LULA COVER

ফিরলেন লুলা, ব্রাজিল ফিরল বামপন্থায়

শান্তনু দে

এভাবেও ফিরে আসা যায়!

ফিরলেন লুলা। উগ্র দক্ষিণপন্থাকে হারিয়ে ব্রাজিল ফিরল বামপন্থায়।

৯৯.৯৯ শতাংশ গণনার শেষে লুলার পক্ষে সমর্থনের হার ৫০.৯০ শতাংশ। বোলসোনারোর ৪৯.১০ শতাংশ। লুলা জিতলেও, কমেছে ব্যবধান। ২১,৩৯,৪৩৬। মাসখানেক আগে প্রথম রাউন্ডের নির্বাচনে ছিল ৬২ লক্ষ। লুলার পক্ষে সমর্থনের হার ছিল ৪৮.৪৩ শতাংশ। বোলসোনারোর ৪৩.২০ শতাংশ। ফারাক ছিল ৫.২ শতাংশ। একইসঙ্গে হয়েছে বারোটি প্রদেশের গভর্নর নির্বাচন। এই লেখা পর্যন্ত তার ফলাফল এসে পৌছয়নি।

রবিবার ছিল ব্রাজিল এবং লাতিন আমেরিকার জন্য এক নির্ণায়ক দিন। ছিল না মধ্যপন্থার কোনও সুযোগ। ব্রাজিলের কাছে ছিল দু’টো পথ। বেছে নিতে হবে সবচেয়ে খারাপ আর সবচেয়ে ভালোর মধ্যে একজনকে। এবং বেছে নিতে ভুল করেনি ব্রাজিল।

তীব্র মেরুকরণ। দু’জন, দুই বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি। দুই রাজনীতিবিদ, যারা পরস্পরকে ঘৃণা করেন। এবং গোপনও করেন না সেকথা। একজন বলেছেন ‘নতুন ব্রাজিলের’ কথা। তিনি লুলা। বলেছেন, ‘জিতলে সরকারের প্রথম পদক্ষেপ হবে ৩ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষকে ক্ষুধা, ১০ কোটি মানুষকে দারিদ্র থেকে উদ্ধার। গণতন্ত্রের বিকাশ, যেখানে কাউকে একঘরে করে রাখা হবে না।’ বিপরীতে ‘লাতিনের ট্রাম্প’ বোলসোনারোর অস্ত্র ছিল ঘৃণা-বিদ্বেষের প্রচার আর ভুয়ো খবরের বন্যা। একটি সংস্থার হিসেবে: বোলসোনারো, তাঁর ১,৩৯৪ দিনের জমানায় ৬,৪৯১ বার অসত্য ও বিকৃত বিবৃতি দিয়েছেন। মানে দিনে চারবারের বেশি! কেউ আবার দিল্লি-কলকাতার কারো সঙ্গে মিল খুঁজতে যাবেন না! প্রথম রাউন্ডের পর থেকে দক্ষিণপন্থী ইউটিউব চ্যানেলের দর্শক দাঁড়ায় ৯ কোটি ৯০ লক্ষ, যেখানে বামপন্থী চ্যানেলে ২ কোটি ৮০ লক্ষ। ভুয়ো খবর ফিরি করে ভোট কিনতে প্রচার চালানো হয় ‘লুলা জিতলে বন্ধ করে দেওয়া হবে গির্জা, তিনি গর্ভপাত, তরুণদের মাদক-সেবনের সমর্থক, বিশ্বাস করেন না ব্রাজিলের পারিবারিক প্রথায়।’ নেটের লড়াইয়ে হারলেও, হাঁটার লড়াইয়ে জিতেছেন লুলা।

