শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি: নোস্যানল লস’র প্রভাব আরও গভীরে

পার্থপ্রতিম বিশ্বাস

তখন এদেশে সবেমাত্র বাজার অর্থনীতি চালু হয়েছে. অরুণাচল প্রদেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে নির্মীয়মান জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পেশাগত পরামর্শদাতা হিসেবে পাহাড়ে ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চেপে চলেছি। এমন সময় এক পাহাড়ি বাঁকের মুখে হঠাৎ এক মোরগ চাপা পড়ে আমাদের গাড়ির নিচে। অগত্যা পাহাড়ি ধালের গ্রামে বিচারসভায় হাজির হয়ে সেই ‘গাঁও বুড়ার’ ধার্য শাস্তি হিসেবে প্রায় দশ হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হয়েছিল। কিন্তু একটা মুরগি অনিচ্ছাকৃত চাপা পড়ায় এত গুনাগার কেন? এ কথা জিজ্ঞাস করে উত্তর পেয়েছিলাম, সেই মুরগী বেঁচে থাকলে তার কটা ডিম তার থেকে আরো কত মুরগির জন্ম এভাবেই মৃত মুরগির আশু বাজার দরের বাইরে বেরিয়ে সেই মৃত্যুর ক্ষয়ক্ষতির হিসাব কষেছিল সেই গ্রামের প্রধান। সন্দেহ নেই সেদিন ঐ বিচিত্র বিধান অনেকটাই বাহুবলী রাজনীতির বিচারের মত মনে হলেও পরবর্তীকালে বাজার অর্থনীতির ‘Notional loss’ এর ধারণা যে ওই প্রত্যন্ত জনপদে বহু আগে থেকেই পৌঁছে গেছে সেটাই টের পেয়েছিলাম। আজ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ভয়াবহ দুর্নীতির কারনে রাজ্যে ছাব্বিশ হাজার শিক্ষকের চাকরি যাওয়ার পর আবার ফিরে এলো সেই ‘Notional loss’ এর স্মৃতি। অর্থাৎ চাল কাঁকড়ের মতো মিশে থাকা যোগ্য-অযোগ্যের ভিড়ের মাঝে স্কুলের চৌকাঠ পেরিয়ে পড়তে যাওয়া আগামী দুই প্রজন্মের পড়ুয়াদের লেখাপড়ার কি হাল হতে চলেছে সেটাই ঐ ‘Notional loss’ বা অনুমিত ক্ষতি নির্ধারণের মুল বিবেচ্য।

সেই ঘটনার পাক্কা কুড়ি বছর বাদে রাজ্যের স্কুল শিক্ষা দুর্নীতির ঘায়ে এক ধাক্কায় ছাব্বিশ হাজার মানুষের চাকরি যাওয়ায় রাজ্যের জনমানসে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। এ রাজ্যে দুর্নীতির ভিন্ন ভিন্ন রূপ দেখেছে মানুষ। আবাস থেকে একশো দিনের কাজ, ত্রানের টাকা থেকে সরকারি ভাতা, সিন্ডিকেট থেকে কাটমানি। কিন্তু শিক্ষায় বেলাগাম দুর্নীতির অভিঘাত কেবল জেলায় জেলায় রেট-চার্ট বেঁধে তোলা টাকার পরিমাণ কিংবা পার্থ-অর্পিতার ঘরভর্তি টাকার পাহাড় , গয়না দিয়ে বিচার করা যাবে না। বরং শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতির অনুমিত ক্ষতির সামাজিক মূল্য এসবের চেয়ে ঢের বেশি। কার্যত এই দুর্নীতির যাঁতাকলে পড়ে রাজ্যের ধুঁকতে থাকা সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার অস্তিত্ব নিয়েই বড় প্রশ্ন উঠে গেল আজ। ফলে ‘State sponsored’ প্রাতিষ্ঠানিক এই দুর্নীতি, রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে আশু ক্ষতির পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিরও জন্ম দিল। কারণ গুণগতভাবে অন্যান্য দুর্নীতির ক্ষেত্রে আশু ক্ষতি তুলনায় বেশি হলেও শিক্ষা দুর্নীতির ক্ষেত্রে তার দীর্ঘমেয়াদী অভিঘাত আরো ভয়াবহ এবং গুরুতর।

