২০ অক্টোবর ২০২২ ( বৃহস্পতি বার)
সপ্তম পর্ব
মমতা ব্যানার্জি তখন কেন্দ্রের বিজেপি জোট সরকারের শরিক। ২০০৩ সাল। মাত্র একবছর আগে স্বাধীনোত্তর ভারতের জঘন্যতম রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পটভূমি হয়েছিল গুজরাট। রাজ্যে সেই পঞ্চায়েত নির্বাচনে তবু বিজেপি-র সঙ্গে জোট গড়েই বামফ্রন্টের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। তাছাড়া কামতাপুরীদের সঙ্গে তৃণমূলের জোট ছিল। জঙ্গলমহলে জনযুদ্ধ, এমসিসি তখন তৃণমূলের সহযোগী হিসাবে সিপিআই(এম) কর্মীদের উপর হামলা চালাচ্ছে।
সেই সময়, গড়ে তুলতে হবে ‘উন্নততর পঞ্চায়েত’ — আহ্বানটি এলো। বামফ্রন্ট তাদের নির্বাচনী ইশ্তেহারে সেই আহ্বান জানালো। বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু। সিপিআই(এম)-র রাজ্য সম্পাদক তখন কমরেড অনিল বিশ্বাস।
‘উন্নততর পঞ্চায়েত’ কী? তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর কাছে এক সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল ‘উন্নততর পঞ্চায়েত বলতে আপনারা কী বোঝাতে চাইছেন?’
ভূমিসংস্কার, ফসল উৎপাদনে অগ্রগতির তথ্য উল্লেখ করে সেদিন ভট্টাচার্য বলেছিলেন,‘‘পঞ্চায়েত যে কৃষিনীতি কার্যকর করেছে, যে ব্যবস্থা নিয়েছে তাতে কৃষি উৎপাদন বেড়েছে।...আমরা বলছি এই সাফল্যকে সংহত করুন।’’ আর? তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর কথায়,‘‘গ্রামে আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, গ্রামে গরিবের হাতে আরও বাড়তি পয়সা।...এই হচ্ছে একটা স্তর থেকে আর একটা স্তরে যাওয়া। উন্নততর স্তরে যাওয়া।’’
সেদিন তিনি বলেছিলেন কৃষি ভিত্তিক শিল্প নিয়ে। তাঁর কথা ছিল,‘‘এখন সুযোগ এসেছে। সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। রাজ্যে পাঁচটি কৃষি রপ্তানি কেন্দ্র গড়ছি। এরকম আরও অনেক কিছু করছি। গত এক দু’বছরে এই অবস্থাটা সৃষ্টি হয়েছে। একে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে। কৃষি থেকে কৃষিভিত্তিক শিল্প। দ্বিতীয়ত, পঞ্চায়েতের যে আরও অনেক কাজ রয়েছে। যেমন গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষা। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ। পানীয় জল, রাস্তাঘাট, স্বাস্থ্যকেন্দ্র এসব কিছুই পঞ্চায়েতের কার্যকলাপের মধ্যে আসছে।’’ অর্থাৎ যে পঞ্চায়েত ভূমিসংস্কারের অনুঘটক, যে পঞ্চায়েত ফসল উৎপাদন বাড়ানোর কান্ডারী, সেই পঞ্চায়েতই এবার কৃষিভিত্তিক শিল্প
গড়ার কারিগর হবে। গ্রামীণ শিল্প থেকে শিক্ষা, বিদ্যুতায়ন, স্বাস্থ্য — পঞ্চায়েতের পরিসর বাড়ানোই ছিল লক্ষ্য।
পশ্চিমবঙ্গের তখন কী অবস্থায় ছিল?
