২৮শে ফেব্রুয়ারি ব্রিগেড সমাবেশ। রাজ্যের শ্রমজীবী মানুষ কেন ব্রিগেডমুখী হবেন সেই প্রশ্ন নিয়ে সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির ওয়েবটিম হাজির হয়েছিল সিআইটিইউ রাজ্য নেতৃত্বের সামনে। আমরা কথা বলেছি সিআইটিইউ রাজ্য সম্পাদক কমরেড অনাদি কুমার সাহু এবং সিআইটিইউ রাজ্য সভাপতি কমরেড সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সাথে। সেই কথোপকথন এই প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হল।
অনাদি কুমার সাহু
সংগ্রামী জনতার নতুন ইতিহাস লেখা হবে...
১. লকডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বাইরে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকেরা। সেক্ষেত্রে কেন্দ্র এবং রাজ্য দুই সরকারের যে ভূমিকা দেখা গেছে তাতে সেই শ্রমিক পরিবারগুলি এখন কি অবস্থায় রয়েছে?
প্রথম কথা হল লকডাউন একেবারেই অপরিকল্পিত এবং অপ্রস্তুত অবস্থায় ঘোষণা হয়েছিল। অনেকেই ঘুম ভেঙ্গে উঠে জানতে পেরেছে বাইরে বেরনো যাবে না, কাজ বন্ধ। এই মানুষের বেশিরভাগই দৈনিক আয়ের উপরে কিংবা অতি স্বল্প আয়ে পরিবারের খরচ চালান। তাদের কার্যত মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়েছিল এমন অমানবিক সিদ্ধান্ত। কাজের জায়গা বন্ধ হবার পরে তাদের আশ্রয়হীন হতে হল, কেন্দ্র রাজ্য কোনও সরকার তাদের সুরক্ষার সাথে নিজের ঘরে ফেরার দায়িত্ব নেয় নি। এই ঘটনা অভূতপূর্ব। কাজ নেই, রোজগার নেই – লক্ষ লক্ষ পরিবার কিভাবে বেঁচে থাকবে সেই চিন্তা কোনও সরকার করেনি। অসহায় মানুষদের পাশে থাকার শপথ নেয় সিআইটিইউ সহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, প্রগতিশীল ছাত্র, যুব সংগঠন এবং আরও অনেকেই। সেই পাশে থাকার যে নজীর তৈরি হয়েছে তা এক কথায় ঐতিহাসিক। অন্যান্য দক্ষিনপন্থী শক্তির মতো আমরা ভোটের দিকে তাকিয়ে মানুষের লড়াইয়ের সাথী হই না, জীবন জীবিকা রক্ষার লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই আমাদের রাজনীতি। সারা দেশের সাথে আমাদের রাজ্যেও গরীব মানুষ, মেহনতি মানুষ সেই রাজনীতির ভরসা বুকে বেঁধেই লড়াই করছেন।
শহর থেকে গ্রাম, সর্বত্র একই দুর্দশার ছবি। কাজের জন্য হাহাকার, রোজগারের আশায় লক্ষ লক্ষ মানুষ – এদের অনেকে বেকার আবার কারোর কাজা ছিল, হারিয়েছেন। আজ ভারতে বেকারির হার অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙ্গে নিম্নগামী – অর্থাৎ জনগণের অবস্থা শোচনীয়। আমাদের রাজ্যের অভিজ্ঞতা কি? অন্য রাজক্য থেকে ঘরে ফেরা শ্রমিকদের জন্য আমরা হেল্প লাইন চালু করেছিলাম। প্রতিটি গ্রামের প্রতিটি ব্লকের ঠিকানা ধরে কারা কাজ হারিয়ে দুর্দশার শিকার হয়েছেন সেই চিত্র তুলে ধরতে মুখ্যমন্ত্রী, লেবর কমিশনার সকলের কাছে আমরা বিস্তারিত তথ্য পাঠিয়েছিলাম। তার ফল কি হল? রাজ্য সরকার একটি পয়সাও এদের জন্য খরচ করেনি। এদের কোনও সুরাহা হয়নি। এই মানুষগুলি গ্রামে ফিরে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে যুক্ত হতে চেয়েছেন – তাদের সেই সুযোগ দেওয়া হয় নি। আসলে কেন্দ্রের মতোই রাজ্যের সরকারেরও কোনও পরিকল্পনাই ছিল না। এই পরিবারগুলি যথেষ্ট দুর্ভোগ সহ্য করেছেন, এখনও করছেন। শ্রমজীবী মানুষ চিরকালই সংগ্রামরত – তারা সেই যুদ্ধেই রয়েছেন।
২. সারা দেশে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষ যখন শেষ এক বছরে দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন সেই অবস্থায় সিআইটিইউ এবং অন্যান্য শ্রমিক সংগঠনগুলি অসাধারণ ভূমিকা নিয়েছিল। এই থেকে কি আশা করা যায় রাজ্যের শ্রমজীবী জনতা ব্রিগেডমুখী হবেন?
