৯ জুন নয়াদিল্লির বৈঠক শেষে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র পলিট ব্যুরোর বিবৃতি:
অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন
অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের রায়ে বিজেপি জোর ধাক্কা খেয়েছে। ২০১৪ ও ২০১৯ সালের নির্বাচনে তারা যেমন সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল এবারের নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে সেই পরিস্থিতি আর নেই। ৪০০র বেশি আসনে জয়ী হওয়ার স্লোগানকে সামনে রেখে তারা প্রচার চালিয়েছিল, বিজেপির আসন সংখ্যা হয়েছে ২৪০। গত লোকসভায় তাদের প্রাপ্ত আসন ছিল ৩০৩টি, এবারে তার চাইতে ৬৩টি আসন তারা কম পেয়েছে। অর্থাৎ ২০ শতাংশেরও বেশি আসন তাদের কমেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য জরুরী আসনসংখ্যার চাইতে বিজেপির ৩২টি আসন কম রয়েছে। অবশ্য বিজেপির সহযোগী দলগুলি অতিরিক্ত ৫২টি আসনে জয়ী হয়েছে। এনডিএ জোটের হাতে রয়েছে ২৯২টি আসন, যা প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার চাইতে ২০টি বেশি।
ইন্ডিয়া ব্লকের অন্তর্ভুক্ত দলসমুহ সব মিলিয়ে ২৩৪টি আসনে জয়ী হয়েছে। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠতার চেয়ে ৩৮টি আসন কম। নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্যানুসারে এনডিএ দেশের সবকটি নির্বাচনী ক্ষেত্র মিলিয়ে মোট ৪৩.৩১ শতাংশ ভোট পেয়েছে। ইন্ডিয়া ব্লক দলসমূহের পক্ষে রয়েছে ৪১.৬৯ শতাংশ ভোট পেয়েছে। অর্থাৎ দুটি পক্ষের মধ্যে ভোটের পার্থক্য ২ শতাংশের চাইতেও কম।
বিরোধী দলগুলির উপর ব্যাপক আক্রমণ, কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির নির্লজ্জ অপব্যবহার এবং অর্থ শক্তির ব্যাপক ব্যবহারের মধ্যেই এই নির্বাচনগুলি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নির্বাচনের দোড়গড়ায় দুইজন মুখ্যমন্ত্রীকে জেলে পাঠানো হয়েছে, এবং কংগ্রেস এবং সিপিআই(এম) (কেরালার একটি জেলায়)-এর মত রাজনৈতিক দলগুলির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। এনসিপি এবং শিবসেনার মতো বিরোধী দলগুলিকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল এবং অর্থ শক্তির ব্যবহার এবং কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলির হুমকি ও ভয় দেখানোর মাধ্যমে ভাঙ্গা হয়েছিল। বিজেপি, বিরোধী জোটকে ভাঁঙ্গার জন্য সমস্ত ধরণের রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করেছিল এবং জেডি (ইউ) কে এনডিএ জোটে ফিরিয়ে আনতে সফল হয়েছিল।
নির্বাচন কমিশন যদি সকলের জন্য সমান মান্যতার ভূমিকা পালন নিশ্চিত করত তাহলে ফলাফল বিজেপি এবং এনডিএ-র জন্য আরও খারাপ হত। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা বিজেপির এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে জড়িত ছিল। মোদি সহ একাধিক বিজেপি নেতার জঘন্য সাম্প্রদায়িক ভাষণকে নিরস্ত করার ক্ষেত্রে কমিশনের চরম ব্যর্থতা, প্রকৃতপক্ষে,প্রত্যাখ্যান আদর্শ আচরণবিধিকে অর্থহীন করে তুলেছিল। প্রদত্ত ভোটের তথ্য প্রকাশে কমিশনের প্রাথমিক অনিচ্ছা কারচুপির সন্দেহ উত্থাপন করেছিল, যা এই সাংবিধানিক সংস্থার ভূমিকা মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন করেছে।