খাদ্যশস্য উৎপাদনে দেশে প্রথম। মাথাপিছু খাদ্যশস্য গ্রহণের বৃদ্ধির হারেও প্রথম। গ্রামের মানুষ বছরে ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি শিল্পপণ্য কেনেন। বছরে তা তখন ১০% হারে বাড়ছে। স্বল্প সঞ্চয়েও রাজ্য তখন প্রথম। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা(২০০০-’০২)-র তথ্য অনুসারে রাজ্যে তখনই ক্ষুদ্রশিল্পের সংখ্যা ২৭লক্ষ ৭০ হাজারের বেশি। সেগুলিতে কর্মরত প্রায় ৫৮লক্ষ ৭০ হাজার মানুষ।
সেই সময়ে বামফ্রন্ট তাদের ইশ্তেহারে লিখল —‘খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত না করে কৃষির আরও বৈচিত্র্যকরণ, মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ বিকাশ, বনসৃজন, কৃষিপণ্য বিপণন ও প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হবে।’ আর কী লিখল? ‘গ্রামীণ ও ক্ষুদ্রশিল্প প্রসারের উপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে পঞ্চায়েতকে আরও নিবিড়ভাবে যুক্ত করা হবে।’
কেন?
কারন — কৃষিতে কাজের সুযোগ কমছিল। কেন্দ্রীয় সরকারগুলির আর্থিক নীতির কারনে চাষে লাভ ক্রমাগত কমছিল। জোত ছোট হচ্ছিল স্বাভাবিক কারনেই। আবার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনস্বাস্থ্যর মত ক্ষেত্রের আরও প্রসারে শুধু মাত্র রাজ্য সরকারের দপ্তর, বিভাগগুলির তৎপরতাই যথেষ্ট থাকছিল না।
ফলে ‘গ্রামের সরকার’-কে আরও শক্তিশালী করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। তাই ‘উন্নততর পঞ্চায়েত’ লক্ষ্য হিসাবে গৃহীত হয়।
আর এখন? পঞ্চায়েত প্রায় নিষ্ক্রীয়। পঞ্চায়েতের প্রতিটি স্তরের কাজ মূলত অফিসারদের কবলে। গ্রামে কাজের হাহাকার বেড়েছে। কিন্তু কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে পঞ্চায়েতের কোনও ভূমিকা নেই। বড় শিল্পের সম্ভবনা গড়ে উঠেছিল ১৯৯৩-’৯৪ থেকেই। তারই ভিত্তিতে গ্রামে ক্ষুদ্র, ছোট শিল্প বিকাশের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। এখন বড় শিল্প গড়ে তোলার কোনও উদ্যোগ রাজ্য সরকারের নেই। ফলে ক্ষুদ্র, ছোট শিল্প শুকিয়ে যাচ্ছে। বাংলা স্বনির্ভর কর্মসংস্থান প্রকল্পের নাম বদলেছেন মমতা ব্যানার্জি। কিন্তু প্রকল্পটি গুটিয়ে দিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী কর্মসংস্থান বিকাশ প্রকল্প(পিএমইজিপি)-তে গ্রামের
অনেক যুবক ঋণ নিয়ে, সরকারের ভর্তুকি পেয়ে স্বনির্ভর হতেন। পশ্চিমবঙ্গ বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে লাগাতার এই প্রকল্পে দেশে প্রথম হয়েছে। কিন্তু এখন এই প্রকল্পে রাজ্যের বাৎসরিক অগ্রগতি খুব কম।
গ্রামীণ সমাজের সঙ্কট সমাধানে পঞ্চায়েতের কোনও ভূমিকাই নেই।
২০০৩-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে ১৭টির মধ্যে ১৫টি জেলা পরিষদে বামফ্রন্ট জিতেছিল। জেলা পরিষদের ৭১২টি আসনে ভোট হয়েছিল। বামফ্রন্ট জিতেছিল ৬১৮টি আসনে। তৃণমূল ১৫টি, বিজেপি ২টি এবং কংগ্রেস ৬৮টি আসনে জিতেছিল। পঞ্চায়েত সমিতির প্রায় ৬৯% আসনে জয়ী হয় বামফ্রন্ট।
ক্রমশ...
পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক চন্দন দাস এর এই প্রবন্ধটি ১২ টি পর্বে প্রকাশিত হবে। পাঠকদের কাছে আবেদন প্রতিবেদনটি পড়ুন ও শেয়ার করুন।