অধ্যাপক থাপার ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে সতর্ক করলেন

ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন

সম্প্রতি একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিকে বিশিষ্ট ইতিহাস রোমিলা থাপার কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন তাদের সার্বিক ব্যর্থতার জন্য। তিনি লিখেছেন -"শাসনব্যবস্থায় ব্যর্থতা ধরা পড়লে মানুষের মনোযোগ সরানোর জন্য কিছু বলিপ্রদত্ত ছাগলের প্রয়োজন হয়...সভ্যসমা্জ কোন সম্প্রদায়কে কখনই বলির পাঁঠা বানায় না" । ভারতের অতীত ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উথ্থান প্রসঙ্গে তিনি ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের ভূমিকারও তীব্র সমালোচনা করেন।

স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক ভারত গঠনে গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে থাপার বলেন যে এই বিরোধ প্রক্রিয়ার উৎস ভারতের অতীতের মধ্যেই পাওয়া যায়। "আমার অন্যান্য উদাহরণগুলির তুলনায়, এটি তার(বিরোধ) পূর্বসূরীদের সম্পর্কে , বিগত সময়ের চিন্তাভাবনা এবং ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে সচেতন ছিল যার ফলে এই প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাও অতীত সম্পর্কে অবহিত ছিল। সেই দিক থেকে, এটি কিছুটা আলাদা।" সত্যাগ্রহ ছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সেই সূত্রেই জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে থাপার আরো বিস্তারিত কিছু আলোচনা করেছেন। তাঁর মর ভারতে জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক ও অপ্রতিরোধ্য রূপটি ছিল উপনিবেশিকতাবিরোধী জাতীয়তাবাদ, এটি বেশিরভাগ পূর্ববর্তী উপনিবেশেরই একটি সাধারণ অভিজ্ঞতা।এটি নাগরিকের স্বাধীনতাকে বাধা প্রদানকারী বিভিন্ন ধরণের রাজনৈতিক গোঁড়ামিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে প্রস্তুত মুক্ত নাগরিকের দৃঢ়তাকেই বোঝায়।এর উৎস অতীতেই রয়েছে তাই এখানে ইতিহাসের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উপনিবেশবাদের অভিজ্ঞতা নিজেই একটা ঐতিহাসিক পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা যা মানুষকে তার ও যে সমাজের প্রেক্ষিতে এই পরিবর্তন ঘটছে তার সম্পর্কে এক সম্যক উপলব্ধি দেয়।

Image Google

"জাতীয়তাবাদ, আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ঐতিহাসিক পরিবর্তনের একটি অংশ যা গত তিন শতাব্দীতে বিশ্বের নিজেকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গী বদলে দিযেছে।শিল্পায়নের সাথে একত্রে, এটি সেই সময়ের সাথে সম্পর্কিত যা মূলত নতুন প্রযুক্তি প্রবর্তন করে যা পুঁজিবাদের উত্থানের ফলে অনেকগুলি সামাজিক ক্রিয়াকলাপকে সহজতর করেছিল।" এরফলে যে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্ম তারা পরিবর্তনগুলোর নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে ও এই গড়ে উঠতে থাকা পরিবর্তনশীল সমাজকে নতুনভাবে দেখতে শুরু করে। এই সময়ে জ্ঞানের স্তরে, বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম, সাহিত্য এবং জীবনযাত্রার ধরণে উদ্ভাবন ঘটেছিল।

এই পরিবর্তনগুলোর প্রকাশের একটি রূপ ছিল জাতীয়তাবাদের ধারণা। "পূর্ববর্তী শাসন ব্যবস্থার কাঠামো তৈরি করা সামন্ত রাজ্য বা উপনিবেশগুলি অন্য ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং তাদের স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র দ্বারা প্রতিস্থাপন করতে হবে"- এই ধারণা ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকে। রাজাদের বা ব্রিটিশ রাজের দ্বারা প্রজাদের শাসনের পুরোনো ব্যবস্থার বদলে আসে নাগরিকদের শাসনব্যবস্থা। এটি নাগরিক এবং রাষ্ট্রের মধ্যে একটি সরকারের মাধ্যমে যোগসূত্রে আবদ্ধ হয়েছিল যা স্বৈরাচারী বা বিদেশী ছিল না বরং এটি ছিল নাগরিকদের প্রতিনিধিত্বকারী।এই শাসনব্যবস্থা মানে নাগরিকদের দর্শনের প্রতিনিধিত্ব করা যা এর পূর্ব সংজ্ঞা থেকে পৃথক।নাগরিক এবং রাষ্ট্রের মধ্যে এটা শুধুমাত্র যোগসূত্রই নয় যা অতীতের সাথে তুলনীয় নয় বরং এটা ছিল নাগরিকদের অধিকারের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া একটা সম্পর্ক যে অধিকার রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এই নতুন সম্পর্কটি ছিল নাগরিক এবং রাষ্ট্রের মধ্যে একটি চুক্তি যা সংবিধানে লিপিবদ্ধ।"জাতীয়তাবাদ তাই সকল নাগরিককে একত্রিত করে যারা স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সমান মর্যাদা ও অধিকার দাবি করেছিল।"যেহেতু প্রতিটি নাগরিক জড়িত, তাই জাতিরাষ্ট্র নাগরিকদের মধ্যে ধর্ম, জাতি, ভাষা বা এই জাতীয় কোনও পরিচয়ের ভিত্তিতে বৈষম্য করতে পারে না।থাপার তাই বলছেন-" সুতরাং, ধর্মের পরিচয়ের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদ যা অন্য ধর্মের পক্ষে বৈষম্যমূলক তা কখনই জাতীয়তাবাদ হিসাবে বৈধতা পায়নি। "

