরকারী কোম্পানীকে পুরো লাইন / সাবষ্টেশন রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব পালন করতে হবে। সব গ্রাহককেই আগাম টাকা দিয়ে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। কৃষককেও ফসলের দাম কবে পাবে কত পাবে না জানা থাকলেও বিদ্যুতের সম্পূর্ণ দাম (কোনও ভর্তুকী ছাড়া) আগাম দিয়ে কিনতে হবে।
এর পরের প্রশ্ন আরও মারাত্মক। সেই বর্তমান সরকারী কোম্পানীই যদি পরিষেবার দায়িত্ব পালন করে তাহলে কোন জাদু মন্ত্রে পরিষেবা উন্নত হবে? উত্তর কে দেবে? প্রস্তুত থাকুন আরও কঠিন পরিস্থিতির জন্য। সব বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানীকেই সময় মত গৃহীত বিদ্যুতের টাকা মিটিয়ে দিতে হবে উৎপাদক / সংবহনকারী কোম্পানীকে। সরকারী বিতরণ কোম্পানী যার ঘাড়ে শুধুমাত্র গ্রামের দায়িত্ব দেওয়া হ’ল – তার গরীব গ্রাহকেরা টাকা দিতে পারল না – সেও টাকা দিতে না পারলে কি হবে? উত্তর সোজা। এখন যেমন সঠিক সময়ে আপনার ফোন রিচার্জ না হলে ফোন বোবা হয়ে যায়। তেমনি আপনার বাড়ী বা সেচ পাম্পেও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এরকম হাজার হাজার গ্রাহকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে কি অবস্থা হবে? এই প্রশ্নেরও খুব সহজ উত্তর আছে। ইংরেজীতে বললে বলতে হবে ডি-ইলেকট্রিফিকেশন। যার বাংলা হবে মোটামুটি অ-বিদ্যুতায়ন। বুঝতে অসুবিধা হলে উদাহরণ হিসাবে আবার যাই মোবাইল ফোনে। কোনও কোনও ফোনে কল করলে শুনতে পান – এই নম্বরটির পরিষেবা সাময়িকভাবে রদ করা হয়েছে। পরে চেষ্টা করুন। আর একটা উদাহরণ গ্যাস সিলিন্ডারে আছে। যারা অনেক কষ্টে একটা গ্যাস কানেকশন নিতে পেরেছিলেন – এখন তারা প্রায় এক হাজার টাকা দিয়ে সিলিন্ডার কিনতে পারছেন না। সাময়িক কাঠ / খড়কুটো সংগ্রহ করে একটা সিলিন্ডার তিন মাস চালানোর চেষ্টা করছেন।
২৭শে সেপ্টেম্বরের ধর্মঘটে আপনি যোগ দেবেন কিনা স্থির করার জন্য আপনাকে একটি তথ্য সরবরাহ করা যাক। এন.ডি.এ.-তৃণমূলের অনুগ্রহে প্রণীত বিদ্যুৎ আইন ২০০৩ এর ৬নং ধারায় বলা হয়েছিল গ্রামে বিদ্যুৎ দেবার দায় রাজ্য সরকারের – ঐ দায় কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাহ করবে না। আর ৬১(জি) ধারায় বলা হয়েছিল পারস্পরিক ভর্তুকী কমিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করা হবে। ২০০৪ সালে ভারতের ক্ষিপ্ত মানুষ লোকসভায় ৬১ জন বাম সাংসদ নির্বাচিত করলেন। তাদের সমর্থনে মনমোহন সিং এর সরকার নির্ভরশীল ছিলেন। বামপন্থীদের চাপে আইনের সংশোধন হয়েছিল। তার ফলেই রাজীব গান্ধী গ্রামীন বৈদ্যুতিকরণ যোজনা – গ্রামের গরীব মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ শুধু পৌছায়নি, এখনও বজায় আছে। আন্দোলন সংগ্রামের পথে আগুয়ান কৃষকদের দাবীর সাথে বিদ্যুৎ শ্রমিকেরাও ২৭শে সেপ্টেম্বর ধর্মঘটে সামিল হবেন। গ্রাম শহরের সমস্ত গরীব খেটে খাওয়া মানুষও সামিল হয়ে রচনা করবেন নতুন ইতিহাস।
শেয়ার করুন