আগেও বলেছি, আমরা ভোটের দিকে তাকিয়ে মেহনতি মানুষের পাশে দাঁড়াই না। সিআইটিইউ সহ বিভিন্ন শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুব - মহিলা সংগঠন মানুষের যন্ত্রণার অবসান চেয়ে তাদের পাশে থেকেছেন। এই ঘটনাকে মানুষের পাশে বামপন্থী সংগঠন হিসাবে দেখা যেতে পারে, কিন্তু আসলে এই ঘটনা হল মানুষের পাশে থেকে মানুষের লড়াই। লড়াই সংক্রমনের সাথে, লড়াই ক্ষুধার সাথে, লড়াই আশ্রয়ের খোঁজে, চিকিৎসার খোঁজে – এক কথায় এই লড়াই জীবন রক্ষার লড়াই। সারা দেশের সাথে আমাদের রাজ্যে মানুষ প্রমান করেছেন – নিপীড়িত, দুরদশাগ্রস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াতে পশ্চিমবঙ্গের জনগন নিজেদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করেছেন। এই ঐক্য একশোয় একশোভাগ সংগ্রামী চরিত্রের। সেই ঐক্যের চেহারাই এবারের ব্রিগেডে আরও স্পষ্ট হবে।
৩. এই ব্রিগেড সমাবেশকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
এই সমাবেশ যখন হবে তখন আমাদের রাজ্যে নির্বাচন ঘোষণা হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতি নিশ্চিতভাবেই কিছুটা নির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণ দাবী করে। আমরা সেভাবেই এই সমাবেশকে দেখব, বিচার করবো। তবে একটা কথা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেছে কেন্দ্র এবং রাজ্য উওভয় সরকারের কাজেই আমাদের রাজ্যের মানুষ ক্ষুব্ধ। রান্নার গ্যাসের দাম, পণ্যের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি এসবে সাধারণ মানুষ ব্যতিব্যস্ত। মুখ্যমন্ত্রী যতই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন ততই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে তার দল এবং রাজ্য সরকারের দিশাহীনতা। কেন্দ্রের সরকার মানুষের কাজ কেড়েছে উল্টে কর চাপিয়ে খরচের বোঝা বাড়িয়ে চলেছে। পেট্রোলিয়ম পণ্যের দাম বাড়লে সবকিছুর দাম বেড়ে যাবে এটা বুঝতে মহাজ্ঞানী হতে হয় না, সাধারণ, সচেতন মানুষমাত্রেই একথা জানেন, বোঝেন। শ্রম কোড বাতিল করে মালিকের মুনাফার স্বার্থ দেখছে মোদী সরকার, আমাদের রাজ্যেও গত দশ বছরে একটা কলকারখানা হয় নি, কাজের সুযোগ কমেছে। সরকারী চাকরিতে নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি আজ সবার চোখের সামনে। এই পরিস্থিতিতে ব্রিগেড সমাবেশ অবশ্যই বিশেষ রাজনৈতিক গুরুত্ব দাবী করে, আমরা সেই গুরুত্ব দিয়েই এই সমাবেশের আয়োজন করেছি। ২৮শে ফেব্রুয়ারি ব্রিগেডের ময়দানে সংগ্রামী জনতার নতুন ইতিহাস লেখা হবে।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়
ঐতিহাসিক ব্রিগেড হতে চলেছে...
