মুখবন্ধ
পশ্চিমবঙ্গ কবিতা আদাদেমি একটি সরকারী প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি তার কার্যধারা প্রসঙ্গে বেশ কিছু অভিযোগ সামনে এসেছে, বিভিন্ন মাধ্যমে অনেকেই আকাদেমির কাজের বিষয়ে বেশ কিছু জরুরী প্রশ্ন তুলেছেন। শিল্প, সাহিত্যের প্রসঙ্গে দেশ কিংবা রাজ্য সরকারের ভূমিকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কেন? কারণ নয়া-উদারবাদী জমানায় মানুষের কল্যাণে সরকারের যাবতীয় ভূমিকাকেই অস্বীকার করা হয় এবং তারই অভিঘাতে আমাদের দেশেও যাবতীয় প্রগতিশীল, এমনকি জনকল্যাণে কার্যকর হিসাবে ইতিমধ্যে প্রমাণিত সিদ্ধান্তসমূহকেই খারিজ করে দেওয়া হয়। ভারতে নয়া-উদারবাদের তিন দশক পেরিয়েছে, সিপিআই(এম) সহ অন্যান্য বামপন্থী দল ও গণতান্ত্রিক মানুষজন বারংবার এর কুপ্রভাব প্রসঙ্গে সোচ্চার হয়েছেন, এখনও হচ্ছেন। সেই আবহেই পশ্চিমবঙ্গে কবিতা আকাদেমির মতো কোনও সংস্থার বিরুদ্ধে যখন কবি, সাহিত্যিকরাই সমালোচনা করছেন তা অন্যদেরও জানা উচিত। সরকারী নীতি, শিল্প-সাহিত্য কোনও প্রসঙ্গেই রাজ্যের মানুষকে অন্ধকারে রাখা চলে না। তাই রাজ্য ওয়েবসাইটের তরফে আমরা যোগাযোগ করি কবি, গবেষক তন্ময় ভট্টাচার্যের সঙ্গে। তিনি ইতিমধ্যেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন। কবিতা ছাড়া অন্যান্য বিষয়েও তার নিজের লেখা ও সম্পাদিত বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। আজকের এই প্রতিবেদনে তন্ময় তুলে ধরেছেন পশ্চিমবঙ্গ কবিতা আকাদেমি কী, কেন এবং এমন সংস্থার কাজ কেমন হওয়া উচিত।

তন্ময় ভট্টাচার্য
সম্প্রতি, কিছু বিতর্ক ও অভিযোগের সূত্রে আলোচনায় উঠে এসেছে পশ্চিমবঙ্গ কবিতা আকাদেমি। ২০১৬’তে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অনুপ্রেরণা’-য় যাত্রা শুরু এর, সুবোধ সরকারের সভাপতিত্বে। সেই হিসেবে, নবম বর্ষ চলছে এখন। চলতি বিতর্কে যাঁরা কবিতা আকাদেমির কার্যপদ্ধতির বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন, দুর্নীতির অভিযোগের পাশাপাশি তাদের অন্যতম বক্তব্য- ২০২৫ সালে ‘কবিতা উৎসব’ আয়োজিত হয়নি কেন। আর এই নিয়েই বিগত কয়েক সপ্তাহে ঝড় বয়ে চলেছে বাংলা সাহিত্যমহলের একাংশে।
প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নথিতে কবিতা আকাদেমির করণীয় বা লক্ষ্য সম্পর্কে কী লেখা রয়েছে-
‘The Paschimbanga Kabita Akademi is a government academy formed under the I & CA Department for development of Bengali poets and to popularize Bengali poems among the Bengali diasporas. The Academy also performs for awareness of good recitation of poems through workshops and competitions. The academy also organizes programmes and seminars for propagation of Bengali poetry and its recitation.’
