পার্থ মুখোপাধ্যায়
সাল ১৯২১।
মুজফ্ফর আহ্মেদ তখন ৩/৪ তালতলা লেনে থাকতেন।
ডিসেম্বরে শীতের রাতে দশটার মধ্যে শুয়ে পড়লেন। তাঁর সঙ্গে থাকতেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সেদিন তিনি তখন জেগে। সারারাত ধরে পেন্সিল নিয়ে লিখে ফেললেন কালজয়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’। সকালবেলায় কাকাবাবু ঘুম থেকে উঠলে কবি সর্বপ্রথম তাঁকেই শোনালেন।
সেদিনই কবিতাটি শুনে বিজলী পত্রিকার ম্যানেজার অবিনাশ চন্দ্র ভট্টাচার্য্য মহাশয় ছাপার জন্য নিয়ে গেলেন। ৬ ই জানুয়ারি ১৯২২ প্রথম প্রকাশিত হল বিদ্রোহী কবিতাটি।
ঠিক পরের দিন বিজলী পত্রিকার কপি নিয়ে কাজী সাহেব জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি গেলেন। সেখানে পৌঁছে গুরুদেব গুরুদেব করে চিৎকার শুরু করে দিলেন।
ঠাকুর বললেন, ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছ কেন? উপরে এসো।
কাজী সাহেব বললেন তোমাকে খুন করবো, তারপর বাচিক ভঙ্গিতে শোনালেন সেই কবিতা। কবিতা শুনে গুরুদেব তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, হ্যাঁ কাজী তুমি একদিন বিশ্ববিখ্যাত কবি হবে।
পরবর্তীতে ২২শে ফেব্রুয়ারি তাঁর বসন্ত গীতিনাট্য টি বিদ্রোহী কবিকে উৎসর্গ করলেন। তখন নজরুল ইসলাম জেলে। তাঁর সম্পাদনায় ধূমকেতু পত্রিকা থেকে তিনি রাজদ্রোহের অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত।
ব্রাহ্মসমাজে এই নিয়ে হলো তীব্র প্রতিক্রিয়া।ব্রাহ্মসমাজে আসলে কোন লেখা নিয়ে বাইরের কাউকে উৎসর্গ করার রেওয়াজ ছিল না। ঠাকুরবাড়ির সভায় কবিগুরু বলেছিলেন “নজরুলকে আমি বসন্ত গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছি এবং উৎসর্গ পত্রে তাঁকে কবি বলে অভিহিত করেছি”।
কেউ কেউ মন্তব্য করলেন মার মার কাট কাট এ অসির ঝনঝনার মধ্যে রূপ ও রসের প্রলেপটুকু হারিয়ে গেছে।
কবিগুরু বললেন “কাব্যে অসির ঝনঝনা থাকতে পারে না, এও এক অবিচার বটে। সমগ্ৰ জাতির অন্তর যখন বাঁধা অসির ঝনঝনায় তখন ঝঙ্কার তোলে। তখন সেখানে ঐক্যতান সৃষ্টি করছ। তখন কাব্যে তাকে প্রকাশ করবে বৈকি। আমি যদি আজ তরুণ হতাম তাহলে তখন আমার ক্ষেত্রে ঐ সুর বাজত।”
সাল ১৯৩৫।
কবি নজরুল কবিগুরুর কাছে নাগরিক পত্রিকার জন্য একটি লেখা চেয়ে অনুরোধ করলেন। কবিগুরু বয়সের ভারে তখন কিছুটা ক্লান্ত। এক চিঠিতে কবিগুরু সস্নেহে লিখলেন, তার বয়স এখন ৭৫। এই বয়সে পৌঁছতে নজরুলের এখন ঢের দেরী। সময়ের কালে পরস্পরের বয়স যদি অদলবদল হতো তাহলে নজরুল বুঝত এই লেখার যন্ত্রণা কত। কবি চিঠিতে লিখলেন শুনেছি বর্ধমান অঞ্চলে তোমার জন্ম। আমরা থাকি তার পাশের জেলায়। কখনও যদি ঐ সীমা পেরিয়ে এদিকে আসতে পারো খুশি হব। স্বচক্ষে আমার অবস্থা দেখতে পাবে।
এই চিঠির সূত্র ধরে কাজী সাহেব লিখলেন তীর্থপথিক কবিতা।
তাতে লিখলেন,
“হে কবি হে ঋষি অন্তর্যামী আমারে করিও ক্ষমা
পর্বতসম শত দোষ ত্রুটি ও-চরণে হলো জমা”।