World Socialist Forum (14th)

সংঘাত ও আশার দোটানা স্বত্বেও আস্থা আজও সমাজতন্ত্রেই

১৪-তম আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক ফোরামের কিছু অভিজ্ঞতা

চীনের সমাজবিজ্ঞান একাডেমি কর্তৃক আয়োজিত ১৪তম বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ফোরাম ৯ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হয়। দু-দিনের ফোরামে, ৩৭টি দেশের কমিউনিস্ট পার্টির তরফে প্রায় ৭০ জন প্রতিনিধি, বামপন্থী সমাজকর্মী, বিশেষজ্ঞ এবং গবেষকরা অংশগ্রহণ করেন। এই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে চীনা রেড কালচার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহ-সভাপতি হু চেং একটি সাক্ষাৎকার দেন। সেই কথোপকথনই প্রকাশিত হল।

বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সাথে আলাপচারিতায় হু চেং

প্রশ্ন-

বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত ১৪তম বিশ্ব সমাজতন্ত্র ফোরামের অভিজ্ঞতা কেমন, এই অধিবেশনের মূল আলোয় বিষয়গুলি কি ছিলো? বিশেষত ছয়টি মহাদেশ থেকে অংশগ্রহণকারী কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী ও নেতৃত্বর মধ্যে বিভিন্ন কন্ঠস্বর সম্পর্কে আপনার মতামত কী?

হু চেং:

বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ফোরাম আয়োজনের জন্য আমি আনন্দিত এবং আশান্বিত।

আপনার ‘ছয় মহাদেশের বিভিন্ন কণ্ঠস্বর’ সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমি এই ফোরামের ‘সাধারণ বক্তব্য’টি সম্পর্কে আলোচনা করতে চাইব।

কমরেড লেনিন, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের পথপ্রদর্শক, বলেছিলেন: ‘একজন সচেতন শ্রমিক, সে কোন দেশ থেকে এসেছে, ভাগ্যের কোন ফেরে সে এসে উপস্থিত হয়েছে, কিভাবে অপরিচিত মানুষের মাঝে সে মানিয়ে নিচ্ছে, ভাষার বাঁধা পেরিয়ে, আত্মীয়-পরিজন থেকে দূরে, দেশের মাটি থেকে দূরে, তা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার না। চিরপরিচিত সুর ‘ইন্টারন্যাশনাল গান’টি শুনলেইই সে নিজের স্বজন ও সংগ্রামসঙ্গীদের খুঁজে পায়, খুঁজে পায় প্রাণের আত্মীয়কে। মানব সভ্যতার অগ্রগতির যে মহান দায়িত্ব তাঁর কাঁধে, সমাজতন্ত্রের যে অপূর্ব স্বপ্ন তার চোখে, যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল্যবোধ সে তার ধমনীতে বহন করে, তার মধ্যেই জেগে থাকে তারই মধ্যে নিহীত সমাজতন্ত্রে ব্রতী সমস্ত মানুষের ‘সাধারণ কণ্ঠস্বর’ যা এক সুরে বেঁধেছে এই বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ফোরামকে।

আজকের সমাজ পরিচালনা করে ধনতন্ত্রের লোভ, সেখানে পুঁজিই রাজা, এমন সময়ে সমাজতন্ত্রে ব্রতী মানুষের এমন ‘সাধারণ কণ্ঠস্বর’ খুবই প্রয়োজনীয়। দুর্ভাগ্যবশত, চীনের সমাজতান্ত্রিক ফোরামের প্রভাব শুধুমাত্র একাডেমিক মহলে সীমাবদ্ধ, তা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে যথেষ্ঠভাবে প্রভাবিত করে উঠতে পারে না। মার্কসবাদ এবং সমাজতন্ত্রের ন্যায় যেকোন প্রগতিশীল চিন্তাধারাই যদি কেবল একাডেমিক গবেষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে তবে তা বিশেষ কার্যকরী হয়ে উঠতে পারে না। যতক্ষণ না সেই চিন্তাধারা গণমানুষের হাতের তীক্ষ্ণ অস্ত্র হয়ে ওঠে! সেক্ষেত্রে এধরণের চর্চা বড়ো জোর কিছু মানুষের ‘রাজনৈতিক কৃতিত্ব,’ এবং গবষণার কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে রয়ে যায়।

