তারিখ: ১ নভেম্বর ,মঙ্গলবার, ২০২২
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় কমিটি ২৯, ৩০ এবং ৩১ অক্টোবর,২০২২ তারিখে নয়াদিল্লিতে বৈঠক করে নিম্নলিখিত বিবৃতি জারি করেছে:
গুজরাটের মোরবিতে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা: গুজরাটের মোরবি শহরে ব্রিজ ভেঙে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারিয়েছে এমন ১৪০ জনেরও বেশি মানুষের পরিবারের প্রতি কেন্দ্রীয় কমিটি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেছে। আহত হয়েছেন আরও অনেকে। আহতদের অবিলম্বে সমস্ত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা এবং সহায়তা প্রদান করতে হবে।
খবরে প্রকাশ, সুরক্ষা অডিট না করেই এই সেতুটি সংস্কারের পর খুলে দেওয়া হয়। উপরন্তু, যে কোনো সময়ে সেতুতে অনুমোদিত লোক সংখ্যার ঘোষিত সীমা মারাত্মকভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছিল।তদুপরি, সংস্কারের বরাত এমন একটি সংস্থাকে দেওয়া হয়েছিল যার এই ক্ষেত্রে কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। এই দিকগুলো জবাবদিহিতা নির্ধারণের জন্য উচ্চ পর্যায়ের বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে।
রাজ্যপালের অসাংবিধানিক আচরণ:
কেন্দ্রীয় কমিটি এলডিএফ সরকারকে বেসামাল করার জন্য ক্ষমতাসীন বিজেপির রাজনৈতিক উদ্দেশ্যগুলিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কেরালার রাজ্যপালের পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা করেছে।তিনি যেভাবে কেরালার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের পদত্যাগ এবং পরে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন তাতে ভারতীয় সংবিধানের কোনো অনুমোদন নেই।রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য হিসাবে রাজ্যপালের আওতায় রাজ্য আইনসভার পাস করা বিশ্ববিদ্যালয় আইন দ্বারা এই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার কোনও ক্ষমতা নেই।
রাজ্যপালের এই পদক্ষেপগুলি কেরালার ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক এবং বৈজ্ঞানিক উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে লক্ষ্য করে হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের এজেন্ডা প্রচারের উদ্দেশ্যেই পরিচালিত।বিজেপি চালিত কেন্দ্রীয় সরকার একই উদ্দেশ্য নিয়েই জেএনইউ, হায়দ্রাবাদ এবং অন্যান্য কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে নিশানা করে চলেছে। কেরালার জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে রাজ্যপালের এই ধরনের নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্বকে প্রতিহত করবে এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত এলডিএফ সরকারকে অস্থিতিশীল করার সমস্ত প্রচেষ্টাকে পরাজিত করবে।
তামিলনাড়ু:
ক্ষমতাসীন ডিএমকে-নেতৃত্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ ফ্রন্ট সরকারের নেতারা রাজ্যপালকে অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক এবং বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে বিজেপির দৃষ্টিভঙ্গীকে প্রতিফলিত করে এমন মতামত প্রকাশ করার জন্য অভিযুক্ত করেছেন। রাজ্যপালের পদে আসীন থেকে এমন রক্ষণশীল ও বিষাক্ত ধারণার প্রকাশ সংবিধান লঙ্ঘনের সমান।
সিপিআই(এম)-এর কেন্দ্রীয় কমিটি সমস্ত অ-বিজেপি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দলগুলিকে, বিশেষ করে যারা রাজ্যসরকার পরিচালনা করছে, রাজ্যপালদের এই ধরনের অগণতান্ত্রিক সংবিধান বিরোধী কাজের বিরুদ্ধে একত্রে সমবেত হওয়ার এবং ভারতীয় সংবিধানের রক্ষায় একত্রিত হওয়ার জন্য আবেদন করে।
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর অবমূল্যায়ন করা:
