Lenin Rosa Cover

লেনিনের বিপ্লব | রোজার চিঠি

সৌভিক ঘোষ

লেনিনের সবচাইতে বড় অপরাধ কি ছিল?

তিনি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত করতে সফল হয়েছিলেন।

রাশিয়ায় নভেম্বর বিপ্লব (পুরানো ক্যালেন্ডার অনুসারে অক্টোবর বিপ্লব) যদি ব্যর্থ হত, যদি দিন দশেক অসামান্য লড়াইয়ের পরে লেনিন, ট্রটস্কি সমেত বলশেভিকদের সবকটা মাথাকে কেটে মস্কো থেকে সাইবেরিয়া অবধি রাস্তার মোড়ে মোড়ে ঝুলিয়ে রাখা হত তাহলেই তিনি ‘তুচ্ছ ষড়যন্ত্রকারী’ না হয়ে ‘মহান বিপ্লবী’র তকমা পেতেন। পুঁজিবাদী সভ্যতার জোয়াল টেনে নিয়ে যাওয়ার ইজারা পেয়েছেন যারা (বিরাট ব্যবসা, যুদ্ধবাজ বেনিয়া এবং ভাড়াটে মেধাবৃত্তিকার এবং আরও সব যারা আছেন) আজকাল আন্তনিও গ্রামশি কিংবা রোজা লুক্সেমবার্গকে ‘সাচ্চা কমিউনিস্ট’ হিসাবে এবং আরও সঠিক অর্থে লেনিনের প্রতিপক্ষ হিসাবে দেখাতে চাইছেন তাদের বিবেচনায় নভেম্বর বিপ্লব আসলে মুষ্টিমেয় কজন উদ্যোগী বলশেভিকদের ষড়যন্ত্র ও আলসে কেরেনস্কির অসতর্ক গাফিলতির ফলাফল ছাড়া বেশি কিছু নয়। নতুন করে ইতিহাস পর্যালোচনার নামে তারা কবর থেকে তুলে এনে সাজিয়ে বসেছেন সেইসব রুপকথার বেসাতি যাকিছু লেনিন বেঁচে থাকতেই খারিজ হয়েছিল। এমনই এক রূপকথার একটা আস্ত অনুচ্ছেদ উৎসর্গ করা হয়েছে রোজা লুক্সেমবার্গ’কে।

এমন বিকৃতির ভিত্তি কি? রোজার কিছু চিঠিপত্র ও মাঝারি আকৃতির একটা রচনা যার নাম ‘রাশিয়ান রেভলিউশন’। সমস্যা হল পড়তে শেখা, জানা ও বুঝতে শেখার কিছু বিপদও আছে। একবার যে পড়তে শিখেছে আর কিছুতেই সেই মাথাটাকে কিছু নির্দিষ্ট কোটরে আটকে রাখা যায় না (অন্তত প্রকৃত অর্থে শিক্ষার পরিসরে এমনটা হবেই, হাল ফ্যাশনের সোশ্যাল মিডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা অবশ্য বাদ দিতে হবে)- সে তখন শাসক যা পড়াতে চায় সেইসব পড়ার সাথেই সেইসবকিছুও পড়ে ফেলে যা শাসকের মুখোশ টেনে ছিঁড়ে ফেলে। অবশ্য পণ্যের উপযুক্ত গুনমানের অজুহাত তুলে বইপত্রের দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়ে দিয়ে আরও কিছুদিন বোকা বানানো চলতে পারে, কিন্তু ততদিনে আধুনিক ছোটলোকেরা (পড়ুন প্রলেতারিয়েত, সর্বহারা) পুনরায় অতীত দিনের মতো যৌথজীবনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ফেলে। সুতরাং লাইব্রেরী বলেও যে একটা ব্যাপার আছে আর সেখানে বইপত্রও কিছু রয়েছে এটুকু দ্রুত পরিস্কার হয়ে যায়। এতেও না হলে ‘ফ্রেন্ডস অফ সোভিয়েত’ যেমন আগে ছিল এখনও আছে, তারাও প্রয়োজনে এগিয়ে আসেন।