সহজ করে বললে, বাঙালি কবিদের উন্নয়নকল্পে এবং বাংলাভাষীদের মধ্যে বাংলা কবিতা জনপ্রিয় করে তোলার লক্ষ্য নিয়েই জন্ম কবিতা আকাদেমির। পাশাপাশি, ওয়ার্কশপ ও প্রতিযোগিতার মাধ্যমে উত্তম মানের আবৃত্তিশিল্পের সচেতনতা বাড়াতেও ভূমিকা রয়েছে এর। এছাড়াও, বাংলা কবিতা ও আবৃত্তির প্রচারের জন্য অনুষ্ঠান (উৎসব) ও সেমিনারের আয়োজনও করে থাকে এই সংস্থা।
সরকারি এই বয়ান থেকেই উঠে আসে মৌলিক কিছু প্রশ্ন। বাঙালি কবিদের উন্নতিকল্পে এই আকাদেমির ভূমিকা ঠিক কী? ২০১৬-পূর্বের দীর্ঘ সময়ে, কবিতা আকাদেমির সাহায্য ছাড়াই অজস্র বাঙালি কবি উজ্জ্বল হয়েছেন। আকাদেমির সময়কালেও, সংস্থাটির ন্যূনতম সংস্পর্শ ও সাহায্য ছাড়াই লিখেছেন এবং পরিচিত হয়েছেন অনেকে। বরং আকাদেমির দৌলতে কোনও কবির কবিতাচর্চার উন্নয়ন হয়েছে- এমন উদাহরণ দুর্লভ। পরিচিতি অবশ্য বাড়তে পারে, জনসংযোগও- সে-কথা আলাদা। কোনও আকাদেমি বা সংস্থা কীভাবে একজন কবির উন্নতি করতে পারে? উল্টোদিক থেকে প্রশ্ন করলে, একজন কবি কীভাবে লাভবান হতে পারেন এমন একটি সংস্থার দ্বারা? তা হতে পারে কবি হিসেবে সরকারি ডাক পাওয়া, নিজের কবিতা অন্যদের শোনানো, হতে পারে অপরের কবিতাপাঠ বা কবিতা-সংক্রান্ত আলোচনা শুনে ঋদ্ধ হওয়া ইত্যাদি। এগুলি না-পেলে একজন কবি নিজেকে অপূর্ণ মনে করতেই পারেন, কিন্তু এগুলির কোনোটিই কবিতাচর্চার প্রাথমিক প্রয়োজন নয়। হতে পারে না।
সাম্প্রতিক বিতর্কের আবহে বেশ-কিছু মানুষ মুক্তকণ্ঠে জানিয়েছেন, কবিতা আকাদেমি তাঁদের খুঁজে বের করে কবিতাপাঠের আহ্বান জানিয়েছে বিগত বছরগুলিতে। এ-আহ্বান তাঁদের কবিতাচর্চার স্বীকৃতি পাওয়ার সমান-
এমনই মনে করেন তাঁরা। এই মনে করায় অন্যায়ও কিছু নেই। একজন তরুণ কবিতাপ্রয়াসী যদি সরকারি আয়োজনের অংশ হতে পারাকে তাঁর কবিতাচর্চার অর্জন মনে করেন, তাতে সমালোচনারও কিছু দেখি না। কিন্তু সেটাই কবিতা আকাদেমির অনুগত হওয়ার একমাত্র কারণ হতে পারে না। ঠিক যেমন অংশ না-হওয়ার কারণে ক্ষোভও কাম্য নয়। কবিতা উৎসবের আয়োজন ক্ষেত্রবিশেষে জরুরি, বিভিন্ন নবীন কবিতাপ্রয়াসীকে উৎসাহ প্রদানের জন্যেই, কিন্তু তা-ই কবিতা আকাদেমির প্রধান কাজ হতে পারে না। বরং কবিতা-কেন্দ্রিক একটি সরকারি সংস্থার ভূমিকা হওয়া উচিত আরও বৃহৎ।
বর্ণাঢ্য কবিতা উৎসবের আয়োজন না-করে, সেই অর্থ অন্যান্য কী কী গঠনমূলক খাতে ব্যবহার করা যেতে পারে, তা এবার ভেবে দেখা যাক-
১। অনলাইনে কবিতার বইয়ের একটি উৎকৃষ্ট আর্কাইভ তৈরি করা, গত একশো বছরের, দশক ধরে-ধরে। বহু কবি বিস্মৃত, বহু বই বিলুপ্ত। সেগুলো সংগ্রহ করে, ডিজিটাইজ করে, ওপেন অ্যাকসেস দেওয়া। দশকের পাশাপাশি, কবির নামের আদ্যাক্ষর ধরে বইয়ের ক্যাটাগরাইজ করা এবং একজন কবির সমস্ত বই-ই যাতে সেই ডিজিটাল আর্কাইভে থাকে, সে-ব্যবস্থা করা। সেইসঙ্গে, কাব্যগ্রন্থের ডিটিজাল ভার্সনের পাশাপাশি টেক্সট ভার্সনও রাখা, যা যে-কোনও শব্দ বা বাক্য চিহ্নিতকরণে কি-ওয়ার্ড হিসেবে কাজ করতে সক্ষম হবে। এই সামগ্রিক উদ্যোগ সফল হলে, কবি-পাঠক-গবেষক সকলেই উপকৃত হবেন, কবিতার ইতিহাসের সমৃদ্ধ ভাণ্ডারও গড়ে উঠবে।
২। পত্রিকা নয়, অনলাইনেই বাংলা কবিতার ইংরাজি অনুবাদের আর্কাইভ তৈরি করা, বিভিন্ন কবির, এবং তা বিশ্বব্যাপী অবাঙালি পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। বহু বাঙালি কবি বাংলা থেকে ইংরাজি অনুবাদক হিসেবেও দক্ষ। তাঁদের ব্যবহার করা, অবশ্যই উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে। বাংলা কবিতার গণ্ডি বিস্তারের ক্ষেত্রে অনুবাদের পদক্ষেপ তুলনাহীন।
৩। অগ্রজ কবিদের নিয়ে মানসম্মত তথ্যচিত্র তৈরি করা, নিদেনপক্ষে পডকাস্টের আয়োজন করা। এখনও দেবদাস আচার্য, কালীকৃষ্ণ গুহ, অমিতাভ গুপ্ত সহ বহু কবি রয়েছেন। ওই সংস্থা যখন তৈরি হয়েছিল, তখনও মণীন্দ্র গুপ্ত, শঙ্খ ঘোষ, দেবারতি মিত্র, গৌতম বসু প্রমুখ জীবিত ছিলেন। তাঁদের ভাবনাচিন্তা, কবিতা, জীবনদর্শন ইত্যাদি নিয়ে উপযুক্ত তথ্যচিত্র তৈরি করা হয়নি। যাঁরা আজও রয়েছেন, তাঁদের নিয়ে এই পথে আকাদেমির ভাবনাচিন্তা করা প্রয়োজন।
৪। প্রতি বছর অসংখ্য কবিতার বই প্রকাশিত হয়। কবিতা আকাদেমির উচিত নির্বাচিত বইপত্র সংগ্রহ করে একটি লাইব্রেরি গড়ে তোলা। রাজ্যজোড়া গ্রন্থাগারগুলিতে পৌঁছে দেওয়ার দাবি অর্থহীন, কেন-না গ্রন্থাগারগুলি এমনিতেই ধুকছে, তদুপরি কবিতার পাঠক সংখ্যালঘু। ২০০০-পরবর্তী কবিতার বই নিয়ে সরকারি উদ্যোগে কলকাতা শহরে একটি লাইব্রেরি গড়ে তোলা গেলে, তা পাঠক-গবেষক-ছাত্রছাত্রীদের উপকারে লাগতে পারে। সুদূর ভবিষ্যতে বইগুলি ডিজিটাইজ করার পথও খোলা।
৫। সবচেয়ে জরুরি যেটি, পাঠকের পরিধি বাড়ানো। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি জনসংখ্যার বড়োজোর ১ শতাংশ জীবনানন্দ-উত্তর বাংলা কবিতা পড়েন, তার মধ্যেও অধিকাংশই বহুপ্রচারিত ও জনপ্রিয় কবির কবিতা। সেসব বাদ দিলে, সংখ্যাটি ১-২ লাখে এসে দাঁড়াবে। বর্তমানের অধিকাংশ কবির যাবতীয় লেখালিখির সর্বোচ্চ পাঠকসীমা এই ০.১ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গীয় পাঠকই। এর বাইরে বাংলা কবিতার সিরিয়াস/ধারাবাহিক পাঠক নন এমন মানুষের মধ্যে অল্প-অল্প করে সমসময়ের কবিতার স্বাদ পৌঁছে দেওয়া সর্বাগ্রে উচিত। আবৃত্তি একটি পথ হতে পারে, কিন্তু একমাত্র পথ নয়, কেন-না আবৃত্তিশিল্প একটি নির্দিষ্ট গোত্রের কবিতাই ধারণ ও বহন করতে পারে মাত্র। সরকারি বয়ানে যে 'বাংলাভাষীদের মধ্যে বাংলা কবিতা জনপ্রিয় করে তোলার' লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে, কবিতা আকাদেমি সে-পথে পাঁচ শতাংশও এগিয়েছে কিনা, সন্দেহ। একটি নির্দিষ্ট চর্চিত বৃত্তের মধ্যেই ঘোরাফেরা সংস্থাটির (একই কথা কবিতা-কেন্দ্রিক অন্যান্য সংস্থা ও প্রকাশনীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য)। সেই গণ্ডি ভেঙে বৃহত্তর পরিসরে পৌঁছোতে না-পারলে, চর্বিতচর্বণ ছাড়া কিছুই হবে না।
যারা শুধুমাত্র কবিতা উৎসব আয়োজনের পক্ষে এবং সে-কারণেই কবিতা আকাদেমিকে সমর্থন করেন, ওপরের প্রস্তাবগুলি কার্যকর হলে দীর্ঘমেয়াদে উপকৃত হবেন তাঁরাও। সরকারি একটি সংস্থার কাছে কবিতাপ্রেমীদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। বছরভর সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে অনেকেই কবিতা উৎসবের আয়োজন করেন; কবিতা আকাদেমি সে-পথে না-হাঁটলে বিশেষ ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। কিন্তু আর্কাইভ তৈরি ও জনগণকে পাঠের দিকে (রচনার দিকে নয়, কবি-সংখ্যার কমতি নেই এ-রাজ্যে) আকৃষ্ট করার উদ্যোগ সফল হলে, আখেরে লাভবান হবে বাংলা কবিতাই। কবিতা আকাদেমির মতো সংস্থা আদৌ প্রয়োজনীয় কিনা- এ-তর্ক জরুরি, কিন্তু তার চেয়েও জরুরি সংস্থাটির কার্যক্রম সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা। কেন-না কবিদের প্রত্যক্ষ উপকার করতে এ-জাতীয় সংস্থার ভূমিকা কম; কবিতা মূলত ব্যক্তির নিজস্ব চর্চার ফসল।
অতএব, কবিতা উৎসব আয়োজন ইত্যাদি তাৎক্ষণিক ও প্রত্যক্ষ উদ্যোগে না-জড়িয়ে, সংস্থাটি যত তাড়াতাড়ি গঠনমূলক ও স্থায়ী কার্যক্রমে মনোনিবেশ করবে, ততই উপকৃত হবে বাংলা কবিতা। অভিযোগ ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে, ব্যক্তিস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে বাংলাভাষার স্বার্থে কবিতা আকাদেমি উল্লিখিত প্রস্তাবগুলি কার্যকর করার লক্ষ্যে এগোক- এই দাবি রইল।
ব্যবহৃত ছবি সোশ্যাল মিডিয়া সুত্রে সংগৃহীত
ওয়েবডেস্কের পক্ষে মুখবন্ধঃ সৌভিক ঘোষ