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, আমাদের সংবিধানের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য এবং বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচিত রাজ্য সরকারের অধিকারগুলিকে দুর্বল করে চলেছে। আইনশৃঙ্খলা একটি রাজ্যের বিষয়। পুলিশের জন্য ‘এক দেশ এক ইউনিফর্ম’-এর মোদির আবেদন তা লঙ্ঘন করে।
নির্বাচিত রাজ্য সরকারগুলিকে অস্থিতিশীল করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে যেমনটি বিজেপির তেলেঙ্গানায় টিআরএস বিধায়কদের বিপুল পরিমাণ অর্থের লোভ দেখানোর চেষ্টায় দেখা গেছে।
গভীর সংকটে ভারতীয় অর্থনীতি:
মোদি সরকারের নীতিগুলি ক্রমবর্ধমান মন্দা প্রবণতার মধ্যে অর্থনীতিকে গভীর সংকটে নিমজ্জিত করছে। বিশ্বব্যাংক তৃতীয়বারের মতো ২০২৩ অর্থবর্ষের জন্য বৃদ্ধির হার প্রাথমিক ৮.৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬.৫ শতাংশ করেছে।একইভাবে, আরবিআই এটি ৭.৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭ শতাংশ করেছে।পরিসংখ্যান মন্ত্রণালয় (অক্টোবর ১২) অনুসারে ৮টি মূল শিল্প ক্ষেত্রে গত বছরের ১৯.৪ শতাংশের তুলনায় শিল্প বৃদ্ধি ১৮ মাসের সর্বনিম্ন নিবন্ধিত হয়েছে এবং মাত্র ৯.৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভারতীয় মুদ্রা বিপর্যস্ত হয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় হ্রাস পাচ্ছে এবং বাণিজ্য ঘাটতি রেকর্ড মাত্রায় প্রসারিত হচ্ছে।
মানুষের উপর অসহনীয় বোঝা:
এই ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সঙ্কটে জনগণের জীবন-জীবিকার উপর আরো দুর্দশা নেমে এসেছে। এমনকি উৎসবের মরশুমেও বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭.৮ শতাংশে।তা সত্ত্বেও, মোদি সরকার MGNREGS-এর জন্য তহবিল বরাদ্দ করতে অস্বীকার করেছিল এবং ১ এপ্রিল থেকে ২১ অক্টোবরের মধ্যে প্রায় ১.৫ কোটি আবেদনকারীদের কাজ প্রত্যাখ্যান করেছিল৷ ২০২২ অর্থবর্ষে ১.৭৩ কোটি কাজ প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল এবং ২০২১ অর্থবর্ষে ২.১ কোটি আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল৷দারিদ্র্য বাড়ছে এবং বিশ্ব ক্ষুধা সূচক ভারতকে ১০৭/১২১ নম্বরে স্থান দিয়েছে,এবং পরিস্থিতিটিকে 'গুরুতর' হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করেছে।
এই দুশ্চিন্তার উপরে আরো আঘাত এসেছে মূল্যবৃদ্ধির জন্য - উপভোক্তা মূল্য সূচকের মূল্যস্ফীতি পরপর ৯ মাস ধরে RBI-এর নির্ধারিত সর্বোচ্চ ৬ শতাংশের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।খাদ্য মূল্যস্ফীতি সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। আর ডাল/আটা/চালের মত মৌলিক খাদ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় গুদামে মজুদ খাদ্য ৫ বছরের সর্বনিম্ন। খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা বাড়ছে।
সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তীব্র করা:
এই অর্থনৈতিক ধ্বংসের কারণে জনগণের এই কষ্ট এবং তাদের দুর্দশা উপেক্ষা করে, মোদি ব্যক্তিগতভাবে জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তীক্ষ্ণ করার জন্য প্রচারাভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বদ্রীনাথ এবং অযোধ্যায় মোদির ধর্মীয় অনুষ্ঠান নিয়ে মিডিয়া তাদের সময় ব্যয় করছে।মুসলমানদের প্রতিনিয়ত কোন না কোন অজুহাতে নিশানা করা হয়। মুসলমানরা ক্রমবর্ধমানভাবে গুরুতর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বিষাক্ত ঘৃণা ও হিংসাত্মক প্রচারের বিস্তার বাড়ছে। গুজরাটের খেড়াতে সাদা পোশাকের পুলিশকর্মীদের দ্বারা মুসলিম যুবকদের প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করা ঘটনা ভয়াবহ।
