১৩ অক্টোবর ২০২২, (বৃহস্পতি বার)
এবারের স্লোগান —‘লুটেরাদের পঞ্চায়েতকে ফের জনগনের পঞ্চায়েতে পরিণত করো।’
সেবার আহ্বান ছিল —‘বাস্তুঘুঘুর বাসা ভাঙো, জনগনের পঞ্চায়েত গড়ো।’
দুটি স্লোগানের মাঝে ৪৫ বছর পেরোতে চলেছে। পরিস্থিতি ভিন্ন। তবু ‘জনগনের পঞ্চায়েত’ গড়ে তোলাই বামফ্রন্টের মূল লক্ষ্য।
১৯৭৮-র ৪ঠা জুন রাজ্যে প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছিল। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচন হওয়ার কথা আগামী মে-তে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ইঙ্গিত দিয়েছেন আগামী বছরের গোড়ায়, শীতেই তিনি পঞ্চায়েত নির্বাচন করতে চান।
তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ অবস্থা টলমল। মমতা ব্যানার্জির সরকারের বেহাল অবস্থা। দুর্নীতি, চাকরি বিক্রী, সর্বস্তরে কাটমানি, কমিশনের দুঃশাসন তাঁর সরকার কায়েম করেছে। আনিস খানের মত বেশ কয়েকজন প্রতিবাদী নিহত হয়েছেন গত কয়েক বছরে। মানুষের আন্দোলনও প্রবল হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে আগামী জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন মমতা ব্যানার্জি করবেন কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ যথেষ্ট।
তবু, পশ্চিমবঙ্গের এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনও জাতীয় ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব তৈরির দাবি রাখে। ৪৫ বছর আগে এমনটাই, অন্য পরিস্থিতিতে বলেছিলেন বিটিআর। মানে — ভালচন্দ্র ত্রিম্বক রণদিভে।
তিনি মালদহে এসেছিলেন শ্রমিক সমাবেশে। উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহন এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশনের চতুর্দশ বার্ষিক অধিবেসনের প্রকাশ্য সমাবেশ ছিল। সেখানেই বক্তব্য রাখতে এসেছিলেন রণদিভে। তিনি তখন সিআইটিইউ-র সভাপতি।
দিনটি ছিল ১৯৭৮-র ১৩ই মে।
শ্রমিক, কর্মচারীদের আহুত সভা এক বিশাল জনসভায় পর্যবসিত হয়েছিল। রণদিভে সেই সভায় বলেছিলেন,‘‘পঞ্চায়েত নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ স্বৈরতন্ত্রের শক্তি কায়েমী স্বার্থকে পরাস্ত করে এবং গনতন্ত্রের স্বার্থে বামফ্রন্টকে জয়ী করে ভারত জুড়ে নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করবেন। পশ্চিমবঙ্গ আবার ভারতের গনতন্ত্রপ্রিয় মানুষের কাছে নতুন অনুপ্রেরণা যোগাবে।’’
পশ্চিমবঙ্গের প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন সত্যিই পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছিল এক ‘অনুপ্রেরণা।’ গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দেশজোড়া সংগ্রামের এক মশাল। আজও কিছুটা তাই। দেশে গনতন্ত্র আক্রান্ত। সংবিধান সঙ্কটে। রাজ্যেও গনতন্ত্র ধ্বংস করে মানুষের পথ আটকে দাঁড়িয়েছে ‘অনুব্রতর উন্নয়ন।’ কোনও সন্দেহ নেই — বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফলও দেশের যে কোনও প্রান্তে লড়াকু, প্রতিবাদী মানুষের কাছে নতুন অনুপ্রেরণার উপাদান হতে পারে। কারন — পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম)সহ বামপন্থী শক্তির অগ্রগতি এবং নির্বাচনী সাফল্য ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করবেই।
৪৫ বছর আগে তাই হয়েছিল। সেদিনও তৃণমূলস্তরে শক্তিশালী বামপন্থী শক্তির অভ্যুদয় পরবর্তীকালে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এবারও সেই সম্ভবনা প্রবল। তাই — পশ্চিমবঙ্গে এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে আসলে প্রবল ভাবে জড়িয়ে আছে দেশের শ্রমজীবী, গরিব, মধ্যবিত্ত মানুষের আশা। জড়িয়ে আছে দেশ।
পশ্চিমবঙ্গে ‘গ্রামের সরকার’ গড়ার নির্বাচন এবার অনেকটাই সরাসরি দেশের নির্বাচন। দেশের সরকারকে হুঁশিয়ারি দেওয়ার নির্বাচন!
‘রাজ্যের সরকার’র কথা বাদ পড়ল? হ্যাঁ — বাদ দিলাম। কারন দেশের আর রাজ্যের সরকারের মধ্যে নীতির কোনও প্রভেদ নেই। ফলে বিজেপি-কে হুঁশিয়ারি দেওয়ার মানেই মমতা ব্যানার্জির শাসনকে কড়া চ্যালেঞ্জ জানানো।
মমতা ব্যানার্জি আর বিজেপি-র নীতি এক কেন — এর ভালো উত্তর আছে ‘গ্রামের সরকার’-এই। এরা দুজনেই পঞ্চায়েতকে ‘গ্রামের সরকার’ মানেন না। দু’জনের কাছেই পঞ্চায়েত মানে লুটের আখড়া। তাই রাজ্যে পঞ্চায়েত, ব্লকস্তরে মানুষের দাবি নিয়ে বিজেপি-র মিছিল, সভার বিশেষে উদাহরণ নেই।
গ্রামের লড়াই, গ্রামবাসীদের লড়াই — মূলত বামপন্থীদের। বিশেষত সিপিআই(এম) এবং কৃষক সভা, যুব ফেডারেশনের মত সংগঠনগুলির।
কেন?
