প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে পিছু হটছে তৃণমূল। বুধবার বিকালে প্রতিরোধের মুখে পড়ে পুলিশের লঞ্চে চেপে পালাতে হয়েছে তৃণমূলের বহিরাগত দুষ্কৃতীদের। বুধবারের পড়ে ফের বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সন্দেশখালি সাক্ষী থাকলো- এক অনির্বান প্রতিরোধের। সাহস করে ঘুরে দাঁড়ালে পিছু হটে দুষ্কৃতীরা, আরো একবার প্রমান করলো লোনা জলের মাটি।
সন্দেশখালি থানার দাড়িরজঙ্গল মৌজার পেত্নি ঘোলা ও কর্ণখালির গরিব আদিবাসী ও অন্যান্য অংশের মানুষ তাদের জমি ফেরতের দাবিতে আন্দোলন চালাচ্ছেন। গত ৩১ জানুয়ারি ও ৫ ফেব্রুয়ারি রাস্তায় নামেন আন্দোলনকারীরা, চলে অবস্থান বিক্ষোভও। তাঁরা দুদফায় থানা এবং বিডিও অফিসের দ্বারস্থ হন। ৫ফেব্রুয়ারি থানা অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে। শেষে বিডিও অভিযোগ জমা নেন। তাদের অভিযোগ বিগত ৩-৪বছর ধরে জমি লিজের টাকা মিলছে না। শয়ে শয়ে বিঘার পর বিঘা জমিতে শেখ শাহজাহান, শিবপ্রসাদ হাজরা ও উত্তম সর্দাররা মাছচাষ করে আসছে। তাঁরা সরকারি খাল ব্যবহার করতে পারেন না। গ্রামবাসীদের অভিযোগ তৃণমূল কংগ্রেসের সন্দেশখালি -১নং ব্লক সভাপতি ফেরার বাহুবলী শেখ শাহজাহান, তৃণমূল কংগ্রেসে সন্দেশখালি -২ব্লকের সভাপতি জেলা পরিষদ সদস্য শিবুপ্রসাদ হাজরা ও অপর জেলা পরিষদ সদস্য সুশান্ত সর্দার ওরফে উত্তম সরদার, লালটু ঘোষের বিরুদ্ধে। তাঁদের দাবি জমি ফেরত দিতে হবে। পুলিশ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগও আন্দোলনকারীরা প্রথম থেকেই তুলছেন। শাহজাহানের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামার জন্য শাসক দলের হুমকির মুখেও পড়তে হতো।
বিদ্রোহের এমন তীব্র চেহারা সেই সন্দেশখালিতে নজিরবিহীন। পুলিশ প্রশাসনের উপর কোন ভরসা নেই সন্দেশখালির মানুষের। ইডি’র জারি করা লুক আউট নোটিশের পরেও অধরা শেখ শাহজাহান। পুলিশও হাত গুটিয়ে। গ্রামের কংক্রিটের রাস্তা কেটে, রায়তি জমি দখল করে ভেড়ির কারবারের বিরুদ্ধে বারেবারে বলা সত্ত্বেও পুলিশ ছিল নিশ্চুপ। শুধু জমি নয় খাবার জলের পাইপ কেটে দিয়ে ভেড়িতে দেওয়া হয়েছে। প্রতিবাদ করতে গেলে পুলিশ তৃণমূল নেতাদের কাছে পাঠিয়ে দিত গ্রামবাসীদের। আর শাহজাহানের বাহিনী গ্রামবাসীদের তৃণমূলের অফিসে ঢুকিয়ে কোদালের বাট দিয়ে পেটাতো। প্রকাশ্যেই এই অভিযোগ তুলেছেন রাস্তায় নেমে মিছিলে শামিল হওয়া গৃহবধূরা।তাঁদের কথায়, বাড়ির ছেলেদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র, মদের বোতল তুলে পাশের গ্রামের মানুষের হামলা চালাতে বাধ্য করা হত। না করা হলে তাঁদের বাবা-মায়ের ওপর অত্যাচার করা হত। মহিলাদের হুমকি দেওয়া হত রাতে বাড়িতে লোক ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। মধ্যযুগীয় অত্যাচার চালিয়েছে শাহজাহানের বাহিনী।
মঙ্গলবার থসন্দেশখালি থানার অদূরে ত্রিমোহনীতে সভা করে তৃণমূল। সভা শেষে সন্দেশখালি- ২নং বিডিও অফিস সংলগ্ন তৃণমূলের পার্টি অফিসে বসে নীল নকশা তৈরি করা হয় বুধবার মিছিল করে পেত্নীঘোলা,কর্ণখালির আন্দোলনকারীদের উপর হামলা চালানো হবে।
এই খবর গ্রামে গ্রামে রটে যেতেই ছড়িয়ে পড়ে প্রতিরোধের বার্তা। বুধবার দুপুরে বিশেষত মহিলারা নেমে পড়ে রাস্তায়। ওদিকে তখন তুষখালী, জেলিয়াখালি, দাউদপুর, খুলনা, হাটগাছা থেকে সশস্ত্র দুষ্কৃতিরা মিছিলে যোগ দিতে সন্দেশখালি ফেরিঘাটে এলে গ্রামবাসীদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। হামলা চালাতে পারে তা আঁচ করে পালটা দুষ্কৃতীদের তাড়া করতেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, ধুন্ধুমার কান্ড বেঁধে যায়। দুষ্কৃতীদের ছোড়া কাঁচের বোতলে কয়েককজন আহত হন।পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।এরপর মারমুখী পুলিশের লাঠিচার্জে মাথা ফাটে আরেক সাধারণ এক গ্রামবাসী কৃষ্ণপ্রসাদ লাইয়ার। তাঁকে খুলনা হাসপাতালে নিয়ো যাওয়া হয়। এরপর সন্দেশখালি থানা ঘেরাও করে শুরু হয় বিক্ষোভ। আন্দোলনকারীদের দাবি শেখ শাহজাহান, শিবু হাজরা, উত্তম সর্দার, লাল্টু ঘোষকে গ্রেফতার করতে হবে। ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠিচার্জ করলে করলে আরো এক গ্রামবাসী আহত হন। তার মাথা ফেটে যায়।
আন্দোলনকারীরা জানায় বুধবার রাতেই তারা ধরে ফেলে উত্তম সর্দারকে। আন্দোলনকারীদের হাত থেকে উত্তম সর্দারকে পুলিশ ছিনিয়ে নিয়ে যায়। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারীদের বলা হয় উত্তম সর্দারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার তারা জানতে পারে আন্দোলনকারীরা চলে যাওয়ার পর উত্তমকে ছেড়ে দেয়। এই উত্তমই এরপর বহিরগতদৃতর বাড়িতে,পোল্ট্রিতে ভাঙচুর চালায় এবং মেছো ঘেরির আলাঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। যার দায় চাপানোর চেষ্টা করে আন্দোলনকারীদের ওপর। অন্যদিকে শিবু হাজরা বেপাত্তা। অথচ পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে শিবু হাজরা ১১৭জন গ্রামবাসীর নামে এফআইআর করেছে। যার মধ্যে জামিন অযোগ্যো ৩০৭ধারা দেওয়া হয়েছে। আন্দোলনকারীদের বক্তব্য আমরা হকের দাবিতে আন্দোলন করছি, কেন ভাঙচুর করবো? জনগনের ক্ষোভ থেকে বাঁচাতে আসলে পুলিশই উত্তম সর্দারকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে দেয়।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে কাছারি পাড়া, কর্নখালি, পেত্নীঘোলা,পাত্র পাড়া, কলোনি পাড়ার আন্দোলনকারীরা। লাঠি, ঝাঁটা গাছের ডাল যে যা হাতের সামনে পেয়েছে তাই নিয়ে মহিলা পুরুষ এসে জমা হয় সন্দেশখালি থানা লাগোয়া এলাকায়। থানার ওসির চোখে চোখ রেখে আন্দোলনকারী মহিলারা আঙ্গুল উঁচিয়ে স্পষ্ট জানিয়ে দেন যতক্ষণনা শেখ শাহজাহান, শিবু হাজরা, উত্তম সর্দার ও লাল্টু ঘোষকে গ্রেফতার করা হচ্ছে ততক্ষণ আমরা কেউ বাড়ি যাব না। আমরা শান্তি চাই। শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক সব দিক দিয়ে মার খেতে খেতে আমাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে আন্দোলনকারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকার ফলে শেষমেশ ঘটনাস্থলে আসেন ডিআইজি সুজিত কুমার, এসপি হোসেন মেহেদী রহমান, অ্যাডিশনাল এসপি পার্থ ঘোষ সহ বিশাল পুলিশ বাহিনী। পুলিশের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা ঘটনাস্থলে আসতেই আন্দোলনের ঝাঁঝ আরও বেড়ে যায়। তাঁরা স্লোগান দিতে থাকে শেখ শাহজাহান শিবু হাজরা উত্তম সর্দার লাল্টু ঘোষকে গ্রেফতার করতে হবে। লিখিত অভিযোগ করা হয় আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে। তাঁরা অনশন অবস্থানে পড়েন।
রাত পর্যন্ত থানার সামনে হাজার হাজার মহিলা, পুরুষ। দাবি একটাই- ফেরার বাহুবলী শাহজাহান শেখ, তার ঘনিষ্ঠ উত্তম সর্দার, শিবু হাজরার মত লুটেরা তৃণমূল নেতাদের গ্রেপ্তার করতে হবে।এই সম্মিলিত ক্ষোভের স্রোতকে সকাল থেকেই ঠেকাতে ব্যর্থ। আন্দোলন ভাঙতে ফেরার সেই তৃণমূলী নেতা উত্তর সর্দারের অভিযোগের ভিত্তিতে ১১১জন গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। এফআইআর তালিকায় প্রথমেই রয়েছেন সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির সদস্য নিরাপদ সর্দার। পাঁচজন সিপিআই(এম) কর্মী, সংগঠকের বিরুদ্ধে মিথ্যা এফআইআর।ইতিমধ্যে আন্দোলনকারী প্রায় পাঁচ থেকে আটজন মহিলার পরিবারের সদস্যদের আটক, গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।