কেন্দ্রীয় কমিটি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের এই ধরনের তীক্ষ্ণতার বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির ব্যাপক সংহতির জন্য পার্টির আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছে।
জম্মু ও কাশ্মীর:
জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা এবং রাজ্য হিসাবে স্বীকৃতি বিলুপ্ত হওয়ার তিন বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত।কিন্তু এখনও পরিস্থিতি জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও জীবিকার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে চলেছে।
সিপিআই(এম) বাম দলগুলির সাথে জম্মু ও কাশ্মীরের পরিস্থিতি নিয়ে অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির সাথে একটি পরামর্শমূলক প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্যোগ নেবে।
আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনসমূহ:
নির্বাচন কমিশন হিমাচল প্রদেশ এবং গুজরাটের নির্বাচনী দিনক্ষণ ঘোষণাকে পৃথক করায় গুজরাটে আদর্শ আচরণবিধি কার্যকর হওয়ার আগে বিজেপি আরও বেশি সময়ের সুবিধা পেয়েছে। মোদি ব্যক্তিগতভাবে বিজেপির নির্বাচনী প্রচারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন যা মূলত সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে তীক্ষ্ণ করা এবং কেন্দ্রীয় কোষাগারের অর্থ খরচ করে জনগণের জন্য নতুন প্রকল্প এবং সুবিধা ঘোষণা করার দিকে মনোনিবেশ করছে।এই সরকারি প্রকল্পগুলির মধ্যে কয়েকটিকে জনগণের জন্য তাঁর "ব্যক্তিগত দীপাবলি উপহার" হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল। গুজরাটের বিজেপি সরকার অভিন্ন দেওয়ানী বিধি প্রনয়নের অভিপ্রায় ঘোষণা করেছে।
হিমাচল প্রদেশে সিপিআই(এম) ১১ জন প্রার্থীকে মনোনীত করেছে এবং একটি আসনে যেখানে সিপিআই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে,তাদেরকে সমর্থন করেছে। বাকি আসনগুলিতে সিপিআই(এম) বিজেপি প্রার্থীদের পরাজিত করার আহ্বান জানিয়েছে।
গুজরাটে, যেহেতু এখনও নির্বাচনের দিন ঘোষণা করা হয়নি, সিপিআই(এম) বিজেপির পরাজয় নিশ্চিত করতে অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সাথে আলোচনা করছে।
ব্রাজিলে বামেদের বিজয়:
তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে লুই ইনাসিও লুলা দ্য সিলভার বিজয়কে স্বাগত জানিয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটি। স্ব-ঘোষিত ফ্যাসিবাদী ডানপন্থী জাইর বলসোনারোর পরাজয় লাতিন আমেরিকায় বামপন্থীদের জন্য আরও অগ্রগতির লক্ষণ। সমাজতান্ত্রিক কিউবা ছাড়াও চিলি, বলিভিয়া, কলম্বিয়া, পেরু, হন্ডুরাস ইত্যাদি দেশে বামপন্থী রাষ্ট্রপতিরা নির্বাচিত হয়েছেন।
এমভি গোবিন্দন পলিট ব্যুরোতে নির্বাচিত:
কেন্দ্রীয় কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে সিপিআই(এম) কেরালা রাজ্য কমিটির সম্পাদক ড. এমভি গোবিন্দনকে পার্টির পলিট ব্যুরোতে নির্বাচিত করেছে।
কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বান:
কেন্দ্রীয় কমিটি ট্রেড ইউনিয়ান সমূহ,কৃষক সভা, ক্ষেতমজুর ইউনিয়ান গুলির ডাকা মানুষের ক্রমবর্ধমান দুর্দশা ও ১৪ দফা দাবি সম্বলিত দাবিসনদের ভিত্তিতে দেশজোড়া লাগাতার প্রতিবাদ আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে, এই প্রতিবাদের অন্তিম পর্যায় হবে ২০২৩সালের এপ্রিল মাসে সংসদ অভিযান।
জনগণের জীবন জীবিকার ক্রমবর্ধমান বোঝা,দলিত, নারী ও প্রান্তিক জনগণের ওপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণ এবং গণতান্ত্রিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার ওপর হামলার বিরুদ্ধে স্থানীয় সংগ্রাম ও প্রতিবাদ কর্মকাণ্ড জোরদার করার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটি পার্টির সকল ইউনিটকে আহ্বান জানিয়েছে।