আপনার প্রশ্নের ‘ছয় মহাদেশের বিভিন্ন কণ্ঠস্বর’ প্রসঙ্গে বলি, আমি মনে করি এটি কমিউনিস্ট, সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শীয়দেরই বিভিন্ন কণ্ঠস্বর, যা কিনা আমাদের সঙ্গীতকে আরও সমৃদ্ধ, সঙ্গতিপূর্ণ এবং সুরেলা করে তোলে।

প্রশ্ন-

ফোরামের মূল আলোচ্য বিষয়গুলি সম্পর্কে যদি আলকপাত করেন। এবং এই আলোচনা বাস্তবে, বিশেষত আজকের পরিবর্তনশীল বিশ্বের মেরুকরণের রাজনীতিত, যুদ্ধ, একচেটিয়া পুঁজিবাদ, বাণিজ্যের আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদির প্রেক্ষাপটে কতটা প্রাসঙ্গিক?

হু চেং:

অধিবশনের বিভিন্ন বক্তব্য এবং আলোচনা শোনার পর, বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের নানা লেখাপত্র যা তাঁরা আমাদের হাতে দিয়েছেন সেসব পড়ে আমার মনে হয়েছে এই সভার কেন্দ্রীয় বিষয়গুলি ‘ক্যাপিটাল’-এর পর্যালোচনা করার সময় ফ্রেডরিক এঙ্গেলস যে কথাগুলি লিখেছিলেন সেসবই যেন ফিরে ফিরে আসছে। তিনি বলেছিলেন: ‘পৃথিবীর ইতিহাসে পুঁজিপতি শ্রেনী এবং ও শ্রমিক শ্রেনীর উদ্ভবের সময় থেকেই, অন্য কোনও বই-ই শ্রমিকদের জন্য এই বইটিরর মতো এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। পুঁজির এবং শ্রমের সম্পর্ক হল আধুনিক সামাজিক ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু।’ আমি বিশ্বাস করি, পুঁজির এবং শ্রমের সম্পর্ক আজও আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বসমূহের কেন্দ্রবিন্দু।

চীনা দার্শনিক লাও জু একবার বলেছিলেন, ‘অল্পেই অনেকটার স্বাদ পাওয়া যায়, অনেকটার লোভ বিভ্রান্ত করে।’ এঙ্গেলসের কথামত, আমরা যদি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এই কেন্দ্রবিন্দুটির সারসংক্ষেপ স্পষ্টভাবে উপলব্ধী করতে পারি, তাহলেই এই আন্তর্জাতিক ফোরামের প্রকৃত সার্থকতা আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করা যায়। পুঁজি ও শ্রমের অক্ষের কেন্দ্রবিন্দুতে বসবাসকারী সাম্রাজ্যবাদ এবং পুঁজিবাদের যুগেও সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ নিয়ে অব্যাহত আলোচনাতেই ফোরামের সবচেয়ে বড় বাস্তব তাৎপর্য নিহীত। এতেই প্রমাণিত হয় যে পুঁজিপতি এবং ক্ষমতাসীনরা যতই ধন-সম্পত্তি ও ক্ষমতা দখল করে বসে থাকুক না কেন, শ্রমিকদের চিৎকারকে তারা কখনো দমাতে পারবে না! যদিও এমন চিৎকার পাঁচ তারা কোনও হোটেলে সাযুয্যহীন এবং অক্ষম মনে হতে পারে। আমরা, চীনের কমিউনিস্টরা, পৃথিবীর দলিত নীপিড়িত শ্রমিকদের কণ্ঠস্বর আরও বেশি করে শুনতে চাই।

প্রশ্ন-

এই আন্তর্জাতিক অধিবেশনে হওয়া আদানপ্রদাণ ও মতামত বিনিময় বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্র নির্মাণে কী প্রভাব ফেলবে?

