৫ জুন ২০২২, রবিবার
এবছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসে ইউএনইপি (United Nations Environment Programme)-র আহ্বান “একটিই বিশ্ব”, স্বাভাবিক ভাবে এই বিশ্বকে প্রাণের উপযোগী করে রাখার দায়িত্ব আমাদের। এ যেন ফাঁসির কাঠগড়ায় এক আসামীর স্বীকারোক্তি। পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশের হত্যাকারি এই ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা। রাষ্ট্র সঙ্ঘের কর্তাদের ভাবের ঘরে চুরির এ এক নতুন কৌশল।
এই কৌশলী ব্যবস্থার বিরোধিতা করতে ২০২১ সালে গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনের সময় শহরের রাস্তায় পরিবেশ কর্মিদের মিছিলের আহ্বান ছিল “Change the System, not The Climate”। ব্যবস্থার পরবর্তন করো, জলবায়ুর নয় - সেই ব্যবস্থা যা আমাদের প্রাকৃতিক পুঁজি (natural capital) কে ব্যক্তি মুনাফার উৎস হিসাবে বিচার করে। ইতিমধ্যে প্রকাশিত ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (IPCC) বা আইপিসিসি-র ষষ্ঠ রিপোর্টের প্রথম ওয়ার্কিং গ্রুপ (Physical science basis)-এর প্রতিবেদন জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ তথ্য হাজির করেছে। ২য় দল (Adaptation) এবং ৩য় দল (Mitigation)-এর প্রতিবেদন এই ভয়াবহ ভবিষ্যৎ থেকে মুক্তির পথ বাতলেছে।
একটি সহজ সত্য আমদের বুঝতে অসুবিধা হয়না। এবছর স্টকহোম সম্মেলনের অর্ধ শতবর্ষ। ১৯৭২ সালে প্রথম প্রায় ২০০টি দেশের রাষ্ট্র নায়করা স্টকহোমে রাষ্ট্র সঙ্ঘের হিউম্যান এনভায়রনমেন্ট (Human Environment) সম্মেলনে পরিবেশ রক্ষার আলোচনায় সম্মিলিত হন। তারপর ১৯৯২ এর বসুন্ধরা সম্মেলন, বছর বছর জলবায়ু পরিবর্তনের সভা, কত প্রতশ্রুতি, কিন্তু আন্তর্জাতিক ভাবে আইন সম্মত কোনও চুক্তি (legally binding treaty) হয়নি। অথচ ১৯৮০র দশকের শুরুতে বাজার অর্থনীতি এবং বিশ্বায়নের অন্যান্য পরিকল্পনার সূত্রপাত হয়। পরে ডাঙ্কেলের প্রস্তাব (Dunkel draft text) এবং গ্যাট চুক্তি এইভাবেই ধাপে ধাপে মাত্র ৮/৯ বছরে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO)-এর মত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা তৈরি হয়ে যায়। এই চুক্তি ভঙ্গ করলে হেগ শহরের আন্তর্জাতিক আদালতে ডাক পড়বে। এই সত্যই বাজার অর্থনীতির পরিবেশ রক্ষা উদ্যোগের আসল চেহারা।
কার্বন বানিজ্য কি মুস্কিল আসান?
পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এখন গভীর সংকটে। নতুন করে এই সংকট থেকে মুক্তির জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের নতুন পথ খুঁজছে। মানুষের এই আসন্ন দুর্দশাকে মুনাফার জন্য ব্যবহার করার সমস্ত লক্ষণ ‘কার্বন বাণিজ্যে’র মধ্যে অন্তর্নিহিত। কার্বন বাণিজ্যের সহায়ক হয়ে উঠেছে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে অনুষ্ঠিত সম্মেলন গুলি। এই সংকটের পথ হিসাবে সবুজায়নের নামে 'কার্বন-ভাণ্ডার’ নির্মাণ-কেন্দ্রিক পদক্ষেপ একদিকে অরণ্য বাস্তুতন্ত্র এবং অন্যদিকে অরণ্যবাসীদের অরণ্য সম্পদের উপর অধিকারকে বিপদের মুখে ফেলতে চলেছে। সরকারের প্রথম লক্ষ্য হলো, দেশের প্রায় ২৪ শতাংশ জুড়ে যে বনভূমি আছে তাকে আরও কঠোর আইন দিয়ে বেঁধে ফেলা এবং অরণ্যে স্ট্রাকচারাল আডজাস্টমেন্টের মাধ্যমে কর্পোরেট অনুপ্রবেশকে সুনিশ্চিত করা। এটা করতে পারলে অরণ্য সম্পদের বাণিজ্যিকীকরণের পথ আরও সহজ হবে।
আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার বলছে যে দেশের ৪০ কোটি মানুষ অরণ্যের উপর নির্ভর করেন। তাসত্ত্বেও এদেশের কার্বন শোষণের নামে অরণ্য বানিজ্যিকরনের পথে সরকার অনেকটা এগিয়ে। যদি সরকার তা করতে পারে দেশের বনবাসী আদিবাসীদের অরণ্যের সমস্ত অধিকার খর্ব হবে। দ্য হিন্দু জানুয়ারি ম্যাসের প্রথম সপ্তাহে এক খবরে বলেছে যে ইতিমধ্যে দেশের বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের উপদেষ্টা কমিটি অর্থাৎ FAC (Forest Advisory Committee) সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে অরণ্য অন্য যে কোন পণ্যের মতো সরকার চাইলে বেসরকারি সংস্থা কে বিক্রি করতে পারে। এই পদ্ধতির এক গালভরা নাম দেওয়া হয়েছে। নামটি হোল ‘Green Credit Scheme’। ২০১৫ সালে এমন এক পরিকল্পনার কথা বলা হলে প্রতিবাদের কারণে কার্যকর হয়নি। ভারতবর্ষের লক্ষ হল ২০৩০ সালের মধ্যে ২৫২.৩ কোটি টন কার্বন শোসনের জন্য অরণ্য ভূমি প্রস্তুত করা। হিসেব বলছে এর জন্য চাই আরও ৩ কোটি হেক্টর বনাঞ্চল। এখন এদেশে প্রায় ৭ কোটি হেক্টর বনাঞ্চল রয়েছে।
২০২০ সালের শুরুতে যখন অতিমারি আবহে ভারতবাসী গৃহবন্দি তখন দেশের পরিবেশ ও অরণ্য রক্ষার অধিকাংশ আইন পরিবর্তন করে কর্পোরেটদের পরিবেশ রক্ষার সমস্ত দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত করতে চেয়েছে সরকার। দেশের পরিবেশ অভিঘাত সম্পর্কিত ইআইএ (Environmental impact assessment) আইন, অরণ্য নীতি-১৯৮৮, অরণ্য আইন-১৯২৭, অরণ্য সংরক্ষণ আইন-১৯৮০ ইত্যাদির নীরবে নেতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে।
দেউচা-পাচামি থেকে তিলাবনি
বীরভূমের দেউচা-পাচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিনসিংহা প্রস্তাবিত কয়লাখনি নিয়ে অবাস্তব পরিকল্পনা করছে আমাদের রাজ্যের সরকার। যে খনির এখনও অনুসন্ধানের কাজ শেষ হয়নি, খনি পরিকল্পনা তৈরি হয়নি সেখানে মানুষের উচ্ছেদ কাজ শুরু হয়েছে। এই এলাকার মধ্যে নিশিন্তপুরের বনাঞ্চল ধ্বংস সহ গনপুরের অরণ্য, দ্বারকা নদী ইত্যাদি প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের উপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তার তুল্য মূল্য বিচার করছেনা সরকার। এক দুর্ভেদ্য ব্যাসাল্টের স্তর ভেদ করে ৫০০ মিটারেরও বেশী গভীরতা থেকে কয়লা তোলার যে অলীক স্বপ্ন দেখছে সরকার তার বলি হবে ওখানকার মানুষ ও পরিবেশ।
এরাজ্যে পরিবেশ রক্ষার কথা বলতে গেলেই সরকারী দলের লোকেরা বলবে “কেন ৩০ বছর আগে যে অমুক করেছে বামফ্রন্ট সরকার এখন করতে গেলে বাধা”। পৃথিবী এখন আরও রুগ্ন হয়েছে। অরণ্য ধ্বংস করে চাষাবাদ তারপর শিল্প। কোথাও তো ঘুরে দাঁড়াতে হবে। প্রকৃতির সহ্যের ক্ষমতা ধীরে ধীরে অতিক্রান্ত হয়েছে। এরাজ্যের উপকূলবর্তী অঞ্চল প্রতি বছর কোন না কোন ঘূর্ণিঝড়ে তলিয়ে যাচ্ছে। বায়ুদূষণে শহরগুলি বিধ্বস্ত। জলাভূমি গুলির অকাল মৃত্যু ঘটাচ্ছে শাসক মাফিয়ার যুগলবন্দী। আইপিসিসি বলছে এরাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে তাপপ্রবাহের সময় ও পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। উত্তরে বৃষ্টির পরিমাণ বাড়বে। তাই উন্নয়নের নামে কর্পোরেট বান্ধব পরিবেশ নষ্টের পরিকল্পনায় সামিল না হয়ে বিকল্পের কথা ভাবতে হবে।
তিলাবনি পাহাড়ের ধ্বংসের পরিবেশগত সমস্যার কথা সরকার এবং পরিবেশ দপ্তরের আধিকারিকদের না বোঝার কারণ নেই। মুনাফার লোভে অন্ধ কর্পোরেটদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে সরকার এবং তার রাজনৈতিক দাদারা গোটা পাহাড়কে লুঠ করে নেওয়ার পরিকল্পনা এই অঞ্চলের পক্ষে ভয়ঙ্কর হতে পারে। কারণ এই ঘটনা এখানকার রুক্ষতা এবং আবহাওয়ার পরিবর্তনকে আরও ত্বরান্বিত করবে। তিলাবনির গাছপালা, পাথর, মারাং বুরু এখানকার মানুষের জীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে। দ্বারকেশ্বর নদীর উৎসের অপমৃত্যুর এক বড় কারণ হবে তিলাবনির খনন কাজ।