দেবব্রত ঘোষ
এত বড় লেখা, আপনারা রেখে যান, আমি পরে দেখবো, তারপর স্বাক্ষর করবো। আবেদন পত্রটি রেখে আসা হয়, পরদিনই সেই ব্যক্তির কাছে স্বাক্ষর করাতে যারা গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে একজনকে ফোন করে বাড়িতে আসতে বলেন এবং বাড়িতে নিজে সকলের স্বাক্ষর করান। একজন ব্যক্তি বাড়িতে ছিলেন না বলে, তার পাশাপাশি সকল পরিবারের স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হলেও তাকে করানো যায় নি। সেই ব্যক্তি রাস্তায় ছেলেদের কাছে বলে আমি এসেগেছি, তোমরা কাগজ নিয়ে আসো, আমি স্বাক্ষর করবো এবং করলেন। এবার যে উদাহরনে জায়গার নাম না করলে তাৎপর্য বোঝা যাবে না। হুগলী জেলার গোঘাট। যখন স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান চলছে, তখন এক মাংস বিক্রেতা দোকান থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, কি জন্য সই হচ্ছে ? যারা করাচ্ছিলেন তারা বললেন, এককথায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে দোষীদের শাস্তি দিতে এবং দুর্নীতি বিরোধী বিচারগুলির দ্রুত নিস্পত্তির জন্য মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে সারা বাংলায় ১কোটি স্বাক্ষর করে পাঠানো হবে। তখন সেই ব্যক্তি বললেন শুধু আপনারা করাবেন ? আমরা কি করাতে পারবো না ? আমাকে আপনাদের কাগজটা দিয়ে যান, আমি দোকানে রেখে দেবো, অনেকের স্বাক্ষর করে আপনাদের কাছে জমা দেবো। সেই ব্যক্তি এখনও স্বাক্ষর করিয়ে যাচ্ছেন। একটি বাজারে সবজি বিক্রেতা বাবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স, মাস্টার্স, বিএড-এ বরাবর প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ বছর তিরিশের কর্মহীন তাপসের কথা বলতেই হয়। প্রথমদিন তার বাড়িতে স্বাক্ষর করতে গেলে, পুরো বয়ান পড়ার পর তিনি এবং তার বাড়ির লোক দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্বাক্ষর দেন। সেইদিন রাত্রে তাপস তার পাড়ার বামপন্থী কর্মীটির বাড়িতে যান এবং স্বাক্ষর সংগ্রহের একটা সেট চেয়ে নেন। এর দুইদিন পর তার বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে ৪৮জনের স্বাক্ষর করে জমা দেন। আবার এর পার্শ্ববর্তী গ্রামের সংখ্যালঘু জসিম বা ইন্দাদুল যারা কর্মসূত্রে ভিন রাজ্যে বসবাস করেন, স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে এগিয়ে এসে নিজেদেরকে অংশীদার করে নেন স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানের কর্মী হিসাবে। এভাবে প্রতিদিনই বৃত্তটা প্রসারিত হচ্ছে। বর্তমানে সেই বৃত্তটার মধ্যে ঘটছে নতুন রক্তের সঞ্চারণ, আর সেই কাজে আগুয়ান হওয়ার জন্যে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান কর্মসূচী আমাদের মধ্যে সরবরাহ করছে পর্যাপ্ত আত্মবিশ্বাস। এরকম রাজ্যের প্রতিটা প্রান্তে প্রতিদিন প্রচুর অভিজ্ঞতার কথা আসছে। শুধু বাড়ি বাড়ি নয়, কলকারখানার শ্রমিকদের মধ্যে, দোকান মালিক, কর্মচারী, বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক কর্মচারী সহ সর্বক্ষেত্রে যেখানেই পৌঁছানো যাচ্ছে, সেখানেই অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, বাড়িতে গেলে সেখানে তরুণ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা সবচেয়ে আগে এগিয়ে এসে স্বাক্ষর করছেন, গ্রামের গরিব পাড়াতে মহিলাদের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। গ্রামের পর গ্রাম এরকম অভিজ্ঞতাও আসছে যে, কোনো বাড়ি প্রত্যাখ্যান করছে না। স্বাক্ষর সংগ্রহে এই কয়েকদিনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যা উঠে আসছে তা হল-
১। চুরি, দুর্নীতি আমাদের রাজ্যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে, এটা মানুষ বিশ্বাস করছে ২। দুর্নীতির সাথে উন্নয়নের সম্পর্ক আছে এবং এই দুর্নীতির জন্যই ১০০দিনের কাজ, আবাস যোজনার মত কাজ থেকে প্রকৃত উপভোক্তারা বঞ্চিত হচ্ছেন ৩। চুরি, দুর্নীতিতে যেমন এ রাজ্য সরকার দায়ী, সেরকম কেন্দ্রের বিজেপি সরকার আরও বড় দুর্নীতিবাজ একথাও উঠে আসছে ৪। দুর্নীতিতে পঞ্চায়েত, পৌরসভা, ভূমি রাজস্ব দপ্তর সহ সরকারী কর্মচারী এবং পুলিশের একটা বড় অংশ যুক্ত আছে, সে কথা মানুষ বলছেন ৫। আপামর জনসাধারণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ হোক এটা চাইছেন এবং দুর্নীতিগ্রস্ত চোর, নেতা, মন্ত্রী, এম.এল.এ, এম.পি., প্রধান, সদস্য, কাউন্সিলার, চেয়ারম্যান সকলের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি চাইছেন ৬। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতি জনগণের কাছে উন্মোচিত হচ্ছে। শিবপুর বা রিষড়ার ঘটনা দাদা-দিদির সেটিং ছাড়া কিছু না, এ কথা মানুষ বলছেন।
গ্রামবাংলায় তৃণমূল জমানার আগেও নব্যধনীর উত্থান দেখা গেছিল কিন্তু তাদের ধনী হওয়ার ক্ষেত্রটি প্রধানতঃ ছিল ব্যবসা, বাণিজ্য। ব্যতিক্রমি ক্ষেত্র ছাড়া তাদের লুঠেরা, অত্যাচারীর ভুমিকা দেখা যায় নি। ২০১১সালের পর তৃণমূল জমানায় নব্যধনীদের বেশির ভাগটাই রাতারাতি বাড়ি, গাড়ি, জমি, সম্পত্তির শীর্ষে পৌঁছাতে আশ্রয় নেয় রাজনীতির যা ২০১১-র আগে বাম জমানায় ছিলনা। এরা শুধু আশ্রয় নিচ্ছে এমনটা শুধু না, এরা শাসক দলের কর্তৃত্বের আসনে চলে এসেছে। গ্রামের প্রধান, সমিতির সভাপতি, জেলা পরিষদের সদস্য, এম.এল.এ., আবার কেউ কেউ সরকারী পদ না পেলেও দলের অঞ্চল বা ব্লক সভাপতি হয়ে এসব কাজ চালাচ্ছেন। আবার কেউ এসব সরকারী পদে নেই কিন্তু গ্রামের মধ্যে প্রধান দল ও প্রশাসনের প্রধান কর্তৃত্বে এরাই আছেন।
এরাই এখন গ্রামের রাজনীতিকে শাসক দলের পক্ষে নিয়ন্ত্রণে প্রধান ভূমিকা নেয়। অথচ এদের নব্যধনীতে রূপান্তরের পুরো পর্বটাই ব্যাপক চুরি, লুঠ এবং দুর্নীতির মাধ্যমেই ঘটেছে। যা ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বা লুঠেরা পুঁজির বাস্তব দৃষ্টান্ত। নিজেদের ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, আয় কমছে, জিনিসপত্রের, ওষুধের দাম আকাশছোঁয়া, সংসার চালানোয় দুর্বিষহ অবস্থায় পৌঁছে যাচ্ছে, তখন মানুষের মধ্যে এইসব প্রশ্ন এবং ক্রোধও লক্ষ্য করা যাচ্ছে এবং তার প্রতিফলন ঘটছে স্বাক্ষর সংগ্রহে। গ্রামবাংলায় কোন কাজ না থাকায় অনেক ঘটনার মধ্যে দুটি বড় ঘটনা সামনে চলে আসছে। একটি হল, প্রতিদিন হাজার হাজার ছেলে মেয়ে বাইরে চলে যাচ্ছে কাজের জন্য আর অন্যদিকে একটা অংশের যুবকরা বিপথে পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিদিন নেশার ক্ষেত্র বিস্তৃত হচ্ছে, নানা ধরণের অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। এসব বিষয় বাড়ির অভিভাবকদের উপলব্ধি এবং উদ্বেগের মধ্যে আসছে- এটাও স্বাক্ষর সংগ্রহের সময় আলোচনায় উঠে আসছে।
দুর্নীতির সাথে দুষ্কৃতীর যোগসূত্র থাকবে, দুর্নীতি থাকবে অথচ দুষ্কৃতী থাকবেনা, এটা কখনও হতে পারে না। তাই রাজ্য জুড়ে গ্রাম-শহর সর্বত্র দুষ্কৃতী বাহিনীর রমরমা চলছে, দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য থাকবে আর পুলিশের সাথে যোগসাজশ থাকবে না, এটাও হতে পারে না। তাই পুলিশের দলদাস ভূমিকা সম্পর্কে মানুষ মুখ খুলছেন।