এই নির্বাচনের আগে অবধি নিজেদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রচার করার জন্য দেশের মিডিয়ার একটা বিরাট অংশের উপরই বিজেপির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় ছিল। সেই নিয়ন্ত্রনেরই ফলাফল ছিল এক অতিরঞ্জিত এক্সিট পোল। কর্পোরেট মিডিয়ার সাথে আঁতাত করে বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে বিজেপি সমাজমাধ্যমে নিজেদের পক্ষে বিকৃত তথ্য ও ভাষ্য ছড়িয়ে গেছে। ভোটদানকে প্রভাবিত করতে তারা যেমন বিশাল পরিমানে অর্থশক্তিকে ব্যবহার করেছে তেমনই অনেক জায়গায় ভোটারদের মধ্যেও হাজার হাজার কোটি টাকা সরাসরি বিতরণ করেছে।
আমাদের সংবিধান, গণতন্ত্র এবং নাগরিক স্বাধীনতার জন্য আগুয়ান বিপদগুলিকে তুলে ধরার পাশাপাশি ইন্ডিয়া ব্লকের অন্তর্ভুক্ত দলগুলি বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, কৃষি সঙ্কট ইত্যাদির সাথেই মানুষের জীবন-জীবিকার বিষয়গুলিকেই মূল এজেন্ডা হিসাবে প্রচার চালিয়েছিল৷ জীবন-জীবিকার সমস্যাকে সামনে রেখে পরিচালিত এই ব্যাপক সংগ্রাম, বিশেষ করে কৃষকদের লড়াই এবারের নির্বাচনী ফলাফলে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, রাজস্থান, হরিয়ানা এবং পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ পাঁচটি রাজ্যে কৃষিবলয়ে বিজেপি তাদের জেতা আসনের মধ্যেই ৩৮টি আসনে পরাজিত হয়েছে। মোদি সরকার যেভাবে তাদের জীবিকা ধ্বংস করেছে গ্রামীণ ভারত তারই বিরুদ্ধে নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। 'মোদি শাসনের এক দশক' জুড়েই দেশের গ্রামাঞ্চলে প্রকৃত মজুরি কার্যত এক জায়গায় আটকে ছিল। এবারের ফলাফল থেকে স্পস্টই অনুমান করা যায় সারা দেশের ১৫৯টি গ্রামীণ লোকসভা নির্বাচনী ক্ষেত্রে মানুষ আসলে পরিবর্তনের পক্ষে ভোট দিয়েছে।
নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে বঞ্চিত হওয়া সত্ত্বেও মোদির আধিপত্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা জারী থাকবে। ফ্যাসিবাদী কৌশল ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠিত হতে চাওয়া হিন্দুত্ববাদী-কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে জনসাধারনের লড়াইকে আগামী দিনে আরও জোরদার করতে হবে। এই লড়াই সংসদের ভেতরে ও বাইরে চালিয়ে যেতে হবে।
বামেদের ফলাফল
বামপন্থী দলগুলি ৮ জন সাংসদ [সিপিআই(এম) ৪, সিপিআই ২, সিপিআই (এমএল) ২] সহ লোকসভায় নিজেদের উপস্থিতিকে সামান্য হলেও উন্নত করতে পেরেছে। এই নির্বাচনে সিপিআই(এম)-এর ফলাফল প্রসঙ্গে, বিশেষ করে কেরালার ফলাফলে পার্টির পলিট ব্যুরো নিজেদের হতাশা ব্যক্ত করছে। দেশজুড়ে রাজ্য পার্টি ইউনিটগুলির নিজস্ব পর্যালোচনার ভিত্তিতেই পার্টি সামগ্রিক পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা করবে।
NEET পরীক্ষা
NEET পরীক্ষা পরিচালনায় বিভিন্ন অনিয়ম ও অভিযোগ সামনে এসেছে। এধরণের পরীক্ষা পরিচালনায় ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি (এনটিএ)-র তরফে গুরুতর গাফিলতি লক্ষ্য করা গেছে। শিক্ষাক্ষেত্রের নীতি হিসাবে এমন কেন্দ্রীকরণ আমাদের সংবিধানের বোঝাপড়ার পরিপন্থী। শিক্ষা কেন্দ্র ও রাজ্যের অধিকারের যৌথতালিকায় অন্তর্ভুক্ত বিষয়, আমাদের সংবিধান তাকেই স্বীকৃতি দেয়। রাজ্য সরকারগুলির অধিকারকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করার এমন কৌশল কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।
পলিট ব্যুরো দাবি করছে যে সাম্প্রতিক NEET পরীক্ষার সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলির একটি সঠিক তদন্ত করা হোক।