আমরা সম্ভবত এই প্রশ্ন করতেই পারি যে ততটা তাৎপর্যপূর্ণভাবে না হলেও এক শতাব্দী আগে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের অস্তিত্ব কেন ছিল ! এটি মূলত সেই ভারতীয়দের দ্বারা ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতিক্রিয়া ছিল যারা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে একটি জাতি-রাষ্ট্র গঠনের জন্য সুবিধাজনক ভেবেছিল।১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের কারণ এবং পরবর্তী ঘটনাবলী নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমরা দুটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের জন্য সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে সঠিকভাবেই দোষারোপ করি; তবে প্রক্রিয়াটিতে আমরা ঔপনিবেশিক ধারণাগুলির যে গভীর ছাপ তা ভুলে যাই।

ভারত সহ বেশিরভাগ উপনিবেশের ক্ষেত্রেই তাদের অতীত সম্পর্কিত ধারণা তৈরিতে ঔপনিবেশিক প্রভাব খুব প্রবল,সেক্ষেত্রে দেশটির ইতিহাসের পাঠ হয়েছে ঔপনিবেশিক দৃষ্টি থেকেই। এই ইতিহাসের কিছুটা ভারতের উপনিবেশবিরোধী জাতীয়তাবাদের দ্বারা গৃহীত হলেও বেশ কিছু বিষয়ে বিরোধীতাও স্পষ্ট ছিল। এই বিরুদ্ধতা উপযুক্ত উপনিবেশবিরোধী জাতীয়তাবাদ গঠনে সাহায্য করেছিল। যদিও ঔপনিবেশিক ইতিহাস পাঠের দৃষ্টিভঙ্গীর ফলে অপেক্ষাকৃত কম গ্রহণযোগ্য ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের সূচনায় সাহা্য্য হয়েছিল। এগুলি কম বৈধ ছিল কারণ জাতীয়তাবাদ একটি একক সর্বজনীন পরিচয়কে সমর্থন করে, অন্যদিকে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ একটি ইচ্ছাকৃতভাবে নির্বাচিত পরিচয়কে সমর্থন করে যা সর্বসম্মত নয় এবং একটি ব্যতীত সমস্ত কিছু বাদ দেয় ।

এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক কেন ঔপনিবেশিক ইতিহাস পাঠকেই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উৎস হিসাবে দেখা হয় ! ভারতের ঔপনিবেশিক উপলব্ধিটি দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।জেমস মিল ১৮১৭ সালে যুক্তি দিয়েছিলেন যে ভারতের ইতিহাস মূলত দুটি দেশের ইতিহাস- হিন্দু ও মুসলমান- যারা নিরন্তর পরস্পরের বিরোধিতা করে গেছে। ঔপনিবেশিক পন্ডিতেরা এই ধারণার দ্বারাই পরিচালিত হয়েছিলেন এবং ভারতীয় সমাজ ও সভ্যতা বুঝতে এই ধারণারই প্রয়োগ করেছিলেন। ভারতের ইতিহাসকে তারা তিনটে পর্বে ভাগ করেন- হিন্দু, মুসলমান এবং ব্রিটিশ । এই পর্ব বিভাজন মূলত অনৈতিহাসিক এবং অর্ধশতাব্দী পূর্বে যখন ঔপনিবেশিক ইতিহাস চর্চার বিষয়ে অনেকগুলো গুরুতর প্রশ্ন ওঠে তখন এই ধারণাগুলো পরিত্যাগ করা হয়। তবে, এই ঔপনিবেশিক তত্ত্বটি মুসলমান ও হিন্দু উভয় ধর্মীয় জাতীয়তাবদের দ্বারা অনুগতভাবে অনুসরণ করা হয়েছিল।হিন্দুত্ববাদী ইতিহাসের ভিত্তিতে চলা হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা বা তার পাশাপাশি চলা মুসলমান রাষ্ট্রের ধারণা উভয়েরই উৎস ভারতের ঔপনিবেশিক ইতিহাস চেতনা। এই দুটো একে অপরকে খারিজ করে গেলেও মূলগতভাবে দুটোই উপনিবেশবিরোধী জাতীয়তাবাদের পরিপন্থী।

James Mill

মুসলিম ও হিন্দু জাতিরাষ্ট্রের ঔপনিবেশিক প্রচার ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের প্রেরণা জুগিয়েছিল।ইসলামী সম্পৃক্ততা দাবিকারী সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে গোষ্ঠীগত পার্থক্যগুলি স্বীকৃতি দেওয়া সহজ ছিল, সেখানে ঐতিহাসিক চিহ্নিতকরণের একটা কাঠামো রয়েছে।সুন্নিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে এমন জায়গাগুলিতে শিয়াদের আক্রমণের উদাহরণ আছে এবং এই জাতীয় ভিন্ন মতামতকে আজও নিয়মিতভাবে চাপা দেওয়া হয়। গজনির সুলতান মামুদ মুলতানের শিয়া মসজিদে যখন আক্রমণ চালিয়েছিল একই সময়ে হিন্দু মন্দিরগুলোতেও সে আক্রমণ চালায় আর এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই কারণ এটা ছিল ইসলামের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব।

কিন্তু হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের এইরকম কোন ঐতিহাসিক চিহ্ন না থাকায় এর জন্য একটা কাঠামো তৈরি করতে যথেষ্ট পরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল।হিন্দু জাতিরাষ্ট্র গঠনের তত্ত্বটাকে শক্তিশালী করার উপযুক্ত কাঠামো তৈরির জন্য ইতিহাসের পুনর্গঠনের প্রয়োজন ছিল । এই কাজটা করা হয় ভারতের বিপুল সংখ্যক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বাদ রেখে হিন্দুত্বের পতাকার তলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের রাজনৈতিক জমায়েতের মাধ্যমে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে বৃহত্তম ছিল মুসলিম সম্প্রদায় তাদের মধ্যেও সমান্তরাল প্রবণতা উদ্ভূত হয়েছিল। "পুনর্গঠনটি জাতীয়তাবাদে দ্বৈত সত্ত্বাকে উৎসাহিত করেছিল: যারা জাতীয়তাবাদকে ভাবে ঔপনিবেশিকতাবিরোধী জাতীয়তাবাদকে লালন করে এমন একটি ধর্মনিরপেক্ষ, অন্তর্ভুক্তিমূলক দর্শন হিসাবে ,অন্যদিকে যারা একে ভাবে হিন্দু বা ইসলামিক ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ হিসাবে যেখানে দুটো সম্প্রদায় একে অপরের প্রতিপক্ষ" ।

Cultural Diversity

থাপার দুই ধরনের জাতীয়তাবাদের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেন- বৃহত্তর উপনিবেশবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদের স্পষ্টতই আলাদা লক্ষ্য ছিল।এটি ভারতকে নাগরিকদের একটি রাষ্ট্র হিসাবে দেখেছিল যারা , উৎস নির্বিশেষে এবং যথেষ্ট সমান পরিচিতি সহ সমান মর্যাদার অধিকারী এবং একটি স্বাধীন, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক জাতি-রাষ্ট্রের দাবিতে একত্রিত হয়েছিল।এটি প্রাথমিক বা সুনির্দিষ্ট নাগরিকত্ব পরিকল্পনা করা মনোভাব থেকে আলাদা ছিল, যেমনটা দুটি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে স্পষ্ট। "জাতীয়তাবাদ, যদি অনেকগুলোর মধ্যে একটি একক পরিচয় দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়, তবে তা আর জাতীয়তাবাদ থাকে না এবং সংখ্যাগুরুবাদের রূপ নেয় যা ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের বিরোধী এবং ফ্যাসিবাদের হুমকি নিয়ে আসে।" এর ফলে জন্য অভ্যন্তরীন শত্রু হিসেবে ভাষা বা ধর্মের ভিত্তিতে সংখ্যালঘুদের লক্ষ্যবস্তু করে তাদের বলির পাঁঠা করা হয়। গত কয়েক বছরে, কিছু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বলির পাঁঠা হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে, এবং দুর্ভাগ্যজনক হলেও প্রচেষ্টাগুলো কিছুটা সাফল্য অর্জন করেছে।শাসনব্যবস্থায় কোনও ব্যর্থতা দেখা দিলেও মনোযোগ সরানোর জন্যেও বলির পাঁঠা প্রয়োজন।সবশেষে অধ্যাপক থাপার আমাদের সতর্ক করেছেন এইধরণের প্রবনতাগুলো সম্পর্কে ও বলেছেন সভ্য সমাজে এই মানসিকতা বর্জনীয়।


শেয়ার করুন