আবার ১৯৭৮-এ ফিরবো। এবার কাঁথিতে। তখন মে’র গোড়া। গণশক্তি তখন সান্ধ্য। কলকাতার প্রায় কোন সংবাদপত্রেই কাঁথি ‘দূরবর্তী এলাকা।’ দিনের খবর সেই দিনই প্রকাশ করার সুযোগই প্রায় ছিল না। মে-র গোড়াতে বেশ কয়েকটি সভা হয়েছিল। তার একটি সভা হয়েছিল কাঁথির রাখাল বিদ্যাপীঠে। সভাগুলিতে বক্তা ছিলেন কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত। ছিলেন বিমান বসু এবং অন্যান্যরা। গণশক্তিতে সেই খবর প্রকাশিত হয় ৫ই মে, ১৯৭৮-এ।
সেদিন কাঁথির সভাগুলিতে সিপিআই(এম)-র তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক, বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান প্রমোদ দাশগুপ্তর আহ্বান ছিল,‘‘গ্রামে গ্রামে গরিব-মধ্যবিত্তের পঞ্চায়েত গড়ে তুলুন।’’ এই আহ্বানের ব্যাখ্যায় দাশগুপ্ত বলেন,‘‘আমরা এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গ্রামের জনকল্যাণমূলক কাজে গ্রামের গরিব-মধ্যবিত্তদের ভূমিকার স্বীকৃতি দিতে চাই।...গ্রামের বিত্তশালী, বৃহৎ ভূস্বামীর দল এই ঘাঁটিগুলি আঁকড়ে রয়েছে। তারা গরিব জনগনের উপর অত্যাচার করছে, শোষণ করছে।...কায়েমী স্বার্থবাদীদের হাতে পঞ্চায়েতগুলি যাওয়ার অর্থ হলো, গরিব-মধ্যবিত্তদের উপর শোষণ অব্যাহত থাকা। গ্রামের মোড়লদের দাপট অব্যাহত থাকা। আমরা এই ব্যবস্থার অবসান চাই।’’
‘ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ’ শব্দ দুটি একবারও উচ্চারণ না করে কিভাবে গ্রামের ভালোমন্দের দায়িত্ব গরিব, মধ্যবিত্তদের হাতে বামফ্রন্ট তুলে দিতে চায়, কী কী করতে চায় — বক্তৃতাটিতে তা বুঝিয়েছিলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত।
১৯৭৮-এ, পঞ্চায়েতের সেই নির্বাচনেও একটি স্লোগান হয়ে উঠেছিল মানুষের মনের কথা — ‘বাস্তুঘুঘুর বাসা ভাঙো, জনগনের পঞ্চায়েত গড়ো।’
সেই লক্ষ্যপূরণে দুর্দান্ত ভূমিকা পালন করেছিলেন তরুণ প্রজন্ম। খেতমজুর, কৃষকসহ শ্রমজীবী মানুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিলেন তাঁরা। কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্তর কথায় — ‘গৌরবজনক ভূমিকা’!
সেই নির্বাচনের পরে একটি প্রবন্ধ লেখেন প্রমোদ দাশগুপ্ত। তিনি তখন সিপিআই(এম)-র রাজ্য সম্পাদক, বামফ্রন্টের(তখন বেশি ব্যবহৃত হত ‘বামপন্থী ফ্রন্ট’) চেয়ারম্যান। তাঁর প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল ‘পঞ্চায়েত ও গণউদ্যোগ।’ প্রবন্ধটির নিচে তারিখ— ১লা আগস্ট, ১৯৭৮।
সেই প্রবন্ধটির প্রথম ভাগে পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর্যালোচনা ছিল। পর্যালোচনায় চারটি পয়েন্ট ছিল। তার একটিতে তরুণ প্রজন্মের ভূমিকার কথা তুলে ধরেন তিনি। তাঁর লেখায়,‘‘বিগত রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের সময় থেকেই বহু সংখ্যক যুবক-যুবতী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি(মাঃ)-র পতাকাতলে সমবেত হতে থাকেন। তাঁরা গনতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন, ছাত্র ফেডারেশন, কৃষক সভা, মহিলা সমিতি প্রভৃতি গণসংগঠনের সদস্য পদ অর্জন করেন এবং গনতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে থাকেন। পঞ্চায়েত নির্বাচনে তাঁরা খুবই গৌরবজনক ভূমিকা পালন করতে থাকেন। প্রতিটি গ্রাম প্রতিটি এলাকায় শত শত যুবকর্মীকে নিয়ে নির্বাচনী কর্মীদল গড়ে ওঠে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামপন্থী ফ্রন্টের সাফল্যে এঁদের ভূমিকাও অনস্বীকার্য।’’
এবারও জনগনের পঞ্চায়েত ফের গড়ে তোলার সংগ্রামে সামনের সারিতে এসে দাঁড়িয়েছে ছাত্র,যুব সমাজ। কলেজস্ট্রীট, ধর্মতলায় তাঁদের সমাবেশের মেজাজ গ্রামের সরকার গড়ে তোলার অন্যতম অনুঘটক হবে।
ক্রমশ.........
পঞ্চায়েত ব্যবস্থা নিয়ে লেখক চন্দন দাসের লেখা আনুমানিক বারোটি পর্বে প্রকাশিত হবে সম্পূর্ণ লেখাটি পেতে ওয়েবসাইটে নজর রাখুন...