ইতিমধ্যে চাকরি-হারা যোগ্য শিক্ষকের দল রাজপথের আন্দোলনে নেমেছেন সরকারের ছত্রছায়ায় থাকা এসএসসির এই নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে। শাসকদলের নেতা, মন্ত্রী, বিধায়ক এবং আমলাদের সম্মিলিত ও পরিকল্পিত প্রয়াসের মাধ্যমে এই বিপুল দুর্নীতি সংগঠিত হয়েছে দিনের পর দিন। ফলের তাদের ওই প্রাতিষ্ঠানিক অপরাধের যাবতীয় প্রমাণ লোপাটের লক্ষ্যে যোগ্য এবং অযোগ্য উভয়গোত্রের প্রার্থীদের OMR সিট থেকে শুরু করে নিয়োগের প্রাসঙ্গিক প্রতিটি তথ্য লোপাট করা হয়েছে। আর সেই প্রমাণ লোপাটের কারণেই যোগ্য- অযোগ্যের মাঝে চালে কাঁকড় বাছা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আর এই সুযোগে যোগ্যপ্রার্থীদের ঢাল বানিয়ে রাজ্যের সরকার অযোগ্যদেরও চাকরি রক্ষায় সোচ্চার। কিন্তু আদালতের রায় গোটা নিয়োগ পদ্ধতি গুরুতর প্রশ্নের মুখে পড়ায়, যে বিপুল নিয়োগ খারিজ হয়েছে তার দায় রাজ্য সরকার এবং স্কুল শিক্ষা কমিশনের। ভূতের মুখে রাম নামের মত তীব্র সামাজিক চাপে পড়ে মুখ্যমন্ত্রী এখন স্বশাসিত এসএসসি থেকে সরকারের ভূমিকা আলাদা করতে চাইছেন। কিন্তু রাজ্যের আইন মেনে তৈরি হওয়া সংস্থা এসএসসির স্বশাসনের জলাঞ্জলি ঘটেছে শাসকদলের নিয়ন্ত্রণের রাজনীতিতেই। ফলে শুধু এসএসসি নয়, কলেজ সার্ভিস কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, রাজ্য নির্বাচন কমিশন, রাজ্যে মানবাধিকার কমিশন প্রতিটি স্বশাসিত সংস্থার মাথায় বসেছে সরকার মনোনীত বাছা বাছা কুশীলবেরা। আর এই মডেলেই এসএসসির মাথায় বাছাই করা প্রশাসক আর ঘুষের বিনিময়ে বাছাই করা অযোগ্যের তালিকা জুড়ে দিয়েছে সেই কমিশন ওই ছাব্বিশ হাজারের তালিকায়। ফলে এই বিপর্যয়ের দায় কেবল কমিশনের নয় উপরন্তু সেই দায় রাজ্যের গোটা মন্ত্রিসভার যারা এই নিয়োগ দুর্নীতি ঢাকতে অতিরিক্ত শিক্ষকের পদ তৈরির মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

এই বিপর্যয়ের অভিঘাত হিসেবে স্কুল শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা সবেতেই চিড় খেতে চলেছে সরকারি শিক্ষার প্রতি সাধারন মানুষের আস্থা। বাম আমলে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে রাজ্যের শিক্ষক সমাজের যে আর্থসামাজিক স্বীকৃতির উত্তরণ ঘটেছিল, রাজ্যে পালাবদলের পর তার দ্রুত অবনমন ঘটেছে। ফলে ক্লাস ঘরে আসা মানুষটা আদপে শিক্ষকতার যোগ্য কিনা এই প্রশ্ন মুখে না হলেও পড়ুয়া থেকে পাড়ার অভিভাবক, সকলের মনে ভিড় করছে। আড় চোখে সেই শিক্ষক ও তার গোটা পরিবার আজ সমাজের আতশ কাঁচের তলায়। প্রতিদিন যে শিক্ষকেরা এখনো কর্মরত স্কুলে স্কুলে, তাঁদের নিয়েও জিজ্ঞাসা চিহ্ণ তৈরি হচ্ছে! শিক্ষকের নিয়োগে খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে অভিযোগ করছেন বাম আমলের চিরকুটে চাকরি নিয়ে। কিন্তু গত চৌদ্দ বছরে একটা চিরকুট প্রকাশ্যে আনতে পারেননি তার সরকার। বরং তাঁর আমলে চিরকুটে লেখা ঘুষ দেওয়া প্রার্থীদের OMR গুলো হারিয়ে গেছে ফলে এক কথায় সরকারি ষড়যন্ত্রের এখন সরকার পোষিত স্কুলের হাজার হাজার শিক্ষক শিক্ষা কর্মীরা ছাত্র-শিক্ষক অভিভাবকের পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে এরা যে তিল তিল করে গড়ে তোলা শিক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু সেই ব্যবস্থা ভেঙে গেলে রাজ্যের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের পড়ুয়াদের হাল সবচেয়ে সঙ্গীন হবে। ফলে যখন সরকারি স্কুলের ঝাঁপ বন্ধ হতে চলেছে সরকারি অব্যবস্থায় তখন নতুন বাণিজ্যের ঝাঁপি খুলে বসেছে রাজ্যজুড়ে বেসরকারি শিক্ষা। ফলে সেই ফেলো কড়ি মাখো তেলের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় রাজ্যের প্রান্তিক পরিবারের পড়ুয়ারা যে ছিটকে যাবেন তার আগাম পূর্বাভাস মিলতে শুরু করেছে রাজ্যের ভয়াবহ স্কুল ছুটের সংখ্যায়। পাশাপাশি সরকারি স্কুল শিক্ষায় রাজ্যে ধারাবাহিক দুর্নীতির প্রভাবে সরকারি ব্যবস্থা যে আদপে অদক্ষ অযোগ্য এটাই প্রমাণের চেষ্টা চলবে নতুন উদার অর্থনীতির প্রচারের আবহে।

ফলে আজ রাজপথে চাকরিহারা শিক্ষকদের আন্দোলন শুধু তাদের চাকরি বাঁচানোর লড়াই নয় বরং রাজ্যের সরকার পোষিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখা লড়াই। যে শিক্ষক নিয়োগ ইতিমধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে সেই দুর্নীতির অংশীদার হিসেবে এসএসসি, মধ্য শিক্ষা পর্ষদ, রাজ্যের শিক্ষা দপ্তরের সাথে পুলিশ প্রশাসনও জড়িয়ে গিয়েছে। ফলে রাজ্যজুড়ে ডিআই অফিসের সামনে প্রতীকি অবরোধের যে কর্মসূচি নিয়েছিল চাকরিহারা আন্দোলনরত শিক্ষক সমাজ তার বিরুদ্ধে প্রকৃত প্রতিশোধ নিতে নেমে পড়েছে রাজ্যের পুলিশ বাহিনী। প্রতিশোধের স্পৃহায় পুলিশ প্রশাসন আন্দোলনরত শিক্ষকদের লাঠিপেটা করে থামেনি। লজ্জা, ভয়, নিয়ম-কানুন লাটে তুলে শিক্ষকদের লাথি মারতেও পিছপা হয়নি রাজ্যের পুলিশ। আসলে পুলিশের লাথি শিক্ষকের দেহে পড়েনি, পড়েছে রাজ্যে সরকার পোষিত শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর। রাজ্যে পালাবদলের পর স্কুলে কলেজে শাসকদলের নেতাকর্মীরা শিক্ষকের পায়ে হাত দিয়ে সম্মান জানানোর পরিবর্তে গায়ে হাত তোলার সংস্কৃতি তৈরি করেছিল। আজ সেই সরকারের তৃতীয় ইনিংসে রাজ্যের পুলিশ মন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকারি পুলিশ, সরকারি শিক্ষকদের গায়ে লাথি মারার কদর্য নজির গড়ল। কিন্তু ‘sword is mightier than pen’ এই তত্ত্বে যারা সেদিন লাঠি চালিয়েছে, লাথি মেরেছে সমাজ গড়ার স্থপতিদের, ইতিহাসে তাঁদের স্থান যে জুটবে আস্তাকুঁড়েতে তার লক্ষন ফুটে বেরোচ্ছে রাজ্য জুড়েই।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন