১৫ অক্টোবর ২০২২, শনিবার
পঞ্চম-পর্ব
বদলে গেছিল গ্রামীণ অর্থনীতি। যা না হলে গনতন্ত্রের বিকাশ অসম্ভব ছিল। আর সেই কাজ করেছিল ভূমিসংস্কার।
পঞ্চায়েতের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল ভূমি সংস্কার। কৃষককে পাট্টা দেওয়ার কাজটি হয় ভূমিসংস্কার দপ্তরের উদ্যোগে। এর জন্য জেলাস্তরে, ব্লকস্তরে আছেন ঐ দপ্তরের আধিকারিক। কিন্তু পঞ্চায়েত সমিতির ভূমি স্থায়ী সমিতির বৈঠকেই কারা ভূমিহীন, কোন্ জমির পাট্টা দেওয়া হবে, কত জমি খাস হয়েছে — এই সব সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি ঠিক হয়। তারাই প্রস্তাব পাঠায় ব্লক ভূমিসংস্কার আধিকারিকের কাছে। আর ভূমিহীনের তালিকা, খাসজমির অবস্থা পঞ্চায়েতগুলি পাঠায় পঞ্চায়েত সমিতির কাছে। ফলে তৃণমূলের পরিচালিত পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত সমিতির ভূমি স্থায়ী সমিতি সে কাজ করবে না এটাই স্বাভাবিক।
বামফ্রন্টের পরিচালনার সময় কালে রাজ্যে প্রায় ১৪লক্ষ ৪ হাজার ৯১ একরের বেশি জমি খাস হয়েছে। তার মধ্যে কৃষিযোগ্য জমি ১৩লক্ষ ১৪ হাজারের বেশি। এই একইসময়ে কৃষি ও কৃষিযোগ্য মিলে সারা দেশে খাস হয়েছে ৬৯ লক্ষ ৩ হাজার ৯০৪ একর জমি।
অর্থাৎ সারা দেশের ২০%-র বেশি জমি খাস হয়েছে এই রাজ্যে। অথচ সারা দেশের কৃষি জমির মাত্র ৩%-র অধিকারী পশ্চিমবঙ্গ। জমিদারদের মামলার কারনে মূলত আদালতে বিচারাধীন বলে বিলি করা যায়নি প্রায় ১লক্ষ ৭৮ হাজার ৪৯৫ একর জমির পাট্টা। সারা দেশের ৫৪%-র বেশি পাট্টাদার এই রাজ্যে থাকেন। তাঁদের সংখ্যা ২৯ লক্ষ ৮৫ হাজারের বেশি। এদের মধ্যে তফসিলী জাতিভুক্ত মানুষ প্রায় ১১লক্ষ ১১ হাজার। আদিবাসীদের মধ্যে প্রায় ৫লক্ষ ৩৮ হাজার জন পেয়েছেন পাট্টা। তফসিলী জাতি এবং আদিবাসীরা মিলে মোট জনসংখ্যার ৩০%। অবশ্য ভূমিসংস্কারের ফলে বিলি হওয়া পাট্টার ৫৫% পেয়েছেন তফসিলী জাতি ও আদিবাসী অংশের মানুষ। অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর আওতায় থাকা পাট্টাপ্রাপকদের প্রায় ২৭% সংখ্যালঘু। কিন্তু সংরক্ষিত নন যাঁরা তাঁদের মধ্যে বন্টিত জমির ৩৬.২৪% পাট্টা পেয়েছেন সংখ্যালঘুরাই। প্রায় ৪লক্ষ ৯০হাজার সংখ্যালঘু পাট্টা পেয়েছেন।
অধিকার পেয়েছেন মহিলারাও। রাজ্যে যৌথ পাট্টার অধিকারী হয়েছিলেন ৬লক্ষ ৩ হাজার ৯৮৭টি পরিবার। অর্থাৎ পরিবারের জমিতে মহিলা-পুরুষের সমান অধিকার। আবার স্বামীর মৃত্যু হলে জমির অধিকারী হন স্ত্রীরাই। কিছু ক্ষেত্রে এমনও ঘটেছে। পাশাপাশি ২০১১-র সেপ্টেম্বরের হিসাবে এছাড়াও রাজ্যের ১লক্ষ ৬২ হাজারের বেশি মহিলা একাই জমির মালিক। রাজ্যে বন্টিত মোট জমির প্রায় ৩০%-র উপর মহিলাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
ভূমিসংস্কারের ফল কী?
১৯৭৩-’৭৪ সালে দেশের গ্রামবাসীদের ৫৬.৪শতাংশ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করতেন। পশ্চিমবঙ্গে এই হার ছিল ৭৩.২শতাংশ। ১৯৭৩ থেকে ২০০৫-র মার্চ পর্যন্ত দেশে সবচেয়ে দারিদ্র কমেছে কেরলে। দ্বিতীয় স্থানে পশ্চিমবঙ্গ। এই পরিসংখ্যান রাজ্য সরকারের নয়। ২০০৭-এ জাতীয় নমুনা সমীক্ষার ৬১তম রাউন্ডের ফলাফল প্রকাশ করে ভারতের প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরো। ১৯৯৪-র সাহা-স্বামিনাথানের রিপোর্ট বলছে ১৯৮১-’৮২ থেকে ১০বছরে পশ্চিমবঙ্গে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছিল ৬. ৯%। ধারেকাছে কেরালা ছাড়া আর কোনো রাজ্য নেই।
ভূমিসংস্কার রাজ্যে অনেক মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়িয়েছে। যা একই সঙ্গে উৎপাদন বাড়িয়েছে আবার চাহিদাও বাড়িয়েছে। কারন সারা দেশে যেখানে ক্ষুদ্র ও প্রন্তিক কৃষকের হাতে মোট জমির মাত্র ৪৩%রয়েছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে ৮৪ শতাংশ জমির মালিক ঐ অংশের কৃষকরা। এইসবের সম্মিলিত ফলাফল রাজ্যে ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে আম জনতার।
প্রসঙ্গত ২০০৮-র ডিসেম্বরে প্রকাশিত যোজনা কমিশনের রিপোর্ট ‘ডেভেলপমেন্ট চ্যালেঞ্জেস ইন এক্সট্রিমিস্ট অ্যাফেক্টেড এরিয়াস’ শিরোনামের রিপোর্ট বলছে, সিলিং বহির্ভূত জমি এভাবে বিলি করার কাজ পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, মহারাষ্ট্র ছাড়া কোথাও হয়নি। ঐ রিপোর্ট আরো বলছে — ‘গত তিন দশকে দেশের অধিকাংশ জায়গায় সিলিং বহির্ভূত জমি উদ্ধারের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। ভাবখানা এই যেন সিলিং বহির্ভূত জমি চিহ্নিত করার কোনো সুযোগই নেই।’ ব্যতিক্রম পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরালা। বামফ্রন্টের চোখে ভূমিসংস্কার ছিল এক ঐতিহাসিক কর্মসূচী।
তৃণমূলের কী মনোভাব ভূমিসংস্কার নিয়ে? মমতা ব্যানার্জির সরকারের ২০১১-র ১৮ই অক্টোবর (মেমো নং-আই আর সি/৬২৪/১১)-র নির্দেশিকা বলছে সমস্ত — ‘ভূমিহীনদের মধ্যে মূলত কৃষিজমি বণ্টনের যে ধারায় আগের ভূমি সংস্কার চলেছে, তা থেকে সরে আসতে হবে এবার।’ রাজ্যের জোট সরকারের জমি নীতির সুপারিশকারী কমিটি বলেছে, ‘জমির অবৈধ দখলদারিকে কখনও ভূমি সংস্কার বলা যায় না। বরং এটিকে জমি ডাকাতি বলা যায়। সরকার যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে এই জমি ডাকাতি বন্ধ করতে।’
গরিবের জমির অধিকার হল ‘জমি ডাকাতি।’
ক্রমশ......
পশ্চিমবঙ্গয়ের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক চন্দন দাসের এই প্রবন্ধটি ১২ টি পর্বে প্রকাশিত হবে।