সেভাবেই বাজারে সহজলভ্য হয়েছে রোজা লুক্সেমবার্গের চিঠিপত্রের সংকলন (ইংরেজি), ‘রাশিয়ান রেভলিউশন’ সহ তার সংগৃহীত রচনাবলীও। এইসব প্রকাশিত বইয়ের পাতায় চোখ রাখা যায় না, রাখলেই কপালে উঠে যায়! একথা ঠিক যে রোজা লুক্সেমবার্গ রাশিয়ার বলশেভিকদের সমস্ত কাজের সাথে, সিদ্ধান্তের সাথে একমত ছিলেন না। কিন্তু তিনি নভেম্বর বিপ্লবের বিরোধী ছিলেন বলে যেমনটা ঝড় তুলে দেওয়া হয় (আর কিছু না হোক বুদ্ধিজীবীদের চা- কফির পেয়ালাটুকু অন্তত সেই ঝড়ে নড়ে ওঠে) আদৌ তা নয়।

কি বলছেন রোজা লুক্সেমবার্গ?

১৯১৭ সালের ২৪ নভেম্বর নিজের বন্ধু ল্যুইজি কাউটস্কি’কে (কার্ল কাউটস্কির স্ত্রী) চিঠি লিখেছেন তিনি। সেই চিঠিতে রয়েছে রাশিয়ার বিপ্লব টিকে থাকতে ব্যর্থ হবার সম্ভাব্য কারণসমূহের পর্যালোচনা- হ্যাঁ সম্ভাব্য কারণ, নিশ্চিত না। ল্যুইজি’কে তিনি বলছেন- ‘Are you happy about the Russians? Of course they won’t be able to hold out in this Witches’ Sabbath—not because statistics show such backward economic development in Russia, as your clever spouse has it all worked out, but because the Social Democracy in the highly developed West consists of miserable cowardly dogs, who, while looking on calmly, will let the Russians bleed to death. But a downfall like that is better than “living on for the Fatherland.” It is a world-historical deed, the traces of which will not have disappeared eons from now. I expect even more great things in the coming years, but I would like to admire the course of world history—not only through the bars on the cell window’! অর্থাৎ রাশিয়ায় লেনিনরা যা করেছেন তার পাশে দাঁড়াতে উন্নত সমাজের পশ্চিম ইয়োরোপীয় সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা ব্যর্থ হবেন কারণ তারা কাপুরুষ, বিপ্লব সংগঠিত করতে তাদের চিরায়ত অনীহা, ঝুঁকি নিতে ভয়। তারা আরও অপেক্ষা করার নামে রাশিয়ার বিপ্লবকে চোখের সামনে মরতে দেবেন, তবু কিছু করতে এগিয়ে আসবেন না। শেষে জুড়ে দিচ্ছেন তার আশা এই যে বলশেভিকরা এমন বিপদ সম্পর্কে অবহিত হয়েও সামনের দিকেই এগিয়ে যাবেন। আরও বলছেন পিতৃভূমি রক্ষার অজুহাত তুলে বিপ্লব সংগঠিত না করে বেঁচে থাকার চাইতে বলশেভিকদের মতো সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গিয়ে মৃত্যুই শ্রেয়, কেননা তাতে ইতিহাসের পাতায় নতুন উদাহরণ তৈরি হয়, শোষিত মানুষের লড়াই একচুল হলেও সামনের দিকে এগোয়। ঠিক এই যুক্তিতেই লেনিন জনসাধারণের এক বিরাট অংশকে বিপ্লবের পক্ষে সমবেত করেছিলেন।

ভি আই লেনিন ও রোজা লুক্সেমবার্গ একে অন্যের কমরেড ছিলেন। ‘তুম ভি ভালো, হাম ভি ভালো’ গোছের একে অন্যের পিঠ চুলকানো ব্যাপার নয়; দুজনেই আরেকজনের মতামত, কাজের তীব্রতম সমালোচনা করেছেন- তবু একে অন্যের পাশেই থেকেছেন, এমনই কমরেডশিপ ছিল তাদের। সেই কমরেডশিপ একদিনে গড়ে ওঠেনি, এরও প্রেক্ষিত ছিল। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকই হল সেই প্রেক্ষাপট, লেনিন এবং রোজা দুজনেই বার্ন্সটাইনদের সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়েছিলেন। সেই সময় কার্ল কাউটস্কিও তাদের সাথেই ছিলেন, পরে তিনি শিবির বদলে ফেলেন। সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যে কমরেডশিপ গড়ে ওঠে তা কার্যত লোহা থেকে রূপান্তরিত হয়ে ইস্পাতের চরিত্রই অর্জন করে। সব দেশেই তার উদাহরণ রয়েছে।

আরও আছে।

১৯১৭ সালেই ক্লারা জেটকিন’কে লেখা চিঠিতে রোজা বলছেন ‘The events in Russia are of amazing grandeur and tragedy. Lenin and his people will not of course be able to win out against the insuperable tangle of chaos, but their attempt, by itself, stands as a deed of world-historical significance and a genuine milestone’। বারে বারে এই যে লেনিনরা শেষ অবধি পারবেন না বলে সতর্ক করছেন রোজা, এর কারণ কি? এইবার আমাদের মনে রাখতে হবে এক বিশেষ ঘটনা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হল সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধ, কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক (৩য় আন্তর্জাতিক)-র বাসলে কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত হয়। এই যুদ্ধের সাথে সর্বহারার কোনও সম্পর্ক নেই- তাই এই যুদ্ধে পিতৃভূমি রক্ষার নামে শ্রমিকরা নিজেদের দেশের শাসক গোষ্ঠীর পক্ষে দাঁড়াবে না। এই যুদ্ধ পরিস্থিতির সুযোগকে কাজ লাগিয়েই দেশে দেশে গৃহযুদ্ধ পরিচালনার মাধ্যমে বিপ্লবী সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। পরে রাশিয়া ও জার্মানির পার্টি ছাড়া আর কেউই সেই সিদ্ধান্তের মর্যাদা রাখেন নি। বাকি সকলেই (অন্যান্য দেশের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিগুলি) নিজেদের দেশের শাসক গোষ্ঠীর পক্ষ অবলম্বন করেছিল। বলশেভিকরা শেষ অবধি বিপ্লবের সাফল্য ধরে রাখতে পারবেন না বলে রোজার দুশ্চিন্তার ভিত্তি হল এটাই। জার্মানিতে রোজা এবং লিবনেখ্‌ট জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এসপিডি) বামপন্থী বিপ্লবী অংশের (স্পার্টাকাস লিগ) নেতৃত্ব ছিলেন, তারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির শ্রমিকশ্রেনিকে সমবেত করে ব্যাপক ধর্মঘটের আয়োজন করেন- জার্মানিতে সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। ১৯১৬ সালের জুন মাসে তার দুজনেই গ্রেপ্তার হন, আড়াই বছরের জন্য তাদের কারাবাসের শাস্তি পেতে হয়। রাশিয়ায় যখন বিপ্লব সংগঠিত হচ্ছে তখনও রোজারা জেলেই ছিলেন, আন্দাজ করা কঠিন নয় সেই সময় ঐ অবস্থার মধ্যে কিভাবে এবং কতটুকু সঠিক খবর তাদের কাছে পৌঁছেছিল। একদিকে ইয়রোপীয় সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির শোভিনিজম সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতা আরেকদিকে সঠিক তথ্যের অভাব দুয়ে মিলে রোজা;কে নভেম্বর বিপ্লবের ভবিষ্যৎ সাফল্য সম্পর্কে সন্দিহান হতে বাধ্য করেছিল। সেমন সন্দেহ স্বাভাবিক, তবে সেকথা উপলব্ধি করতে গেলে বিপ্লবী জীবন সম্পর্কেও অবহিত থাকতে হয়- শুধুমাত্র বই পড়ে সবটা হয় না।

লেনিনের সাথে রোজার বিতর্ক ছিল। প্রথমেও ছিল, পরেও ছিল। কমিউনিস্ট রাজনীতিতে সফল হতে ধরাবাঁধা হাতে-গরম সুত্র নেই, মার্কস-এঙ্গেলস অমন কিছু লিখে যাননি। তারা দুজনে মিলে এমন এক দর্শনের নির্মাণ করেছেন যার প্রয়োগে বিপ্লবীকে নিজের দেশের বাস্তব পরিস্থিতি বিচার করতে হয়, সেই অনুযায়ী উপযুক্ত সিদ্ধান্তও গ্রহণ করতে হয়। এই প্রসঙ্গেই মনে রাখতে হবে বিপ্লব এমনই ব্যাপার যা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত পথে চলে না, যেকোনো সময় নতুন পরিস্থিতির বাঁক-মোড় ইত্যাদির বাধা পেরোতে হয়। তাই নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ। নিছক সুত্রায়নের তাড়নায়  লেনিন একে মার্কসীয় বিশ্ববিক্ষার সারাংশ বলেননি।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার রাশিয়া, জার্মানি। দুই দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পার্থক্য অনেক। জার্মানিতে প্রলেতারিয়েত উন্নত গণতান্ত্রিক বোধে সঞ্জাত, রাশিয়া তখনও ইয়োরোপের পিছনের উঠোন, পশ্চাৎপদ চাষাড়ে দেশ। এই দুই দেশে বিপ্লব কিভাবে অভিন্ন লক্ষ্যে বিভিন্ন রূপ নেবে তার রূপরেখা সবটা তৈরি ছিল না। রোজার সাথে লেনিনের বিতর্কের ভিত্তি ওটাই। আজও সবটা আগে থেকে বোঝার উপায় নেই, যেটুকু আছে তা পৃথিবীর বুকে সংগঠিত সফল কিংবা ব্যর্থ বিপ্লবের অভিজ্ঞতা। লেনিন সফল হয়েছিলেন, রোজা পারেননি। আমাদের লেনিনের থেকেও শিখতে হয়, আবার রোজার কথাবার্তা থেকেও শিখতে হয়।

কেউ বলতে পারেন, ব্যর্থ বিপ্লব কিংবা ব্যর্থ বিপ্লবী কোন শিক্ষা দেয়?

দেয় অনেককিছুই। এই লেখার শেষে শুধু দুটি প্রসঙ্গের উল্লেখ রইল।

এক। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের যে ধারণা তার বিকাশ হয়েছে সময়ের সাথেই। সেদিন জার্মানির প্রেক্ষাপটে রোজা লুক্সেমবার্গ যা যা বলেছিলেন তার সবটা ফেলে দেবার নয়। লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকদের সাফল্য স্বত্বেও পরের দিকে সোভিয়েত ইউনয়ন গণতান্ত্রিক পরিসরকে খাটো করে বিবেচনা করেছিল, এমনটা করা হলে সম্ভাব্য বিপদকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। সোভিয়েতের শিক্ষাও তাই। আর তাই রোজা লুক্সেমবার্গ।

দুই। বিতর্ক, মতামতের ভিন্নতা সব পেরিয়ে বিপ্লবীর জীবন নিজেই হয়ে ওঠে এপিক। সেই এপিক সাহস যোগায় পরের প্রজন্মকে। এমনকি চার কি পাঁচ প্রজন্ম পেরিয়েও। কেমন সেই সাহস? জেলের কুঠুরিতে বসে আসন্ন বিপ্লবে যোগদানের ইচ্ছায় রোজা প্রতিদিন ভিতর থেকে পুড়েছিলেন, সেই আগুনই তার লেখনিতে পাওয়া যায়। অ্যাডলফ ওয়ার্স্কিকে লেখা চিঠির একজায়গায় তিনি বলছেন... With the coming of the European revolution, the Russian counter-revolutionaries will lose not only support [from abroad] but also—what’s more important—their courage. Thus the Bolshevik use of terror is above all an expression of the weakness of the European proletariat. Certainly, the agrarian relations that have been established are the most dangerous aspect, the worse sore spot of the Russian revolution. But here too there is a truth that applies—even the greatest revolution can accomplish only that which has ripened as a result of [historical] development. এই উপলব্ধি লেনিনেরও ছিল।

সবশেষে বন্ধু ল্যুইজি কাউটস্কিকে লেখা চিঠির শেষ অংশটি আরেকবার দেখে নেওয়া যায়- ‘I expect even more great things in the coming years, but I would like to admire the course of world history—not only through the bars on the cell window’।

ব্যর্থ হবার মানেই আগাগোড়া ভুল এমনটা না।

লেনিন নিজেই রোজা সম্পর্কে এমন সিদ্ধান্তের বিরোধী ছিলেন।

তারা দুজনেই বিপ্লবী ছিলেন বলেই।


শেয়ার করুন