সারা দেশসহ আমাদের রাজ্যে প্রধান সমস্যা হল অর্থনৈতিক অবস্থা। এরই প্রভাব পড়েছে কর্মক্ষেত্রে, বেকারত্ব বাড়ছে ক্রমশ। কিছু ডোল দিয়ে সেই সমস্যার সমাধান হয় না। আসলে তো রাজ্যের বেকার যুবসমাজ দিশাহীন। এই কারণেই আমাদের স্লোগান সব হাতে কাজ। গোটা দেশে কি চলছে? একদিকে শ্রম কোড বদল করা হচ্ছে, অন্যদিকে নয়া কৃষি আইন। নিপীড়িত মানুষ - তার আবার জাত কিসের? ধর্ম কিসের? ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সবাই! তার পরিচয় একটাই - আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নিপীড়িত জনতার একজন সে। ধর্মীয় মেরুকরণের আসল উদ্দেশ্য শ্রমিক শ্রেণীকে ভেঙে দেওয়া, কৃষক সমাজকে টুকরো টুকরো করে দেওয়া। হিন্দুত্বের নামে রাষ্ট্র গঠনের কথা বলার রাজনীতির মূল কথা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট আদায়।
আমাদের রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একই কায়দার রাজনীতি করেন, তারও যাবতীয় কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য যেন তেন প্রকারেন ক্ষমতায় টিকে থাকা।
ধর্মনিরপেক্ষ তার কথা আমরা বলছি, ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সেই গনতন্ত্রকে রক্ষা করতে হবে। বামপন্থীদের আহ্বানে খেটে খাওয়া মানুষ ব্রিগেডে আসবেন সেই দাবিতেই।
আজ কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে গোটা দেশে আন্দোলন চলছে, এই আইনের বিকল্প প্রস্তাবনা বামপন্থীরা অনেক আগেই বলেছে। ভূমিসংস্কার যা একমাত্র বামেরাই রাজ্যের সরকারে এসে কার্যকর করেছিল, সারা দেশে সেই কাজ কিছুই এগোয় নি। ভূমি সংস্কার ব্যতিরেকে কৃষিক্ষেত্রে সংস্কার হয় না। আজ তৃনমূল সরকার বলছে দুয়ারে সরকার। হাস্যকর দাবি! গ্রাম সভা, পঞ্চায়েত, কর্পোরেশন, ওয়ার্ড কমিটি এগুলির মাধ্যমেই মানুষ দৈনন্দিন সমস্যা জানাতে পারতেন। সেই ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া হল, আসলে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হল। বিজেপি বলছে ডবল ইঞ্জিনের সরকার চাই। এর থেকে ভয়ংকর কথা হতে পারে না! এর অর্থ কেন্দ্রীয় সরকার ইচ্ছাকৃত ভিন্ন মতাদর্শের রাজ্য সরকারকে যথাযথ সাংবিধানিক সহায়তা দেবে না! আমাদের দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে কেন্দ্র এবং রাজ্যে ভিন্ন দলের সরকার অত্যন্ত স্বাভাবিক। যে সব রাজ্যে বিজেপির সরকার আছে সেখানকার তথ্য কি মানুষকে আদৌ ভরসা দেয়? আসলে বিজেপি কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্কের বিন্যাসকে কেন্দ্রের অভিমুখে সরিয়ে নিতে চাইছে - এটাকেই আমরা একনায়তান্ত্রিক শাসনের দিকে সরে যাবার ইঙ্গিত হিসাবে চিহ্নিত করছি।
কোভিড আরো একবার গোটা পৃথিবীতে পুঁজিবাদের বেহাল দশার চিত্রটা স্পষ্ট করে দিয়েছে। পুঁজিবাদ যে আজকের পৃথিবীতে আর কিছু দিতে পারে না সেকথা মানুষ আরো একবার নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে পারলেন। সারা পৃথিবীর মানুষ যখন সরকারের অসহযোগিতায় দিশাহারা তখন একমাত্র পুঁজিবাদের বিকল্প পথে চলা দেশগুলিতেই সংক্রমণ রোধে সাফল্য দেখা গেল। আমাদের দেশেও কেরলের নজির ভুলে যাওয়া চলে না।
আমরা এই বিকল্পের কথাই বলি, এই বিকল্পের স্লোগানই তুলি। পুঁজিবাদ নিজে সংকটে পড়েছে - সব হাতে কাজ তো দূর চলতি মুনাফা নির্ভর ব্যবস্থায় মানুষের প্রয়োজনে যতটুকু রিলিফের ব্যবস্থা একটা সরকার করতে পারে সেইটুকু ও দেওয়া যাচ্ছে না। আর এখানেই গোটা জনতাকে একজোট করার সূত্রটি রয়েছে। নয়া উদারবাদী অর্থনীতির আক্রমণে গোটা ব্যবস্থাটাই আক্রান্ত। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন তুলে দেবার পরে যেমন খাদ্যের প্রয়োজনে গরীব মানুষের মিছিল অবশ্যম্ভাবী তেমনই এর ফলে কর্মচারীদের ডি এ বৃদ্ধির আন্দোলন ও ক্ষতিগ্রস্থ! অত্যাবশ্যকীয় পণ্যই যদি না থাকে তবে ডি এ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। এই কারণেই মানুষের আন্দোলন আজ এক রেখায় এসে মিলে যাচ্ছে। সেই সমাবেশ ই দেখবে এবারের ব্রিগেড। নিশ্চিত করে বলা যায় অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে জনসমাবেশের সাক্ষী থাকবে মহানগর কলকাতা।