হু চেং:

যদিও আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এখনও অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে, একটা বড় অংশই সংশোধনবাদে আক্রান্ত হয়ে রয়েছে তবুও, এই ১৪তম অধিবেশনের মতামত বিনিময় কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসীদের জন্য একটি মঞ্চকে তুলে ধরেছে যাতে তারা তাদের বেছে নেওয়া পথের ঠিক-ভুল যাচাই করে সত্যের অনুসন্ধান করতে পারে। এর প্রভাব এখনো অবশ্যই সীমিত, তবু এর মধ্যে দিয়ে অনেক মানুষকে আদর্শগত ভীত খুঁজতে সহায়তা দেওয়ার কাজকে এগোনো যায়। কিন্তু যদি এই প্রতিশ্রুতি বাস্তব সংগ্রামে পরিণত না হয়, তবে তা কেবল কল্পনাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

প্রশ্ন-

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে গ্লোবাল সাউথ অর্থাৎ বিশ্বর দক্ষিণপ্রান্তের নিপীড়িত দেশগুলির উত্থান, পুঁজিবাদের ক্ষয় এবং সাম্রাজ্যবাদী-ফ্যাসিস্ট আক্রমণের প্রেক্ষাপটে চীনের ভূমিকা আপনি কিভাবে দেখছেন? এই অধিবেশনে তা কিভাবে এটি প্রতিফলিত হয়ছে?

হু চেং:

চীনের ‘ভূমিকা’ এবং কাজ নিয়ে আলোচনা না করে বরং আমি প্রথমেই বলতে চাই যে, অংশগ্রহণকারী বিশ্বের বিভিন্ন কমিউনিস্টরা আসলে এই অধিবেশণে চীনা কমিউনিস্টদের আশা এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে এসেছেন। অধিবেশন চলাকালীন আমি দেশ-বিদশের বহু কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মীর সাথে মতামত বিনিময় করেছি। পুঁজিবাদী এই সমাজে তাঁদের অধ্যবসায়ের সঙ্গে লড়ে যাওয়ার উদাহরণ আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত এবং উৎসাহিত করেছে।

আপনি জানেন, চীনা বিপ্লবের সাফল্য কমরেড লেনিনের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক দ্বারা শুরু ও পরিচালিত হয়েছিল। চীনা বিপ্লবে বিদেশি কমিউনিস্টদের সাহায্য আমরা ভুলব না। একইভাবে, আজ এই অধিবেশনে আন্তর্জাতিকতাবাদী কমিউনিস্ট যাঁরা এসেছেন, অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই চীনা সমাজতন্ত্রের কাজে ব্রতী কমরেডদের ‘ভূমিকায়’ অনেকটা অবদান রেখে গেলেন। চীনের কমরেডরা আজও চীনে কমিউনিজমের পুনর্জাগরণের প্রচেষ্টায় লড়ে চলেছে এমনই আন্তর্জাতিকতাবাদী কমিউনিস্টদের উৎসাহ ও উদ্দীপনার উপর ভরসা রেখেই। আপনারা যে সাহস ও শক্তির সঞ্চার ঘটিয়েছেন তার জন্য আমরা চিরকৃতজ্ঞ।

শেষে আরও একটি কথা আমি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বলতে চাই, ফোরামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় ৯ সেপ্টেম্বর, চীনের জননেতা ও পথপ্রদর্শক মাও সেতুংয়ের মৃত্যুদিনে। এই অনুষ্ঠান ছিলো তাঁর স্মৃতির প্রতি চীনা কমিউনিস্টদের শ্রদ্ধাঞ্জলী। কমরেড ব্র্যান্ড-এর তরফে উল্লিখিত বক্তব্য ধার করেই আমার আলোচনা শেষ করতে চাইব। ব্র্যান্ড মার্কস এবং এঙ্গেলসের দিক-নির্দেশনায় প্রতিষ্ঠিত জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির চেয়ারম্যান ছিলেন, মাও সেতুংয়ের মৃত্যুদিনে স্মরণিকা হিসাবে তিনি বলেন- ‘মাও সে তুংয়ের মৃত্যু তাঁর দ্বারা চরিত্রায়িত একটি যুগের অবসান ঘটায়। কিছু মানুষের জন্য তিনিই আশা, এবং অন্যদের জন্য তিনি একটি আদর্শগত এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। এই দুই পরিস্থিতিই অব্যাহত থাকবে।’

আমরা, আশা এবং সংঘাত উভয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়েই আমাদের প্রত্যয় ও রাজনৈতিক নৈতিকতাকে বজায়  রেখে এগোব। আন্তর্জাতিকতাবাদী কমিউনিস্টদের অনুপ্রাণিত করার চেষ্টাও অব্যাহত থাকবে।

সাক্ষাতকার ও ভাষান্তরঃ শ্রেয়সী চৌধুরী
ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া সুত্রে প্রাপ্ত

শেয়ার করুন

উত্তর দিন