কুৎসার আড়ালে প্রকৃত সত্য মরিচঝাঁপি - ৩

১৪ জানুয়ারি ২০২০১ , বৃহস্পতিবার

মরিচঝাঁপি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে বাঘেদের রক্ষা করতে গিয়ে নাকি গরীব মানুষের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। এ কথা ঠিক যে সংরক্ষিত বনাঞ্চল রক্ষা করাটা সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আর সে কাজ করে বামফ্রন্ট সরকার কোন অন্যায় করেনি। তাছাড়া বিপজ্জনক পরিবেশে মানুষকে বসবাস করতে দেখলে তাকে নিরস্ত করা ও বিকল্প পথ দেখানো দায়িত্বশীল সরকারের কাজ যা বামফ্রন্ট সরকার করেছিল। মরিচঝাঁপি এক দিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল,অন্যদিকে মানুষের বসবাসের জন্য অনুপযুক্ত ছিল। কিন্তু সমস্ত যুক্তি ও অনুরোধ কে অগ্রাহ্য করে,জেনেশুনে মানুষখেকো বাঘের মুখে বাস্তুহারাদের ফেলে দেওয়ার যে অপরাধ করেছিলেন বাস্তুহারা উন্নয়ন সমিতির নেতারা তা অমার্জনীয়।

মরিচঝাঁপিতে উদ্বাস্তু কলোনী তৈরীর ইতিহাসের দিকে একটু নজর দিলে দেখা যাবে যে উদ্বাস্তু উন্নয়নশীল সমিতির নেতারা সরকারি জমি একর পিছু ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি করে দেন। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জমি এভাবে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করার অধিকার এই নেতাদের কে দিয়েছিল?সরকারের নিষেধ সত্ত্বেও তারা জমি বিলি, গাছ কাটা ও চোরচালানের কাজ চালিয়ে গেছেন। তাই মাঝে মধ্যেই পুলিশ কাঠ বোঝাই নৌকা আটক করতে গেলে উদ্বাস্তুদের সাথে পুলিশের সঙ্ঘাত বাধে। একেই পুলিশি নির্যাতন বলে সমালোচনা করেছে বামবিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও তাদের বশংবদ কলমচিরা।



মরিচঝাঁপিতে প্রকৃতির সাথে উদ্বাস্তুদের অসম লড়াই চলছিল। অসুখ,অনাহার,মৃত্যু ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। অথচ কলকাতার বিভিন্ন লেখক ও বাজারি পত্রিকার সাংবাদিকরা নানাভাবে প্রমাণ করবার চেষ্টা করছিলেন যে মরিচঝাঁপিতে আগন্তুকরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছিলেন এবং অভিযোগ করছিলেন যে সরকার এই স্বাবলম্বনকে স্বীকৃতি না দিয়ে অন্যায় করছে। এই সমস্ত দাবি ছিল অসত্য ও অতিরঞ্জিত। ধান উৎপাদন বা অন্য কোন ফসল চাষ সেখানকার লোনা জমিতে সম্ভব ছিলনা। নিকটবর্তী দ্বীপে দিনমজুরি, জঙ্গলের কাঠ ও নদীর মাছ বিক্রি, চোরাচালানি ছিল জীবনযাপনের একমাত্র উপায়। অথচ শুধু সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তু উপনিবেশের রোমান্টিক ছবি তুলে ধরা হয়েছিল স্বাবলম্বনের নিদর্শন হিসেবে।

মরিচঝাঁপির বিরুদ্ধে কোনো অর্থনৈতিক অবরোধের প্রমাণ দেওয়া না গেলেও এ নিয়ে বিস্তর রটনা হয়েছে। তৎকালীন রাজ্য সরকার চোরাচালানের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল এবং কুমিরমারিতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। কিন্তু তাকে অর্থনৈতিক অবরোধ বলা নিকৃষ্ট মানের রাজনীতি ছাড়া কিছুই নয়। মরিচঝাঁপিতে ক্ষুধা-দারিদ্র্য,অনাহার, অপুষ্টির ব্যাপক প্রকোপ ছিল এবং তার জন্য যে মৃত্যু পর্যন্ত হত তা নিয়ে কোন সন্দেহ  নেই। কিন্তু এই মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? দায়ী কি তারা নন যারা দরিদ্র মানুষদের ভুল বুঝিয়ে মরিচঝাঁপির মত বিপদসঙ্কুল দ্বীপে নিয়ে এসেছিলেন এবং পরবর্তীকালে দ্বীপে থাকতে অনিচ্ছুকদের এই এলাকা ত্যাগ করতে দেননি?    



মরিচঝাঁপিতে পুলিশী সন্ত্রাস নিয়ে নানা কল্প কাহিনী আছে।আসলে ৩১জানুয়ারি,১৯৭৯ মরিচঝাঁপি থেকে ছ'কিলোমিটার দূরে কুমিরমারীতে পুলিশ ক্যাম্পের উপরে সশস্ত্র আক্রমণ হয়।এই হামলায় দশজন পুলিশ আহত হন। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে তীর-ধনুক ধারী উদ্বাস্তু ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করবার চেষ্টা করে। কোণঠাসা অবস্থায় পুলিশ গুলি চালালে দুজন নিহত হন যাদের মধ্যে একজন আদিবাসী মহিলা। উল্লেখ্য, এই ঘটনার দু'দিন আগেই পুলিশ বেআইনি কাঠবোঝাই তিনটে নৌকো  আটকালে আরোহীরা তাদের আক্রমণ করে। চোরাচালানের কাজকে স্বনির্ভরতা বলে চালানো দক্ষিণপন্থী শক্তি এই প্রশাসনিক পদক্ষেপগুলিকে পুলিশী  সন্ত্রাস বলে ব্যাপক অপপ্রচার করেছিল।

মরিচঝাঁপিতে কতজন মারা গিয়েছিলেন এই নিয়ে যথেচ্ছ রটনা হয়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী দু'জন পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন মনো মুণ্ডা নামে স্থানীয় একজন আদিবাসী রমণী। ঘটনার কয়েক দিন পর আনন্দবাজারে মৃতের সংখ্যা লেখা হয় ৬। নব্বইয়ের দশকের শেষ থেকে কুৎসা ছড়ানোর উদ্দেশ্যে এই সংখ্যাকে বাড়িয়ে কেউ লিখেছেন কয়েক শত, কেউ লিখেছেন কয়েক হাজার। কিন্তু এদের সকলের মধ্যে অদ্ভুত মিল যে কেউই কোনরকম তথ্যসূত্র দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি।বিধানসভায় সরকারীভাবে ঘোষিত মৃতের সংখ্যাকে বিরোধীরা চ্যালেঞ্জ করলে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু তাদের মৃতের নামের তালিকা দিতে বলেছিলেন।  সে তালিকা তারা আদৌ দিতে পারেননি।

মরিচঝাঁপিতে মৃতের সংখ্যা গোনার আরেকটি পদ্ধতিও এখন প্রচলিত। কোনরকম তথ্য-প্রমাণের মধ্যে না গিয়ে দণ্ডকারণ্য থেকে যতজন পশ্চিমবঙ্গের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন আর যতজন দণ্ডকারণ্য ফিরে গিয়েছিলেন এই দুই সংখ্যার বিয়োগফল যা হয় তাকেই কিছু কিছু তথাকথিত গবেষক মৃত ব্যক্তির সংখ্যা বলে চালিয়ে দিয়েছেন। দণ্ডকারণ্যে ফিরে না যাওয়া ব্যক্তিরা অনেকেই যে পশ্চিমবঙ্গের  জনসমুদ্রে মিশে গিয়েছেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এমন হিসেবনিকেশ এখনও চলছে!

মরিচঝাঁপির ঘটনার এক বছর পরেই কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হয় ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন সরকার।সমালোচকদের বক্তব্যের যদি সারবত্তা থাকতো তাহলে কি তৎকালীন বিরোধী দল কংগ্রেস কেন্দ্রীয় সরকারকে কাজে লাগিয়ে বামফ্রন্টকে রাজনৈতিক ভাবে কোণঠাসা করতনা? আজও কোন নির্ভরযোগ্য,বস্তুনিষ্ঠ তথ্য বামবিরোধীদের কাছে নেই। এখন বামবিরোধীদের নতুন অস্ত্র তথাকথিত ‘প্রত্যক্ষদর্শী’দের সাক্ষাৎকার।এত বছর এনারা কোথায় ছিলেন?মরিচঝাঁপিতে মানুষের আগমন তো সুদূর অতীতের কোন ঘটনা নয়।এতকাল তারা নীরব ছিলেন কেন আর এখন তারা তথ্য,প্রমাণ ছাড়া যা বলছেন তাকে কোন যুক্তিতে সত্য বলে মেনে নেওয়া হবে? তবে যে মালকানগিরি থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ পশ্চিমবঙ্গের দিকে পাড়ি দিয়েছিলেন সেখানে জ্যোতি বসুর মৃত্যুর পর আয়োজিত শোকসভায় স্থানীয় উদ্বাস্তু নেতা অরবিন্দ ঢালি বলেন যে তাদের ভুল হয়েছিল(দৈনিক স্টেটসম্যান, ১৯/০১/২০১০)।  



মরিচঝাঁপি পর্ব নিঃসন্দেহে বেদনাদায়ক, অনভিপ্রেত। ঘটনাপরম্পরা প্রমাণ করে যে এই দুঃখজনক পর্বের দায়ভার সদ্য ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট সরকারের নয়। রাজ্যের দক্ষিনপন্থী শক্তিগুলি কেবল রাজনৈতিক ফয়দা তোলার জন্য এই সঙ্কট সৃষ্টি করেছিল।

::::::::::::::: মরিচঝাঁপি সংক্রান্ত আর একটি বিশেষ পর্ব আগামী কয়েকদিনের মধ্যে প্রকাশিত হবে, কাজ চলছে.....

আগামীকালের পর্ব ........চলবে...


শেয়ার করুন

উত্তর দিন