লুলাকে লড়তে হয়েছে কর্পোরেট মিডিয়া, ব্রাজিলের সংসদের সেনেট ও কংগ্রেসে গেড়ে বসে থাকা দক্ষিণপন্থী শিবির, মধ্যপন্থার ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা দক্ষিণপন্থী শক্তি, কৃষি বাণিজ্য লবি, সামরিক বাহিনী ও পুলিশের দিকে ঝুঁকে থাকা শক্তি, নয়া উদারবাদী মধ্যবিত্ত, চার্চের অনুগামী শক্তি, সাধারণভাবে ব্রাজিলের পিতৃতান্ত্রিক পরিবারতন্ত্রের রক্ষণশীল মূল্যবোধ এবং সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে প্রচ্ছন্ন মার্কিনী হস্তক্ষেপ— এইসবের বিরুদ্ধে। লুলা জিতে রাষ্ট্রপতি হলেও তাঁকে ফাঁকা মাঠ ছেড়ে দেবে না দক্ষিণপন্থীরা। সেনেট ও কংগ্রেসে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকা দক্ষিণপন্থীরা বাধা দেবে জনমুখী কর্মসূচি রূপায়ণে। সামাজিক সম্পদ বন্টনে বৈষম্য অপসারণের নীতি তারা মানবে না।

জয়ের পরে লুলা বলেছেন: ‘আমরা বাস করব এক নতুন সময়ে। শান্তি, ভালোবাসা আর আশার সময়ে। যাঁরা আমায় ভোট দিয়েছেন, শুধু তাঁদের জন্য নয়, আগামী বছর নববর্ষের দিন থেকে আমি কাজ করব সাড়ে ব্রাজিলের ২১ কোটি মানুষের জন্য। যেখানে থাকবে না দুই ব্রাজিল।’ তিনি বলেছেন, ‘এই জয় শুধু আমার নয়, ওয়ার্কার্স পার্টির নয়, যে দলগুলি আমাকে সমর্থন করেছে তাদের নয়, এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জয়, সেকারণে এই জয় গণতন্ত্রের জয়।’

লুলার জয়ের পর লাতিন আমেরিকার কুড়িটি দেশের মধ্যে অর্ধেকের বেশি দেশেই এখন মধ্য-বাম থেকে বামপন্থী সরকার। মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা ছিলই। লুলার জয়ের পর লাতিনের বৃহত্তম প্রথম তিনটি দেশেই এখন বামপন্থী, মধ্য-বাম সরকার।

তখনও কলম্বিয়ার নির্বাচন হয়নি। বছরের গোড়ায় চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা গ্লোবাল টাইমসের হিসেব, লাতিনের অন্তত ১৫টি দেশে সরকার চালাচ্ছেন বামপন্থী অথবা মধ্য-বাম নেতৃত্ব। আর এখন— বস্তুত, এই প্রথম লাতিন আমেরিকার ছ’টি বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ— ব্রাজিল, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, চিলি, কলম্বিয়া এবং পেরুতে বামপন্থী অথবা মধ্য-বাম সরকার।

২০২১: বামপন্থী, মধ্য-বাম নেতৃত্বরা জেতেন পেরু, হন্ডুরাস, চিলিতে। তার আগে মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা এবং বলিভিয়ায়। এই অঞ্চলের বৃহত্তম দেশে লুলার জয় এই স্রোতকে তুলেছে একেবারে শিখরে। স্বাভাবিক। লাতিন আমেরিকার অর্থনীতির ৪০ শতাংশের বেশি জুড়ে রয়েছে একা ব্রাজিল।

লাতিন আমেরিকার সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক। তবে রয়েছে একটি সত্যিকারের সম্ভাবনা। নয়া উদারবাদের ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে বিকল্প নির্মাণ। নয়া উদারবাদের বিরোধিতা থেকে নয়া উদারবাদ-উত্তর মডেল নির্মাণ। যদিও কাজটা সহজ নয়। দু’টি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক মডেলের সংঘাত অনিবার্য। একদিকে নয়া উদারবাদ, অল্প কিছু মানুষের মধ্যে সম্পদের কেন্দ্রীভবন, সামাজিক খাতে বরাদ্দে তাচ্ছিল্য, অন্যদিকে প্রগতিশীল কর্মসূচী, যেখানে উন্নয়নের কেন্দ্রে জনগণ। আর এই চ্যালেঞ্জের মুখে ঐক্য নির্মাণে ব্রতী লাতিন আমেরিকা।


শেয়ার করুন