কলকাতায় আরপিডি -শান্তনু দে

১৯ জুন ২০২২ (রবিবার)

সেদিন শেষবিকেলে আকাশ কালো করে উঠেছিল তুমুল ঝড়। সেদিন ছিল মে-দিন। ১৯৪৬।

কলকাতার এক শ্রমিক সমাবেশে ব্রিটেন থেকে এসেছেন একজন কমরেড। বেশ লম্বা, কিন্তু রঙ বাদামি। দেখতে অনেকটা উত্তর ভারতের মানুষদের মতো। চশমার ভারী লেন্সের আড়ালে উজ্জ্বল চোখ। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক শক্তির বিজয়ের পর ভারতের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে শ্রমিকশ্রেণির নির্ণায়ক ভূমিকা নেওয়ার কথা মনে করাতে এসেছেন তিনি। নিয়ে এসেছেন আন্তর্জাতিক সংহতির বার্তা।

সে এক অগ্নিগর্ভ সময়। নৌ-বিদ্রোহের পর উত্তাল দেশ। পরিস্থিতি সামল দিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি পাঠিয়েছেন ক্যাবিনেট মিশন। আর তা কভার করতেই তাঁর ভারত সফর। গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ডেইলি ওয়ার্কার পত্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে। ১৯২১ থেকে এই প্রথম, তাঁকে ভারতে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

তিনি রজনী পাম দত্ত। ব্রিটিশ ও ভারতীয় কমিউনিস্টদের কাছে ‘আরপিডি’ নামে পরিচিত।

কলকাতায় রজনী পাম দত্ত। বলা হয়েছিল বাছাই করা দু-তিনশ জন ইংরেজি-বুঝতে পারা কমিউনিস্ট ও দরদী সভায় থাকবেন। শেষে দেখা যায় তা আট হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে (সৌজন্যে: ‘ভারতে আর পাম দও’, সিপিজিবি’র লন্ডন জেলা কমিটি থেকে প্রকাশিত পুস্তিকা)

সেদিন এআইটিইউসি’র ডাকা শ্রমিক সমাবেশ থেকে তাঁর যাওয়ার কথা শহরতলির শিল্পাঞ্চলে। সন্ধ্যায় সেখানে মে দিনের সভা ডেকেছে ভারতের অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি। তিনিই মুখ্য বক্তা। এদিকে তাড়া করছে প্রবল ঝড়-বৃষ্টি। দুর্যোগে আর ভালো করে সভার কাজ হয়ে ওঠেনি। দও-সহ সবাইকে ফিরতে হয় ভিজে একসা হয়ে। সবাই উদ্বিগ্ন তাঁর শরীর নিয়ে। অথচ, পরদিন সকালে উঠেই তাঁর অনুরোধ তিনি যেতে চান সেইসব শ্রমিকদের কাছে। এবং যানও। কাঠফাটা রোদে তিনটি কারখানায় গেট মিটিং করেন। তাপমাত্রা যখন ৪৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। লিখছেন দিলীপ বোস (রজনী পাম দত্ত— ভারতীয় জনগণের মহান সন্তান, লেবার মন্থলি, মার্চ ১৯৭৫)।

কলকাতায় তাঁকে স্বাগত জানাতে কমিউনিস্ট পার্টির ডাকে একটি সভা হয়। বলা হয়েছিল বাছাই করা দু-তিনশ জন ইংরেজি-বুঝতে পারা কমিউনিস্ট ও দরদী তাতে থাকবেন। শেষে দেখা যায় তা আট হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে (‘ভারতে আর পাম দও’, সিপিজিবি’র লন্ডন জেলা কমিটি থেকে প্রকাশিত পুস্তিকা)।

এই কলকাতাতেই রজনী পামের বাবা উপেন্দ্র কৃষ্ণ দত্তের জন্ম। রামবাগানে দত্ত পরিবারে। তুতো দাদু সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ রমেশ চন্দ্র দত্ত, যিনি প্রথম ঋগ্বেদ অনুবাদ করেছিলেন বাংলায়, আবার লিখেছিলেন ‘ইকনমিক হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’। উপেন্দ্র কৃষ্ণ ডাক্তারি পড়তে যান ইংল্যান্ডে। পরে সেখানেই থেকে যান। ‘পাম’ ছিল তাঁর সুইডিশ স্ত্রীর পারিবারিক পদবী। ছেলের জন্ম রাতে বলে পরিবারের অনুরোধে নাম রেখেছিলেন রজনী। উপেন্দ্র কৃষ্ণ ছিলেন কেম্ব্রিজে গরিবের ডাক্তার। ‘ছ-পেনির ডাক্তার’ নামে পরিচিত। যাঁর বাড়ি ছিল ইংল্যান্ডে সফররত ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতাদের আশ্রয়।