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল একটি পাড়ায় ১০০জনের মধ্যে ৯০জন স্বাক্ষর দিলে প্রমাণ হচ্ছে যে যারা বিগত নির্বাচনগুলিতে তৃণমূল বা বিজেপিকে শুধু ভোট দিয়েছেন তাই নয়, বেশকিছু ক্ষেত্রে কর্মীরাও স্বাক্ষর দিচ্ছেন।
তাই যে মাত্রায় মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাইছেন, আমরা যারা এই লড়াই করছি, সেই মাত্রায় কি নিজেদের নিয়ে যেতে পারছি ? সবটা এখনও হচ্ছে না, এটা স্বীকার করে নিতেই হয়, মানুষের আকাঙ্ক্ষা আর আমাদের ভূমিকার মধ্যে যদি কোন ফাঁক থেকে যায়, তাহলে মস্ত বড় ভুল হয়ে যাবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই এবং বিশেষ করে রাজ্য ও কেন্দ্রের দুই চরম দুর্নীতিগ্রস্থ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বামপন্থীদের প্রতি যে বিশ্বাস ও আস্থা দীর্ঘদিন ধরে ধারাবাহিক ভাবে পদযাত্রা, মিছিল, সমাবেশ, আইন অমান্য, জেলা পরিষদ সহ বিভিন্ন সরকারী দপ্তর অভিযানের মধ্যে দিয়ে অর্জন করা গেছে, তাকে আরও শক্তিশালী করতে সব মানুষের কাছে আমাদের পৌছাতেই হবে। কর্পোরেট মিডিয়া ওদের শ্রেণি স্বার্থে, মুনাফার স্বার্থে তৃণমূল ও বিজেপিকে দেখাতে বাধ্য। না হলে রাজ্যে দুর্নীতির দুই পাণ্ডা অভিষেক ব্যানার্জী ও শুভেন্দু অধিকারীর খবর ছাড়া কাগজ ছাপা হয় না কেন ? আরও দুর্নীতির দুই শিরোমণি মোদী ও মমতার এত চাটুকারিতা কেন ? দেশের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি আদানি কাণ্ডে সব মিডিয়া চেপে গেল কেন ? কয়লা, বালি, গরু পাচার, নিয়োগ দুর্নীতির আগে সারদা-নারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত ঠাণ্ডা ঘরে চলে গেল কেন ? কোনদিনই মিডিয়াকে এসব প্রশ্ন নিয়ে ঘণ্টা খানেক আলোচনা করতে দেখা যায় না। ওরা মিডিয়াতে থাকুক, আমরা মানুষের কাছে যাই, মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনের সংগ্রাম চালিয়ে যাই।
বর্তমানে এই রাজ্যে ক্ষমতা কর্তৃত্বের যে স্বেচ্ছাচারিতা চলছে, যার ফল হিসাবে দুর্নীতি শুধু প্রাথমিক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করেছে তাই না, মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটানোর কাজ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে চালু করা হয়েছে, সেটা ভবিষ্যৎ বাংলার সমাজ এবং সভ্যতার ক্ষেত্রে খুবই উদ্বেগের। তাই স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানের উদ্দেশ্য শুধু দুর্নীতি রোধ করা, দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া নয়, একটা বড় উদ্দেশ্য হল ক্ষমতার দম্ভ এবং কর্তৃত্বকে নিরন্তর প্রশ্ন করা, প্রতিবাদ করার জন্য মানুষকে সচেতন করা এবং ঐক্যবদ্ধ করা। যিনি স্বাক্ষর করছেন, তিনি শুধুমাত্র দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্বাক্ষর করছেন না, নীরবে এই বাংলার সমাজ, সভ্যতার অগ্রগতির স্বার্থে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছেন।
মানুষের এরকম সাড়া, যা বহুদিন দেখা যায় নি, তাই এখনই এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে চলুন সবাই মানুষের কাছে যাই, তাদের পরামর্শ গ্রহণ করি। মনে রাখতে হবে মানুষই ইতিহাস রচনা করে, পৃথিবীতে কখনো কোনোদিন কোন স্বৈরাচারী, ফ্যাসিস্ট, চোর, ডাকাত, লম্পট, দুর্নীতিগ্রস্তরা ইতিহাস তৈরি করতে পারে নি, এখানেও পারবে না।