পি সি যোশীর সঙ্গে রজনী পাম দত্ত। ১৯৪৬, ভারত সফরের সময়।

রজনী পামের জন্ম (১৯ জুন, ১৮৯৬), বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া সবকিছু ইংল্যান্ডে হলেও, ভারতের প্রতি, দেশের জনগণের প্রতি ভালোবাসা আসলে তাঁর বাবার সূত্রে। তাঁর জীবনে বাবার প্রভাব ছিল অনেকটা। লিখেছেনও সেকথা, ‘আজিকার ভারত’ বইয়ের উৎসর্গ-পত্রে। ‘আমার বাবা… যাঁর কাছ থেকে পেয়েছিলাম রাজনীতির প্রথম পাঠ— ভালোবাসতে শিখেছিলাম ভারতের মানুষ ও মুক্তিকামী সংগ্রামী সমস্ত মানুষকে।’

আরপিডি ছিলেন ইতিহাসের মনযোগী ছাত্র। সামাজিক অসাম্যের কারণ সন্ধানে তিনি বিষয়ের গভীরে যেতেন। ১৯১৪, অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজের ছাত্র থাকাকালীন তিনি যোগ দেন ইন্ডিপেনডেন্ট লেবার পার্টিতে। সে বছরই প্রথম প্রকাশ করেন বিখ্যাত মার্কসবাদী জার্নাল লেবার মান্থলি। প্রায় পাঁচদশক যিনি তার সম্পাদক ছিলেন। ছিলেন সিপিজিবি’র মুখপত্র ডেইলি ওয়ার্কার পত্রিকার সম্পাদক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধ-বিরোধী মিছিলে গিয়ে জেলে যান। দ্রুতই তিনি বুঝতে পারেন দুনিয়ার শোষিত মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ মার্কসবাদ। এমনকি অক্টোবর বিপ্লবের আগেই হয়ে উঠেছিলেন মার্কসবাদী। ছাত্রদের মধ্যে মার্কসবাদের প্রচারের জন্য তাঁকে অক্সফোর্ড থেকে বের করে দেওয়া হয়। একই অভিযোগে তিনি ও তাঁর দাদা ক্লিমেন্স পাম দত্তকে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাখা হয় কড়া নজরদারিতে। পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দিলে সেখান থেকে ভালো নম্বর পেয়ে পাশ করেন। ১৯২১, তিনি ছিলেন গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ছিলেন আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। ১৯৩৬, ‘অ্যান্টি ইম্পিরিয়ালিজম পিপলস ফ্রন্ট ইন ইন্ডিয়া’ (দত্ত-ব্র্যাডলে তত্ত্ব)-র অন্যতম স্থপতি।

১৯৩৫, জ্যোতি বসু ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়েছেন বিলেতে। গোটা ইউরোপ অশান্ত। ইতালিতে মুসোলিনির উত্থান। জার্মানিতে ক্ষমতায় হিটলার। জাপানের চীন আক্রমণ। ইংল্যান্ডের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক। হ্যারল্ড লাস্কি তাঁর ফ্যাসিবিরোধী ভাষণ দিচ্ছেন। ভি কে কৃষ্ণমেননের নেতৃত্বে ভারতীয় ছাত্ররা তৈরি করলেন ইন্ডিয়া লিগ। জ্যোতি বসু তাঁদের অন্যতম। তখন প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট পার্টি করা যেত না, কারণ ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি ছিল নিষিদ্ধ। ভারতীয় ছাত্রদের মধ্যে রজনীপামের ছিল দুরন্ত প্রভাব। মার্কসবাদে শিক্ষিত করতে তিনি স্টাডি সার্কেলের ব্যবস্থা করলেন। ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন ভূপেশ গুপ্ত, জ্যোতি বসু, সাজ্জাদ জাহির, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, মোহিত সেনরা। ভারতীয় কমিউনিস্ট গ্রুপগুলি আলাদা-আলাদা করে বৈঠকে বসত লন্ডন, অক্সফোর্ড এবং কেম্ব্রিজে।

মে দিন, ১৯৪৬। কলকাতা। রজনী পাম দত্তর সভা থেকে বেরিয়ে আসা শ্রমিকদের একাংশ। (সৌজন্যে: ভারতে আর পাম দও’, সিপিজিবি’র লন্ডন জেলা কমিটি থেকে প্রকাশিত পুস্তিকা)

১৯৪৬, রজনী পাম ভারত সফর শুরু করেন করাচি বিমানবন্দর থেকে। এই সফরে তিনি দেখা করেছিলেন গান্ধীজী, জওহরলাল নেহরু, পি সি যোশীর সঙ্গে। জ্যোতি বসু তার আগেই লন্ডন থেকে দেশে ফিরেছেন। রেলওয়ে শ্রমিক কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস প্রার্থী হুমায়ুন কবীরকে পরাস্ত করে জ্যোতি বসু তখন অবিভক্ত বঙ্গীয় বিধানসভায় নির্বাচিত সদস্য।

তাঁকে বলা হতো স্তালিনের ‘ব্রিটিশ মুখপাত্র’। স্তালিনের জীবনাবসানের পর লেবার মান্থলি-তে লিখেছিলেন ‘স্তালিন ও ভবিষ্যৎ’।

২০ ডিসেম্বর, ১৯৭৪। তাঁর জীবনাবসান। পরদিন সকালে অল ইন্ডিয়া রেডিও’র ঘোষণা: প্রয়াত রজনী পাম দত্ত। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় শিরোনাম: ব্রিটিশ মার্কসবাদী আর পাম দত্ত প্রয়াত।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন